শেষ_পর্যন্ত পার্ট: ১

0
3495

শেষ_পর্যন্ত

পার্ট: ১

লেখিকা: সুলতানা তমা

হসপিটালে অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে আছি, আমার ভালোবাসার মানুষটা অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে শুধুমাত্র আমার ভুলের জন্য, রক্তের জন্য অপারেশন শুরু করা যাচ্ছে না, কি করবো কোথায় খুঁজবো রক্ত ওর গ্রুপের রক্ত যে সহজে পাওয়া যায় না, কিছু ভেবে পাচ্ছি না শুধু পাগলের মতো কেঁদেই যাচ্ছি….
–রিফাত কি হয়েছে ফোন করে হসপিটালে আসতে বললি আর তোর শার্টে এতো রক্ত কেন
–আব্বু আলিফা…
–হ্যাঁ আলিফা কি হয়েছে ওর কাঁদছিস কেন
–ও এক্সিডেন্ট করেছে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে ওর গ্রুপের রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না
–কান্না করিস না আমরা রক্তের ব্যবস্থা করবো, রিয়ান কোথায়
–রিয়ান রক্ত খুঁজতে গেছে কিন্তু পাচ্ছেনা ফোন করেছিল
–তুই কান্না বন্ধ কর আমি দেখছি
–আব্বু আমার আলিফা বাঁচবে তো আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না
–তুই থাম ডক্টর আসছে আমাকে কথা বলতে দে
–হুম

আব্বু: ডক্টর আমার বৌমা….
ডক্টর: রক্ত পাওয়া গেছে একজন রক্ত দিতে এসেছেন আমরা এখনি অপারেশন শুরু করবো
আব্বু: কে রক্ত দিল
ডক্টর: উনি বলেছেন পরে আপনাদের সাথে আলাপ করবেন, অপারেশনটা খুব রিস্কি আল্লাহ্‌ কে ডাকুন

–রিফাত কান্না থামা আল্লাহ্‌ কে ডাক
–আব্বু আমার সাথেই কেন বার বার এমন হচ্ছে আর আলিফার এক্সিডেন্ট কি আজকের দিনেই হতে হলো
–ভাগ্য বলে মেনে নে কান্না করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে
ভাগ্য ভেবে সবকিছু মেনে নেওয়া কি সম্ভব, ওইদিকে আলিফা মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে আমি এখানে কিভাবে শান্ত হয়ে বসে থাকবো, মাথাটা প্রচুর যন্ত্রণা করছে চোখ দুটু বন্ধ করে ভাবছি সেই দিন গুলোর কথা….

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগের কথা সেদিনও আমার জন্মদিন ছিল আর প্রতিবারের মতো সেদিনও এতিমখানায় বাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল….
রিয়ান: ভাইয়া তোমার হলো এতিমখানায় যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে তো
আমি: হ্যাঁ এইতো শেষ সব গুছিয়ে নিয়েছিস তো
রিয়ান: হ্যাঁ আব্বু আর ড্রাইভার মিলে সব খাবার গাড়িতে তুলে দিয়েছেন
আমি: আব্বু কোথায়
রিয়ান: গাড়ির পাশেই
আমি: চল
রিয়ান: আব্বু গেলাম
আব্বু: আজ খুব দেরি হয়ে গেল অনেক দূর যেতে হবে….
আমি: আব্বু আমি ওখানে নতুন যাচ্ছি না তুমি অযতা টেনশন করো না
আব্বু: ওকে সাবধানে যাস আর যতো তাড়াতাড়ি পারিস ফিরে আসিস
আমি: ওকে আব্বু টাটা

রিয়ান: ভাইয়া আমি আজ ড্রাইভ করি তুমি পাশে বসে গল্প শুনাও
আমি: কিসের গল্প
রিয়ান: তাই তো কিসের গল্প আমি তো ভুলেই যাই তুমি যে পাল্টে গেছ এসব যে এখন আর পারো না
আমি: কি বলতে চাইছিস
রিয়ান: বলতে চাইছি আর কতো দিন এভাবে কাটাবা এখন অন্তত বিয়ে করো নাহলে অন্য কোনো উপায়ে আমাকে বাঁচাও
আমি: মানে
রিয়ান: আব্বুর নাকি ঘরে বৌমা চাই তুমি তো বিয়ে করবা না তাই আমাকে এখন বিয়ে করতে হবে আমি পারবো না এখন আর তোমার আগে তো একদমই না
–বিয়ে আমার আর এই জীবনে হয়তো করা হবে না তুই রাজি হয়ে যা তাতে যদি আব্বু একটু শান্তি পান
–ভাইয়া তু….
–চুপ কর প্লিজ ভালো লাগছে না
–সরি ভাইয়া তোমাকে বিয়ে শব্দটা বলে কষ্ট দিয়ে ফেললাম
রিয়ান এর কথার আর কোনো উত্তর দিলাম না, রিয়ান ড্রাইভ করছে আর আমি নিশ্চুপ হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি…..
আমি রিফাত, আব্বু ছোট ভাই রিয়ান আর ছোট বোন প্রিতি এই আমাদের ছোট্র সংসার, খুব ছোটবেলায় আম্মুকে হারিয়ে ছিলাম কিন্তু আব্বু আমাদের তিন ভাই বোনকে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেননি, আব্বু এক হাতে এতো বড় ব্যবসা সামলিয়েছেন আর এক হাতে আমাদের তিন জনকে বাবা মা দুজনের আদর দিয়ে বড় করেছেন, মাঝে মাঝে আম্মুকে খুব মিসস করি কিন্তু আব্বুর ভালোবাসা আম্মুর অভাবটা আমাদের বুঝতে দেয় না
–ভাইয়া (হঠাৎ রিয়ানের ডাকে চারদিকে তাকালাম আমরা এতিমখানায় চলে এসেছি)
–ভাইয়া তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন শরীর খারাপ নাকি
–না এমনি তুই খাবার গুলো নিয়ে যা আমি আসছি
–আবার কোথায় যাচ্ছ
–আসছি

এতিমখানার চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগলাম এই এতিমখানায় আগে আম্মুর সাথে আসতাম, আম্মু এখানেই বড় হয়েছেন, এখনো আসি তবে সবসময় না শুধু আমার প্রতি জন্মদিনে
–ওই অন্ধ নাকি চোখে দেখেন না (হঠাৎ কারো ধমকে ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো, সামনে তাকিয়ে দেখি একটি মেয়ে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে, এই চোখ আমার খুব চেনা কিন্তু দুইটি মানুষের এক রকম চোখ একি রকম রাগ কিভাবে সম্ভ….)
–কি হল কথা বলছেন না কেন
–কি করলাম আমি
–আরে আপনি তো দেখছি সত্যি একটা কানা মানুষ
–মানে
–নিচে তাকিয়ে দেখুন আপনি আমার বিড়ালটা কে লাতি মেরেছেন (নিচে তাকিয়ে দেখলাম সত্যি একটা ভিজা বিড়াল, আনমনে হয়ে হাটতে গিয়ে ঘাসের উপর বিড়ালটা যে ছিল লক্ষ্য করিনি)
–ভিড়ালটা এমনি ভিজে গেছে আমি ওকে এখানে রেখে তোয়ালে আনতে গেছি আর আপনি….
–আমার কথা শুনোন আমি দেখিনি
–দেখবেন কিভাবে আপনি তো একটা কানা মানুষ
–আরে শু….
যাক বাবা আমার কোনো কথাই শুনলো না চলে গেলো, এই মেয়েরও বিড়ালের জন্য এতো আদর একদম নিল….
–ভাইয়া তুমি এখানে আমি তোমাকে….
–কি হল আমার দিকে এমন হা করে তাকিয়ে আছিস কেন
–ভাইয়া তুমি হাসছ (রিয়ান এসে আমাকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো, আমি বোকার মতো দাড়িয়ে ভাবছি হ্যাঁ আমি তো সত্যি এই মেয়েকে দেখে নিজের অজান্তেই হাসছি)
–ভাইয়া তিনটা বছর ধরে তোমার মুখে হাসি দেখি না আব্বু আমি প্রিতি কতো চেষ্টা করেছি তোমার মুখে একটু হাসি ফুটানোর জন্য কিন্তু সবসময় ব্যর্থ হয়েছি
–বাদ দে না রিয়ান
–না ভাইয়া তুমি বল তুমি কাকে দেখে কি দেখে হাসছ আমি তোমাকে সেটাই এনে দিব
–ঠিক আছে আবার তাকে দেখলে তোকে দেখাবো
–হুম চলো এখন

গাড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছি আর মনে মনে মেয়েটিকে খুঁজছি কিন্তু কোথায় চলে গেলো হঠাৎ করে
–ভাইয়া এখানের সব কাজ শেষ চলো বাসায়….
–হুম কিছু বলছিলি
–তুমি কি কাউকে খুঁজছ
–না তো
–একদম মিথ্যে বলবা না তুমি অন্যমনস্ক হয়ে ছিলে তাই আমি বাসায় যাওয়ার কথা যে বলেছি তুমি শুননি বল কাকে খুঁজছিলে
–একটি মেয়ে
–সত্যি
–হুম কিন্তু হঠাৎ করে কোথায় যে হারিয়ে গেলো
–চলো খুঁজে দেখি
–না থাক আব্বু টেনশন করছেন বাসায় যেতে হবে পরে নাহয় আবার আসবো
–ঠিক আছে

চোখ দুইটা বন্ধ করে গাড়িতে বসে আছি বার বার মেয়েটির রাগি চোখ দুটু মনে পড়ছে, কিছুতেই বুঝতে পারছি না দুইটা মানুষের একরকম চোখ একরকম রাগ কথা বলার ধরণ একরকম হয় কিভাবে
–রিয়ান
–হ্যাঁ ভাইয়া বলো
–জানিস এই মেয়েটি একদম নিলার মতো
–মানে
–সেই রাগি চোখ রাগে চেঁচিয়ে কথা বলা সব একরকম
–সবসময় নিলার কথা ভাব তো তাই হয়….
–না তুই যখন দেখবি তখন তুইও বলবি ও নিলার মতো
–হুম আগে বাসায় যাই এসব চিন্তা এখন বাদ দাও
–হুম

বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো, এসে দেখি আব্বু আর প্রিতি খাবার টেবিলে বসে অপেক্ষা করছেন
রিয়ান: আব্বু তোমরা খেয়ে ঘুমাওনি কেন
আব্বু: তোদের রেখে কখনো খেয়েছি যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়
আমি: ঠিক আছে

খাবার টেবিলে বসেও মেয়েটির কথা শুধু মনে পড়ছে মাথায় ঢুকছে না চেহারা অন্যরকম হলেও রাগ কথা বলা সবকিছু দুটি মানুষের মধ্যে একরকম হয় কিভাবে
আব্বু: কিরে রিফাত খাচ্ছিস না কেন
রিয়ান: আব্বু তোমাদের একটা কথা বলা হয়নি
আব্বু: কি
রিয়ান: জানো আজ ভাইয়াকে তিনবছর পর হাসতে দেখেছি
প্রিতি: ভাইয়া সত্যি
রিয়ান: হ্যাঁ আর ভাইয়া একটি মেয়েকে দেখে….
আমি: রিয়ান থামবি
আব্বু: রিফাত আমার কাছে বলতে অসুবিধা কোথায় বল মেয়েটি কে আমি ওকে এনে দিব
আমি: জানিনা আব্বু তবে মেয়েটির মধ্যে আমি নিলাকে খুঁজে পেয়েছি
প্রিতি: আবার নিলা
আমি: আব্বু যদি সত্যিই আমাকে হাসতে দেখতে চাও তাহলে এই মেয়েটিকে এনে দাও যেভাবে পারো
আব্বু: তুই চিন্তা করিস না আমি কালই এতিমখানায় যাবো
রিয়ান: ভাইয়া না খেয়ে চলে যাচ্ছিস কেন
প্রিতি: ঘড়ির কাটায় বারোটা বেজে গেছে
আব্বু: কবে যে ওর এই অভ্যাস পাল্টাবে

কারো কোনো কথার জবাব না দিয়ে সোজা বারান্দায় চলে আসলাম, একের পর এক সিগারেট খেয়ে যাচ্ছি আর দূর আকাশের সেই তারাটির দিকে তাকিয়ে আছি, আমি যেমন প্রতিদিন রাত বারোটায় এই তারাটি দেখতে আসি তেমনি এই তারাটিও আমাকে দেখার জন্য রোজ রাতে অপেক্ষা করে, শুধু অমাবস্যার রাতে ও আসে না বড্ড অভিমানী তো তাই সে অমাবস্যা রাতে আমার উপর খুব অভিমান করে, এই তারাটি আর কেউ না আমার নিলা, আমার উপর অভিমান করে ও আকাশের তারা হয়ে গেছে, আজ নিলাকে বড্ড মিসস করছি কারণ আজ যে আমি সেই মেয়েটির মধ্যে নিলাকে খুঁজে পেয়েছি, আর পারছি না খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তাই আজ আর চোখ দুটু কে বাধা দিলাম না একের পর এক সিগারেট খাচ্ছি আর চোখ দুটু সেই তারার দিকে তাকিয়ে অবাধ্যের মতো কেঁদে যাচ্ছে…..

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে