শ্যামাপ্রিয়া পর্ব-০১

0
15

#শ্যামাপ্রিয়া
#সূচনাপর্ব
#তামান্না_আনজুম_মায়া

স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনে বে”হুঁশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো বেপারী বাড়ির মেজো বউ!

কিছুসময়ের ব্যবধানেই যেনো সবকিছু এলোমেলো হতে দেখলো জয়নাল বেপারী,,,,!কিছু সময় পূর্বের কথা মনে করেই হতাশ শ্বাস ছাড়লেন ছেলেটা বাড়ি ফিরলেই কোনো না কোনো অঘট’ন ঘটে,,,,,,,!

“বেপারী বাড়িতে বড় উঠোনে বসে মাছ কাটছিলেন বাড়ির বউ রা,আজ পুকুর থেকে মাছ ধরা হয়েছে,মাছ কাটার ফাঁকে টুকটাক গল্প করছেন তিন জা খোদেজা, নাজমা,আঁখি তাদের শ্বশুর এগিয়ে আসলেন তাদের দিকে তা দেখে তিনজনই ঘোমটা আরো কিছু্টা টেনে দিলেন।
আঁখি জিজ্ঞেস করলেন,,আব্বা কিছু বলবেন?
,,নাতি-নাতনিরা সব স্কুল কলেজে যাবে সকালের খাবারের বন্দোবস্ত হলো কি না জানতে আসলাম।
,,জ্বি আব্বা,সকালের নাশতা তৈরি করেই মাছ কাটতে বসেছি,ময়নার মা কে বলে দিয়েছি সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে,আম্মাকে খাবার দিয়ে এসেছেন বড় ভাবি আপনি আসতে দেরি হওয়াও মেজো ভাবিও এসে যোগ দিলেন মাছ কাটায়,আপনি গিয়ে ঘরে বসুন আমি আসছি আপনাকে খাবার দিবো।
জয়নাল বেপারী হাঁটা দিলেন পুরোনো দুইতলা ভবনটির দিকে।তিনি উঠোনের মাঝ বরাবর যেতেই লোহার মরিচা ধরা গেইট টা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে উঠলো,একটু জোরেই যেনো কেউ গেইটটা ধাক্কা দিয়েছে তা বুঝতে পেরে সেদিকে চোখ নিবদ্ধ করলেন তিনি,তার মেজো ছেলে রিপন বাড়িতে এসেছে, দুই বছর ধরে কোনো খোঁজ খবর নেই আজ হঠাৎ বাড়িতে আসায় চমকালেন জয়নাল।ছেলেটা বউ বাচ্চার খবর রাখে না বাড়িতে কারো সাথে যোগাযোগ করে না আজ আসলো কি মনে করে।

রিপন এসেই উঠোনে পাতা চেয়ারটায় বসলো,এতোদিন পর স্বামী কে দেখে হাতের মাছ ধপ করে মাটিতে পড়ে গেলো নাজমার,চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো, চোখের কার্নিশ বেয়ে দুই ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়লো।

রিপন ফ্যাচফ্যাচে কন্ঠে বললো
,,এই নাজমা এক গ্লাস পানি দে তো।
নাজমা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন রান্নাঘরের দিকটায় এক প্রকার ছুট লাগালেন, স্বামীর এতো অবহেলার পরও যেনো তার আদেশ অমান্য করতে পারলো না সে।
পেছন থেকে জয়নাল ডেকে উঠলেন

,,নাজমা এই অপদার্থ টার কোনো কথাই শোনবে না তুমি।বাড়ি এসে হুকুম চালাচ্ছে কোন দেশের জমিদার সে,বউ বাচ্চার খবর রাখে না এখানে এসে আবার খবরদারী করে কোন সাহসে?লোকসমাজে মুখ দেখাতে পারি না।বাড়ি ছিলো না শান্তিতেই তো ছিলাম,কোন মতলবে বাড়ি তে এসেছে বলে যেনো বিদায় হয়,ওর মুখ ও দেখতে চাই না আমি।কোনো কথাই অজানা না আমার, নতুন সংসার পেতেছে শহরে তাহলে এমুখো হলো কেনো আবার।

নাজমার আর রান্নাঘরে যাওয়া হলো না,শ্বশুরের মুখ থেকে স্বামীর দ্বিতীয় সংসারের কথা শুনে সেখানেই জ্ঞান হারিয়েছে সে।”

খোদেজা, আঁখি মাছ কাটা ফেলে ছুটে গেলেন সেদিকে, নাজমার হাত ঠেলে ডেকে চলেছেন। আঁখি তিথি বলে ডাক দিলেন,,
,,ও তিথি কই গেলি মা তাড়াতাড়ি আয় দেখ তোর চাচি বেহুঁ’শ হইয়া গেছে। ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো তিথি দশটায় ক্লাস আজ এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে,তার উপর নিচ থেকে চেচামেচির শব্দ পেয়ে ওড়না হাতে নিয়ে বের হলো তাড়াতাড়ি। তার মেজো চাচি কে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে জগ ভর্তি পানি নিয়ে আসলো।চিৎকার চেচামেচি তে বাকিরাও ছুটে এসেছে ময়নার মায়ের হাতে তরকারি বাটি তার পেছনে বর্ষা,নেহাল,ইফাত, অসুস্থ শরীর নিয়ে জুলেখা বেগমও ছুটে এসেছেন।

নেহাল ছুটে মায়ের কাছে গেলো,তিথি নাজমার মাথায় অনবরত পানি ঢালছেন ইফাত ছুটে তেলের বোতল নিয়ে আসলো তেল, পানি দেওয়ার দশ মিনিটের মাথায় চোখ খুললেন তিনি।উঠেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাও মাও করে কেঁদে দিলেন।নেহাল মা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উঠালো, বর্ষা চেয়ার এনে দিলো তাতে বসালেন নাজমা কে।

রিপন কর্কশ গলায় বললো
,,এসব ন্যাকা কান্না শুনতে এখানে আসিনি আমি, আর কারো নাটক দেখার ও সময় নাই আমার।ছাফ ছাফ বলে দিচ্ছি আব্বা এবার আমি আমার ভাগের সম্পত্তি নিয়েই তবে যাবো।

জয়নাল বেপারী রেগে বলে উঠলেন,সংসারের জন্য কি ছাই টা করেছিস তুই যে ভাগ নিতে এসেছিস।দিন রাত এক করে সংসারের জন্য করে গেছে তোর বড় আর ছোট ভাই সংসারে তো এক কানা কড়ি ও দেসনি কখনো কোন মুখে ভাগ চাস তুই লজ্জা করে না।

,,না করে না আব্বা।তুমি তো আমাকে জন্ম দিয়েছো সে সুবাদে আমি ও সমান অংশ পাবো কথা বাড়িয়ো না দুই দিন থাকবো দুইদিনের ভিতর উকিল ডেকে সব ঝামেলা মিটাও এর পর আর এই বাড়িতে ফিরবো না আমি,এখন ব্যবসায় লস হয়েছে আর্জেন্ট আমার টাকা লাগবে মাথা আর গরম কইরো না তোমরা।

,,তোকে আমি একটা কিছু দিবো না,যা পারিস করে নে।তুই যেহেতু এই বাড়ির কারোর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখিসনি এতোদিন আমরাও আর তোকে চিনি না। আজ থেকে আমি ভাববো আমার তিন মেয়ে দুই ছেলে নাজমা আমার মেয়ের মতো থাকবে এখানে বিয়ে করে এনে কষ্ট তো কম দিলি না।তোর মতো একটা ছেলের সাথে বাড়ি ছাড়াই ওর বড় ভুল ছিলো।তোর ভাগের সব সম্পত্তি আমি নেহাল আর নিশিতার নামে করে দিবো এই কথাই চূড়ান্ত আর কোনো কথা বলতে চাই না আমি।তুই ভালো করেই জানিস আমি এক কথার মানুষ।
“রিপন তেড়ে আসলেন জয়নালের দিকে তিথি গিয়ে সামনে দাড়িয়ে পড়ে,
,,কি করছেন টা কি চাচ্চু ভুলে যাচ্ছেন তিনি আপনার বাবা।
,,না ভুলি নাই, তুই সব সময়ের মতো আমার আর আব্বার মাঝে আসবি না সর সামনে থেকে বাপের মতো এতো সব বিষয়ে পন্ডিতি করতে আসোছ কেন?
,,দেখেন আমাকে নিয়ে যাই বলেন আমার বাবা কে নিয়ে কিছু বললে তা আমি মেনে নিবো না বলে দিলাম।আপনি বাড়ি তে কেনো আসেন বুঝি না। বাড়ির পরিবেশ টা ন’ষ্ট না করলে কি আপনার শান্তি লাগে না নাকি।
,,বাপরে নিয়া বললে গাঁয়ে লাগে বুঝি,তা তোর বাপ কোন দিক দিয়া সাধু রে দুই দুইটা বিয়ে করছে আর আমি করলেই মানুষ চোখে দেখতে পারে না।কেনো আমি করলে দোষ তোর বাপে করলে পুণ্য?তোর মা
মর’তে না মর’তেই তো আরেক টা বিয়া কইরা আনছে।
তোরে তো ওই মহিলা নিজের মাইয়া বলে মেনে ই নেয় নাই তোর বাপ ও তো বউয়ের উপর কিছু কইতে পারলো না, ওই বাপের জন্য দেখি তোর দরদ উতলাইয়া পড়ে!

,,আমার বাবা যেমনই হোক আমার মা বেঁচে থাকতে তো আরেকটা বিয়ে করেন নাই, আর এমন না যে তিনি আমার ভরণ পোষণ দেন না সব দায়িত্ব ঠিকই পালন করে রোজ সময় করে আমার খোঁজ নেন।আর আপনি নিজেকে আমার বাবার সাথে তুলনা দেন কোন সাহসে।আপনি তো চাচীআম্মার খোঁজ ও নেন না নেহাল নিশিতাকে একটা ফোন দেওয়ার সময় হয় না।দায়িত্বজ্ঞা”নহীন মানুষ আপনি।চলে যান এখান থেকে।

,, এক চ ড় বসাবো কানের নিচে, বড় বড় কথা বলতে শিখে গেছিস দেখছি,তা আব্বা এমন দা*মড়ি মেয়ে কে বাড়িতে বসিয়ে খাওয়াচ্ছেন কেনো?বিয়ে সাদি দিতে পারছেন না নাকি, যা কালি গাঁয়ের রং কোনো পোলা তো থুথুও ফেলবো না এদিকে।মায়ের মতোই রং পাইছে মা টারে তো তোর নানা আমার ভাইয়ের কপালে ঝুলাই ছিলো আল্লাহ বাঁচাইছে অকালে ম রছে আ’পদ!

তিথির চোখ টা কেমন ভিজে উঠলো,তবুও কান্না আটকে রাখলো ঠোঁট চেপে।এটা নতুন না কোনো কিছু ঘটলেই আগে তার গাঁয়ের রং নিয়ে প্রশ্ন তুলে সবাই,পরে তার মা,তিথির বাবা তিথি কে অসম্ভব ভালোবাসেন, মা বাবা দুজনের ভালোবাসা একাই দিয়েছেন মেয়েকে তা নিয়ে আফসোস নেই তিথির।বাবার দ্বিতীয় বিয়ে সৎ মা নিয়েও কখনো কথা বলেনি।তবে তার সৎ মা খোদেজা কখনো তার দিকে মমতার হাত বাড়ায় নি ভালোবেসে মায়ের ভালোবাসা দেয় নি সেই ছোট বেলা থেকেই তিথি শিখে গেছে একলা থাকা, সত্যের জন্য লড়াই করা।সবাই যাই বলুক তার দাদা দাদি তাকে সব সময় সবার উপরে রেখেছেন ভালোবেসেছেন এর থেকে বেশি কিছু পাওয়ার নেই জীবনে।তবুও অবুঝ মন ক টূ কথা মেনে নিতে চায় না সহজে।তিথি চুপ করে গেলো।

নেহাল বলে উঠলো আপনার তো বহুত সুন্দর চেহারা যা দেখিয়ে দুই বাচ্চার বাপ হওয়া সত্ত্বেও আরেকটা বিয়ে করে ফেললেন নাচতে নাচতে, আপনার লজ্জা করে না এই মুখ নিয়ে আবার সবার সামনে আসতে, আপনার ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে সে দিকে তাকিয়ে অন্তত ভালো হয়ে যেতেন, আগে থেকেই তো পর কীয়া করাটা আপনার স্বভাব হয়ে দাড়িয়ে ছিলো এখন আরেক টা সংসার পেতেছেন।আপনার ছেলে বলে নিজেকে পরিচয় দিতেও আমার রুচিতে বাঁধে।
নেহালের কথা শেষ না হতেই তাকে মা রতে এগিয়ে আসে রিপন।তার যেনো মাথায় রক্ত উঠে গেছে।
,,,,,,,,,,
পাশের বাড়ির সৌরভ এগিয়ে আসতে গেলো তখনই তাকে পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো।
সৌরভ আর নেহালদের বাড়ি আসলো না আজ তার বন্ধু এসেছে ঢাকা থেকে, আবার চলে যাবে তাই বন্ধু কে সময় দিতে লাগলো, এমনিতে ও অন্যের বাড়ির ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলাটা পছন্দ না সৌরভের।
*
রিপন নেহাল কে মা রার জন্য হাতে ইট তুলে নেন, জয়নাল সাহেব চেচিয়ে উঠেন,নাজমা বেগম বলে উঠে
,,কি করছেন আপনি শান্ত হোন নেহাল আপনার ছেলে।
রিপন রেগে বললো
,,এই ছেলে তোর আমার না, আমার বিষয়ে কথা বলতে না করে দে না হয় একদম মাটিতে পুঁ’তে ফেলবো।

বলেই আবার তেড়ে আসে তিথি নেহালকে বাঁচাতে গিয়ে ধাক্কা দেয় রিপন কে।ভুলবসত তিনি মাটিতে পড়ে যায়।
তিথি রেগে কথা শুনাতে থাকে রিপন কে।রেগে গেলে তার গলার আওয়াজ বৃদ্ধি পায় যেনো দ্বিগুণ। জয়নাল ও কিছু বলছেন না কি বলবেন বুঝতে পারছেন না তিনি, এ নিয়ে বাড়িতে চার বার এমন হয়েছে সব কিছুর পেছনে রয়েছে রিপন, আর তাকে পরিবারের বিরুদ্ধে উস”কে দিয়েছে তার নতুন বউ।

বেপারী বাড়িতে যে কিছু হয়েছে তা রাস্তায় চলাচল করা পথচারী রাও বুঝতে পারছেন।কেউ কেউ উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন আবার নিজের কাজে চলে গেছেন।
***
সৌরভের ঢাকা থেকে আসা বন্ধু ফাহমিদের গ্রাম মোটেও পছন্দ না, এখানের মানুষ সহজ সরল তবে এরা ঝ গ ড়া করে বেশি, এক জনের বিষয় অন্য জন নাক গলায় এসব তার ভীষণ অপছন্দ আর মানুষ গুলাও কেমন গায়ে পড়া টাইপের বাবার জোড়াজুড়ি তে এসেছে সে সৌরভের বাবা আর ফাহমিদের বাবা বন্ধু, বন্ধুর জন্য কিছু জিনিস ফাহমিদকে দিয়ে পাঠিয়েছেন তিনি।সৌরভ ও ঢাকাতেই থাকে,ফাহমিদ সব সময় বলে যেনো পুরোপুরি ভাবে সেখানে থাকে গ্রামে আসে কে! ফাহমিদ বাতাস খেতে একটু বাহিরে বের হয়ে উঠোনে পায়চারি করছিলো, পাশের বাড়ির থেকে একটা মেয়ের উচ্চ শব্দে বলা কথা ভেসে আসছে,ফাহমিদ বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকায়।মনে মনে বলে এসব মানুষের আর কাজ নেই নাকি।এগিয়ে এসে দেখে একটা মেয়ের পেছনের দিক দেখা যাচ্ছে তার সামনে একজন মধ্যবয়স্ক লোক।দুজনের মধ্যে তর্কা তর্কি চলছে।
ফাহমিদ মনে মনে বলে উঠে
,,কি বেয়া”দব মেয়ে!বড়দের সাথে এভাবে কে কথা বলে।গ্রামের মেয়েরা মনে হয় এমনই হয়।মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে আসে ডিজ গাস্টিং!
চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে