শেষ রাত পর্ব-২১+২২+২৩

0
1300

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২১
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আমার বুকে খুব ভয়ংকর কিছু একটার উপস্তিতি টের পাচ্ছি তুলতুলের আম্মু। স্বাভাবিক কোনো রোগ বলে মনে হচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎই বুকে সেই ভারী জিনিসটা অনুভব করি। তখন আচমকাই তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়। আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কষ্টটা?’

ধ্রুব ভীষণ উত্তেজিত হয়ে কথা গুলো বললেন। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। ধ্রুব এখনও বুকে হাতে দিয়ে হাঁপাচ্ছেন৷ হয়তো এতগুলো কথা এক সাথে বলার কারণে এমনটা হয়েছে। আচ্ছা ওনার কি সত্যিই কিছু হয়েছে? আমি উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে গেলাম ধ্রুবর দিকে। ওনার বাহুতে হাত রেখে চিন্তিত গলায় বললাম-

‘কি বলছেন আমি তো কিছুই বলতে পারছি না। কি হয়েছে আপনার! আর হঠাৎ করে অসুস্থই বা হলেন কিভাবে! ডক্টর দেখিয়েছেন?’

‘ভয়ংকর কিছু একটা হয়েছে। খুবই ভয়ংকর। ডক্টর কিছুই করতে পারবে না। আমি এখনও টের পাচ্ছি আমার বুকে সেই ভয়ংকর জিনিসটা নাড়াচাড়া করছে। আমাকে তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে ওই জিনিসটা।’

ধ্রুব এবারও হাইপার হয়ে কথাগুলো বললেন। তার এমন বিধস্ত অবস্থা দেখে আমি খানিকটা ভয় পেলাম। ওনার পাশে বসে ভয় জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম-

‘খুব খারাপ লাগছে আপনার? ডক্টর আনতে বলবো? কি হয়েছে বুকে? আগে তো কখনো এসব বলেননি। আর কি সব নাড়াচাড়া করার কথা বলছেন? কিসের ভারী ভয়ংকর জিনিস? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে বলুন না তুলতুলের আব্বু৷ আমার ভয় করছে।’

ধ্রুব সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ওনার ভাবভঙ্গি আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কখনই বুঝতে পারি না। ধ্রুব তার মাথা হাল্কা উঁচু করে ক্ষীণ স্বরে বললেন-

‘বুঝিয়ে বলবো?’

আমি দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। ধ্রুব এবার আধশোয়া হয়ে বসলেন। হাত নাড়িয়ে আমাকে কাছে ডেকে বললেন-

‘এদিকে আসুন। বুকে মাথা রেখে শুনুন।’

ধ্রুব অপেক্ষা করলেন না। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার মাথা ওনার বুকে চেপে ধরলেন। আমি অবাক হলাম। খানিকক্ষণ স্তব্ধ থেকে দারুণ আগ্রহ নিয়ে শুনলাম ওনার বুকের ধুকপুকানি। ওনার হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। হয়তো কিছুটা দ্রুত গতিতে। তবে এটাই কি ওনার সমস্যা! আমি সরে আসতে চাইলেই ধ্রুব বাধা দিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন শক্ত করে। নরম গলায় বললেন-

‘আমার বুকে বিশাল এক ভালোবাসার দলা পাকিয়ে গেছে। পাহাড় সমান ভালোবাসা অনুভব করছি। হঠাৎ করেই বুকের ভেতর এসে চেপে বসলো এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা। ভালোবাসা গুলো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। বুকের ভেতর চাপা থাকতে চাইছে না কিছুতেই না। ভালোবাসা ছাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে সারা পৃথিবীতে। শহরের প্রতিটি অলিতে গলিতে। আর আমাদের সেই বেলি ফুল গাছটাতে। ফুল হয়ে ফুটতে চাচ্ছে ভালোবাসা। বৃষ্টির ফোটা হয়ে ঝড়তে চাচ্ছে। ধুয়েমুছে দিতে চাচ্ছে সকল বিষাদ আর অবসন্নতা।’

ধ্রুব থামলেন। নিরব হলেন কিছুক্ষনের জন্য। আমি স্তম্ভিত হলাম। বাকরুদ্ধ কর অবস্থা হলো আমার। বাহিরে দমকা হাওয়া বইছে। এলোমেলো বাতাস। আমার মন, মস্তিষ্ক সবটাই এলোমেলো হলো সেই বাতাসের মতো। ধ্রুব ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ফেললেন। বিষন্ন গলায় বললেন-

‘ভালোবাসারা বুকের ভেতর থেকতে না চেয়ে আমায় তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে। অসহনীয় যন্ত্রণা। আমি অসহায় হয়ে পরেছি ভালোবাসার অত্যাচারে। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পরেছি। আপনার কি মনে হচ্ছে না এটা খুব ভয়ংকর একটা রোগ! আমার মনে হচ্ছে আমি এই রোগে-ই মারা যাবো। আমার বুকটা ফেটে যাবে। একটু যত্ন দরকার। আপনার উচিত ছিল একটু যত্ন নেওয়া। ভালোবাসা গুলো একটু আপনার আগলে রাখা প্রয়োজন ছিল।
একটু সামলে নেওয়া প্রয়োজন। পারবেন তো আমাকে বাঁচতে? আমার পারসোনাল বুকটাকে একটু আগলে রাখতে পারবেন আপনি!’

আমি কোনো জবাব দিলাম না। এই মূহুর্তে কিছু বলার মতো অবস্থা আমার নেই। গলার স্বর আটকে গেছে কণ্ঠনালীতে। আমার মস্তিষ্কের পুরোটা জায়গায় দখল করে নিয়েছে ধ্রুবর কথা গুলো। আমি ভাবতে লাগলাম তার বলা কথা। ওনার ভালোবাসা আগলে রাখার ক্ষমতা কি আমার আছে? আমি কি আদোও কারও ভালোবাসা যত্নে রাখার যোগ্য? জানি না এসব প্রশ্নের উত্তর। এই অনুভূতি গুলোকে অসহনীয় লাগতে লাগলো। ভীষণ অস্বস্তি বোধ করলাম আমি। শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায় জেদ বয়ে গেল। রাগ হতে লাগলো নিজের উপর। আমি কারও ভালোবাসা আগলে রাখার ক্ষমতা রাখি না। যে আমার কাছে ভালোবাসা নিয়ে আসবে সে শুধুই কষ্ট পাবে। আমার দ্বারা মানুষ শুধুই কষ্ট পায়।

ধ্রুব হাল্কা হেসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন-

‘আমার মনে হয় আপনি একটা শামুকের মতো। শামুক যেমন একটু নাড়াচাড়াতে নিজেকে খোলসের ভেতর লুকিয়ে নেয়। আপনিও ঠিক সেভাবেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাচ্ছেন। তবে সমস্যা নেই। আপনি শামুক হলে আমি আপনার খোলস হতে রাজি। নিজেকে লুকিয়ে নিতে চাইলে আমার মাঝেই লুকিয়ে নিতে হবে। অন্য কোথাও না। অন্য কারও সেই অধিকার নেই।’

ধ্রুব আমাকে ছেড়ে দিতেই আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। নিজেকেই এখন রুগী মনে হচ্ছে। ধ্রুবর বুকের ব্যথাটা যেন এখন নিজের মধ্যেই এসে পরেছে। বুক ধড়ফড় করছে তীব্রভাবে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। আমি ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। ধ্রুব বিছানা থেকে উঠে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘আপনি পড়তে বসুন আমি শাকিল আর আব্বু-আম্মুর সাথে কথা বলে আসি। আমি এসেই আপনার সব পড়া চেক করবো। কাল সকালে আপনার এক্সাম তাই আজ এখানেই থাকবো।’

ধ্রুব হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে বসে থেকে বই নিয়ে পড়তে বসলাম।

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। ভেজা মাটির গন্ধ ছড়িয়ে পরলো চারপাশ। কানে শুধু ভাসতে লাগলো বৃষ্টির পাগল করা ছন্দ। অনুভূতিহীন আমি হঠাৎ করেই বৃষ্টির ছন্দে মাতাল হলাম। চেনা অচেনা সব অনুভূতিরা এসে ঝাপটে ধরলো আমায়। বৃষ্টিস্নাত এক গভীর রাত। ধ্রুব আমার হাত নিজের মুঠোয় আগলে নিয়ে এগিয়ে গেলেন বারান্দার দিকে। আমাকে পাশে নিয়ে দাঁড়ালেন রেলিঙের সামনে। বৃষ্টির ছাঁট আসছে গাঁয়ে। শীতল হাওয়ায় কাঁটা দিয়ে উঠছে সারা শরীর। দু’জনের মাঝে এক আকাশ সমান নিরবতা। মিনিট খানেক পর নিরবতা ভাঙে ধ্রুব অতি নিম্ন স্বরে বললেন-

‘এই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আর মুশলধারার বৃষ্টি দুটোই তোমার মতো স্নিগ্ধ। আমাদের মাঝের এই নিরবতা ঠিক তোমার চোখের মতোই গভীর। আর বাতাস!! সেটা তো তোমার মুগ্ধকরা চাহনির মতোই শীতল।’

আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবর মুখের দিকে। কয়েকঘন্টা আগের সেই কথাগুলো আবারও মনে পরলো। হঠাৎ করেই ধ্রুবর এমন পরিবর্তন আমাকে বার বার অস্বস্তিতে ফেলছে। ধ্রুব তার মুগ্ধ দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করলেন। অত্যন্ত শীতল কন্ঠে থেমে থেমে বললেন-

‘সানসাইন! শুনো না একটা কথা বলছি। তোমাকে ভালোবাসি। হুম তোমাকে ভালোবাসি আমি। তোমাকে ভালোবাসার কারণটা জানি না। আর খুঁজতেও চাই না। ভালোবাসার নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পেলে ভালোবাসার তীব্রতা কমে যায়। মানুষটার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। আর হ্যাঁ আমি কিন্তু তোমাকে জোর করছি না আমাকে এত জলদি ভালোবাসতে। তুমি ধীরে ধীরে বুঝবে নিজের অনুভূতি তখনই আমায় ভালোবাসবে। হয়তো তোমার আগেই আমি বুঝে যাবো তোমার ভালোবাসা।’

আমি মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ধ্রুব আমার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে গাঢ় স্বরে বললেন-

‘তুলতুলের সাথে কথা হয়েছে??’

আমি মিহি কন্ঠে বললাম-

‘হ্যাঁ ডিনার করার পরেই কথা হয়েছে।’

‘আচ্ছা এখন যান রুমে যেয়ে ঘুমিয়ে পরুন। সকাল সকাল উঠতে হবে।’

আমি মাথা নাড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়াতেই ধ্রুব পেছন থেকে ডাকলেন,

‘তুলতুলের আম্মু!’

আমি পেছন ঘুরে কৌতুহলী চোখে তাকালাম ওনার নির্লিপ্ত চোখের দিকে। ঠোঁটের কোণে তরল ভঙ্গির হাসি। মুখে বৃষ্টির পানি লেগে আছে। কি অদ্ভুতই না দেখাচ্ছে তাকে। আমার দিকে চেয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন-

‘আমার হতে হলে পুরোপুরি আমারই হতে হবে। সেখানে অতীতের বিন্দুমাত্র রেশ থাকবে না। আমি অপেক্ষা করতে রাজি তবে হার মানতে নয়।’

‘ধ্রুব ভাই আপনি জানেন অনুর যে পরিক্ষার হলে ফিট হয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে?’

ভাইয়ার কথা শুনে আমি জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে তাকালাম। ভাইয়া পাত্তা দিলো না আমার চাহনি। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। মুখে সয়’তানি হাসি। ভাইয়াকে আরও উৎসাহ দিয়ে ধ্রুব বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘ক্লাস ফাইভের সমাপনী পরিক্ষা দেওয়ার সময় ফিট হয়েছিল সেটা জানি। এখনও কি সেই অভ্যাস আছে??’

‘অবশ্যই আছে। কেন থাকবে না! এই যে এখনও যদি দুষ্টুমি করে একটা থাপ্পড় দেই দেখবেন কান্না করতে করতে বেহুশ হয়ে গেছে।’

ভাইয়া পুরো ড্রয়িং রুম কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। ধ্রুবও তাল মিলালো ভাইয়ের সাথে। তাদের এমন ঝংকার তোলা হাসি দেখে আমি রাগান্বিত গলায় বললাম-

‘ভাইয়া তুই কি থামবি নাকি আম্মুর কাছে বিচার দিবো?’

ভাইয়া মুখ বিকৃতি করে করে বলল-

‘দেখলেন ধ্রুব ভাই কিছু না বলতে কেমন শুরু করেছে।’

আমি রেগেমেগে কিছু বলবো তার আগেই ধ্রুব নিজের হাসি চেপে রেখে বললেন-

‘থাক শাকিল বাদ দাও। একটু পর এক্সাম এখন আবার কান্নাকাটি করলে সমস্যা।’

ধ্রুবর কথায় আমি তীক্ষ্ণ চোখে চাইলাম। ধ্রুব ঠোঁট চেপে হাসলেন। আমার রাগ পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে আমার হাত ধরে বেরিয়ে পরলেন ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। পুরো রাস্তা আমি আর কোনো কথা বলিনি। ভার্সিটিতে এসে আমি গাড়ি থেকে নামতেই ধ্রুব আমার পেছন পেছন আসলেন। আমার সাথেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন সানিয়ার জন্য। আমি কিছু বললাম না। বেশ খানিকটা সময় পর সানিয়া আসলো। ধ্রুবর সাথে কুশল বিনিময় শেষে ভার্সিটির ভেতরে চলে যাবো তখনই ধ্রুব আমার হাত ধরে নরম গলায় বললেন-

‘ঠিক মতো এক্সাম দিও। আর হ্যাঁ অন্য কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করো না। মনোযোগ দিয়ে লিখবে। নিজের উপর বেশি চাপ দিও না যতটুকু পারবে ততটুকুই লিখবে। আর হ্যাঁ সব কিছু নিয়েছো কিনা একবার দেখে নাও।’

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে ধ্রুবর কথা শুনলাম। আমার পাশ থেকে সানিয়া দুষ্টুমি করে বলল-

‘দুলাভাই আপনার বউ কিন্তু এর আগেও অনেক বার এক্সাম দিয়েছে। আর আপনি যেমন করছেন মনে হচ্ছে কোনো বাচ্চা এই প্রথম এক্সাম দিতে এসেছে।’

ধ্রুব খানিকটা বিব্রতবোধ করলেন। থতমত খেয়ে বললেন- ‘আচ্ছা যাও তোমরা দেরি হচ্ছে।’

সানিয়া এবারও ঠোঁট চেপে হেসে বলল-

‘দুলাভাই অনুর হাতটা না ছাড়লে যাবো কিভাবে? অবশ্য আপনি অনুর সাথে যেতে চাইলে আমি টিচারের সাথে কথা বলে দেখতে পারি রাজি হয় কি-না।’

ধ্রুব এবার ভীষণ লজ্জা পেলেন। ঝট করে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে চোখ বুলালেন। দু হাত পকেটে গুজে জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়েই চলে গেলেন তিনি। আমি অপলক সেদিকেই চেয়ে থাকলাম। ধ্রুব কারো কথায় লজ্জা পায়, বিব্রতবোধ করেন এটাও আজ নতুন দেখছি৷ মানুষটাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি।

‘দুলাভাই তোর অনেক কেয়ার করে তাই না অনু? তোর কি মনে হচ্ছে না তোর নেওয়া সিদ্ধান্তটাই ঠিক ছিল?’

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২২
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তোর কি মনে হচ্ছে না দুলাভাইকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা তুই ঠিক নিয়েছিস! আমার কেন যেন মনে হচ্ছে দুলাভাই তোর জন্য পারফেক্ট। দুলাভাই-ই একমাত্র ব্যক্তি যে তোকে ভালো রাখতে পারবে।’

সানির কথার প্রতিত্তোরে আমি কিছুই বললাম না। নির্লিপ্ত চোখজোড়ার দৃষ্টি নামিয়ে একদম পায়ের কাছে এনে স্থির করলাম। আশেপাশের হৈচৈ আর সানির বলা একের পর এক কথা কোনটাই কানে এসে পৌঁছালো না। আমার মস্তিষ্কে চলতে থাকা চিন্তাধারা গুলো একটা জায়গায় এসে থমকে গেল। পৃথিবীর কেউ কারও জন্য পারফেক্ট নয়। কেউ কাউকে পুরোপুরি ভালো রাখতে পারে না। কেউ বিনাকারণে কাউকে ভালোবাসে না। প্রয়োজন ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই হয় না। কারণ ছাড়া একটা পাতাও নড়ে না। সব কিছুতেই কারণ আছে, স্বার্থ আছে। আচ্ছা ধ্রুবর ভালোবাসা কি সত্যি! আর সত্যি হলেও এই ভালোবাসার কারণ কি? আমার ভগ্নহৃদয়ের প্রতি সহানুভূতি? না-কি জোরজবরদস্তি হয়ে যাওয়া স্ত্রীকে মেনে নেওয়ার প্রচেষ্টা? হঠাৎ করেই কেন ভালোবাসা হলো? এত এত প্রশ্নের জবাব কে দিবে আমায়? ধ্রুব কি দিতে পারবে আমার সকল প্রশ্নের জবাব!
ক্লাসে রুমে এসে পা রাখতেই আমার মস্তিষ্ক স্থির হয়ে গেল। পরিবর্তন হলো আমার মন। বিশৃঙ্খল সকল চিন্তাভাবনা তালাবদ্ধ করে রাখলাম মনের মাঝে। মস্তিষ্কে পুরোটা জুড়ে শুধুই পরিক্ষা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। মনি মা’র কথা মনে পরতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। তার মেয়ে আমি। তার সব ইচ্ছে পূরণ করতে হবে আমাকে। মোহনা আপু না পারলেও আমাকে পারতে হবে। খুব মনোযোগ দিয়ে পরিক্ষা দিলাম। যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়েও ভালো লিখেছি পরিক্ষার খাতায়। ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেইটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার অবচেতন মন বলছে ধ্রুব আমাকে নিতে আসবে। আমি অপেক্ষা করলাম। একমিনিট, পাঁচ মিনিট, দশমিনিট অনেকটা সময় ধরেই অপেক্ষা করলাম। ধ্রুব আসলেন না। এমন কি ফোন করে কিছু জানালেনও না। আমি তবুও পথ চেয়ে রইলাম ধ্রুবর জন্য। সানি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল। ক্লান্ত গলায় বলল-

‘দোস্ত চল না আমরা একাই চলে যাই। দুলাভাই বোধহয় আসবে না। শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় বল!’

সানি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে কিছু একটা ভাবলো। পরক্ষণেই উত্তেজিত হয়ে বলল-

‘কি অদ্ভুত! দুলাভাই আসবে কি-না তা ওনাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেই তো হতো৷ কি বোকা আমরা। এতক্ষণ কেন আসলো না এই বুদ্ধি! যাইহোক সময় নষ্ট না করে দুলাভাইকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস কর আসবে কি-না।’

আমি শান্ত চোখে সানির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘আমি কখনো ওনাকে নিজে থেকে ফোন দেইনি।’

সানি প্রচন্ডরকম অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। চোখের ছানা বড় বড় করে অবিশ্বাসের গলায় বলল-

‘তুই দুলাভাইকে নিজে থেকে ফোন দিস নি মানে কি? বিয়ের এতদিন হয়ে গেলো অথচ তুই দুলাভাইকে একবারও নিজে থেকে কল করিসনি?’

আমি প্রতিত্তোরে ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখলাম ভাইয়া আসছে। আমার সামনে এসেই হাঁটুতে দু’হাত ভর দিয়ে ঝুঁকে হাঁপাতে লাগলো। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল-

‘ওই রোডে প্রচুর জ্যামরে অনু। জানিস তোর জন্য কতটা পথ আমার হেঁটে আসতে হয়েছে!’

আমার সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ভাইয়ার ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুখের দিকে। দু-হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে সন্দিহান কন্ঠে বললাম-

‘আমি বলেছি তোকে আসতে?’

‘তুমি বলো নাই কিন্তু তোমার স্বামী মানে আমার ধ্রুব ভাইয়ের হুমুক তার মহারানীকে যেন আমি যত্নসহকারে কোলে করে বাসায় নিয়ে যাই।’

ভাইয়ার বিকৃতভাষ্য শুনে আমি জ্বলন্ত চোখে চাইলাম। পরক্ষনেই নিজের রাগ সামলিয়ে নিয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন করলাম-

‘উনি তোকে আসতে বলেছে কেন?’

‘আরে ধ্রুব ভাইয়ের-ই তো আসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই নাকি জরুরী কাজ পরে গেছে তাই তো আমাকে ফোন করে বললো তোকে নিয়ে যেতে। এখন চল তাড়াতাড়ি। অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। সানি তুইও চল।’

ভাইয়া তৎক্ষনাৎ একটা অটোরিকশা থামিয়ে আমাদের নিয়ে উঠে পরলেন। বেশ খানিকটা পথ যেতেই তীক্ষ্ণ শব্দে আমার ফোন বেজে উঠল। আমি ফোন হাতে নিতেই স্কিনে ধ্রুবর ছবি আর তার নিচে স্পষ্ট একটা নাম ভেসে উঠলো ‘তুলতুলের আব্বু।’ নিজের অজান্তেই খানিকটা স্বস্তি বোধ করলাম।

‘কিরে ফোন রিসিভ করছিস না কেন!’

সানি আমার গায়ে হাল্কা ধাক্কা দিতেই আমি অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত ফোন রিসিভ করলাম। সাথে সাথেই ধ্রুব নিম্ন স্বরে বললেন-

‘সরি আমি আসতে পারিনি৷ আসলে হঠাৎ করেই একটা জরুরি কাজ পরে গিয়েছিল। তাই শাকিলকে বলেছি যেন আপনাকে নিয়ে আসে।’

‘ঠিক আছে সমস্যা নেই। আমি বুঝতে পারছি।’

ধ্রুব কিছুটা সময় নিশ্চুপ থেকে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন-

‘পরিক্ষা ভালো হয়েছে?’

আমি ছোট করে ক্ষীণ স্বরে বললাম ‘হ্যাঁ’।

‘এখন কি রাস্তায়?’

‘ হুম।’

‘শাকিল আছে সাথে?’

‘ হুম আছে।’

আমাদের কথার মাঝে আচমকাই ভাইয়া সামনে থেকে ধমকে উঠলো৷ রাগে চিড়বিড় করে বলল-

‘এসব কি ধরনের কথাবার্তা অনু! হ্যাঁ, হুম এসব কেমন কথা? আমার তো শুনেই বিরক্ত লাগছে ধ্রুব ভাইও নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছে। তুই কি লজ্জা পাচ্ছিস আমার সামনে কথা বলতে! অদ্ভুত ব্যাপার তো। আমি তো তোকে কখনও আমার সামনে লজ্জা পেতে দেখিনি।’

ভাইয়ার কথার সুর টেনেই সানি কৌতুক করে বলল-

‘নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে একটু আধটু লজ্জা পাওয়াটাই স্বাভাবিক শাকিল ভাই।’

এতক্ষন লজ্জা না পেলেও সানি আর ভাইয়ার কথায় এবার আমি সত্যি সত্যিই লজ্জা পেলাম। লজ্জাভাব আরও প্রখর হলো যখন ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ধ্রুবর তরল ভঙ্গির হাসি শুনতে পেলাম। লজ্জায় লাল হতে লাগলাম আমি। ইচ্ছে করলো নিজেকে আড়াল করে নেই সব কিছু থেকে। কিন্তু এটা সম্ভব না কিছুতেই না। ধ্রুব নামক এই নির্লিপ্ত মানুষটার কারনেই প্রতিদিন নতুন নতুন অনুভূতির সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করতে হবে।

বিষন্নতার চাদরে মোড়ানো রাতের আকাশ। ধূসর কালো মেঘগুলো ভাসছে বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। প্রবলবেগে বইছে বৈশাখের ঝোড়ো হাওয়া। আকাশের দিকে উদাসীন চোখে চেয়ে আনমনেই ভাবতে লাগলাম ধ্রুব এখন কি করছে? তিনিও কি আমার মতোই এই বিষন্ন আকাশ দেখছে? ওনাকেও কি ছুঁয়ে দিচ্ছে এই বিশৃঙ্খল বাতাস? ভীষণ এলোমেলো হয়ে আছে আমার মন। কাল দুপুর থেকে ধ্রুবর সঙ্গে একবারও কথা হয়নি। ধ্রুব ফোন দেয়নি আর আমিও ফোন করে ওনার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করিনি। মনি মা’র কাছেও লজ্জায় কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। সব কিছুতেই যেন একটা দ্বিধাবোধ কাজ করে। ইচ্ছে করলেও সব ইচ্ছে পূরণ করতে মন সায় দেয় না। দ্বিধাবোধ আর অস্বস্তিতে বাধা পরে যায় সকল ইচ্ছে। ফোনের রিংটোনের শব্দে আমার ভাবনায় ছেদ পরলো। ক্ষীণ বিরক্তি নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। ধ্রুব ফোন করেছে। খানিকক্ষণ স্থির চেয়ে থাকলাম স্কিনের দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে কানের কাছে ধরলাম। ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষটা নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন-

‘আমি অপেক্ষা করছি। দু মিনিটের মধ্যে বাহিরে আসুন।’

আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ধ্রুব লাইন কেটে দিলেন। আমি হতভম্ব হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পুরো বিষয়টা যেন মাথার উপর দিয়ে গেল। এই রাতের সময় বাহিরে কিভাবে? আর উনি অপেক্ষা করছেন মানে কোথায় অপেক্ষা করছেন? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ধ্রুবর সতর্কবার্তা এসে পৌঁছালো আমার ফোনে। ‘এক মিনিট বাকি জলদি আসুন।’ ধ্রুব মেসেজ দেখেই আমি হড়বড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। ড্রয়িং রুমে কাউকে না দেখে পা টিপে চুপিচুপি বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে। গেইটের কাছে আসতেই গাড়ি নিয়ে ধ্রুবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দু হাত পকেটে গুঁজে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার শান্ত শীতল মুখশ্রী। আমি ওনার দিকে এগিয়ে এসে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘ভেতরে না এসে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আর আমাকেই বা বাহিরে আসতে বললেন কেন?’

ধ্রুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে হাত বের করে তার এলোমেলো চুলে নিখুঁত কাজ চালিয়ে দিলেন। সুন্দর করে চুল গুলো গুছিয়ে নিয়ে আমার প্রশ্ন পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে বললেন-

‘ Let’s go’

‘কোথায় যাবো?’

আমার প্রশ্নে ধ্রুব খুব সহজ গলায় বললেন-

‘আমি যেখানে যাবো সেখানেই।’

আমি ভ্রু কুচকে ফেললাম। ওনার কথায় নাকোচ করে বললাম-

‘আমি কোথাও যাবো না। আমার ইচ্ছে করছে না। বাসায় কেউকে বলে বের হইনি।’

ধ্রুব বাঁকা হাসলেন। অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন-

‘আপনার ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে। if i call you, you have to be there.’

আমি আগের মতোই ভ্রু কুচকে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধ্রুব বোধহয় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেন। কড়া গলায় বললেন-

‘যা বলেছি তা করুন। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসুন তুলতুলের আম্মু।’

আমি যন্ত্রের মতো চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম। ধ্রুবও বসলেন। আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললেন-

‘সিট বেল্ট লাগিয়ে নিন।’

ধ্রুবর কথা মতোই আমি সিট বেল্ট লাগিয়ে নিলাম। গাড়ি চলছে। এলাকার গলি পেড়িয়ে চলে এলো অন্য রাস্তায়। আমি কিছুটা ইতস্তত করে বললাম-

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? আর বাসায় এসে ভেতরে যান নি কেন? আম্মু আমাকে না পেয়ে চিন্তা করবে তো।’

‘বউয়ের সাথে প্রেম করতে এসেছি। এতে আমার বোকাসোকা শ্বাশুড়ি ভিলেন হবেন বলে তো মনে হয়না।’

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৩
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘বউয়ের সাথে প্রেম করতে এসেছি৷ এখানে আমার বোকাসোকা শ্বাশুড়ি ভিলেনের রূপ নিবে বলে তো মনে হচ্ছে না। উনি আমাকে আপনার চেয়েও বেশি ভালোবাসে যেমনটা আমার মা আপনাকে ভালোবাসে। তাই ভালোবাসায় ভালোবাসায় কাটাকাটি।’

ধ্রুবর মুখে অমায়িক হাসি। কত সহজ সরল ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছেন। রাত নয়টা বাজে কাউকে কিছু না বলেই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। আমাকে বাসায় না পেয়ে সবাই অস্থির হবেন কি-না এতে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে ম্লান কন্ঠে বললাম-

‘বাসার ভেতরে যাননি কেন?’

ধ্রুব ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে চেয়ে অদ্ভুত ভাবে হাসলেন। গলার স্বর নামিয়ে মিনমিনিয়ে বললেন-

‘আসলে আমার লজ্জা লাগছিল। বউয়ের সাথে দেখা করতে প্রতিদিন শ্বশুর বাসায় যাওয়া ব্যাপারটা খুবই লজ্জাজনক মনে হচ্ছে। তা ছাড়া এসব দেখলে সবাই তো আমাকে বউ পাগল বলবে যা মোটেও আমার ক্যারেক্টারের সাথে যায় না।’

ওনার কথা শুনে আমার ভীষণ হাসি পেল। আমি মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলাম। কোনো রকম নিজের হাসি লুকিয়ে চাপা কন্ঠে বললাম-

‘অহহ আচ্ছা! শ্বশুর বাসায় বউয়ের সাথে দেখা করতে যাওয়া লজ্জাজনক ব্যাপার!! আর এখন যে কাউকে না জানিয়ে বউকেই তুলে নিয়ে যাচ্ছেন তার বেলায় কি? এটা তো আরও ভয়াবহ ব্যাপার। এটা কি বুঝতে পারছেন?’

ধ্রুব অবাক চোখে আমার দিকে তাকালেন। পরক্ষনেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললেন-

‘বিয়ের আগে প্রেম করার শখ বিয়ের পর মেটাচ্ছি এর জন্য একটু আধটু ভয়াবহ কাজ তো করতেই হবে। আমার আবার বীরপুরুষ টাইপ প্রেমিক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। এখন না হয় প্রেমিকের জায়গায় বীর স্বামী হলাম তাতে ক্ষতি কি!’

আমি অবাক হলাম। বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলাম ধ্রুবর দিকে। কি বলছেন এসব? মানুষটা কি পাগল হয়ে গেছে না-কি! একবার লজ্জায় লাল হচ্ছে আবার কি সব সাংঘাতিক প্রেম প্রেম কথা বলছেন। নির্ঘাত মাথার তার ফার সব ছিঁড়ে গেছে। নাহলে এমন হলেন কি করে?

‘এই রেস্টুরেন্টের কথা মনে আছে আপনার?’

ধ্রুবর কথায় আমি ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলাম। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালাম৷ আনমনা হয়ে বললাম-

‘হ্যাঁ বিয়ের আগে আপনার সাথে দেখা করেছিলাম এখানে।’

আমার কথার বিনিময়ে তিনি মৃদুস্বরে হাসলেন। গাড়ি রাস্তার একপাশে থামিয়ে আমার দিকে ঘুরে বসলেন হাসি হাসি মুখে। খানিকক্ষণ রেস্টুরেন্টের দিকে চেয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন-

‘সেদিন আম্মু আমাকে একপ্রকার জোর করেই আপনার সাথে দেখা করতে পাঠিয়েছিল। আমি রেস্টুরেন্টের এই জানালার পাশেই বসে ছিলাম। রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিলাম অনাকাঙ্ক্ষিত এক মানুষের। ভেবেছিলাম এত এত বছর আগে দেখা সেই ছোট্ট পিচ্চি মেয়েটা হয়তো বিচ্ছেদের দাহনে পুড়ে বিষন্ন, উদাসীন এক রমনীতে পরিনত হয়েছে। তখন হঠাৎ করেই রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মায়াকাড়া চেহারার এক শ্যামলতার দিকে নজর পরে৷ যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। খুবই বিধস্ত লাগছিল তাকে। আচমকাই একটা বাচ্চা দৌড়ে যাওয়ার সময় তার সাথে ধাক্কা লেগে নিচে পরে যায়। সেই বিষন্ন রমনী খুব মমতার সঙ্গে বাচ্চাকে তুলে দেয়৷ কি যেন কথা বলছিল বাচ্চাটার সঙ্গে। কথার মাঝে হঠাৎ করেই হাসি ফুটলো তার সেই উদাসীন মুখে। রাতের আকাশে থাকা ধ্রুব তারার মতোই ঝলমলে ছিল ওই হাসি৷ একদম তীরে মতো এসে বিধেছিল আমার বুকে। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেছিলাম বুকের বা পাশটায়। খানিকটা সময়ের জন্য থমকেও গিয়েছিলাম। পরমুহূর্তে সেই হাসিটাও থমকে গিয়েছিল। ভীষণ আফসোস হয়েছিল হাসিটা মিলিয়ে যেতে দেখে। আবারও সেই মনমরা মুখ। ঘন আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে গেল সেই হাস্যজ্বল চেহারা। যখন আমার কাছে এসছিল মেয়েটা তখন একদমই ভিন্ন লাগছিল তাকে। চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। ঝলমলে চোখ দুটোর নিচে জমানো কালি গুলো নির্ঘুম রাত কাটানোর জানান দিচ্ছিলো। মন খারাপ হয়েছিল ভীষণ।’

ধ্রুব থামলেন। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলেন সেই রেস্টুরেন্টের দিকে চেয়ে। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বিস্ময়ে বড় হয়ে যাওয়া চোখ দুটো দিকে ধ্রুবর শান্ত শীতল মুখখানা দেখলাম। উনি আমার প্রতিটি বিষয় এতটা নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তা আমার ভাবনার মধ্যেই ছিল না। তাহলে কি উনি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন!
আমি নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করলাম-

‘আপনি আমায় ভালোবাসেন কেন? হঠাৎ এই ভালোবাসার কারণ কি?’

ধ্রুব বরাবরের মতোই তার সহজাত তরল ভঙ্গির হাসি দিলেন। তার শান্ত শীতল চাহনি স্থির করলেন আমার কৌতূহলী চোখের দিকে। কোনো কথা না বলেই গাড়ি নিয়ে ফিরে এলেন বাসার পথে। গেইটের কাছে গাড়ি থামতেই আমাকে বললেন-

‘নামুন। বাসায় এসে পরেছি।’

আমি গাড়ি থেকে নামলাম। আমার সাথে সাথে ধ্রুবও তার সিট থেকে নেমে এলেন গাড়ির বাহিরে। আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত নরম সুরে বললেন-

‘আমি ঠিক করেছিলাম আমি তোমার মুখের হাসি দেখতে চাই। তোমার জন্য নয় আমার নিজের জন্য। সেদিনের মতোই আমি বার বার তোমার হাসি দেখে থমকে যেতে চাই। বুকের সেই চিনচিনে ব্যথাটা অনুভব করতে চাই৷ নিজেকে মুগ্ধ করার জন্য হলেও তোমার হাসিটা আমার খুব প্রয়োজন। আর আমি তোমাকে চাই আমার নিজের স্বার্থের জন্য। আমি তোমাকে ভালোবাসি নিজের জীবনটাকে পরিপূর্ণ করার জন্য। তোমার ঠোঁটের হাসি সারাজীবন দেখার জন্য। সবটাই চাই আমার নিজের জন্য এটাই হলো তোমাকে ভালোবাসার কারণ। বুঝলে সানসাইন?’

আমি মূর্তি ন্যায় থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। কি অদ্ভুত এক অনুভূতি। নিজের স্বামীর মুখে এমন সব কথা শুনেও যেন অস্বস্তি হচ্ছে। লজ্জা লাগছে। তার চেয়েও বেশি হচ্ছি অবাক। মানুষটা এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে! কাউকে ভালোবাসার কারণ কি আদোও এসব হতে পারে? আমাকে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব দু হাত বাড়িয়ে সহজ গলায় বললেন-

‘তুলতুলের আম্মু! আসুন তো আমাকে একটা টাইট হাগ দিন। তুলতুল পাখি হয়তো অপেক্ষা করছে কখন আমি গিয়ে আপনার পক্ষ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরবো সে জন্য। আসুন আসুন জলদি আমাকে জড়িয়ে ধরুন। নাহলে শ্বশুর বাড়ির কেউ দেখে ফেললে আমার লজ্জায় পরতে হবে।’

ধ্রুব জোর করেই আমাকে টেনে নিলেন তার বুকে। আমি হাল্কা কেঁপে উঠলাম। অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল সারা শরীরে। অনুভূতিরা সব পাল্লা দিয়ে বিশৃঙ্খল ভাবে ছুটে চলল আমার মস্তিষ্কে। অসাড় হয়ে এলো শরীর। ধ্রুর বুকের ধুকপুকানি শুনে যেন আরও বেশিই চমকে গেলাম। বরফের ন্যায় জমে যেতে লাগলাম আমি। ধ্রুব আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বললেন-

‘তোমাকে ভালোবাসার তৃষ্ণা আমার কখনোই মিটবে না সানসাইন। আমার হৃদ স্পন্দ আমার বেঁচে থাকার জন্য যতটা জরুরি ঠিক ততটাই জরুরি তোমাকে ভালোবাসা। আমার পারসোনাল বুকের ভাড়া হিসেবে আমার তোমাকেই প্রয়োজন। আমার পারসোনাল বুকটা শুধু তোমার জন্যই বরাদ্দ। এখানে শুধু মাত্র তুমি আর তোমার ভালোবাসারা থাকবে। তোমার অতীত, তোমার বিষন্নতা, তোমার কষ্ট সব কিছু আমি মুছে দিতে চাই আমার ভালোবাসা দিয়ে। তুমি এখন আমাকে ভালো না বাসলেও আমার বিশ্বাস একটা সময় তুমি ঠিক আমায় ভালোবাসবে। আমার চেয়েও বেশি আমায় ভালোবাসবে।’

‘কিরে অনু! তুই এতো রাতে বাইরে থেকে আসলি কীভাবে?’

আম্মুর কথা শুনেই আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম৷ ভয়াতুর চোখে আম্মুর দিকে পিটপিট করে তাকালাম। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন আমার দিকে। আমার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। আম্মুকে কি জবাব দিবো তার উত্তর হাজার ভেবেও খুঁজে পেলাম না। ধ্রুবর সঙ্গে বাহিরে গিয়েছিলাম বলাও ঠিক যুক্তিযুক্ত মনে হলো না। খুবই লজ্জার ব্যাপার বলেই মনে হলো। আর কোনো মিথ্যা কথা কিংবা বাহানাও খুঁজে পাচ্ছি না। প্রচন্ড রাগ লাগছে ধ্রুবর উপর। নিজে তো চলেই গেল অথচ আমাকে এই পরিস্থিতিতে ফেলে গেল।

‘অনু আমার সাথে ছাদে গিয়েছিল মা।’

ভাইয়ার কন্ঠ শুনে আমি পেছন ফিরে দরজার দিকে চাইলাম। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আম্মুর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাইয়া। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই আম্মু ধমকে উঠলেন। তিক্ত গলায় বললেন-

‘ এত রাতে ছাদে কি প্রয়োজন? খেয়েদেয়ে কি তোদের কোনো কাজ নাই? রাত-বিরেতে ভূত-পেত্নীর মতো ছাদে ঘুরাঘুরি করছস। এসব কি ধরনের বাজে অভ্যাস?’

‘আহহ মা আমরা তো আর প্রতিদিন ছাদে যাই না। আজকেই তো গেলাম। এখানে এত রাগার কি আছে? এখন যাও খাবার দাও আমরা আসছি।’

ভাইয়ার কথা গুলো বলতে বলতেই সোফায় গাঁ এলিয়ে দিলো। আম্মু তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রাগে গজগজ করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ভাইয়া তৎক্ষনাৎ উঠে আমার কাছে আসলো। আমার মাথায় চড় দিয়ে চাপা কন্ঠে বলল-

‘নিজের আপন জামাইয়ের সাথেও লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতে যাওয়া লাগে আপনার? আমি যদি ছাদ থেকে আপনাদের রোমান্টিক সিন না দেখতাম তাহলে আপনাকে কে বাঁচতো আম্মুর এসব বিরতিহীন প্রশ্ন থেকে?’

অন্য সময় হলে হয়তো আমার মাথায় চড় দেওয়ার বিনিময়ে ভাইয়াকে আরও দশটা চড় খেতে হতো। কিন্তু আজ লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। ছিঃ কি বিব্রতকর পরিস্থিতি। আর ভাইয়াও কিভাবে লাগামহীন ভাবে কথাগুলো বলে ফেলল। নিজের ছোট বোনকে এসব বলতে কি তার একটুও লজ্জা লাগলো না? হা’রামি একটা। নির্লজ্জ। সবটাই হিয়েছে ধ্রুবর সঙ্গ পেয়ে৷

‘যা সর। আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমনে লজ্জায় লাল নীল হওয়া লাগবে না তোর। রুমে গিয়ে ফ্রশ হয়ে আয় ডিনার করবি।’

আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে এলোমেলো ভাবে পা ফেলে রুমে চলে আসলাম। ধ্রুবর বলা প্রতিটি কথা মাথার মধ্যে ঘুরছে। ওনার কথা ভেবে ফাঁকা রুমেই লজ্জা পেলাম আমি। ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও চলে যাই নিজের লজ্জা নিয়ে। আচমকাই তীক্ষ্ণ শব্দে আমার ফোন বেজে উঠলো। ভাবনার মাঝেই কেঁপে উঠলাম আমি। হুশ ফিরতেই শুকনো ঢোক গিলে অপ্রস্তুত হয়ে ফোন রিসিভ করলাম।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে