শেষ_পর্যন্ত
পার্ট: ১৫
সাত মাস পর….
সকালে মুখে রোদের আলো পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো, ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি আলিফা জানালা খুলে দিয়েছে, আমার মুখে রোদ পড়েছে দেখে হাসছে। আমি পাশ ফিরে শুয়ে রইলাম। আজ আমাদের বিয়ের সাত মাস পূর্ণ হলো। আজকে আলিফার উপর সবকিছু নির্ভর করছে ও যা চাইবে তাই হবে। আচ্ছা আলিফা যদি আজ ডিভোর্স চায়…?
আড়চোখে আলিফার দিকে তাকালাম, রুমে পায়চারী করছে আর কি যেন ভাবছে।
আলিফা: আবার ঘুমিয়ে পড়ছ যে অফিসে যাবে না
আমি: না
আলিফা: কেন
আমি: আলিফা আজ আমাদের বিয়ের সাত মাস পূর্ণ হয়েছে তোমার মনে আছে তো….
আলিফা: হুম
আমি: কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ
আলিফা: (নিশ্চুপ)
আমি: আলিফা আজ নিশ্চুপ হয়ে থাকলে হবে না, সাত মাস অনেক সময় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য
আলিফা: আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না
আমি: তা বললে তো হবে না। সাত মাস হয়ে গেছে রাতুল দেশে ফিরে আসবে, তোমাকে তো এখন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। (বলতে বলতে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম)
এসে দেখি আলিফা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম।
আলিফা: রিফাত সত্যি করে একটা কথা বলবে
আমি: কি
আলিফা: এই সাত মাসে তোমার কি মনে হয়েছে আমার মন কাকে ভালোবাসে
আমি: আমি এখনো তোমার মন বুঝতে পারিনি। তুমি আমার সাথে ভালো ব্যবহার করো আবার রাতুলের সাথেও কথা বলে যাচ্ছ কি বুঝবো বলো
আলিফা: আমি না দুটানায় পড়ে গেছি আমি তোমাদের কাউকেই কষ্ট দিতে চাই না
আমি: তুমি যা চাইবে আমি তাই মেনে নিবো
আলিফা: যদি ডিভোর্স চাই (ওর এমন কথায় কেমন যেন বোবা হয়ে গেলাম, এখন কি বলবো)
আলিফা: কি হলো
আমি: কিছুনাহ, ডিভোর্স চাইলে আমি দিবো কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি তুমি যেভাবে ভালো থাকবে তাতেই আমি খুশি
আলিফা: আর যদি তোমার কাছে থেকে যেতে চাই
আমি: সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালবাসবো সবসময় আগলে রাখবো তোমাকে, কোনো কষ্ট পেতে দিবো না
আলিফা: প্রশ্নগুলো রাতুল কে করলে সেও এমন উত্তর দিবে এখন তুমি বলো আমি কাকে বেছে নেই
আমি: তোমার মন যা চায় তাই করো
আলিফা: মন কি চায় আমি নিজেই বুঝতেছি না
আমি: তোমার মন একবার আমাকে চায় একবার রাতুলকে চায় বুঝেছ এজন্যই তুমি দুটানায় পরে গেছ। কিন্তু আলিফা বুঝার চেষ্টা করো এভাবে সম্ভব না।
আলিফা: হুম
আমি: রাতুল কি বলেছে দেশে কবে আসবে
আলিফা: আর দুদিন আছে
আমি: রাতুল এসে যখন তোমার সামনে দাঁড়াবে তখন কি করবে তারচেয়ে ভালো আজই সিদ্ধান্ত নাও
আলিফা: রিফাত আমাকে একটু একা থাকতে দাও তো
আমি: ওকে।
আলিফা কি সিদ্ধান্ত নিবে আমি জানিনা কিন্তু আমি আজ একটা সিদ্ধান্ত নিবোই এভাবে তো চলতে পারে না। আব্বুর সাথে কথা বলার জন্য আব্বুর রুমে আসলাম।
আমি: আব্বু আসবো
আব্বু: আয়
আমি: আব্বু
আব্বু: কিছু বলবি
আমি: হুম
আব্বু: বল
আমি: আব্বু আমি আলিফাকে সাত মাস সময় দিয়েছিলাম ভালোভাবে বুঝে যেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিন্তু ও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। রাতুল দেশে চলে আসবে আব্বু আমি আর পারছি না আমি এই দুটানা থেকে মুক্তি চাই
আব্বু: কি করতে চাইছিস
আমি: আলিফা যদি এভাবে থাকতে চায় তাহলে আমার পক্ষে সম্ভব না আমি ওকে ডিভোর্স দিবো
আব্বু: এইটা কি ঠিক হবে
আমি: তো আমি কি করবো আব্বু, আলিফা প্রতিনিয়ত রাতুলের সাথে কথা বলে যাচ্ছে আমি তো একটা মানুষ আব্বু আমারো তো কষ্ট হয় আর কতো সহ্য করবো
আব্বু: ঠিক আছে তুই আলিফার সাথে আবার কথা বলে দেখ আমি ভেবে দেখছি
আমি: হুম।
রুমে চলে আসলাম, আলিফা ফোনে কথা বলছে। এই মেয়েকে তো থাপড়াইতে মন চাইতেছে, দুদিকেই ঠিক রাখছে এইটা তো ঠিক না। রাতুল আমি দুজনেই কষ্ট পাচ্ছি।
আলিফা: রিফাত এসেছ শুনো আমার সিদ্ধান্ত
আমি: হুম বলো (বুকের বাম পাশে ধুকধুক করছে, ভয় হচ্ছে আলিফা যদি ডিভোর্স চায় তখন কি করবো আমি, পারবো আলিফাকে ডিভোর্স দিতে…?)
আলিফা: রিফাত কি হয়েছে তোমার এভাবে ঘামছ কেন
আমি: কই কিছু নাতো
আলিফা: কিছু না বললেই হলো।
এক গ্লাস পানি এনে আমার হাতে দিলো। পানি খেতে খেতে ওর দিকে তাকালাম, এসব তো এখন স্মৃতি হয়ে যাবে আর আমাকে তাড়া করে বেড়াবে।
আলিফা: রিফাত আমি কাউকেই কষ্ট দিতে চাই না। তোমার কাছে থাকলে রাতুল কষ্ট পাবে রাতুলের কাছে চলে গেলে তুমি কষ্ট পাবে। কিন্তু তোমাদের এই কষ্ট দেওয়া ছাড়া আমার সামনে কোনো রাস্তা নেই। আমি অনেক ভেবে দেখেছি কষ্ট দিলে দুজনকেই দেওয়া উচিত।
আমি: দুজনকে মানে বুঝলাম না
আলিফা: আমি তোমাদের দুজনকেই মুক্তি দিতে চাই
আমি: মানে কি
আলিফা: রাতুলকে বলবো তোমাকে আগে বলছি তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও, রাতুলের সাথেও আমি সব সম্পর্ক বাদ দিয়ে দিবো।
আমি: মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার পাগলের মতো এসব কি বলছ, একবার ভেবে দেখেছ তোমার কি হবে কোথায় যাবে তুমি
আলিফা: কেন আব্বুর কাছে
আমি: তোমার আব্বু আমার উপর ভরসা করে বলেছিলেন তোমাকে যেন আগলে রাখি, আমি হয়তো পারবো না কিন্তু রাতুল তো পারবে তুমি যেকোনো একজনের কাছে থাকো প্লিজ
আলিফা: একজন হাসবে অন্যজন কাঁদবে তা তো হতে পারে না
আমি: এসব বলেছ রাতুলকে
আলিফা: না রাতে ও ফোন করবে তখন বলে দিবো
আমি: তাহলে আর বলার প্রয়োজন নেই তুমি রাতুলের কাছে চলে যাও আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছি। তুমি যার সাথেই থাকো তোমাকে সুখী দেখলেই আমি শান্তি পাবো
আলিফা: রিফাত শু….
আলিফার ফোন বেজে উঠলো, রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কি বললো শুনিনি কিন্তু আলিফা একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি ওকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিলাম। হঠাৎ করে কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। পানি ছিটিয়ে দিলাম ওর চোখে মুখে কিন্তু জ্ঞান ফিরছে না।
আব্বু: রিফাত কি হয়েছে আলিফা এভাবে চিৎকার করলো কেন
প্রিতি: ভাবির চিৎকার শুনে আমরা দৌড়ে এসেছি, কি হয়েছে
আমি: জানিনা কে যেন ফোন করলো ও রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কি বলেছে যেন সাথে সাথে আলিফা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো
আব্বু: রিয়ান আলিফার মোবাইল এনে দেখতো কে ফোন দিয়েছিল
রিয়ান: দেখছি আব্বু।
আলিফার চোখেমুখে পানি ছিটাতে ছিটাতে হঠাৎ ওর জ্ঞান ফিরলো।
আমি: আলিফা কি হয়েছে
আলিফা: রিফাত আব্বু আআআব্বু… (আবার অজ্ঞান হয়ে গেলো)
রিয়ান: আব্বু এতিমখানার ম্যানেজার ফোন করেছিল ভাবির আব্বু মারা গেছেন
আব্বু: এজন্যই মেয়েটা এতো কষ্ট পেয়েছে। ছোটবেলা থেকে কারো আদর ভালোবাসা পায়নি, বড় হয়ে একজনের পেলো তো আজ উনি মেয়েটাকে একা রেখে চলে গেলেন
রিয়ান: আব্বু ভাবির তো জ্ঞান ফিরছে না আমি ডক্টরকে ফোন করে আসতে বলছি
আব্বু: হুম।
আলিফার মাথাটা আমার কোলে নিয়ে বসে আছি, এখনো অজ্ঞান হয়ে আছে। যে মেয়েটা একটু আগে বলছিল আমাকে রাতুলকে মুক্তি দিয়ে বাবার কাছে চলে যাবে সে মেয়েটাই কিনা এখন একা হয়ে গেলো।
আলিফা: রিফাত আমি আব্বুর কাছে যাবো (হঠাৎ আলিফার জ্ঞান ফিরে আসলো)
আমি: আব্বু আলিফার জ্ঞান ফিরেছে
আব্বু: মা এখন কেমন লাগছে
আলিফা: আমি আব্বুর কাছে যাবো
আব্বু: হ্যাঁ আমরা সবাই যাবো, ডক্টর আসছে তোমাকে দেখিয়ে তারপর যাবো
আলিফা: আমি ঠিক আছি ডক্টর লাগবে না, আমাকে আব্বুর কাছে নিয়ে চলো
আমি: আব্বু বাসায় এসে ডক্টর দেখানো যাবে ওকে এখন নিয়ে যাওয়াই ভালো
আব্বু: ঠিক আছে, রিয়ান গাড়ি বের কর আমরা সবাই যাবো।
গাড়িতে আলিফা আমার কাধে মাথা রেখে আমাকে জরিয়ে ধরে বসে আছে। এখন আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না, সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সকালে ভেবেছিলাম আলিফা কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে আমিই সিদ্ধান্ত নিবো, ওকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু ওকে একা করে দেই কিভাবে, আমি ওর পাশে না থাকলে কে থাকবে রাতুল তো দেশের বাইরে।
রিয়ান: ভাইয়া ভাবির ফোন এসেছে মোবাইল আমার কাছে ছিল
আমি: প্রিতি ফোনটা এনে তুই রিসিভ কর তো (প্রিতি ফোন হাতে এনে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: কি হলো রিসিভ কর
প্রিতি: ভাইয়া রাতুল ফোন দিয়েছে (আমাদের তো রিসিভ করা ঠিক হবে না, পরে যদি আলিফাকে ভুল বুঝে)
আমি: আলিফা তোমার ফোন এসেছে।
আলিফা ফোন রিসিভ করে গাড়ির জানালার কাছে গেলো কথা বলতে। হঠাৎ গোঙিয়ে উঠলো তাড়াতাড়ি ওর পাশে গেলাম, গিয়ে দেখি আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে।
আমি: আব্বু আলিফা তো আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে
আব্বু: বেশি কষ্ট পেয়েছে তো চিন্তা করিস না আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে
আমি: হুম। (আলিফাকে কাছে এনে বুকের সাথে জরিয়ে ধরলাম, এই একটু সময়ে মেয়েটা কেমন যেন নীরব হয়ে গেছে)
আব্বু: রিফাত সকালে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি তা ভুলে যা, এখন তুই আলিফার সবকিছু
আমি: কিন্তু আব্বু রাতুল যদি ফিরে আসে
আব্বু: ফিরে আসলে আলিফা যদি নিজের ইচ্ছায় রাতুলের কাছে যেতে চায় তখন বাধা দিবি না কিন্তু এখন মেয়েটার কেউ নেই তাই আমি চাইবো তুই অতীতের সব কষ্ট ভুলে মেয়েটাকে আপন করে নে
আমি: হুম আব্বু।
আলিফার আব্বুর লাশ জরিয়ে ধরে ও খুব কান্না করছে। কাঁদুক আজ আর বাধা দিবো না।
ম্যানেজার: মেয়েটা খুব একা হয়ে গেলো
আব্বু: কে বললো আমার বৌমা একা হয়ে গেছে, ওর এক আব্বু মারা গেছে আর এক আব্বু তো বেঁচে আছে। আমি সবসময় আলিফাকে আগলে রাখবো।
ম্যানেজার: আপনার কথা শুনে স্বস্তি পেলাম, আসলে মেয়েটা ছোট থেকেই একা তো তা….
আব্বু: এখন আর ও একা না, ওর পুরো একটা পরিবার আছে স্বামী আছে।
ম্যানেজার: মেয়েটা খুব ভালো ছোট থেকে চিনি তো ওকে কখনো কষ্ট দিও না বাবা (আমাকে কথা গুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন)
আলিফার আব্বুর দাফন কাজ শেষ করে ওকে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।
আলিফা শুয়ে শুয়ে কাঁদছে, রাত হয়ে গেলো সকাল থেকে মেয়েটা সমানে কেঁদে যাচ্ছে এভাবে কাঁদলে তো মেয়েটা….
রিয়ান: ভাইয়া ডক্টর এসেছেন
আমি: হুম ভিতরে নিয়ে আয়।
ডক্টর আলিফাকে দেখে কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে ওকে রেস্ট নিতে বলে চলে গেলেন। আলিফা আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে দেখে ওর পাশে গিয়ে বসলাম।
আমি: কি হয়েছে এতো ভেঙে পড়ছ কেন
আলিফা: আমি যে আবারো খুব একা হয়ে গেলাম, আব্বু আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলেন
আমি: কেঁদো না প্লিজ কে বলেছে তুমি একা আমরা আছি তো, এখানে তো তোমার আরেকজন আব্বু আছেন তাহলে এতো ভেঙে পড়ছ কেন
আলিফা: রিফাত (আমার হাত ধরে কান্না করে দিলো)
আলিফা এখন আমাকে ছাড়বে নাকি রাতুলকে ছাড়বে ভেবে পাচ্ছে না, দুজনকে ছেড়ে দিলে যাবে কার কাছে এজন্যই এতো ভেঙে পড়ছে আমি তা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তো ওকে আর কাঁদতে দিবো না, ও আমাকে ভালোবাসুক বা না বাসুক আমি ওকে সবসময় ভালবাসবো, ওকে সবসময় আগলে রাখবো।
আলিফার দিকে তাকিয়ে দেখি ঘুমিয়ে পড়েছে, ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বললাম “তোমাকে কখনো হারাতে দিবো না রাগিণী, অনেক ভালবাসবো তোমায়”
চলবে?