শেষ_পর্যন্ত পার্ট: ১১

0
2002

শেষ_পর্যন্ত

পার্ট: ১১

লেখিকা: সুলতানা তমা

আলিফা কিছু না বলে আলতো করে আমার চোখের পানি মুছে দিলো….

বাসায় আসতেই সবাই নানা রকম প্রশ্ন করতে শুরু করলো কিন্তু আমার কান দিয়ে এসব কিছু ঢুকছে না। আমার শুধু মনে পড়ছে আলিফার খাইয়ে দেওয়ার কথা, চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়ার কথা, চোখের পানি মুছে দেওয়ার কথা।

বিছানায় শুয়ে আছি ছোটমা এসে পাশে বসলেন।
ছোটমা: রিফাত কি হয়েছে
আমি: কিছুনা (ছোটমার কোলে মাথা রাখলাম)
ছোটমা: আমার কাছে লুকাস না বল কি হয়েছে
আমি: ছোটমা আমি আলিফাকে ছাড়া থাকতে পারবো না, আমি না আস্তে আস্তে ওর মায়ায় জরিয়ে যাচ্ছি।
ছোটমা: কাঁদিস না দেখিস একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে
আমি: সেই দিনের অপেক্ষায় তো বসে আছি কিন্তু আদৌ কি কিছু ঠিক হবে
ছোটমা: নিজের ভালোবাসার উপর বিশ্বাস রাখ, মনে রাখিস বিশ্বাস এমন এক জিনিস যা অনেক অসম্ভব কে সম্ভব করে দেয়।
ছোটমা ভিতরে আসবো (দরজায় তাকিয়ে দেখি রিয়ান দাঁড়িয়ে আছে)
ছোটমা: আয় অনুমতি লাগে নাকি
রিয়ান: তোমার বড় ছেলের সাথে কি কথা বলছ তা তো আর জানিনা
ছোটমা: হয়েছে পাকনামি করতে হবে না
আমি: কিছু বলবি
রিয়ান: হুম ছোটমাও এখানে আছেন তোমার থেকে একটা কথা জানতে চাই
আমি: কি
রিয়ান: গাড়িতে ভাবিকে এসব কি বলছিলে। ছেড়ে চলে যাবে যখন মায়া বাড়াচ্ছে কেন। এসব কথা কেন বলেছ ভাইয়া কিছু হয়েছে (ছোটমার মুখের দিকে তাকালাম উনি নিরবে কাঁদছেন)
ছোটমা: রিয়ান আমার সাথে চল রিফাতকে একটু একা থাকতে দে, আমি তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।
রিয়ান ছোটমার সাথে চলে গেলো। আমি নিরবে কাঁদছি আর ভাবছি নিলা থাকলে আজ এতো কিছু হতো না, কেন যে পাগলীটা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। আচ্ছা নিলার মৃত্যুর রহস্য কি আমি কখনো জানতে পারবো না…?

হঠাৎ মাথায় কারো হাতের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আলিফা আমার মাথার কাছে বসে আছে। নিলার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি। কিন্তু আলিফা হঠাৎ….
আলিফা: রিফাত সরি
আমি: কেন
আলিফা: আমার জন্য তোমার এই অবস্থা হলো
আমি: তোমার আবার কিসের দোষ
আলিফা: আমি যদি ফ্লোরে না ঘুমাতাম তাহলে তো এমন হতো না
আমি: ঠিক আছে এখন তোমার ভুলটা শুধরিয়ে নাও
আলিফা: কিভাবে
আমি: এই রুমের সোফা স্টোররুমে রেখে আসবো তাহলে দুজনেই খাটে ঘুমাতে পারবো, কারণ ফ্লোরে তো আর ঘুমাতে দিবে না নিজেও ঘুমাবে না
আলিফা: রিফাত প্লিজ পাগলামি করো না
আমি: আলিফা আ…
রিফাত আসবো (আব্বুর কন্ঠ শুনে আলিফা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো)
আমি: হ্যাঁ আব্বু এসো
আব্বু: তুই যেতে পারবি না তাই ডক্টর কে ফোন করে বাসায় এনেছি
আমি: আব্বু আমি সুস্থ হয়ে গেছি ডক্টর লাগবে না
আব্বু: একদম চুপ।
আব্বুর মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই তাই চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ডক্টর জ্বর মেপে ওষুধ দিয়ে চলে গেলো।
আব্বু: বৌমা রিফাত কে কিছু খাবার খাইয়ে ওষুধ গুলো খাইয়ে দাও তো
আলিফা: ঠিক আছে আব্বু।
আলিফা আর আব্বু চলে গেলেন।

একটু পর আলিফা খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলো। ভাবছি খাবো না বলে বায়না ধরলে তো আলিফা নিজের হাতে খাইয়ে দিবে বায়না কি ধরবো…? কিন্তু যদি না খাইয়ে দেয়, আমার তো খিদে লেগেছে।
আলিফা: রিফাত উঠো খেয়ে নাও
আমি: আমার তো হাত ব্যথা করছে
আলিফা: কেন হাতে কি হয়েছে আবার
আমি: হাহাতে হাতে (এখন কি বলি)
আলিফা: তোতলাচ্ছ কেন
আমি: না মানে
আলিফা: সোজা বললেই পারো আমার হাতে খেতে চাও
আমি: তুমি আমার মনের সব কথা বুঝ শুধু ভালোবাসি যে এইটা বুঝ না
আলিফা: তোমার মন খারাপ হউক আমি তা চাই না চুপচাপ খেয়ে নাও
আমি: হুম

আলিফা আমাকে খাইয়ে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে চলে যেতে লাগলো।
আমি: আলিফা
আলিফা: হুম আর কিছু লাগবে
আমি: লাগবে তো
আলিফা: কি
আমি: তোমার ভালোবাসা
আলিফা: ফাজলামো বাদ দিয়ে একটু ঘুমাও
আমি: ঘুম আসছে না।
আলিফা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলো তারপর আমার মাথার কাছে এসে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো, যা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
আমি: এসব শুধু দায়িত্ববোধ থেকে করছ তাই না
আলিফা: মানে
আমি: আব্বু বলে গেছেন তাই আমাকে খাইয়ে দিলে, এখন আমার ঘুম আসছে না তাই চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছ। সবকিছু শুধু দায়িত্ববোধ থেকে করছ কারণ তুমি এই বাড়ির বউ তাই না
আলিফা: এইটা না হয়ে তো অন্যকিছু হতে পারে
আমি: হ্যাঁ পারে তবে ভালোবাসা না আমি অসুস্থ
তাই সহানুভূতি দেখাচ্ছ
আলিফা: দূর থাকো তুমি একা।
রাগ দেখিয়ে চলে গেলো। ভালোবাসে এইটা বললেও সমস্যা আবার ভালোবাসে না এইটা বললেও সমস্যা। কোন পথে যে যাই আমি।

হঠাৎ কারো হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো, দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত এগারোটা বাজে। সেই বিকেলে ঘুমিয়েছিলাম কখন যে এতো রাত হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি কেউ ডাকেওনি। কিন্তু আলিফা কোথায় আমার পাশেও নেই সোফায়ও নেই, আর এতোরাতে হাসছে কে। আবার হাসির শব্দ শুনতে পেলাম, বারান্দা থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। আর কারো হাসি না আলিফার হাসি। কিন্তু এতো রাতে আলিফা বারান্দায় কি করছে। আস্তে আস্তে উঠে বারান্দায় গেলাম, আলিফা ফোনে কথা বলছে আর হাসছে নিশ্চয় রাতুল হবে। ওকে কি ডাকবো আবার যদি রেগে যায় কিন্তু ও যেভাবে হাসছে সবাই তো শুনতে পাবে তখন তো আব্বু রেগে যাবেন। এসব ভাবতে ভাবতে ওর কাধে হাত রাখলাম সাথে সাথে ও চমকে গিয়ে পিছন ফিরে তাকালো।
আলিফা: রিফাত তুমি
আমি: কার সাথে কথা বলছ (ফোনে আস্তে কি যেন বলে ফোন রেখে দিল)
আলিফা: রিফাত সবকিছুতে এতো বাড়াবাড়ি ভালো না, আমি কার সাথে কথা বলছি সেটা জেনে তুমি কি করবে আর তুমি তো জানই আমি কাকে ভালোবাসি
আমি: হুম জানি বুঝতেও পেরেছি
আলিফা: তাহলে ডিস্টার্ব করছ কেন
আমি: তোমার হাসির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেছে অন্যদেরও ঘুম ভেঙে যেতে পারে আর আব্বুর ঘুম ভাঙলে রেগে যাবেন। তাই বলতে এসেছি আস্তে কথা বলো আর যত খুশি মন খুলে হাসো
আলিফা: এভাবে কথা বলছ কেন
আমি: এতোক্ষণ তুমি যেভাবে কথা বলেছ তারপরে এরচেয়ে ভালো ভাবে কথা বলা যায় না (মাথা খুব যন্ত্রণা করছে তাই ফ্লোরেই দফ করে বসে পড়লাম)
আলিফা: রিফাত
আমি: আমাকে তোমার ধরতে হবে না আমি ঠিক আছি। অনেক সহানুভূতি দেখিয়েছ আর চাই না
আলিফা: এসব কি বলছ
আমি: প্লিজ এখান থেকে চলে যাও আমাকে একা থাকতে দাও একটু।
আলিফা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো।

বারান্দায় বসে একের পর এক সিগারেট খাচ্ছি আর আকাশের তারা দেখছি, যে তারায় আমার নিলা আছে। ভেবেছিলাম আলিফাকে ভালোবেসে এই রাত জেগে তারা দেখার অভ্যাস ছাড়তে পারবো কিন্তু আলিফাই তো অন্য কারো।

মাথা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে এলোমেলো পায়ে হেটে রুমে আসলাম। দেয়াল থেকে নিলার ছবিটা এনে বুকে জরিয়ে বারান্দায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। হঠাৎ চোখ পড়লো আলিফা বালিশ ছাড়া ঘুমিয়ে আছে। কাছে গিয়ে ওর মাথার নিচে বালিশ দিলাম, গায়ে বিছানা চাদরটা টেনে দিয়ে চলে আসতে চাইলাম আলিফা আমার হাত ধরে ফেললো।
আমি: ঘুমাও নি
আলিফা: ঘুমিয়েছিলাম ভেঙে গেছে
আমি: হুম ঘুমিয়ে পড়ো
আলিফা: তুমি ঘুমাবে না অনেক রাত হয়েছে তো
আমি: (মৃদু হাসলাম)
আলিফা: হাসছ যে
আমি: এমনি, আমার হাতটা ছাড়ো
আলিফা: হুম (হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে বসলো)
আমি: ঘুমিয়ে পড়ো গুডনাইট
আলিফা: রিফাত
আমি: কি কিছু বলবে
আলিফা: আসার সময় তো তুমি জিজ্ঞেস করছিলে মায়া বাড়াচ্ছি কেন। এখন যদি আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করি মায়া বাড়াচ্ছ কেন
আমি: উত্তরটা খুব সহজ আমি তোমাকে ভালোবাসি
আলিফা: কিন্তু….
আমি: তুমি আমাকে ভালোবাস না তাই তো…? সমস্যা নেই আমি নাহয় এভাবেই তোমাকে ভালোবেসে যাবো সবসময়
আলিফা: রিফাত তোমার হাতে কি
আমি: নিলার ছবি
আলিফা: এতো রাতে নিলার ছবি দিয়ে কি করবে
আমি: নিলা সবসময় তো আমার সঙ্গী ছিল এখনো আছে, ও কখনো আমার ভালোবাসার অমর্যাদা করেনি
আলিফা: আমি কখনো কাউকে কষ্ট দিতে চাই না কিন্তু দেখো কিভাবে যে সবকিছু উলটপালট হয়ে গেলো, নিজের অজান্তেই আমি তোমার মন ভেঙে দিলাম
আমি: মন তো আগেরই ভাঙা নতুন করে আর কি ভাঙবে (চলে আসতে চাইলাম আলিফা আবার পিছু ডাকলো)
আলিফা: রিফাত
আমি: হুম
আলিফা: (নিশ্চুপ)
আলিফাকে নিশ্চুপ দেখে ওর দিকে তাকালাম, আলিফার চোখে পানি। কাছে গিয়ে আলতো করে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বারান্দায় আসতে আসতে ভাবলাম, আলিফা তো আমাকে ভালোবাসে না তাহলে আমি কষ্ট পেলে ও কষ্ট পায় কেন…? আমি কাঁদলে আলিফাও কাঁদে কেন…? তাহলে কি আলিফা আমাকে ভালোবাসে নাকি এসব শুধুই মায়া….? প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা নেই কখনো জানতে পারবো কিনা তাও জানিনা।

বারান্দার চেয়ারে বসে বসে নিলার ছবিটা বুকে জরিয়ে ধরে আকাশের তারাটার দিকে তাকিয়ে আছি হঠাৎ কাধে কারো হাতের স্পর্শে পিছনে তাকালাম। পিছন ফিরে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, আমার সামনে নিলা দাঁড়ানো।
আমি: নিলা তুমি
নিলা: হ্যাঁ আমি, কি হয়েছে এতো কষ্ট পাচ্ছ কেন
আমি: নিলা তোমার মতো কেউ আমাকে ভালোবাসে না। আলিফা, যার মধ্যে তোমাকে খুঁজে পেয়েছিলাম সেতো অন্য কারো।
নিলা: (মৃদু হাসল)
আমি: তুমি হাসছ নিলা। জানো তোমাকে হারিয়ে আমি কতো কষ্ট পেয়েছিলাম, হঠাৎ করে যখন আলিফা আমার জীবনে আসলো তখন আমি ওকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু সবকিছু ভুল হয়ে গেলো। আমি কি নিয়ে বাঁচবো বল বার বার একি আঘাত সহ্য করা যায় নাকি…?
নিলা: তোমার পাশে কেউ নেই তো কি হয়েছে আমি তো আছি, আগে যেমন ছিলাম এখনো আছি আর সবসময় থাকবো। দেখো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিলা এসে আমার পাশে বসে আমাকে জরিয়ে ধরলো, আমিও নিলাকে জরিয়ে ধরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। নিলাকে ফিরে পেয়ে যেন সব কষ্ট ভুলে গেছি, আমি আবার আমার নিলাকে ফিরে পেয়েছি…..

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে