#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৪
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
‘আমার কথা ভেবে লজ্জা পাচ্ছিলেন বুঝি তুলতুলের আম্মু!’
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ধ্রুবর গাঢ় কন্ঠস্বর শুনেই আমি চমকে গেলাম। অপ্রস্তুত হয়ে বললাম- ‘আপনি?’
‘নাম্বার না দেখেই কি কল রিসিভ করেন সবসময়?’
ধ্রুবর কাঠকাঠ গলায় পালটা প্রশ্নে আমি খানিকক্ষণ নিশ্চুপ রইলাম। ক্ষীণ স্বরে বললাম-
‘আসলে খেয়াল করিনি। হঠাৎ করে কল দিলেন কোনো দরকার ছিল?
ধ্রুব ভারী হয়ে আসা কন্ঠে বললেন-
‘অদ্ভুত তো! আপনি সব কিছুতেই দরকার খুঁজে বেড়ান কেন? কারণ ছাড়া কি আপনাকে কল দেওয়া যাবে না! যাইহোক আপাতত আপনার সাথে প্রেম করাই আমার অতি দরকারী বিষয়। আপনার সাথে প্রেম করার চেয়ে দরকারী কিছু আমার কাছে আর নেই। বুঝেছেন আমার কথা!’
ধ্রুব শেষে কথাটা হাল্কা ধমকের স্বরেই জিজ্ঞেস করলেন। আমি ঘোরলাগা কন্ঠে ছোট করে ‘হুমম’ বললাম। ধ্রুব আবারও গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-
‘বলেছিলাম তো আপনাকে ফোনটা দিয়েছি আমার প্রয়োজনে। রাতবিরেতে আমার যখন ইচ্ছে হবে আমি তখনই কল দিবো। আর ফোন বন্ধ পেলে বা রিসিভ না হলে ডিরেক্টর আপনাদের বাসায় চলে আসবো মনে থাকে যেন। আর হ্যাঁ আমার কথা শুনে আমাকে বখাটে মনে হলে হবে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। নিজের বউয়ের কাছে শুধু বখাটে কেন নির্লজ্জ, অসভ্য, বেহায়া সব কিছুই হওয়া যায়। যাইহোক এখন রাখছি। গাড়ি ড্রাইভ করছি। বাসায় পৌঁছে কল দিবো।’
ধ্রুব আমাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই কল কেটে দিলেন। আর আমি হতভম্ব হয়ে ফোন কানের কাছে ধরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। মুহুর্তেই হতচকিত ভাব কাটয়ে লজ্জায় লাল রাঙা হলাম। মানুষটার কন্ঠ শুনলেই এখন কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। তার কথা ভাবতেই ভীষণ লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে। কি ভয়ংকর পরিস্থিতি। ভয়াবহ অনুভূতি।
‘অনু তোর কি হয়েছে বল তো!’
সানির আক্রোশ ভরা কন্ঠস্বরে আমার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে এলো। চোখ ছোট ছোট করে সানির মুখের দিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলাম-
‘আমার আবার কি হবে?’
আমার প্রশ্নে সানির মুখে বিরক্তির রেশ দেখা গেল। ভ্রু জোড়ার সংযোগস্থলে সুতীক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো। বড় বড় চোখদুটোতে সন্দেহ ফুটে তুলে অত্যন্ত অধৈর্য্য হয়ে বলল-
‘কিছুদিন ধরে তুই সব সময় কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকিস। কিছু জিজ্ঞেস করলেই মুচকি হেসে উত্তর দিচ্ছিস। বিনাকারণেই লজ্জা পাচ্ছিস। খুবই অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যবহার করছিস। আগে তো কখনো এমন ব্যবহার করিস নি। তোর মাঝে আমি কেমন যেন প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি। তুই কি প্রেমে ট্রেমে পরলি না-কি অনু? দুলাভাইয়ের প্রেমে পরেছিস? কিন্তু কবে! কখন? কীভাবে?’
সানির প্রশ্নগুলো তীরের মতো এসে হানা দিলো আমার মনে। প্রতিটি কথা গেঁথে গেল মনের কোণে। প্রেমের কথা শুনেই ক্ষীণ লজ্জার উপস্থিতি টের পেলাম। তবুও নিজেকে যথাসাধ্য সামলে নিলাম। কৃত্রিম রাগ নিয়ে চটপটিয়ে বললাম-
‘চুপ থাকতো সানি। ফালতু কথা বলিস না৷ চুপচাপ আমার সাথে বসে থাকতে চাইলে বস না হলে চলে না।’
আমার রাগ প্রকাশে সানির তেমন কোনো হেলদোল হলো না৷ সে এখনও কৌতুহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো৷ আগ্রহ নিয়ে আবারও কিছু বলতে চাইলেই আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম। সানি হতাশ হয়ে গাল ফুলিয়ে ফেলে৷ আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকলো। আমি ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেললাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম সানির বলা কথা গুলো। আমি কথায় কথায় লজ্জা পাচ্ছি! মুচকি হেসে উত্তর দিচ্ছি? প্রেমে পরেছি? আসলেই কি তাই! কেউ কি তার স্বামীর প্রেমে পরে? আমি কি ধ্রুবর প্রেমে পরেছি? জানা নেই। তবে আমি জানি আমি যখন তখন বেখেয়ালি হয়ে যাচ্ছি। ধ্রুবর স্পর্শে এখন থমকে না গিয়ে কেঁপে উঠছি। তার কথা ভেবেই একা একা লজ্জাবোধে নিজেকে আড়াল করে নিতে চাচ্ছি। তাকে দেখলেই আমার দৃষ্টি থমকে যাচ্ছে। রাত-বিরেতে ধ্রুবর ফোন কল পাওয়া। যখন তখন বাসার নিচে এসে দেখা করা। কিছু অযুক্তিক কারণ দেখিয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেওয়া। এসব কিছুতেই নিজেকে এক কিশোরী মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। নতুন নতুন প্রেমে পড়া এক কিশোরী মেয়ে। যে কি-না বিনাকারণেই হাসবে। একা একাই লজ্জায় লাল হবে। প্রেমিক পুরুষের স্পর্শে ভয়ংকরভেবে কেঁপে উঠবে তার শরীর আর মন দুটোই। আবেগি হবে কিছু ভালোবাসাময় কথা শুনেই। যার মস্তিষ্কটা জুরে থাকবে শুধু একজন প্রেমিক পুরুষেরই বিচরণ। আর সেই প্রেমিক পুরুষ হলেন ধ্রুব৷ নাছোড়বান্দা বীর প্রেমিক পুরুষ।
‘কেমন আছো অনন্যা?’
হঠাৎই পাশ থেকে চিরচেনা কন্ঠস্বর শুনে আমি স্তম্ভিত ফিরে পেলাম। মাথা উঁচু করে পাশে তাকাতেই ভীষণ পরিচিত এক মুখ চোখের সামনে আটকে গেল। উদাসীন তার চাহনি। চোখ দুটো ডেবে গেছে ভীষণ অযত্নে। সব সময় হাস্যজ্বল থাকা মুখখানার বিভৎস অবস্থা। গাল ভর্তি অবহেলায়, অযত্নে বেড়ে ওঠা দাঁড়ি। ঠোঁটে কালচে পোড়ার দাগ। কতশত সিগারেটের উত্তপ্ত ছোয়া পেয়েছে এই ঠোঁট তার হয়তো নির্দিষ্ট হিসেব নেই। শরীরের কি বাজে বিধ্বস্ত অবস্থা। এসবটা কি আমার জন্যই হয়েছে! আমার চোখাচোখি হতেই তার কালচে পোড়া ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে মলিন হাসি দিলো। আমি যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়ালাম। আমার পাশাপাশি সানিও দারুণ চমকিত ভাব নিয়ে তাকায় সাদাফের দিকে। আমি প্রত্যুত্তর করলাম না৷ নিরুত্তর চোখে তাকিয়ে রইলাম সাদাফের দিকে। সাদাফ মৃদু হেসে ম্লানমুখে বলল-
‘আমি কি তোমার সাথে একটু একা কথা বলতে পারি অনন্যা?’
আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। নিজেকে সহজ করে সানির দিকে চেয়ে ভারী কন্ঠে বললাম-
‘সানি তুই চলে যা। তোর দুলাভাই হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে আমি ওনার সাথেই বাসায় চলে যাবো।’
সানি অবাক চোখেই সাদাফের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার কথা শোনা মাত্রই মাথা নাড়িয়ে নিঃশব্দে চলে গেল। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রাস্তার দিকে চাইলাম। ধ্রুবর এতক্ষণে এসে পরার কথা ছিল। কিন্তু এখনও আসছে না কেন? যদি এখানে এসে আমাকে সাদাফের সাথে দেখে তাহলে কি আমাকে ভুল বুঝবে! হুহ্ কখনোই না। উনি আমাকে আগেও বিশ্বাস করেছেন আর সারাজীবন বিশ্বাস করবেন। এটা আমি জানি। উনি কখনই আমাকে ভুল বুঝবেন না।
‘আমি এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি৷ তাই শেষ বারের মতো তোমায় দেখতে আসলাম। আশাকরি বিরক্ত হলেও আজ অন্তত মুখ ফিরিয়ে নিবে না। সব সময়ের মতোই আমাকে সহ্য করবে।’
আমি নিশ্চুপ তবে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম সাদাফের দিকে। ক্ষীণ স্বরে থেমে থেমে প্রশ্ন করলাম-
‘দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছো মানে কি? কোথায় যাচ্ছো?’
সাদাফ হাসার চেষ্টা করে বলল- ‘কানাডা আব্বুর কাছে চলে যাচ্ছি। সাথে আম্মুকেও নিয়ে যাবো। সেখানেই আব্বুর বিজনেসে একটু মন দিবো। সব কিছুই রেডি হয়ে গেছে। হাতে বেশি একটা সময় নেই। কাল রাতেই ফ্লাইট৷ জানি না আবার কখনও কোনো পিছুটানে এই দেশে ছুটে আসবো কি-না।’
‘কিন্তু হঠাৎ করেই এই সিদ্ধান্ত কেন? তুমি তো কখনই এই দেশে ছেড়ে তোমার আব্বুর কাছে যেতে চাওনি।’
আমি সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন গুলো করেই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম তার জবাবের আশায়। সাদাফ আম বাগানের অদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। ঠোঁট প্রসারিত করে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলল-
‘আগে এই দেশটা খুব সুন্দর স্নিগ্ধ লাগতো। সবুজ গাছপালা, নীল আকাশ, রাস্তার চারপাশের কোলাহল সব কিছুতেই মুগ্ধতা খুঁজে পেতাম। কারণ তখন আমার মনে তোমার বসবাস ছিল। আমার পাশে তোমার অস্তিত্ব ছিল তাই। আমি প্রকৃতি প্রেমি বাউন্ডুলে ছেলে। সারাদেশ ঘুরেও তোমার কাছে ফেরে এসেছি। এত ভালোবেসেছি এই প্রকৃতিকে। আর সেই প্রকৃতিই কি-না তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এখন আমার কাছে বিষাক্ত মনে হচ্ছে। মস্ত বড় ভুল মনে হচ্ছে। জানো তো, তুমিহীনা এই শহর বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু বিষাদ আর বিষাদ। শহরের প্রতিটি অলিগলিতে শুধুই তোমার স্মৃতি ভেসে ওঠে। নীল আকাশ এখন শুধুই আমার দীর্ঘ শ্বাসের সাথী। এখন আর ভালো লাগে না এই আকাশ৷ তুমি ছাড়া একলা আমি এখানে কি করে থাকি বলো তো অনুপাখি! আমার দম আটকে আসে। ভীষণ কষ্ট হয়। বদ্ধ ঘরেও যেন তোমার স্মৃতিরা এসে আমাকে আঁকড়ে ধরে। তোমার প্রতি অবহেলা করার অপরাধে আমি নিজের কাছেই অপরাধী। এত এত বোঝা নিয়ে আমি থাকবো কীভাবে?’
আমি আহত দৃষ্টিতে দেখলাম সাদাফের টলমলে চোখ দুটো। সব সময় যে চোখদুটোতে মুগ্ধতা ছেয়ে থাকতো আজ সেই চোখে শুধুই বিষাদ। ঠোঁটের হাসিও যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে মিহি কন্ঠে বললাম-
‘নিজেকে দোষী ভেবো না সাদাফ। এটাই আমাদের ভাগ্যে ছিল তাই অতীত ভুলে যাও। নতুন করে সব কিছু শুরু করো। মুভ অন করো।’
সাদাফ আক্রোশ ভরা কন্ঠে বলল- ‘সব কিছু কি এতটাই সহজ যতটা সহজ ভাবে তুমি বলছো? একটি বারের জন্য কি আমাকে রেখে দাওয়া যায়নি অনন্যা? ভালো না-ই বা বাসতে ঘৃণা নিয়েই না হয় সারাজীবন আমার সাথে থাকতে। কিভাবে আমি নিজেকে সামলাবো? তুমি ছাড়া সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার একটা কারণ কি তুমি আমায় দেখাতে পারো?’
আমি খানিকক্ষণ নিশ্চুপ রইলাম। দৃষ্টি তুলে আবারও সাদাফের দিকে চেয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম-
‘কারও জন্য জীবন থেমে থাকে না সাদাফ৷ তুমিও বাঁচবে আর আমিও বাঁচবো৷ ভিন্ন কোনো উপন্যাসের পাতায়৷ ভিন্ন কোনো গল্পের চরিত্র হয়ে। আমি চাইনা তুমি অতীত আঁকড়ে ধরে পিছিয়ে থাকো৷ এতে আমি নিজেকে অপরাধী মনে করবো। তুমি যদি নিজের জীবন এভাবেই নষ্ট করে আমাকে অপরাধী বানাতে চাও তাহলে তুমি তা-ই করো। আর যদি আমার কথা ভেবে হলেও নিজেকে গুছিয়ে নাও তাহলে আমি কৃতজ্ঞ।’
সাদাফ আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিতে রইলো। অতি সন্তপর্ণে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সে।
‘মাম্মা.. মাম্মা!’
আচমকাই তুলতুলের ডাকে আমি চমকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালাম৷ ধ্রুব তুলতুলকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার হাতে অনেকগুলো রঙিন বেলুন। তুলতুল ছটফট করছে ওনার কোল থেকে নেমে আমার কাছে আসার জন্য। আমি অপলক দৃষ্টিতে ধ্রুবর গাম্ভীর্যপূর্ণ চোখের দিকে চেয়ে রইলাম। ভীষণ গম্ভীর লাগছে তাকে। সাদাফকে দেখে কি রেগে যাচ্ছেন তিনি!
চলবে…
#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৫
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
ধ্রুব খুব আশ্চর্যজনক ভাবে নিজের গাম্ভীর্যতা লুকিয়ে ফেললেন। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে সরল হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। আমার সামনে আসা মাত্র তুলতুল আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা করলো না। ধ্রুবর কাছ থেকে লাফিয়ে এসে পরলো আমার কোলে। আমি তৃপ্তির হাসি দিলাম। মেয়েটা কত সুন্দর ভাবেই না আমার সারা মুখে আদরের ছোঁয়া দিয়ে দিচ্ছে। কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটা বেশ বড় হয়ে গেছে। যদিও এই বিশ দিনে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে তুলতুলের সঙ্গে। তবে আজ ভিন্ন লাগছে। চুল গুলো বড় হয়েছে বোধহয়। খুব নিখুঁত ভাবে তার বড় বড় চুল গুলোতে সিঁথি কেটে দু’টো ঝুটি করা হয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম এই নিখুঁত কাজ আর কারও নয় ধ্রুবর। ঘন্টা খানেক সময় লাগিয়ে হলেও সে খুব নিখুঁতভাবেই তুলতুলের চুল বাধার কাজ সম্পূর্ণ করেন। খুব উৎসাহ নিয়েই এই কাজ করেন। বিয়ের পর থেকে এমনটাই দেখেছি। একবার না পারলে বার বার চেষ্টা করেন। আর তুলতুলও লক্ষী মেয়ের মতো চুপচাপ বসে থাকে। একটু বিরক্তি প্রকাশও করে না।
‘কেমন আছো সাদাফ?’
ধ্রুবর কন্ঠস্বর শুনে আমার দৃষ্টি সেদিকে দিলাম। দেখলাম ধ্রুব সাদাফকে জড়িয়ে ধরে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছেন। সাদাফের মুখেও হাসি তবে সেটা অপ্রস্তুত কৃত্রিম হাসি। ওনারা একে অপরের হালচাল জিজ্ঞেস করে পাশের বেঞ্চিতে বসলেন। আমিও তুলতুলকে কোলে নিয়ে সামনের বেঞ্চিতে বসলাম। দূর থেকেই সংকোচিত মনে ধ্রুবকে লক্ষ্য করতে লাগলাম৷ তার কথা বলার ধরনে সুখী সুখী ভাব। মুখটাও বেশ হাসি হাসি। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি তার স্ত্রী’র প্রাক্তনের সঙ্গে কথা বলছেন। খুব কাছের বন্ধুর সাথে অনেক দিন পর দেখা হলে যতটা আন্তরিকতা প্রকাশ করা প্রয়োজন ঠিক ততটাই তাদের মাঝে দেখা যাচ্ছে। সাদাফ নিজেও এখন সহজ হয়ে এসেছে। কোনো জড়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কথা বলার মাঝেমধ্যেই তুলতুলের তীব্র চিৎকারে বিস্ময় নিয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আবারও চোখে ফিরিয়ে নিচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই।
‘তা কি করছো এখন? কোথাও কি ট্যুরে গিয়েছিলে এই কিছুদিনের মধ্যে?’
ধ্রুবর এই সহজ প্রশ্নেও সাদাফের মাঝে বিষন্ন ভাব এসে পরলো। মাটির দিকে চেয়ে ম্লানমুখে বলল-
‘নাহ ট্যুরে এখন আর যাওয়া হয় না। ঠিক করেছি কানাডা একেবারে সেটেল্ড হয়ে যাবো। কাল রাতেই ফ্লাইট। দেখি সেখানে আব্বুর কোনো কাজে আসতে পারি কি-না।’
সাদাফের জবাবে ধ্রুব কিছুটা সময় চুপ করে রইলো। ভ্রু কুচকে ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘আমার জানা মতে ধরাবাঁধা নির্দিষ্ট নিয়মে চলা এমন জীবন তোমার পছন্দ না। তাহলে হঠাৎ করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?’
সাদাফ আড়চোখে আমার দিকে একঝলক তাকালো। তার এই তাকানোর মাঝে ছিল আমার প্রতি অভিযোগ কিংবা তীব্র অভিমান। সাদাফ অদূরে দৃষ্টি দিয়ে আক্রোশ ভরা কন্ঠে বলল-
‘সব সময় পছন্দ অপছন্দ এক থাকে না। পরিস্থিতির সাথে সাথে পছন্দের জিনিসও একটা সময় অসহনীয় হয়ে ওঠে। পছন্দের না হলেও কিছু সিদ্ধান্ত পরিস্থিতির কারণে নিতে হয়।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। খেয়াল করলাম ধ্রুব আমার দিকেই নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছেন। শান্ত শীতল তার চাহনি। মুখের হাসিটা এখন আর নেই৷ হয়তো সাদাফের চলে যাওয়ার কথায় কিছুটা অবাক হয়েছেন। হয়তোবা আমার ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছেন। ধ্রুব আমার দিকে চেয়েই গাঢ় স্বরে বললেন-
‘আমি সোজাসাপ্টা কথা বলার মানুষ। ঘুরিয়ে পেচিয়ে আমি কথা বলতে পারি না। তাই যা বলার কোনো প্রকার বিনীতা ছাড়াই বলবো। হয়তো আমার কথায় বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে কিছু কথা বলা প্রয়োজন বলেই আমি বলতে চাচ্ছি।’
সাদাফ হাল্কা করে মাথা নাড়লো। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি ধ্রুবর দিকে৷ উনি ঠিক কি বলতে চাচ্ছেন তা-ই বোঝার চেষ্টা করছি। ধ্রুব আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সাদাফের দিকে স্থির করলেন। অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-
‘আমি তোমার অতীত সম্পর্কে সবটাই জানি। হয়তো আমি তোমাকে তোমার অতীত আর অনন্য কোনোটা-ই ফিরিয়ে দিতে পারবো না। তবে আমি চাইনা তোমাদের মনে একে অপরের প্রতি তিক্ততা থাকুক। কোনো না কোনো কারণে বিচ্ছেদ যেহেতু হয়েছে সেটা মেনে নিয়েই তোমরা নতুন ভাবে জীবন শুরু করো সেটাই আমি চাই। তুমি আমার ফ্রেন্ড। অল্প দিনের হলেও আমার খুব কাছের ফ্রেন্ড। আমার চোখের সামনে তুমি ভেঙে পরবে সেটা আমি দেখতে পারবো না। আশাকরি তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো।’
‘এসব বলা খুব সহজ তাই না! তবে মেনে নেওয়া কি এতটা-ই সহজ? কাউকে এতটা ভালোবাসার পর তাকে ভুলে যাওয়া কি সত্যিই সম্ভব? তুমি কি বুঝবে আমার যন্ত্রণা ধ্রুব! হয়তো বুঝবে না। কারণ আমার জায়গায় তো তুমি নও। বিচ্ছেদের তীব্র কষ্ট। অবাঞ্ছিত কিছু যন্ত্রণা দিন দিন ঘুনে পোকার আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। এসব কি বুঝবে তুমি?’
ধ্রুব নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলো সাদাফের দিকে। নিরুত্তর তার দৃষ্টি। আমি চুপচাপ বসে তাদের কথা শুনছি। তাদের কথার মাঝে কথা বলার কোনো প্রয়োজন বোধ মনে হলো না বলেই আমি নিশ্চুপ। তুলতুল বেলুন নিয়ে খেলছে। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। সব সময়ের মতো আজ সেই পে পু শব্দ করা জুতো পায়ে নেই। ভালোই হয়েছে আজ সেই জুতো না পরায়। জুতোর তীক্ষ্ণ পে পু শব্দে হয়তো তাদের কথার মাঝে ব্যাঘাত ঘটাতো। অবশ্য এই পর্যন্ত দু বার বেলুন ফুটিয়ে তুলতুল আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তবে এতে তুলতুলের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। সে নিজের মতোই খিলখিল করে হাসছে। প্রাণোচ্ছল হাসি।
‘আমি বুঝতে পারি অনন্যর তীব্র যন্ত্রণা কেমন ছিল। তার চোখে দেখেই আমি সবটা বুঝে ফেলি। কিছুদিন পর পর তোমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করায় প্রতিবারই বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় ছটফট করেছে সে। তার চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক ছিল তাকে অপেক্ষায় রেখে বন্ধুদের সাথে তোমার আনন্দে থাকার মুহূর্ত গুলো ভাবা। প্রতিবার তার অনুভূতি, অপেক্ষা, অভিমান সব কিছুকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে তোমার চলে যাওয়া। তীব্র যন্ত্রণাদায়ক ছিল। নির্ঘুম রাত ছিল তার সাক্ষী। তুমি কি খেয়াল করে দেখো নি তোমার ভালোবাসার মানুষের চোখ দুটো! বিষন্নতায় আঁধার হয়ে যাওয়া তার মুখখানা দেখে তোমার বুকে ব্যাথা হয়নি?’
সাদাফ প্রত্যুত্তর করলো না। মূর্তি ন্যায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। এতগুলো বছর এই প্রশ্নগুলো করতে চেয়েও আমি সাদাফকে করতে পারিনি। হয়তো তার কাছে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই। এইজন্যই হয়তো দৃষ্টি নামিয়ে চুপ করে বসে আছে। ধ্রুব আমার নির্লিপ্ত চোখের দিকে চেয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। তার দৃষ্টি স্থির রেখেই অতি নরম গলায় বললেন-
‘আমি খেয়াল করেছি সবটাই। তার বিষাদগ্রস্ত মুখ, তার উদাসীন দৃষ্টি, গাঢ়তর কালি পড়া ক্লান্ত চোখ সবটাই খেয়াল করেছি। হঠাৎ হেসে সেই হাসি আবার মিলিয়ে যাওয়ায় আমার বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথাও অনুভব করেছি। আমি জানি না তুমি কিভাবে অনন্যকে উপেক্ষা করেছো বা করতে পেরেছো। তবে আমি পারিনি। অনন্যকে দেখার পর আমার আর অন্য কোনো কিছুর প্রতিই মায়া কাজ করেনি। এই মেয়েটাকে ভালোবাসার পর আর কোনো কিছুকেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনি। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনি। ট্যুরে যেতে ইচ্ছে করেনি। এই মেয়েটার মাঝেই আমি আমার সারা পৃথিবীর মুগ্ধতা খুঁজে পেয়েছি। ওকে ভালোবাসার পর পাহাড় পর্বত, সমুদ্র, আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি সব কিছুই অনন্যর সামনে তুচ্ছ মনে হয়। ওর চোখের দিকে তাকালেই বিশাল এক সাগর দেখতে পাই। নীল আকাশ দেখতে পাই। ওর চোখদুটো দেখে আমি পারিনি বেশিক্ষণ নিজের বেপরোয়া স্বভাবটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে। প্রকৃতিকে ভালোবেসে সব সময়ের মতো উড়নচণ্ডী হয়ে থাকতে পারিনি। তুমি পেরেছো তবে আমি পারিনি। হয়তো এই দিক দিয়ে তুমি আমাকে ব্যর্থ ভাবতে পারো। আমি একদিনও ওকে ছাড়া থাকতে পারছি না। এতেই আমার ঘুম উড়ে যাচ্ছে। অল্প কিছুদিনের দূরত্বেই ভালোবাসার তীব্রতা অনুভব করতে পারছি। এই মেয়েকে ছাড়া একমুহূর্তে ভালো থাকা আমার জন্য অসম্ভব। তুমি কি বুঝতে পারছো ভালোবাসার পার্থক্যটা! তোমার উচিত নিজের ভুল গুলো শুধরে নেওয়া। পরের বার কাউকে ভালোবাসলে তার মাঝেই নিজের পৃথিবী খোঁজার চেষ্টা করা। যদি নিজের আনন্দ, উল্লাস, মুগ্ধতা সব কিছু কারও মাঝে খুঁজে পাও তখন বুঝবে তোমার ভালোবাসার প্রখরতা।’
আমি মুগ্ধ হলাম। ধ্রুবর প্রতিটি কথায় আমি আবারও নতুন করে ভালোবাসার মানে খুঁজে পেলাম। ধ্রুবর চাহনিতে এক রাশ মুগ্ধতা দেখলাম। আমি আবারও ভালোবাসা শিখলাম নতুন করে। ধ্রুব নামক ভালোবাসা। কিছু নতুন নতুন অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত করালো আমাকে। আমাকেও কেউ এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ভেবেই অভিভূত হলাম। আমার মাঝেও কেউ তার পৃথিবী খুঁজে পায় শুনেই নিজেকে কারও সুখের কারণ হিসেবে মনে করলাম। এই বুঝি আমি আবারও প্রেমে পরলাম। খুব ভয়ংকর ভাবেই পরলাম। আমি বুঝি নিজেকে আত্মসমর্পণ করলাম ধ্রুবর ভালোবাসার কাছে!
সাদাফ মাথা নত করে আছে। হয়তো সে বুঝতে পেরেছে তার ভুল। কেউ কোনো কথা বলছে না। এবার সত্যিই বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হইলো। তবে বেশিক্ষণ আর এমনটা থাকলো না। তুলতুল সাদাফের কাছে যেয়ে তার কোলে ওঠার জন্য শার্ট ধরে টানছে। সাফাদ দৃষ্টি তুলে তুলতুলের দিকে চাইলো। খুব যত্নসহকারেই তাকে কোলে তুলে নেয় হাসি মুখে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। তবে ধ্রুবর শান্ত শীতল চাহনি এখনও আমার মাঝেই নিবদ্ধ হয়ে থাকলো।
‘আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?’
আমার প্রশ্নে ধ্রুব কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলেন-
‘না, আপনার উপর রেগে থাকার কোনো কারণ নেই।’
আমি ভ্রু কুচকে সন্দিহান কন্ঠে বললাম- ‘রেগে না থাকলে মুখ এমন অন্ধকার করে রেখেছেন কেন?’
ধ্রুব কোনো প্রকার প্রত্যুত্তর করলেন না। চুপচাপ সামনের দিকে চেয়ে ড্রাইভ করছেন। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে তুলতুলের দিখে চাইলাম। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে মেয়েটা। সাদাফকে ছেড়ে কিছুতেই আসতে চাচ্ছিলো না। গলা জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছিলাম ওর কান্ডকারখানা। মেয়েটা অল্পতেই সবার সাথে মিশে যায়। মেয়ে, মেয়ের বাবা, দাদা-দাদি সবার মাঝেই এত ভালোবাসা আসে কোত্থেকে! সবার প্রতি তাদের ভালোবাসার আর সীমা থাকে না। সে অচেনা হলেও তারা আপন করে নিতে একটুও সময় নেয় না। আমি ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে তুলতুলের কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিলাম। ভালো করে আগলে নিলাম তাকে৷ ধ্রুবর দিকে চেয়ে মলিন কন্ঠে বললাম-
‘আমি বুঝিতে পারছি আপনি আমার উপর রেগে আছেন। তবে আমি সত্যি করে বলছি আমি ইচ্ছে করে সাদাফের সাথে দেখা করিনি। আমি জানতাম না ও এখানে আসবে।’
ধ্রুব কড়া গলায় বললেন- ‘বললাম তো আমি রেগে নেই।’
‘এই তো রাগ দেখিয়ে কথা বলছেন আমার সাথে। তাহলে মিথ্যা কেন বলছেন যে রেগে নেই!’
ধ্রুব বিরক্তি নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমার কথায় তিনি ভীষণ বিরক্ত হচ্ছেন সেটা ওনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
চলবে…
#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৬
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
‘আমি আপনার উপর রাগ করিনি। তবে সাদাফের সঙ্গে আপনাকে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেছে।’
ধ্রুব কাঠ কাঠ গলায় কথা গুলো বলেই ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিলেন। আমি কিছুটা সময় চুপ থেকে নিম্ন স্বরে বললাম-
‘কিন্তু আমি তো ইচ্ছে করে সাদাফের সাথে দেখা করিনি।’
ধ্রুব কপট রাগ দেখিয়ে বললেন- ‘আমি সেটা জানি তবুও আমার রাগ লাগছে।’
আমি সরু চোখে ওনার দিকে চেয়ে থাকলাম। আজ প্রথম উনি আমার সাথে রাগ দেখিয়ে কথা বলছেন। সাদাফকে নিয়ে তার প্রব্লেম হচ্ছে কিংবা রাগ লাগছে এটাও আজকেই প্রথম প্রকাশ করলেন। মানুষটাকে এতদিন নির্বিকার, অনুভূতিহীন মনে হতো। কোনো কিছুতেই রিয়েক্ট করেন না। রাগ দেখান না৷ স্ত্রীর প্রাক্তন নিয়েও মাথা ঘামান না। সব বিষয়েই যেন তিনি নির্বিকার থাকেন। তবে আজ ভিন্ন মনে হচ্ছে। নির্বিকার মানুষটার মধ্যেও রাগ আছে। স্ত্রীর প্রাক্তন নিয়েও তিনি জেলাস। এটাই কি স্বাভাবিক নয়! আমি ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে দৃষ্টি নামিয়ে নিম্ন স্বরে বললাম-
‘সরি আমার ভুল হয়ে গেছে। নেক্সট টাইম আর এমন কিছু হবে না।’
ধ্রুব গাড়ির স্পিড কমিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে চাইলেন। ভ্রু জোড়ার মাঝে সুতীক্ষ্ণ ভাঁজ পরেছে। আমার কথায় যেন তার বিরক্তি ভাব আরও দ্বিগুণ হয়েছে। চোখমুখ কুচকে তিক্ত গলায় বললেন-
‘আমি কি বলেছি আপনাকে সরি বলতে!’
‘আপনি রেগে আছেন বলেই তো সরি বললাম। এখন তো দেখছি সরিও বলা যাবে না। তাহলে আপনিই বলুন কি করলে আপনার রাগ কমবে?’
ধ্রুব প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না। আগের মতোই ড্রাইভিং করতে লাগলেন। আমি মলিন মুখে তাকিয়ে থাকলাম ওনার দিকে। গাড়ি থামলো বাসার সামনে এসে৷ আমি তুলতুলকে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই ধ্রুব আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। নিঃশব্দে তুলতুলকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গাঢ় স্বরে বললেন-
‘আমার রাগ ভাঙানোর জন্য আপনাকে কিছুই করতে হবে না। সময় হলে আমি নিজেই চেয়ে নিবো।’
ধ্রুব গাম্ভীর্যের সাথে পা বাড়ালেন বাসার ভেতরে। আমি কয়েক মুহুর্ত সেদিকে স্থির তাকিয়ে থেকে হাঁটা শুরু করলাম। এই মানুষটাকে শুধু একটা কথাই বলা যায় আর তা হলো “অদ্ভুত” ভীষণ ভীষণ ভীষণ অদ্ভুত।
‘তোদের মধ্যে কি কিছু হয়েছে অনু? দুপুরে আসার পর থেকে ধ্রুব কেমন যেন গোমড়া হয়ে আছে।’
মনি মা’র কথায় আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। ডাইনিং টেবিলের প্লেট গুলো গোছাতে গোছাতে বললাম-
‘তেমন কিছু হয়নি মনি মা। উনি এমনিতেই একটু রেগে আছেন।’
আমি প্লেট গুলো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাবো তখনই মনি মা আমাকে আটকে দিলেন। আমার হাত থেকে প্লেট গুলো নিয়ে আবারও টেবিলে রাখলেন। আমি বিস্মিত চোখে মনি মা’র দিকে তাকালাম। আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে মনি মা নিজেও বসলেন। কিছুক্ষন আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন-
‘আমি জানি তোদের সম্পর্ক আর দশ-টা সম্পর্কের মতো না। তবে তোরা মন থেকে চাইলেই তোদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হবে। সময় নে, চেষ্টা কর দেখবি ধীরে ধীরে তোরা দু’জনেই এই সম্পর্কে স্বাভাবিক হয়ে আসবি। আমি ধ্রুবকে বুঝিয়েছি। আজ তোকে বলছি। বিয়ের সম্পর্কটা অনেক পবিত্র আর মূল্যবান একটা সম্পর্ক। কবুল বলার সাথে সাথেই স্বামী স্ত্রীর মনে একে অপরের প্রতি আলাদা একটা টান বা অনুভূতির জন্ম নেয়। না চাইতেও তখন এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন হয়ে যায়। কারণ সব সম্পর্কের উর্ধ্বে হলো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। তাই এই সম্পর্কের যত্ন নিতে শিখ। আশাকরি তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস।’
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। মনি মা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন-
‘এসব আমি গুছিয়ে রাখছি। তুই এখন রুমে যা। অনেক রাত হয়ে গেছে।’
আমি মনি মা’র কথা অগ্রাহ্য করে প্লেট গুলো নিয়ে রান্না ঘরে যেতে যেতে বললাম-
‘ভাইয়ার জন্য পাত্রী দেখতে যাবে তাই আম্মু তোমাকে পরশু ওই বাসায় যেতে বলেছে।’
মনি মা আমার কাছে এসে ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে বললেন-
‘কেন তুই যাবি না!’
