শেষ_পর্যন্ত পার্ট: ২০

0
1940

শেষ_পর্যন্ত

পার্ট: ২০

লেখিকা: সুলতানা তমা

“রিফাত উঠো প্লিজ অনেক বেলা হয়ে গেছে” হঠাৎ আলিফার চেঁচামেচিতে চোখ মেলে তাকালাম। আলিফা আমার হাত ধরে টানছে, ইচ্ছে হচ্ছে ওকে টান দিয়ে আমার বুকে শুয়ে দিয়ে বলি “ভালোবাসি রাগিণী” কিন্তু সেটা করা যাবে না কারণ আজ থেকে আমি আলিফাকে অবহেলা করবো। আচ্ছা আমি যে বার বার বলছি ওকে অবহেলা করবো পারবো তো আমি। না না এসব কি ভাবছি পারতে তো আমাকে হবেই, না পারলে অন্তত অভিনয় করতে হবে আমাকে।
আলিফা: রিফাত যাবে কিনা সবাই নাশতা করার জন্য বসে আছে (আলিফার দিকে তাকালাম, রাতে ডিভোর্স এর কথা বলাতে মেয়েটা অভিমান করে চলে যেতে চেয়েছিল আর এখন হাসছে)
আলিফা: এই কি ভাবছ এতো চলো (এক ঝটকা দিয়ে আলিফার হাত সরিয়ে দিলাম, চেঁচিয়ে বললাম)
আমি: আর কখনো আমাকে ডাকতে আসবে না। আমার যখন খুশি উঠবো, যখন খুশি খাবো বুঝেছ।
আলিফা: রিফাত তুমি আমার সাথে এমন করছ কেন
আমি: তোমার সাথে এর চেয়ে ভালো ব্যবহার করা যায় না।
আলিফা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আলিফার দিকে আর না তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।

নাশতা করছি আর ভাবছি রাতে যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছি সেটা আব্বুকে এখনি জানানো প্রয়োজন।
আমি: আব্বু একটা কথা ছিল
আব্বু: বলে ফেলো
আমি: আব্বু আসলে আমি এই বাসায় থাকতে চাইছি না, আলিফাকে নিয়ে অন্য বাসায় উঠতে চাইছি (সবাই খাবার রেখে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: কি হলো সবাই এমন হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন
রিয়ান: ভাইয়া তুমি বুঝতে পারছ কি বলতেছ
প্রিতি: ভাইয়া তুমি আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাইছ
আব্বু: থাম তোরা, ও যখন নিজে থেকে যেতে চাইছে তারমানে কোনো কারণ নিশ্চয় আছে (আব্বু যে কিভাবে আমার মনের কথা বুঝে যান। আসলেই তো আমি একটা কারণেই এই বাসা থেকে যেতে চাইছি। আর সেটা হলো আলিফাকে কষ্ট দেওয়া। এখানে সবার মাঝে থাকলে ওকে আমি কষ্ট দিতে পারবো না তাই অন্য বাসায় যাওয়া প্রয়োজন)
আব্বু: রিফাত তুই যেতে পারিস তবে আমি যেখানে বলি সেখানে
আমি: ঠিক আছে আব্বু
আলিফা: সবাই যার যার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছ একবারো আমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে না
আমি: ওমা তুমি সিদ্ধান্ত নিতে জানো আমি তো জানতাম….
আব্বু: রিফাত চুপ কর। আলিফা বলো তুমি কি চাও
আলিফা: আমি এই বাসা ছেড়ে তোমাদের ছেড়ে যাবো না
আমি: এই বিষয়ে আর একটা কথাও শুনতে চাই না। আমি যাবো তাই তুমিও আমার সাথে যাবে (আলিফাকে চেঁচিয়ে বললাম, ও কাঁদতে কাঁদতে রুমে চলে গেলো)
আব্বু: রিফাত কি হচ্ছে এসব
আমি: আব্বু ওকে কষ্ট দেওয়া প্রয়োজন নাহলে ও বুঝবে না সত্যিকারের ভালোবাসা কোনটা
আব্বু: তাই বলে
আমি: হ্যাঁ আব্বু এজন্যই আমি ওকে নিয়ে অন্য বাসায় যাবো
আব্বু: ঠিক আছে যা ভালো মনে হয় কর
আমি: হুম।

আলিফা বসে বসে কাঁদছে এখন কি করি ওকে কাঁদিয়ে নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে। কিন্তু যেতে তো হবেই ও সবার মাঝে থাকলে অবহেলাটা অনুভব করতে পারবে না।
আমি: বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি না করে সবকিছু গুছিয়ে নাও
আলিফা: আমি যাবো না যেতে হয় তুমি একা যাও
আমি: একদম চুপ, রেডি হয়ে নাও বলছি
আলিফা: যাবো না বললাম তো
আমি: এমন ভাবে কান্না করছ মনে হচ্ছে তোমাকে আমি ওখানে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলবো (কথাটা শুনে কেমন করে যেন আমার দিকে তাকালো)
আমি: এভাবে কি দেখছ যাও রেডি হয়ে নাও
আলিফা: বুঝেছি এজন্যই এতোকিছু করছ
আমি: মানে
আলিফা: তুমি আমাকে ওখানে নিয়ে সত্যি সত্যি মেরে ফেলবে আমি বুঝে গেছি এজন্যই এতো প্ল্যান করেছ (জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করেছে আজব মেয়ে তো কি বলে এসব)
আমি: কান্না থামাও আর রেডি হও নাহলে কিন্তু
আলিফা: আমি তোমাকে ভালোবাসি না বলে সত্যি সত্যি আমাকে মেরে ফেলবে (এখন ওকে কি বলা উচিত ভেবে পাচ্ছি না। কেমন বোকা মেয়ে উফফফ)
আমি: আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমাকে মারা তো দূরের কথা তোমাকে…. (দূর ওকে এসব বলে লাভ কি ও তো ভালোবাসা কি সেটাই বুঝে না)
আলিফা: চুপচাপ রেডি হয়ে নাও।

রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। যতোক্ষণ রুমে থাকবো এই পাগলীর সাথে বকবক করতেই হবে।
রিয়ান: ভাইয়া কখন যাবে তোমরা (রুম থেকে বেরুতেই দেখি রিয়ান)
আমি: একটু পর কেন
রিয়ান: না মানে তোমাকে ছাড়া কখনো….
আমি: বুঝেছি, আমি মাত্র এক সপ্তাহের জন্য অন্য বাসায় যাচ্ছি। এই এক সপ্তাহে যদি মনে হয় আলিফা আমাকে ভালোবাসে তাহলে ফিরে আসবো আর যদি মনে হয় ভালোবাসে না তাহলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে মুক্ত করে দিবো
রিয়ান: ভাইয়া এক সপ্তাহ পর তোমার জন্মদিন আর তুমি ভাবিকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবছ
আমি: এটাই মনে হয় আমার এই জন্মদিনের সবচেয়ে বড় গিফট
রিয়ান: ভাইয়া
আমি: নিচে যা আমি রেডি হয়ে আলিফাকে নিয়ে আসছি
রিয়ান: হুম।

রুমে এসে দেখি আলিফা এখনো বসে বসে কাঁদছে। ইচ্ছে হচ্ছে একটা ধমক দিয়ে নিয়ে যাই।
আমি: এখনো রেডি হওনি
আলিফা: (নিশ্চুপ)
আমি: তোমার রেডি হতে হবে না চলো
আলিফা: দাঁড়াও রেডি হয়ে আসছি
আমি: লাগবে না আর অন্য কারো বাসায় যাচ্ছি না ওইটাও আমাদের বাসা
আলিফা: হুম।

আলিফাকে নিয়ে বেরিয়ে আসলাম, মন খারাপ করে আছে দেখে মনে হচ্ছে ও বাবার বাড়ি থেকে শশুড় বাড়ি যাচ্ছে।
আব্বু: সাবধানে যাস
আমি: আব্বু এতো চিন্তা করছ কেন আমি কি অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি এখান থেকে কিছু দূরেই তো বাসা
আব্বু: তাও সাবধানে থাকিস
আমি: ওকে।

ড্রাইভ করছি আর আলিফাকে আড়চোখে দেখছি, আলিফাও বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে।
আমি: কিছু বলবে
আলিফা: আমি জানি তুমি কেন আমাকে নতুন বাসায় নিয়ে যাচ্ছ
আমি: কেন
আলিফা: বলেছিলে না এখন থেকে অবহেলা করবে তাই
আমি: তুমিতো আমায় ভালোবাস না আমি তোমাকে অবহেলা করলেই কি। (ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ের মনে যে কি চলছে আল্লাহ্‌ জানেন)

বাসায় এসেই রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম, আলিফা আমার পিছন পিছন এসে রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলো।
আমি: এইটা আমার রুম তাই এইটা এভাবে দেখার কোনো মানে হয় না
আলিফা: তোমার রুম মানে
আমি: আমার রুম মানে আমার রুম। এই রুমে আমি ঘুমাবো তুমি অন্য রুমে, যাও যে রুম পছন্দ হয় সেটা গিয়ে পরিষ্কার করে নাও
আলিফা: আজব তো আমরা কখনো আলাদা থেকেছি নাকি
আমি: আমরা কখনো এক সাথে ঘুমিয়েছি নাকি
আলিফা: না মানে এক রুমে তো থেকেছি। আসলে এতো বড় বাসায় আমরা দুজন মানুষ মাত্র অন্য রুমে ঘুমাতে আমার ভয় করবে
আমি: সেটা তোমার ব্যক্তিগত সমস্যা আমার কি
আলিফা: অবহেলা বুঝি মানুষ এভাবে করে
আমি: যাও তো আমার চোখের সামন থেকে।
আলিফা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রাগ দেখিয়ে তো বললাম চোখের সামন থেকে চলে যেতে, অচেনা জায়গায় আবার হারিয়ে যাবে না তো। আস্তে আস্তে আলিফার পিছু পিছু আসলাম। আমার রুমের পাশের রুমে গিয়ে ঢুকলো মনে হয় এই রুমেই থাকবে।
আমি: রুম তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করে রান্না বসাও গিয়ে (হঠাৎ আমার কন্ঠ শুনে আলিফা চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো, সত্যিই তো মেয়েটা ভয় পায়)
আলিফা: মানে
আমি: দুপুরে খেতে হবে তো নাকি। রান্না ঘরে সব আছে গিয়ে রান্নাটা করে নাও
আলিফ: হুম।

আলিফা রান্না করছে আর আমি বার বার গিয়ে ওকে পাহারা দিচ্ছি, ভয় পায় যদি তাই। নিলা যখন মাঝে মাঝে রান্না করতো তখন খুব দুষ্টুমি করতাম ওর সাথে, আলিফা রান্নায় ব্যস্ত ইচ্ছে হচ্ছে দুষ্টুমি করি কিন্তু….
রুমে চলে আসলাম নিলার ছবিটা সাথে নিয়ে এসেছিলাম। দেয়ালে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। পাগলীটা তো দিব্বি হাসছে কষ্টে তো রেখে গেছে আমাকে, আবার ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছে বিয়ে করি যেন, বউকে অনেক ভালোবাসি যেন কিন্তু একবারো ভাবেনি বউটা আমাকে ভালোবাসবে কিনা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছে মহারাণীর রান্না এখনো শেষ হয়নি, কি যে রান্না করছে ও জানে।
আলিফা: রিফাত যাও খেয়ে নাও (পাশ ফিরে দেখি আলিফা, ওর যা অবস্থা হয়েছে দেখার মতো)
আমি: রান্না শেষ হয়েছে তাহলে
আলিফা: রান্না তেমন করিনি তো তা….
আমি: থাক আর বলতে হবে না।
আলিফাকে রেখেই খেতে চলে আসলাম।

খেয়ে সোফায় বসে আছি, ইচ্ছে করেই বসে আছি কারণ আলিফা এখনো খায়নি কোথায় যে আছে মেয়েটা। সন্ধ্যা নেমে আসছে অথচ….
আলিফা: রিফাত খেয়ে নিয়েছ
আমি: হ্যাঁ
আলিফা: আমার জন্য একটু অপেক্ষাও করনি
আমি: তুমি কোন দেশের মহারাণী যে তোমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
আলিফা কিছু না বলে মন খারাপ করে গিয়ে খেতে বসলো।

“উনি নাকি আমাকে ভালোবাসে আমি একা একা রান্না করলাম একটু হেল্প করলো না, রুম পরিষ্কার করলাম তাও একটু হেল্প করলো না উল্টো রান্না করতেই এসে খেয়ে নিলো। আমার খিদে লেগেছে কিনা জানার প্রয়োজন মনে করেনি। আবার নাকি আমাকে ভালোবাসে হুহ” বসে বসে আলিফার কথা শুনছিলাম এবার উত্তর দেয়া উচিত। উঠে উপড়ে আসতে আসতে আলিফার দিকে তাকিয়ে বললাম “আমি কাউকে ভালোবাসি না” তাড়াতাড়ি উপরে চলে আসলাম। লুকিয়ে একবার ওর দিকে তাকালাম, খাবার রেখে বসে আছে হয়তো ভাবছে আমি হঠাৎ ভালোবাসি না বললাম কেন।

রুমে আসার সাথে সাথে শুনতে পেলাম কলিংবেল বাজছে। এই সন্ধ্যাবেলায় তাও এই বাসায় কে আসবে।
নিচে আসলাম আলিফা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি: কি হলো দরজা খুলছ না কেন
আলিফা: এই সন্ধ্যাবেলায় কে আসবে তাও নতুন বাসায় তাই ভয় করছে
আমি: তুমি সরো আমি খুলছি।

দরজা খুলে দেখি নীলিমা। দূর এই মেয়ে আবার এখানে আসতে গেলো কেন, ওকে কেন যেন আমার ভালো লাগে না।
নীলিমা: ভাইয়া
আমি: তুই এখানে
নীলিমা: ভাবিকে দেখার জন্য গ্রাম থেকে আসলাম, বাসায় এসে শুনি তুমি ভাবিকে নিয়ে নতুন বাসায় উঠেছ ভা….
আমি: তোকে দেখে তো বুঝার উপায় নেই গ্রাম থেকে যে এসেছিস, মনে হচ্ছে লন্ডন থেকে এসেছিস।
নীলিমা: কেন
আমি: যা পোশাক পড়েছিস
নীলিমা: সুন্দর লাগছে বুঝি
আমি: হুম ভিতরে আয়
আমি: ভাবি কোথায়। (পিছনে তাকিয়ে দেখি আলিফা নেই গেলো কোথায়)
আমি: তুই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে আমি আলিফাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি
নীলিমা: ওকে।

আলিফার রুমে এসে খুঁজলাম ও নেই, আমার রুমে এসে দেখি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি: আমার রুমে কেন তুমি
আলিফা: তোমার বোন এসেছে ও তো এখন আমার রুমটায় থাকবে তাই আমি আগেই এই রুমে চলে আসলাম
আমি: তুমি না সত্যি একটা আজব মেয়ে তোমার মন বুঝা খুব কঠিন
আলিফা: বুঝার চেষ্টা করলে বুঝে যেতে এতো কঠিন মনে হতো না
আমি: প্রায় একটা বছর ধরে চেষ্টা করছি এতোটুকু বুঝতে পারিনি। সকালে যদি ভালো ব্যবহার করো তো বিকেলে খারাপ। এভাবে কারো মন বুঝা যায় নাকি।
আলিফা: কই এখন তো এমন করি না সবসময় ভালো ব্যবহার করি
আমি: কচু করো, যাও নীলিমা ডাকছে
আলিফা: যাবো না মেয়েটাকে আমার ভালো লাগেনি
আমি: তুমি দেখলে কখন
আলিফা: তোমার পিছন থেকে একবার দেখেছি কি সব ড্রেস পড়েছে ছিঃ
আমি: বেশি কথা বললে তোমাকেও এসব ড্রেস পড়াবো যাও বলছি
আলিফা: ওহ বুঝেছি এসব ড্রেস পড়ে আসাতে ওকে তোমার ভালোই লেগেছে
আমি: মানে
আলিফা: শুনো আমি বাচ্চা মেয়ে না আর তোমার ওই বোন ও বাচ্চা না দেখে তো মনে হয়….
আমি: যাবা তুমি
আলিফা: যাচ্ছি তবে এই মেয়ে যেন দুদিনের বেশি এখানে না থাকে।
আলিফা চলে গেলো কিন্তু কি বলে গেলো ও কি আমাকে সন্দেহ করছে নাকি….? যদি ভালো না বাসবে তাহলে সন্দেহ করবে কেন…? এই মেয়ের মন যে কবে বুঝতে পারবো, আদৌ বুঝতে পারবো কিনা আল্লাহ্‌ জানেন।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে