শেষ_পর্যন্ত
পার্ট: ২৪
দেয়ালে হেলান দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, চোখ দুটু থেকে বৃষ্টির মতো পানি পড়ছে। বুঝতে পারছি না ভাগ্য আমার সাথে এ কি খেলা খেলছে। এখন আমি কি করবো সত্যি বুঝতে পারছি না।
আব্বু: রিফাত কি হলো দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন (আব্বু তোমাকে আমি কি করে বুঝাই আমার মনের ভিতর কি চলছে, আমার মুখ থেকে যে কোনো কথা বের হচ্ছে না। আমি রাতুলকে দেখে যে বোবা হয়ে গেছি)
আব্বু: রিফাত কি হয়েছে তোর, আরে এখানে আয় উনি তোর আলিফাকে বাঁচিয়েছেন অন্তত একটা ধন্যবাদ তো দে
আমি: আব্বু আমি কাকে ধন্যবাদ দিবো যে নিজের ভালোবাসা কে বাঁচিয়েছে
আব্বু: মানে
রিয়ান: কি বলছ এসব ভাইয়া
আমি: আব্বু ও রাতুল আলিফা যাকে ভালোবাসে
আব্বু: কি (আব্বু দফ করে ফ্লোরে বসে পড়লেন, তাড়াতাড়ি গিয়ে আব্বুকে ধরলাম)
আমি: আব্বু তুমি বাসায় চলে যাও তোমার শরীর খারাপ লাগছে
আব্বু: আমার ছেলেটা….
আমি: রিয়ান আব্বুকে নিয়ে বাসায় যা
রিয়ান: তুমি
আমি: হসপিটালে আছি যদি কোনো প্রয়োজন হয়
রাতুল: আপনারা চাইলে সবাই বাসায় গিয়ে রেস্ট নিয়ে আসতে পারেন, আমি আছি আলিফার কাছে (রাতুলের কথা শুনে মনে হলো আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো, ওরা একটু একা থাকুক এতোদিন পর দেখা হয়েছে)
আমি: হুম ঠিক আছে।
আলিফার মাথার পাশে মোবাইলটা রেখেছিলাম, আনতে গেলাম। আলিফা আমার হাত ধরে ফেললো ইশারা দিয়ে বললো যেন না যাই। রাতুল বলছে চলে যেতে আলিফা হাত ধরে আছে কি করবো এখন। রাতুলের দিকে তাকালাম।
রাতুল: আলিফা যখন যেতে দিচ্ছে না তাহলে থাকুন সমস্যা নেই
আমি: হুম।
রিয়ান আর আব্বুকে পাঠিয়ে দিয়ে এসে আলিফার থেকে অনেক দূরে একটা চেয়ারে বসলাম। কেন যেন আলিফার কাছে যেতে ওকে ছুতে বড্ড ভয় হচ্ছে। কিসের এতো ভয় বুঝতে পারছি না, মনের ভিতর এক অজানা ভয় কাজ করছে।
আলিফা: রিফাত তুমি এতো দূরে বসে আছ কেন (আলিফার কথা শুনে ওর দিকে তাকালাম, রাতুল ওর একদম কাছে বসে আছে)
আমি: আলিফা তুমি কথা বলো না কষ্ট হবে তোমার
আলিফা: আমি ঠিক আছি এখন কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে না
আমি: হুম
আলিফা: রাতুল তোমার সাথে আমার কথা বলার আছে
রাতুল: সব কথা পড়ে বলবে আগে তুমি সুস্থ হয়ে উঠো (রাতুলের কথাটা শুনে আলিফা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে)
রাতুল: কি হলো কি দেখছ এভাবে
আলিফা: আগের মতোই ভালোবাস তাই না (বাহ্ রাতুলের একটা কথায় বুঝে গেলো আগের মতোই যে ভালোবাসে আর আমি পুরো একটা বছর চেষ্টা করে বুঝাতে পারলাম না। কত বড় অপদার্থ আমি)
রাতুল: দূরে গেলেই ভালোবাসা কমে যায় নাকি আগে যেমন ভালোবাসতাম এখনো বাসি আর সবসময় বাসবো (ওদের কথা গুলো আমার কানে বিষের মতো ঢুকছে, এখানে বসে থাকলে আমি নির্গাত মারা যাবো। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম)
আলিফা: রিফাত কোথাও যাবে না চুপ করে বসে থাকো
আমি: একটু ডক্টর এর কাছ থেকে আসছি
আলিফা: চুপ করে বসে থাকতে বলেছি বসে থাকো
আমি: হুম।
কিছু করার নেই চুপ করে বসে আছি, আর ওদের কাছে যা রোমান্টিক কথা আর আমার কাছে বিষ সে কথা গুলো শোনার জন্য অপেক্ষা করছি।
আলিফা: রাতুল তুমি দেশে ফিরেছ কবে
রাতুল: এক মাস হবে
আলিফা: আমার সাথে দেখা করোনি কেন
রাতুল: কিভাবে দেখা করবো কোনো রাস্তা ছিল নাকি। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম কিন্তু গিয়ে দেখি দরজায় তালা দেওয়া। এতিমখানায় গিয়ে জানতে পারি তোমার আব্বু মারা গেছেন
আলিফা: হ্যাঁ আর যেদিন আব্বু মারা যান সেদিন গাড়িতে তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই আর ফোনটা বাইরে পড়ে যায়। পড়ে আমি তোমাকে রিফাতের মোবাইল থেকে ফোন করেছিলাম কিন্তু তোমার নাম্বার বন্ধ ছিল। আর কখনো অন পাইনি অনেক চেষ্টা করেছি।
রাতুল: কিভাবে পাবে সেদিন আমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল। দু সপ্তাহ হসপিটালে থেকে বাসায় ফিরে যখন নতুন নাম্বার থেকে তোমাকে ফোন দেই তখন তোমার ফোন বন্ধ ছিল
আলিফা: আমাদের সাথে ভাগ্য খুব ভালো খেলা করেছে (আলিফার এই কথাটা শুনে ওর দিকে তাকালাম, আলিফার চোখে পানি। জানি এই পানির কারণ আমি। আমার কারণে আলিফার ভাগ্যটা উলটপালট হয়ে গেলো)
রাতুল: এই এক মাস তোমাকে পাগলের মতো খুঁজেছি। তোমার শশুড় বাড়ির ঠিকানা তো জানতাম না রাস্তায় রাস্তায় খুঁজেছি। আর আজ যখন পেলাম তখন তুমি মাঝ রাস্তায় পিছনে গাড়ি, আমি তোমার কাছে যাওয়ার আগেই গাড়িটা তোমাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়
আলিফা: তাহলে তখন আমার কাছে যাওনি কেন
রাতুল: আমি যাওয়ার আগে রিফাত মানে তোমার হাজবেন্ড চলে এসেছিল তাই আর যাইনি। তোমাদের ফলো করে হসপিটালে চলে আসি কারণ আমি জানতাম তোমার গ্রুপের রক্ত সহজে পাওয়া যায় না
আলিফা: হুম আমর…. (রাতুলের ফোন বেজে উঠলো, ও ফোনটা নিয়ে কেবিনের বাইরে চলে গেলো। নাহ এখানে আর আমি থাকতে পারবো না খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। একটু সময়ের জন্য হলেও আমাকে বাইরে যেতে হবে নাহলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো।)
আলিফার পাশে এসে বসলাম। চোখের পানি কোনোভাবে আড়াল করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম
আমি: আলিফা রাতুল তো আছে তোমার কাছে আমি একটু বাসা থেকে আসছি
আলিফা: আমাকে রেখে বাসায় যাওয়াটা খুব বেশি প্রয়োজন
আমি: নীলিমার সাথে আমার একটু কথা আছে, আমি যাবো আর আসবো
আলিফা: বজ্জাত মেয়েটার সাথে তোমার কিসের কথা একদম ওর কাছে যাবে না
আমি: একটু প্রয়োজন আছে যেতে হবেই তাড়াতাড়ি চলে আসবো
আলিফা: রিফাত তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না (কি বলবো এখন ওকে, চোখের পানি যতোই আড়াল করার চেষ্টা করছি ততোই যেন বেশি কান্না পাচ্ছে)
আমি: নারে পাগলী আমার আবার কষ্ট কিসের আসছি আমি।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসলাম, চোখের পানি মুছতে মুছতে কেবিনের বাইরে আসতেই রাতুলের সামনে পড়ে গেলাম। রাতুল আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি চলে আসলাম।
বাসায় এসে নীলিমাকে খুজছি কিন্তু পাচ্ছি না। ওকে তো আমার খুঁজে পেতেই হবে কেন করেছে এমন ওকে বলতেই হবে।
ছোটমা: রিফাত কাকে খুঁজছিস পাগলের মতো
আমি: নীলিমা কোথায়
ছোটমা: দেখলাম তো ছাদের দিকে গেলো
আমি: ওকে
ছোটমা: আরে কি হয়েছে আস্তে যা।
দৌড়ে ছাদে আসলাম নীলিমা ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে কি যেন করছে।
আমি: নীলিমা (ও কি যেন নিচে ছুড়ে ফেলতে চাইছিল আমার ডাকে চমকে উঠে পিছনে তাকালো)
নীলিমা: তুমি এই সময় বাসায়
আমি: এই সময় মানে
নীলিমা: না মানে ভাবি হসপিটালে আর তুমি বাসায় চলে এসেছ তাই একটু অবাক হলাম
আমি: তোর হাতে এইটা কি দেখি
নীলিমা: আরে এইটা নিচ্ছ কেন
আমি: এইটা তো নিলার ছবি যেটা সবসময় ড্রয়িংরুমে থাকে
নীলিমা: হ্যাঁ
আমি: তুই ছবিটা নিচে ছুড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিলি
নীলিমা: মানে কি পাগল হয়ে গেছ কি বলছ এসব, ভুলে যেও না ও আমার বোন। আমি কেন ওর ছবি ছুড়ে ফেলে দিতে যাবো
আমি: তাহলে তুই এইটা নিয়ে এখানে কি করছিস
নীলিমা: আপুর কথা খুব মনে পড়ছিল তাই ছবিটা এনে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি একটু একা থাকার জন্য
আমি: ওহ
নীলিমা: হুম
আমি: এসব বাদ দে সত্যি করে একটা বল তো
নীলিমা: কি
আমি: সকালে নাশতার টেবিলে ডিভোর্স পেপারটা কে রেখেছিল
নীলিমা: ডিভোর্স পেপার…? কার ডিভোর্স পেপার…?
আমি: না জানার বান করিস না, ওই বাসায় আমরা তিনজন ছাড়া অন্য কেউ ছিল না আমি বা আলিফা কেউ ডিভোর্স পেপারটা আনাইনি তারমানে…
নীলিমা: তারমানে কি আমি ডিভোর্স পেপারটা আনিয়েছি আর নাশতার টেবিলে রেখে দিয়েছি। তোমার মাথা ঠিক আছে তো পাগল হয়ে গেছ তুমি। আমি কোথা থেকে ডিভোর্স পেপার আনবো আর এতে আমারই বা লাভ কি
আমি: সেটাই তো জানতে চাইছি আমাদের ডিভোর্স হলে তোর লাভটা কি
নীলিমা: পাগল হয়ে গেছ যাও ভাবির সাথে তুমিও গিয়ে হসপিটালে ভর্তি হও
আমি: নেকামো ছাড় নীলিমা বল কেন করেছিস এমন
নীলিমা: ঠান্ডা মাথায় আমার কথাটা শুনো। তোমাদের ডিভোর্স হলে তো আমার কোনো লাভ নেই তাছাড়া তোমাদের ডিভোর্স চাইলে কি আমি তোমাদের এক করার জন্য এতোকিছু করতাম
আমি: এতোকিছু মানে
নীলিমা: আম্মুর মুখে শুনেছিলাম ভাবি অন্য কাউকে ভালোবাসে তাই তোমাকে মেনে নিতে পারছে না। ভাবিকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তাই তোমাদের বাসায় চলে আসি কিন্তু এসে যা বুঝতে পারি ভাবি তোমাকে ভালোবাসে কিন্তু সেটা নিজ থেকে বুঝতে পারছে না। তাই আমি ইচ্ছে করে তোমার কাছে যাওয়ার অভিনয় করেছি, চোখে কিছু পড়া, তোমার টাই ঠিক করে দেওয়া, তোমার হাত থেকে গোলাপ কেড়ে নিয়ে তোমাকে জরিয়ে ধরা সব আমার অভিনয় ছিল
আমি: অভিনয়
নীলিমা: হ্যাঁ কারণ আমি জানতাম একটা মেয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষকে কখনো অন্য কোনো মেয়ের সাথে সহ্য করতে পারে না আর ভাবির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমার এসব আচরণে ভাবি নিজের ভালোবাসা বুঝতে পেরেছে তোমার কাছে গিয়েছে ভালোবাসার কথা বলেছে।
নীলিমার কথা শুনে তো আমার মাথা ভনভন করছে। কি বলছে ও এসব, কিন্তু নীলিমা তো মিথ্যে কিছু বলছে না আমার প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল নীলিমা এসব ইচ্ছে করেই করছে। তাহলে ডিভোর্স পেপার….?
নীলিমা: ভাইয়া কোথায় যাচ্ছ এই সন্ধ্যা বেলায়।
দৌড়ে নিচে চলে আসলাম। আমাকে জানতে হবে ডিভোর্স পেপার আসলো কোথা থেকে।
ছোটমা: রিফাত কি হয়েছে তোর আস্তে যা (দৌড়ে এসে গাড়িতে বসলাম, ছোটমাও পিছন পিছন আসলো)
ছোটমা: এই সন্ধ্যা বেলায় কোথায় যাচ্ছিস
আমি: ছোটমা আমাকে অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে, নিলার মৃত্যুর রহস্য খুঁজে বের করতে হবে আমাকে
ছোটমা: মানে কি নিলার মৃত্যুর রহস্য মানে
আমি: আসছি
ছোটমা: সাবধানে যা।
একের পর এক সিগারেট খাচ্ছি আর খুব স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছি। কোথায় যাবো জানিনা শুধু পাগলের মতো গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। নীলিমার কথা অনুযায়ী তো একটা কথা পরিষ্কার এসবের পিছনে নীলিমা নেই। যদি নীলিমা না থাকবে তাহলে আর কে হতে পারে। নিলার মৃত্যুটা যদি খুন হয়ে থাকে তাহলে খুনটা করলো কে। আমার তো এখন মনে হচ্ছে কেউ একজন আছে যে লুকিয়ে এসব করছে। আর যে নিলার খুন করেছে সেই আলিফা আর আমার ডিভোর্স চাচ্ছে এইটা তো নিশ্চিত। আচ্ছা এমন নয় তো যে নিলাকে খুন করেছিল সে আজ আলিফাকেও গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। হতেই পারে এমন কিছু কিন্তু মানুষটা কে…? কে করছে এসব তাও আমাদের সবার চোখের আড়ালে। কোথায় খুঁজবো আমি তাকে কোন সুত্র ধরে খুঁজবো, খুঁজে কি আদৌ তাকে পাবো আমি….? হঠাৎ রাতুলের কথা মনে পড়লো, ও তো বলেছিল আলিফার এক্সিডেন্ট এর সময় রাস্তার অন্যপাশে ও ছিল। তারমানে কেউ যদি ইচ্ছে করে আলিফাকে ধাক্কা দিয়ে থাকে তাহলে সে মানুষটা কে হয়তো রাতুল গাড়িতে দেখতে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে আসলাম রাতুলকে জিজ্ঞেস করার জন্য।
কিন্তু আলিফার কেবিনের দরজায় এসে কিছু জিজ্ঞেস করার মতো শক্তি আর রইলো না। রাতুল আলিফার পাশে বসে আছে, আলিফার একটা হাত রাতুলের দু হাতের মুঠোয়। রাতুল আলিফার হাত ধরে কাঁদছে আর আলিফা অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে কাঁদছে। এই দৃশ্য দেখে ভিতরে যাওয়ার সাহস আর হলো না। বাইরে একটা চেয়ারে এসে বসলাম। কান্নাকাটি বাধ দিয়ে মাথা ঠান্ডা করে ভাবলাম, ওদের কান্নার কারণ তো আমি। এতোদিন যা হবার হয়েছে এখন আর ওদের কাঁদানোর কোনো অধিকার নেই আমার। যতো কষ্টই হউক আমার সব কষ্ট আড়াল করে আলিফাকে সুখী করার জন্য ওকে আমার ডিভোর্স দিতেই হবে।
চলবে?