‘নাহ মনি মা। এক্সামের প্যারায় অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। তাই কিছুদিন বাসায় থেকে রেস্ট নিবো। আর তুলতুলকে একটু সময় দিবো।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে এখন রুমে যা। বেশি দেরি হলে ধ্রুব হয়তো আরও রাগে যাবে। বাপের মতোই কিন্তু রগচটা হয়েছে। তবে বেশি প্রকাশ করে না।’
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে অলস ভঙ্গিতে রুমের দিকে যেতে লাগলাম। দুপুর থেকে ধ্রুব আমার সাথে ঠিক মতো কথা বলেননি। সারাক্ষণ মুখ ভার করেই বসে ছিলেন। উনি সাদাফকে নিয়ে এতটা জেলাস ফিল করেন তা আমার ধারনা ছিল না। মনের ভেতর এত কিছু লুকিয়ে সব সময় সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলেন কিভাবে! কি অদ্ভুত চরিত্র ওনার। ওনাকে বোঝার চেষ্টা করতে করতেই হয়তো আমি বুড়ি হয়ে যাবো। তবুও হয়তো ওনাকে বুঝতে পারা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
বিছানার মাঝ বরাবর তুলতুল ঘুমিয়ে আছে। পুরো রুমে আমি চোখে বুলিয়ে নিলাম। ধ্রুব রুমে নেই। বারান্দার দরজা খোলা। ঘুটঘুটে অন্ধকার বারান্দা। আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। আবছায়া আলোতে ধ্রুবর পেছন সাইড স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রেলিঙের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি৷ আমি বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে ওনার পাশে এসে দাঁড়ালাম। ধ্রুব আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলেন। এক পলকের জন্যেও আমার দিকে ফিরে তাকালেন না। ভাবটা এমন যে, আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি এটা যেন তিনি লক্ষ্যই করেন নি। আমি উদাসীন চোখে আকাশের দিকে চাইলাম। কৃষ্ণবর্ণের মেঘ গুলো এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। ঝিরিঝিরি হাওয়ার বেগ বেড়েছে প্রবলভাবে। বেলি গাছের পাতা গুলো এক একটা ঢালের সাথে বাড়ি খেয়ে শব্দ তুলছে। আমি এবার হাল ছেড়ে ধ্রুবর দিকে ফিরে দাঁড়ালাম। ক্লান্ত গলায় বললাম-
‘আপনি এখনও রেগে আছেন?’
ধ্রুব প্রত্যুত্তর করলেন। আমার প্রশ্ন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তাকিয়ে রইলেন অদূর মেঘলা আকাশে। কয়েক মুহুর্ত নিরব থেকে পালটা প্রশ্নে করলেন আমাকে,
‘সাদাফ চলে যাচ্ছে, আপনার কষ্ট হচ্ছে না?’
আমি থমকে গেলাম কয়েক মুহুর্তের জন্য। মস্তিষ্কে এলোমেলো ভাবনার সৃষ্টি হলো। সাদাফ চলে যাচ্ছে এ কথাটা আমার মাথায় একদমই ছিল না। দুপুর থেকে ধ্রুবকে নিয়ে ভাবতেই ব্যস্ত ছিলাম। কীভাবে ওনার রাগ ভাঙানো যায়৷ ওনার গাম্ভীর্যতা দূর করা যায় এসব চিন্তা-ই মাথার মধ্যে সর্বক্ষণ ঘুরছিল।
আমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ধ্রুব আমার দিকে ফিরে তাকালেন। অত্যন্ত নরম গলায় বললেন-
‘আমি জানি আপনার মনে এখন সাদাফের জন্য কোনো জায়গা নেই। আপনি কখনও সাদাফের কাছে ফিরে যাবেন না এটাও আমি জানি। আমি আপনাকে ভালোবাসি তার চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি। আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিংবা না বাসেন তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে আমি কখনও আপনাকে ছাড়তে পারবো না। আপনি চাইলেও না। আপনার ব্যাপারে আমি ভীষণ স্বার্থপর। আপনার ছায়াও অন্য কারও পাশে আমার সহ্য হয় না। সেটা সাদাফ হোক কিংবা অন্য কোনো পুরুষ। আর আমার সহ্য হয় না বলেই তখন রাগ হয়েছিল।’
আমি মাথা তুলে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। এই শান্তশিষ্ট মানুষটা আমাকে নিয়ে এতটা-ই জেলাস! আমি থমথমে গলায় বললাম-
‘আপনার রাগ ভাঙানোর জন্য কি করতে হবে আমাকে?’
ধ্রুব আমার দিকে ঝুঁকে মুখোমুখি হয়ে বললেন-
‘আপাতত আমার বুকের যে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে সেটা কমিয়ে দিন। তাহলেই হবে।’
‘কীভাবে?’
আমি বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করতেই ধ্রুব সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসলেন। দু হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে শীতল কন্ঠে বললেন-
‘আসুন। এখানে মাথা রাখুন। বুকে মাথা রাখলেই সেই যন্ত্রণাদায়ক ভারি জিনিসটা শান্ত হয়ে যাবে।’
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্রুব আমার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ওনার বুকে আগলে নিলেন। আমি কেঁপে উঠলাম। আচমকাই আগমন ঘটলো তুমুল বর্ষণের। হিম শীতল বৃষ্টির ফোটা ছুঁয়ে দিলো আমাদের শরীর। অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল সর্বাঙ্গে। অনুভূতিরা যেন দিশেহারা হয়েই মন মস্তিষ্কের সর্বত্র জুড়ে ছুটোছুটি করতে লাগল।
‘তুলতুলের আম্মু আমি যাচ্ছি।’
ধ্রুব কথায় আমি মাথা তুলে ওনার দিকে তাকালাম৷ শার্টের হাতা ঠিক করছেন তিনি। অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তুলতুলের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে নিম্ন স্বরে বললাম-
‘আচ্ছা। সাবধানে যাবেন।’
‘আজ অফিসে প্রচুর কাজ। আসতে অনেক দেরি হবে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
ধ্রুব এবার কিছুটা উচ্চস্বরে বললেন- ‘ওকে তাহলে যাচ্ছি।’
ধ্রুবর কন্ঠে তুলতুল নেড়েচেড়ে উঠলো। আমি এবার খানিকটা বিরক্ত হলাম। তুলতুলের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চাপা কন্ঠে বললাম-
‘কি শুরু করেছেন আপনি? তুলতুল উঠে যাচ্ছে তো৷ আব্বু ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছে। আপনি যান এখন।’
ধ্রুব আহত দৃষ্টিতে আমাকে একবার তুলতুলকে একবার দেখে রুম থেক বেরিয়ে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড পর তিনি আবারও ফিরে এলেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গাঢ় স্বরে ডাকলেন আমাকে,
‘তুলতুলের আম্মু একটু এদিকে আসুন তো।’
আমি সরু চোখে ওনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। কেমন যেন কাচুমাচু করছেন তিনি। কি অদ্ভুত এর আগে তো কখনও তিনি অফিসে যাওয়ার সময় এমন করেননি। আজ আবার কি হলো ওনার! আমি তুলতুলের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে এলাম ওনার কাছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওনার দিকে চেয়ে ক্ষীণ রাগ নিয়ে বললাম-
‘আপনার কি হয়েছে বলুন তো!’
ধ্রুব আচমকাই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন৷ আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ধ্রুবর এহেন কাজে। ঘটনার আকষ্মিকতা বুঝে আমার মস্তিষ্ক সচল হওয়ার আগেই ধ্রুব আমার গালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরলেন। আমি বরফের ন্যায় জমে গেলাম। বিস্ময়ে চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেল আমার। এভাবেই কেটে গেল কিছু মুহুর্ত। ড্রয়িং রুম থেকে আব্বুর আকর্ষণ কাড়া ডাকে আমার হুশ ফিরলো। প্রচন্ডরকম অপ্রস্তুত হয়েই ধ্রুবর বুকে ধাক্কা দিয়ে প্রতিবাদ জানালাম। ধ্রুবর মাঝে পরিবর্তন হলো না৷ তিনি আমার গাল থেকে তার উষ্ণ ঠোঁট জোড়া সরিয়ে নিলেন। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। আমার কানের কাছের মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন-
‘তুলতুলের জন্য দিয়ে গেলাম। ঘুম থেকে উঠলে আমার পক্ষ থেকে তুলতুল পাখিকে আদর করে দিয়েন।’
ধ্রুব কথাটা বলে আমাকে ছেড়ে দিয়েই হনহনিয়ে চলে গেলেন। আমি অবাক চোখে ওনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ পর আনমনেই হেসে ফেললাম। মনে মনে একটু আফসোস হলো ওনার জন্য। বেচারা আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য, একটুখানি ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য তুলতুলের অযুহাত দিচ্ছেন বার বার। তুলতুলের নাম করেই প্রতিবার আমাকে জড়িয়ে ধরছেন। আর আজ তো চুমুও দিয়ে গেলেন তুলতুলের নাম করেই। কি অদ্ভুত সব ছেলেমানুষী তার! ওনার এসব ছেলেমানুষীতেই যেন আমি বার বার দূর্বল হয়ে পরছি। অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি ওনার অদ্ভুত অদ্ভুত কর্মকান্ডে।
সব সময় হাসতে খেলতে থাকা মেয়েটা হঠাৎ করেই চোখের সামনে নিস্তেজ হয়ে পরছে। প্রচন্ড জ্বরে শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠছে মেয়েটার। আমি প্রচন্ডরকম ব্যস্ত হয়েই এক হাতে তুলতুলের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছি আর অন্য হাতে ধ্রুবকে কল দিচ্ছি। ধ্রুব কল রিসিভ করছে না। আমি বার বার কল দিতে লাগলাম কিন্তু কোনো লাভই হলো না। বাসায় আর কেউ নেই৷ ধ্রুব আর আব্বু অফিসে গেছেন। আর মনি মা সকালেই বেরিয়ে পরেছেন আমাদের বাসার উদ্দেশ্যে। মাথা কাজ করছে না। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে আমার। বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে। তুলতুল গোঙাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি করে তুলতুলে কোলে নিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলাম। জ্বরের তাপে যেন পুরে যাচ্ছে মেয়েটার শরীর। সকালের হাল্কা জ্বর দুপুর হতেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। মেয়েটার খাওয়া যাওয়া একদমই বন্ধ হয়ে গেছে। মুখে কিছু দিতেই বার বার বমি করছে। ক্লান্ত হয়েই শরীর একদম নেতিয়ে গেছে। ঠোঁট মুখ শুকিয়ে ফ্যাকাসে বর্ণের হয়ে গেছে। আমি আবারও ধ্রুবকে কল দিলাম। ধ্রুব এবার রিসিভ করলো না। বরাবরের মতোই কয়েকবার রিং বেজে কেটে যাচ্ছে। এবার আমার চোখের বাধ ভেঙে গেল। গাল বেয়ে পরতে লাগলো নোনাজল। আর কোনো উপায় না পেয়ে আমি একাই তুলতুলকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম রাস্তায়। মেয়েটা এখনও আগের মতোই ছটফট করছে।
চলবে…