শেষ_পর্যন্ত
পার্ট: ২৮
আলিফা: রাতুল তুমি এখানে
রাতুল: কি করবো আমাকে কিছু না জানিয়ে হুট করে রিলিজ নিয়ে বাসায় চলে এসেছ
আলিফা: আমি তোমাকে ফোন করতাম এক্ষণি
রাতুল: আমি হসপিটালে এসে তোমাকে না পেয়ে ওখান থেকে বাসার এড্রেস নিয়ে চলে এসেছি।
নিলার ছবিটা বুকে জরিয়ে নিয়ে বারান্দায় বসে ছিলাম, হঠাৎ করে রুমের ভিতর থেকে আলিফা আর রাতুলের কন্ঠ ভেসে আসলো। নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি আর ওদের কথা শুনছি।
রাতুল: চলে আসলে আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না
আলিফা: বললাম তো এক্ষণি ফোন করতাম তোমাকে
রাতুল: এসেছ তো অনেক আগে
আলিফা: হ্যাঁ এসে বাসায় একটা জামেলা হয়েছিল তাই দিতে পারিনি
রাতুল: কি হয়েছিল
আলিফা: বাদ দাও এখানে এসেছ বাসায় তো আব্বু আছেন কি ভাববেন বলতো
রাতুল: ওহ তারমানে চলে যেতে বলছ
আলিফা: রাতুল ভুল বুঝনা প্লিজ
রাতুল: ভুল বুঝছি না আলিফা বুঝার চেষ্টা করো এখন অন্তত কিছু ভাবো
আলিফা: আমি কিছু ভাবতে পারছি না আর ভাবতে চাইও না এখন
রাতুল: এক বছর হয়ে গেছে আলিফা আর তো এভাবে চলতে পারে না
আলিফা: হ্যাঁ বুঝতে পারছি কিন্তু আমি কি করতে পারি বলবা প্লিজ
রাতুল: তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে তাতেই আমি রাজি
আলিফা: চলে যাচ্ছ কেন
রাতুল: সিদ্ধান্ত নিয়ে ফোন করো আসছি।
সবকিছু নীরব হয়ে গেলো, রাতুল মনে হয় চলে গেছে। রাতুল আর কি করবে রাগ করাটা তো স্বাভাবিক, তিনটা মানুষ একি দুটানায় ভুগছি। আর এসব কিছুর জন্য দায়ী আমি। তাই এখন যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমাকেই নিতে হবে, এভাবে আর চলতে পারে না।
রুমে এসে নিলার ছবিটা দেয়ালে রাখলাম, আলিফা বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর পাশে এসে বসলাম, মাথায় হাত দিতেই আলিফা আমার হাত সরিয়ে দিলো।
আলিফা: রিফাত আমার ভালো লাগছে না কিছু
আমি: সব ঠিক হয়ে যাবে কেঁদো না
আলিফা: বললাম তো ভালো লাগছে না, আমাকে একা থাকতে দাও প্লিজ।
আলিফা চেঁচিয়ে উঠলো, তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম।
আব্বুর রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি, ভিতরে চাচ্চু ছোটমা আর প্রিতি আছে। সবার সামনে ডিভোর্স এর কথা বলতে ভয় করছে, সবাই তো কষ্ট পাবে।
চাচ্চু: রিফাত বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ভিতরে আয়
আমি: হুম
প্রিতি: ভাইয়া চা খাবে এনে দেই
আমি: না
ছোটমা: কেন সবাই খাচ্ছি তো
আব্বু: কিরে কি হয়েছে মুখটা এমন লাগছে কেন
আমি: আব্বু উকিল চাচ্চু কে একটু ফোন করে বলে দাও আমি যাচ্ছি
আব্বু: হঠাৎ…
আমি: হঠাৎ কোথায় আব্বু এটাই তো হবার ছিল
প্রিতি: ভাবির সাথে কথা বলেছ
আমি: ওর সিদ্ধান্তের আশায় একটা বছর কেটে গেছে আর এখন তো রাতুল ফিরে এসেছে তাই এইটা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই
ছোটমা: তুই কিভাবে…
আমি: ছোটমা প্লিজ তোমরা এসব বললে আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে পারবো না
চাচ্চু: তাই বলে নিজের কথাটা একবার ভাববি না
আমি: চাচ্চু আলিফা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো, ও যার সাথেই থাকুক শুধু সুখে থাকুক এইটুকুই চাই
ছোটমা: হুম যা ভালো মনে হয় কর
আমি: আব্বু ফোন করে বলে দিও।
রুমে আসলাম, আলিফা এখনো কেঁদে যাচ্ছে। ওর চোখে পানি দেখতে আর ভালো লাগে না। এবার ওর আর রাতুলের হাসার পালা। “আর বেশি দিন তোমাকে কাঁদতে হবে না রাগিণী” আলিফার দিকে একবার তাকিয়ে কথাটা মনে মনে ভেবে বেরিয়ে আসলাম।
উকিল চাচ্চুর সামনে বসে আছি সারা শরীর কাঁপছে বার বার ঘেমে যাচ্ছি, বুঝতে পারছি না এমন হচ্ছে কেন। বড্ড ভয় হচ্ছে সাথে কষ্ট, মনে হচ্ছে কেউ বুঝি আমার কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
চাচ্চু: রিফাত পানিটা খেয়ে নাও (চাচ্চুর কথায় সামনে তাকালাম, উনি পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম। তবুও যেন অস্থির অস্থির লাগছে)
চাচ্চু: এতোই যখন ভালোবাস তাহলে ডিভোর্স এর জন্য এসেছ কেন
আমি: এক তরফা ভালোবাসা তো বেশি দিন বয়ে বেড়ানো যায় না চাচ্চু
চাচ্চু: হুম তোমার আব্বু ফোনে আমাকে সব বলেছেন
আমি: চাচ্চু যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় তুমি ডিভোর্স এর ব্যবস্থা করে দাও, আমি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাই।
চাচ্চু: আরেকবার ভেবে দেখলে হয় না বাবা
আমি: সম্ভব না চাচ্চু
চাচ্চু: হুম
আমি: যদি পারো এখনি…
চাচ্চু: এতো তাড়াতাড়ি সম্ভব না তুমি বাসায় যাও আমি আগামীকাল সকালে পাঠিয়ে দিবো
আমি: ঠিক আছে
চাচ্চু: আরেকটু বসে যাও তোমার শরীর খারাপ লাগছে
আমি: না আমি ঠিক আছি চাচ্চু, আসি।
বেরিয়ে আসলাম, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুইটা বাজে। গ্রামে গিয়ে আবার ফিরে আসতে অনেক রাত হয়ে যাবে, তবুও যাবো। ফোনটা গাড়ির পিছনের সিটে ছুড়ে ফেলে দিলাম আজ একটু একা থাকতে চাই। ড্রাইভ করছি কিন্তু বার বার মাথা ঘুরছে, আজ না আবার এক্সিডেন্ট করে বসি। যাই হয়ে যাক শুধু একবার নিলার কবরের কাছে যেতে চাই। ওখানেই আমার শান্তির জায়গা।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে গাড়িতে বসে নিলার কবরের দিকে তাকিয়ে আছি। কেন যেন মনে হচ্ছে নিলার পাশে চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়তে পারলেই ভালো হতো। এলোমেলো পায়ে হেটে নিলার কবরের পাশে এসে দফ করে বসে পড়লাম। এক হাত দিয়ে নিলার কবর জরিয়ে ধরে আছি, ভিতর থেকে যেন কোনো কথা বের হচ্ছে না। দুটু চোখ থেকে অঝরে পানি ঝরছে। আমার চোখের পানি নিলার কবর ভিজিয়ে দিচ্ছে, আর বার বার নিলাকে বলতে চাইছে “তোর পাশে আমাকে একটু জায়গা দিবি পাগলী, তুই যেভাবে সব যন্ত্রণা ভুলে নীরবে ঘুমিয়ে আছিস আমিও সেভাবে সব যন্ত্রণা ভুলে সারাজীবনের জন্য তোর পাশে ঘুমিয়ে পড়তে চাই”
নিলার কবর আকড়ে ধরে বসে ছিলাম হঠাৎ মনে হলো অনেক রাত হয়েছে বাসায় যেতে হবে। তাড়াতাড়ি গাড়িতে এসে বসলাম। ড্রাইভ করছি কিন্তু কেন যেন এখন কোনো কষ্ট হচ্ছে না শান্তি লাগছে নিলার কবরের কাছে এসে। হয়তো আরো বেশি শান্তি লাগতো যদি একেবারে নিলার পাশে ঘুমিয়ে পড়তে পারতাম।
বাসায় এসে কলিংবেল চাপতেই কে যেন দরজা খুলে দিলো, তাকিয়ে দেখি ছোটমা। ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসে পড়লাম, বাসার সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছে।
রিয়ান: ভাইয়া কোথায় ছিলে তুমি
আব্বু: রাত একটা বাজে রিফাত তোর এখন বাসায় ফিরার সময় হয়েছে
আমি: (নিশ্চুপ)
ছোটমা: একি তোর শরীরে মাটি লাগানো কেন কোথায় ছিলি তুই
নীলিমা: আমার মনে হয় ভাইয়া গ্রামে গিয়েছিল
আলিফা: গ্রামে কেন যাবে (আলিফা যে এখানে লক্ষই করিনি, এই অসুস্থ শরীর নিয়ে…)
আমি: আলিফা তুমি এখানে কেন ঘুমাওনি
প্রিতি: আজ যা করেছ কারো চোখে ঘুম আসবে নাকি
আমি: কি করলাম
প্রিতি: সেই সকালে বেড়িয়েছিলে আর বাসায় আসোনি, সারাদিন ফোন করেছি রিসিভ করনি
আমি: ওহ ফোনটা গাড়ির পিছনে বোধহয় পড়ে আছে
রিয়ান: ভালো তো বাড়ির সবাইকে চিন্তায় রেখে….
চাচ্চু: রিফাত চলে যাচ্ছিস কেন
আমি: এখানে বসে থেকে কি করবো
প্রিতি: খাবে না
আমি: না
চাচ্চু: কোথায় গিয়েছিলি এইটা অন্তত বলে যা (একের পর এক প্রশ্ন শুনতে শুনতে রাগ উঠে যাচ্ছে)
আমি: গ্রামে গিয়েছিলাম নিলার কাছে
আব্বু: তাই বলে কাউকে না জানিয়ে
আমি: আব্বু আমি মারা গেলে নিলার কবরের পাশে আমার কবর দিও। (চোখের পানি মুছতে মুছতে রুমে চলে আসতে চাইলাম)
আব্বু: রিফাত দাঁড়া
আমি: কিছু বলবে
আব্বু: সবাই ঘুমাতে যাও আর রিফাত তুই আমার রুমে আয়
আমি: হুম।
আব্বুর পিছু পিছু রুমে আসলাম, আব্বু দরজা লাগিয়ে দিলেন।
আব্বু: বস
আমি: হুম (আমি বসতেই আব্বু আমার পাশে এসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন)
আব্বু: রিফাত তুই কি সুইসাইড করার চিন্তা করছিস (অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আব্বুর দিকে, আমি সুইসাইড করার চিন্তা করছি আব্বু বুঝলেন কিভাবে)
আব্বু: ছোটবেলা থেকে তো আমিই তোদের বড় করেছি তাই কখন কি ভেবে কোন কথাটা তোরা বলিস সেটা আমি বুঝতে পারি।
আমি: আব্বু
আব্বু: তখন বললি না তোকে যেন নিলার কবরের পাশে কবর দেই তখনি আমি বুঝতে পেরেছি
আমি: (নিশ্চুপ)
আব্বু: এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলি একবারো আমার কথা, রিয়ান প্রিতির কথা ভাবলি না। ভালোবাসা ছাড়া বেঁচে থাকা কষ্টের জানি তাই বলে পরিবারের ভালোবাসা কে তুচ্ছ করবি। আমরা কি তোকে কম ভালোবাসি যে আলিফা চলে যাওয়াতে তোকে সুইসাইড করতে হবে।
আমি: (নিশ্চুপ)
আব্বু: জানি এক কষ্ট দুইবার পেয়েছিস, একি আঘাত দুইবার সহ্য করতে গিয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিস কিন্তু একবার আমাদের কথা ভাব। আমরা তোকে কতো ভালোবাসি তোকে ছাড়া তো আমাদের থাকতে কষ্ট হবে। মানছি আলিফা চলে গেলে নতুন করে আর কাউকে ভালোবাসতে পারবি না কিন্তু আমাদের ভালোবাসা তো আছে। একটা কথা মনে রাখিস বাবা সবাই ছেড়ে চলে গেলেও পরিবার কখনো ছেড়ে যাবে না, পরিবারের ভালোবাসা সবসময় থাকবে। আমি রিয়ান প্রিতি তোকে কতো ভালোবাসি আমাদের ভালোবাসায় কি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবি না।
আমি: আব্বু সরি (আব্বুকে জরিয়ে ধরে কাঁদছি আব্বুও কাঁদছেন)
আব্বু: সুইসাইড করতে নেই বাবা পাপ হয়, আল্লাহর উপর ভরসা রাখ দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে
আমি: সরি আব্বু আর কখনো এসব ভাববো না
আব্বু: হুম যা ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড় গিয়ে
আমি: হুম।
ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ কাধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করে পিছনে তাকালাম। আলিফা এসে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি: ঘুমাও গিয়ে অনেক রাত হয়েছে
আলিফা: সারাদিন আমাকে টেনশন দিয়ে এখন আমার ঘুমানো নিয়ে টেনশন করছ
আমি: সরি যাও ঘুমিয়ে পড়ো
আলিফা: অনেক রাত হয়েছে তুমিও চলো ঘুমাবে
আমি: হুম।
আলিফা চলে গেলো, যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না তাই দাঁড়িয়ে রইলাম। পকেট থেকে ঘুমের ওষুধ গুলো বের করে ফেলে দিলাম। থাক না আব্বু আর ভাই বোনের ভালোবাসায় নাহয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবো। সত্যিই তো সবাই ছেড়ে চলে গেলেও পরিবার কখনো ছেড়ে যায় না আর আমি কিনা সেই পরিবার কে কষ্ট দিতে যাচ্ছিলাম।
আলিফা রুমের লাইট অফ করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে দেখে রুমে আসলাম।
আলিফার পাশে এসে শুয়ে পড়লাম, আজ রাগ দেখাচ্ছে না শুধু অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। আমিও অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইলাম।
আমি: আলিফা আমার শেষ একটা কথা রাখবে
আলিফা: শেষ কথা মানে
আমি: না মানে
আলিফা: কি হয়েছে তোমার হ্যাঁ কিসব উলটাপালটা কথা বলছ (আমার হাত ধরে টানতে শুরু করলো, ওকে জরিয়ে ধরলাম)
আমি: আলিফা শুধু আজকের রাতটা আমাকে তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে দিবে
আলিফা: রিফাত হয়েছে কি তোমার
আমি: প্লিজ
আলিফা: হুম।
আলিফার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছি, ও আমাকে জরিয়ে ধরে রেখেছে।
আলিফা: রিফাত কাঁদছ কেন তুমি
আমি: নাতো
আলিফা: তোমার চোখের পানিতে আমার বুক ভিজে যাচ্ছে আর তুমি নাতো বলছ, কি হয়েছে বলতো।
আমি: কিছুনা ঘুমুতে দাও
আলিফা: হুম।
আলিফা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আমার চোখ থেকে অবাধ্যের মতো পানি ঝরছে। আলিফা তো জানেনা সকালে ওকে আমি ওর জীবনের সবচেয়ে বড় গিফট’টা দিবো। আলিফা অনেক খুশি হবে ওর রাতুলকে ফিরে পেয়ে। কাল আমাদের দুজনের রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে সারা জীবনের জন্য। ডিভোর্স হয়ে যাবে কাল আমাদের।
চলবে?