#শ্যামাপ্রিয়া
#পর্ব২
#তামান্না_আনজুম_মায়া
ফাহমিদ থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির পেছনের দিকের পুকুর পাড়।তখনই কেউ পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো চট করে রেগে গেলো ফাহমিদ জোরে এক ধ’মক বসিয়েছে অপর পাশের ব্যক্তিকে না দেখেই!
,,এই কেমন মেয়ে মানুষ তুমি?কখন থেকে গায়ের উপর পড়ে যাচ্ছো পাড়লে!এতো নির্লজ্জ মেয়ে তো আগে দেখিনি,দেখছো কথা বলতে চাচ্ছি না তাও দেঢ় হাত ঘোমটা দিয়ে বউদের মতো সেজে ঠোঁটের কোনে ওড়নার কোনা ঝুলিয়ে কি প্রমান করতে চাইছো! একটা চ’ড় দিলে এসব ভুত মাথা থেকে সরে যাবে পুঁচকে মেয়ে!
সৌরভ ভড়কালো বন্ধু তার বো”ম হয়ে আছে কেনো হঠাৎ! সে মিহি সুরে ডাকলো
—,,দোস্ত!আমি সৌরভ কি হয়েছে রেগে আছিস কেন?কাকেই বা এতো গুলো কথা শুনালি?
ফাহমিদ ততক্ষণে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পেছনে দ্বিগুণ রাগ মিশিয়ে বললো
—,,ভাই এটা কেমন কথা হলো?আজই ফিরে যাওয়ার কথা আমার।আর তুই কি বললি এটা এখানে সপ্তাহ খানেক থাকতে হবে আমায়!আর ইউ মে’ড?আর তোদের ওই ঘরময় শুধু নির্লজ্জ ধাঁচের মেয়ে,একটা তো মাথা খারাপ করে দিয়েছে ভাই!
আসার পর থেকেই এখানকার মেয়েদের কাহিনি দেখছি,একজন অভদ্র বেয়া’দব মেয়ে কে দেখলাম বাবার বয়সী কারো সাথে উচ্চ বাক্য করছে,আর বাকি সব গায়ে পড়া টাইপের, এ জন্যই আসতে চাই না আমি!
–,,মেয়েদের নিয়ে এতো সমস্যা কেন তোর?আর অভদ্র কাকে বলছিস?
–,,তোদের পাশের বাসার মেয়েটা, এতো বড় বাড়ির মেয়ে নুন্যতম কমনসেন্স নেই!পরিবার কি শিক্ষা দিতে পারেনি।
সৌরভ এবার বিরক্ত হলো না জেনে বুঝে কি সব বলছে ফাহমিদ!
–,,কারো বিষয় না জেনে শুনে মন্তব্য করা উচিত না ফাহমিদ!তিথি চমৎকার মেয়ে,পরিচিত যদি হতে পারতি তাহলে এরকম কথা মুখেও আনতি না!
ফাহমিদ ভ্রু কুঁচকালো পরিচিত হতে পারতো মানে?
–,,এই মেয়ে কি আলাদা নাকি?দেখবি ছেলে দেখলেই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে,চোখ দিয়ে পারলে গি’লে খাবে!
সৌরভ হাসলো –,,তিথির ব্যক্তিত্বের প্রেমে যে পুরুষ পড়বে না আমি বলবো সে পুরুষের মেয়েদের চেনার মতো ক্ষমতা নেই!
পুরুষ মানেই মেয়েদের রূপ,গুনের আগে তার ব্যক্তিত্বে আটকায়!
ফাহমিদ চকিত নয়নে তাকিয়ে বললো–,,মেয়েটাকে পছন্দ করিস তুই?
—,,মানুষ হিসেবে পছন্দ করি, অন্য কোনো কিছু ভেবে বসতে যাস না যেনো ছোট বোনের মতো। দুই দিন পর বিয়ে করলে বউ ঝা’ড়ু হাতে আসবে।
–,,বিয়ে?
–,,হ্যাঁ!যার জন্য বাড়ি ভর্তি মেয়ে মানুষ, মানে আমার ফুফাতো, মামাতো ভাই বোন রা এসেছে,সাথে বড়রা, তুই আমাদের টিনসেড ঘরটার ওইদিকে যাস না,ছেলেদের বেশি সুন্দর হতে নেই মেয়ে মানুষ তাকাবেই এতে তাদের কোনো দোষ নেই।ওরা তো আর জানে না তুই মেয়েদের নাম শুনলেই কে’টে পড়িস তাও আমি সবাই কে মানা করে দিবো!কাল আংকেল আন্টিসহ তোদের বাসার সবাই আসবে,আর তুই ও থাকবি, তোকে গ্রামে আনা যাবে না আগেই জানতাম তাই বাবা আর আংকেল মিলে প্ল্যান করে তোকে আগে পাঠিয়েছে!
————
দেয়াল করা একটা মস্ত বড় বাড়ি পর পর তিনটা একতলা দালান,তার পাশেই পুরনো আমলের তৈরি দু’তালা দালানটা!গাছগাছালির ছায়ায় বাড়িটার সৌন্দর্য বেড়েছে অনেকটা,আজ নিস্তেজ হয়ে নিরবতা পালন করছে যেনো,বাড়ির পেছনে ঘাট বাঁধানো পুকুর পাড় তার উপরেই ছায়া দিতে অবস্থান করছে কৃষ্ণচূড়া গাছটা!
বিমূঢ় হয়ে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি ফেলে সবুজ রঙা পানির দিকে তাকিয়ে আছে এক রমনী,হালকা রোদের আলোয় চকচক করছে তার শ্যামলা তেল চিকচিকে ত্বক!
পড়নের ওড়না বেশ কিছুটা ঝুলে আছে ঘাটের সিঁড়ির ভাঁজে। ঘন কালো লম্বা কেশ গুলো উড়ে যাচ্ছে শরৎ এর মৃদু মন্দ বাতাসে।
মেয়েটা কি ভীষণ উদাসিনী?এই উদাসীনি শান্ত রমনীর জীবনের ঝ’ড় কি কোনো দিন থামবে?নাকি থাকবে বহমান।রূপ লাবণ্য ছাড়া মানুষ আর কিছু কেনো দেখে না,চামড়ার রঙ দিয়েই কি মানুষ বিচার করা লাগবে?সরলতা,মমতা,মায়ার কি কোনো স্থান নেই দুনিয়ায় সবাই কি শুভ্র রঙা মেঘের পিছনে ঘুরে?মেঘের রঙ ও তো ধূসর হয় সে ধূসর রঙা মেঘ কে ও তো মানুষ ভালোবাসে,নাকি ভালোবাসার নাম করে উপভোগ করে তার বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা বৃষ্টি কে!
সবাই শুধু ভেঙ্গে চূড়ে দিতে চায়,কেউ কেন গড়তে আসে না?আশার হাত বাড়িয়ে বলে না। তুমি যেমন তেমনই থাকো আমি তোমায় ওরকম ভাবেই ভালোবাসি!
নাকি ভালোবাসা নামক বস্তু রঙিন মখমলে মোড়ানো।
তিথি তিথি ওই তিথি,,,,,,!
কারো অনবরত ডাকের অতিষ্ঠ হয়ে উঠে দাঁড়ায় তিথি, কি আশ্চর্য মানুষ জন কি একটু একা ছেড়ে দিতে পারে না তাকে।বিরক্তি নিয়ে হাঁটা দিলো তিথি গলা উঁচিয়ে বললো
—,,হ্যাঁ এদিকে আমি।
ইসমা নামক মেয়েটি দৌড়ে আসলো,এসেই ঝাপটে ধরলো তিথি কে।
তিথি খুশি হয়ে বললো–,,কবে ফিরলি?ভার্সিটি বন্ধ দিয়েছে নাকি?
ইসমার হাস্যউজ্জ্বল কন্ঠ
–,,না!ছুটিতে এসেছি, ভাইয়ার বিয়ে তো তিন দিন পর কাল থেকেই অনুষ্ঠান শুরু তুই দেখছি কিছুই জানিস না তিথি!এবার বল মন খারাপ কেনো?
তিথি হাসলো মেয়েটির সাথে তার সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের ছোট থেকেই একই সাথে বেড়ে উঠা,স্কুল, কলেজ একসাথে শেষ করলো।বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিটাই আলাদা করে দিলো ওদের, গন্তব্য হলো ভিন্ন দুই শহরে।
তিথি আবার এসে পাকা সিমেন্টের বেঞ্চিটাতে বসলো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো–,,ওই একই কাহিনি নেহালের বাবা এসে ঝা’মেলা করলো!
তা তুই বল তোর খবর কি?
–,,ওসব ছাড় তো, তোদের বাড়িতে এই একই কাহিনি।এখন তুই আমার সাথে শপিং এ যাবি,ভাইয়ার বিয়ের জন্য কেনাকাটা বাকি কিছু।তুই মানা করতে পারবি না,অনেক দিন এক সাথে ঘুরতে যাই না!
–,,মেজো চাচী অসুস্থ তার উপর ওই স্বার্থপর মানুষ টা বাড়িতে,যাওয়ার পরই যদি শুরু করে!
–,,কিছু হবে না, দাদু সামলে নিবে।
ইসমা মেয়েটা চঞ্চল, হাসিখুশি অপর দিকে তিথি শান্ত, গোমরা ধরনের মানুষ, এতো এতো অমিল হয়েও তাদের মাঝে বুঝাপড়া টা হয় বেশ ভালো!
তিথি তৈরি হয়ে আসলো পুরনো দোতলা দালানটার কাছে,নিচতলায় প্রথম ঘরটাতেই থাকেন জয়নাল বেপারী।বাকি তিনটা এক তলা দালান তিন ছেলের,পরিবার এখনো একসাথে তাদের শুধু থাকে আলাদা ঘরে,জয়নাল বেপারী মৃ’ত্যুর আগে ছেলেদের জন্য যা পেরেছেন সব করে দিয়ে গেছেন।যেনো পরবর্তীতে কোনো ঝামেলা পোহাতে না হয়। দুতলা ঘরটার উপরে তলায় আত্নীয়দের জন্য বরাদ্দ কিছু ঘর আছে,নিচে শুধু তারা বুড়ো বুড়ি থাকে,একপাশের ছোট টিনের ঘরটায় বাড়ির কাজের লোক!
বিশাল বাড়িটির এক পাশে হাঁস,মুরগি,গরু,ছাগল পালন করা হয়,পুকুর ভর্তি মাছ!ফসলি জমিরও অভাব নেই জয়নাল বেপারীর।গ্রামে একজন অতি সম্মানীয় ব্যক্তি তিনি।যে সম্মান এতো বছরে কুড়িয়েছেন তা এখন এক ছেলের কর্মকান্ডে খোয়াতে বসেছেন!
চেয়ারে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন তিনি,তিথি গিয়ে ডাকলো
–,,দাদু!
জয়নাল বেপারী নাতনির ডাকে হাসলেন
–,,দাদু একটু মার্কেটে যাচ্ছি ইসমার সাথে।
–,,গাড়ি করে যা!
–,,না দাদু এতো গাড়ি চড়তে ভালো লাগে না মুক্ত বাতাস পাওয়া যায় না।মুক্ত বাতাসে উড়তে হয়, কখনো কখনো ধুলো মাখতে হয় শরীরে,কৃত্রিম এসি যুক্ত গাড়িতে ভাব থাকলেও ভালো লাগা নেই।আমি চাই অতি সাধারণ হতে যেখানে হেঁটে বেড়াতেও দুবার ভাবতে হবে না,অনায়াসে ফুটপাতে বসে চা খাওয়া যাবে,সকল মানুষের মনের কাছে পৌঁছানো যাবে।নিজেকে আভিজাত্যের খোলসে আবৃত রাখলে কখনো ভালো মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় না।আমি সত্যিকারের বন্ধু চাই যারা সত্যি কার অর্থে আমার আপন হবে।টাকা আভিজাত্যের বলে কেউ আমার কাছে না আসুক,মুখোশ ধারীদের থেকে দূরে থাকতে চাই,মন খুলে হাসতে চাই।প্রাণ খুলে বাঁচতে চাই!
জয়নাল বেপারী হাসলেন।বড় ছেলের টাকার কমতি নেই না আছে তার,তবুও নাতনী তার আত্মনির্ভরশীল! ভার্সিটি জীবনের শুরু থেকে এ অব্দি নিজের যোগ্যতায় নিজে কে গড়ে তুলেছে।তিনি নিজেও জানেন মানুষের ক’টূ কথা কখনো দমাতে পারবে না এই জ্বলজ্বলে সন্ধ্যা তারাকে!
তিথি বেরিয়ে গেলো গেইটের বাহিরে,ইসমা সেজেগুজে হাজির।দুধে আলতা গায়ের রঙ মেয়েটার,চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য! তিথি রিকশা ডেকে নিলো
,,চড়ে বসলো দুজন!
————-
কানে ফোন গুঁজে শপিং মল থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ো যাচ্ছে একজন মেয়ে,কন্ঠে চলনে বলনে তার ভীষণ তাড়া,ফাহিমদ দাড়িয়ে আছে মলের এক পাশে সৌরভ এসেছে তার হবু বউ এর সাথে দেখা করতে।ফাহমিদ দোতলায় উঠার সিঁড়ির কাছে আসতেই ধাক্কা লাগলো কারো সাথে।
ফাহমিদ বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে চলে গেলো সামনে থাকা ব্যক্তি।ফাহমিদের দিক একবারও তাকালো না, বড় কথা মেয়েটা ধাক্কা দিয়েছে নিজে তাও এমন ভাবে গেলো যেনো পথে কেউ ছিলোই না!
ফাহমিদ রাগি রাশভারি কন্ঠে বললো–,,এ কেমন অভদ্রতা!ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছেন?
কিছু দূর গিয়ে মেয়েটা থেমে গেলো,ঘোমটা টানা মাথায়, ছাই রঙা থ্রি পিস গায়ে!একটা অতি ঠান্ডা কন্ঠের শব্দ শুনে চমকে গেলো ফাহমিদ।
–,,স্যরি!তবে দোষটা আপনার ছিলো।
মেয়েটা কথা টা বলেই বেরিয়ে গেলো, একবার পেছন ফেরার প্রয়োজন মনে করলো না!মেয়েটার কি অহং”কার বেশি?
ইসমা শপিং ব্যাগ হাতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলো ফাহমিদ কে দেখে বললো–,,কেমন আছেন ভাইয়া?
ফাহমিদ ইসমা কে দেখে চিনলো,মৃদু হেসে বললো
–,,ভালো!তা তুমি এখানে?
–,,এইতো ভাইয়া একটু কেনাকাটা বাকি ছিলো।তা আপনি ওদিকে কি দেখছেন?
ফাহমিদ শপিং মলের কাঁচের দরজা বাহিরে দাড়িয়ে থাকা মোবাইলে কথা বলতে থাকা মেয়েটার দিক আঙুল উঁচিয়ে বললো
–,,ওই মেয়েটাকে!যে মাত্র একটা ধাক্কা মেরে চলে গেলো,কিন্তু ফিরেও দেখলো কাকে মেরেছে কি অদ্ভুত মেয়ে।
ইসমা হেসে ফেললো,বলে উঠলো
–,,ফিরে তাকাবেও না ভাইয়া!ওকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি!
ফাহমিদের কন্ঠে তীব্র কৌতূহল
–,,কে এই মেয়ে?
–,,তিথি!মেঘলা আইনুম তিথি।আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
আর বলবেন না ভাইয়া মেয়েটা পুরো তেঁতো করলা।সব কথা বলে সোজাসাপ্টা এতে সামনের ব্যক্তি কষ্ট পেলেও ওর কিছু যায় আসে না!ওর একটাই কথা মিথ্যা বলে হাসানোর চেয়ে সত্যি বলে কাঁদানো অনেক ভালো!
ফাহমিদের মন মস্তিষ্কে কি যেনো খেলে গেলো,কেমন ঝোঁকের মতো বসে গেলো একটা নাম তিথি!
কে এই মেয়ে তাকে তো একবার দেখতেই হবে।সকাল থেকে শুধু প্রশংসা শুনে যাচ্ছে,কৌতুহল টা যেনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
চলবে?