#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৮
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
গুমোট আকাশের নিচে কোলাহলপূর্ণ ঢাকা শহরটা যেন আজ বেশ থমথমে। এই আলো তো এই অন্ধকার৷ কিছুক্ষন আগেই আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হলো। ঝড়ো হাওয়ার তান্ডবে এলোমেলো হলো চারপাশ। ঘন্টাখানেকের তীব্র বৃষ্টির শেষে ক্লান্ত হয়েই গতি কমিয়ে পরিবর্তিত হলো মৃদু ঠান্ডা বাতাস আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে। আমি দরজা খুলে বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। পা বাড়ালাম বারান্দার ভেজা মেঝেতে। ধ্রুবর বেলি গাছ গুলোর বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখেই মন খারাপ হলো। ডাল পালা একদম নেতিয়ে গেছে। এতদিনের যত্নে বেলি গাছে যে কয়টা কলি এসেছিল তার প্রায় বেশির ভাগই ঝড়ে পরেছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বেলি গাছগুলোকে ঠিক করে দিতেই কলিং বেল ভেজে উঠলো। মনি মা তুলতুলের গায়ে মালিশ করে দিচ্ছে। তাই আমি বারান্দা থেকে পা টিপে টিপে রুমে আসলাম। ওড়নায় ভেজা হাত মুছে ছুটে চললাম দরজা খুলতে। দরজা খোলা মাত্রই ধ্রুবকে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়তে দেখলাম। শার্টের কিছু কিছু জায়গা ভেজা। মুখে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোটা। আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে শার্টের হাতায় মুখ মুছলেন তিনি। ভেতরে আসতে আসতে উচ্চস্বরে বললেন-
‘আমার তুলতুল পাখি কোথায়?’
আমি দরজা লাগিয়ে ওনার পেছন পেছন এসে গাঢ় স্বরে বললাম-
‘সব সময় আমার তুলতুল পাখি, আমার মেয়ে এসব বলেন কেন?’
ধ্রুব সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসলেন বেশ আরাম করে। আমার দিকে চেয়ে ভ্রু জোড়া নাচিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন-
‘আমার মেয়েকে আমার মেয়ে বলবো না তাহলে কার মেয়ে বলবো?’
আমি কন্ঠে ক্ষীণ বিরক্তি ভাব নিয়ে বললাম-
‘অদ্ভুত তো! তুলতুল কি আপনার একার মেয়ে নাকি যে সব সময় আমার আমার করতে হবে!’
‘অবশ্যই আমার মেয়ে। তাই আমার মেয়ে, আমার তুলতুল এসবই বলবো। তাতে আপনার কি?’
ধ্রুবর ত্যাড়া কথায় আমার মেজাজ খারাপ হলো। অসহ্যকর! মেয়েদের মতো কিভাবে গায়ে পরে ঝগড়া করছেন! আমি ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই মনি মা তুলতুলকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসলেন। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
‘কি নিয়ে এত তর্ক করছিস!’
মনি মা ধ্রুবর পাশে বসতেই ধ্রুব তুলতুলকে নিজের কোলে নিয়ে নিলেন। তুলতুলের গালে চুমু দিয়ে আড় চোখের আমার দিকে চেয়ে বললেন-
‘বুঝলে তো মা! আমার তুলতুলকে এখন আমার বললেও কিছু মানুষের শরীর ছ্যাত করে জ্বলে ওঠে।’
‘আপনার মেয়ে আপনার মেয়ে কি? তুলতুলকে কি আপনি একা জন্ম দিয়েছেন না-কি! তুলতুল আমারও মেয়ে।’
ধ্রুবর কথায় বিরক্ত হয়েই মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেললাম। তৎক্ষনাৎ নিজের কথাতেই লজ্জায় চুপসে গেলাম। মনি মা বুঝলেন আমার অস্বস্তি বোধ তাই তিনি কথা পালটানোর জন্য বললেন-
‘তোরা থাম তো বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করিস না। তুলতুল নিজেই বলবে ও কার মেয়ে।’
আমি মাথা তুলে তাকালাম তাদের দিকে। ধ্রুব মিটমিট করে হাসছেন। ওনার হাসিতে আমি আবারও লজ্জা পেলাম। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ সরিয়ে নিলাম। মনি মা তুলতুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য হাতে তালি দিয়ে আদুরে গলায় বললেন-
‘দিদা বলো তো তুমি কার মেয়ে? মাম্মা’র নাকি পাপ্পা’র!’
তুলতুল কি বুঝলো জানি না। তবে সে খিলখিল করে হেসে ফেলল। কিন্তু কিছু বলল না। খানিকক্ষণ বাদেই তুলতুল ধ্রুবর কোল থেকে নেমে পুরো ড্রয়িং রুম ঘুরে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে মাম্মা মাম্মা বলে ডাকতে লাগল। আমি তুলতুলকে কোলে নিয়েই বিশ্বজয়ী হাসি দিলাম। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললাম-
‘দেখলেন তো তুলতুল কার মেয়ে? তাই এখন থেকে আমার আমার করবেন না। হয় আমাদের মেয়ে বলবেন নাহলে কিছুই বলতে পারবেন না।’
ধ্রুব তার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সোফা থেকে উঠে শার্ট ঝাড়া দিয়ে মিনমিনিয়ে বললেন-
‘পুরো বাড়িটাই আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে। প্রতিটা মানুষ আমার বিপক্ষে স্বরযন্ত্র করছে। সবগুলো রাজাকার। আর এই যে তুলতুল পাখি আপনি আবার আমার কাছে কিছু চেয়ে আবদার করলে তখন বোঝাবো এই বিরোধী দল কি কি করতে পারে।’
ধ্রুব তুলতুলের গালে টান দিয়েই রুম চলে গেলেন। মনি মা আর আমি সশব্দে হেসে ফেললাম ধ্রুবর কথা শুনে। তুলতুল আমাদের হাসি দেখে বেশ উৎসাহ পেল। আমার কোল থেকে নেমে চোখ বন্ধ করে খিলখিল করে হাসতে হাসতে লাগল। আধো আধো বুলিতে অস্ফুটস্বরে বলল-
‘লাজাকার.. লাজাকার…’
আমি আর মনি মা দুজনেই বিস্মিত হয়ে তুলতুলকে দেখতে লাগলাম৷ তুলতুল হাতে তালিয়ে লাফাচ্ছে আর ভীষণ আগ্রহ নিয়ে লাজাকার লাজাকার বলছে। তাল হারিয়ে সামনের দিকে উবু হয়ে পরে যাচ্ছে আবারও উঠে সেই একই কথা বলে যাচ্ছে। হয়তো শব্দটা তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি বিরক্তি নিয়ে মনি মা’কে বললাম-
‘দেখেছো মনি মা তোমার ছেলে এসব কি শিখিয়ে গেল?’
মনি মা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ক্ষীণ স্বরে বললেন-
‘তোরা সবাই আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বি।’
আব্বু আজ সকালেই ব্যবসায়ের কাজে সিলেট গেছে। তাই মনি মা তুলতুলকে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে। তুলতুলকে মনি মা’র রুমে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আসতে আসতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল। রুমে ডুকেই ধ্রুবকে শুয়ে শুয়ে ফোন টিপতে দেখলাম। আমি সেদিকে এক ঝলক তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে আপনমনে চুল আঁচড়াতে লাগলাম। চুল গুলো হাত খোপা করে বিছানার কাছে আসতেই ধ্রুব বললেন-
‘আসুন তুলতুলের আম্মু।’
ধ্রুব বিছানায় শুয়েই এক হাত বাড়িয়ে চোখের ইশারায় আমাকে তার বুকে আসতে বললেন। বাচ্চাদের যেমন করে নিজের কাছে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয় ঠিক সেভাবেই। আমার কপাল কুচকে এলো। সরু চোখে ওনার দিকে চেয়ে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম-
‘আসুন মানে? কোথায় আসবো?’
‘কোথায় আবার আমার বুকে।’
ধ্রুবর সহজ সরল জবাবে আমার চাহনি আরও তীক্ষ্ণ হলো। বললাম-
‘বুকে কেন?!
ধ্রুব ভ্রুক্ষেপহীন গলায় বললেন-
‘আপনি তো কান্না করার জন্য আর ঘুমানোর জন্য আমার বুক শেয়ারে নিয়েছেন তাইনা! তাহলে আসুন ঘুমানোর সময় হয়েছে তো।’
‘আপনি আবারও আমার সাথে মজা করছেন?’
ধ্রুব অমায়িক ভঙ্গিতে হেসে বললেন-
‘আপনার সাথে কি আমার মজা করার সম্পর্ক নাকি যে মজা করবো? আসুন আসুন বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যান। অনেক রাত হয়ে গেছে।’
আমি লাইট অফ করে বিছানার একপাশে শুয়ে তিক্ত গলায় বললাম-
‘সারাদিন অনেক সময় পাবেন আমাকে নিয়ে মজা করার জন্য। তাই রাত-বিরেতে এসব ফাজলামো না করে ঘুমান।’
‘ভালো কথা বললেই দোষ।’
ধ্রুব উদাসীন গলায় কথাটা বলে অন্য পাশ ফিরে শুলেন। আমি ওনার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে ধ্রুবর বুকে আবিষ্কার করলাম। ওনার বুকে কিভাবে আসলাম! কখন আসলাম! তা আমি কিছুই জানি না। ঘুমের মধ্যে বেশি নাড়াচাড়া করার অভ্যাস কিংবা কারও গায়ে হাত পা তুলে দেওয়ার অভ্যাসও আমার নেই। তাহলে কিভাবে ওনার কাছে এলাম? তাহলে কি ধ্রুব এনেছেন? ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কে এর কোনো উত্তর পেলাম মা। আর কোনো কিছু না ভেবে খুব সাবধানে ওনার হাত ছড়িয়ে উঠে বসলাম। সরু চোখে তাকিয়ে পরোখ করতে লাগলাম ওনাকে। উনি কি ঘুমের মধ্যে আমাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন? আমি নিম্ন স্বরে ওনাকে ডাকলাম। কিন্তু তিনি উঠলেন না। বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। আমি ওনার ঘুমের ডিস্টার্ব না করে উঠে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় আসতেই বেলি গাছে ফুটন্ত বেলি ফুল দেখে আনন্দে মন ভরে গেল। বৃষ্টি ভেজা স্নিগ্ধ শুভ্র রঙের ফুল। মুগ্ধতায় আমার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো। আবারও ফিরে আসলাম রুমে। ধ্রুবর হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললাম-
‘তুলতুলের আব্বু উঠুন। আপনার বেলি গাছে ফুল ফুটেছে। আসুন না দেখে যান।’
বেশ কিছুক্ষন ডাকার পর ধ্রুব দারুন বিরক্তি নিয়ে উঠে বসেন। চোখ মুখ খিঁচে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন-
‘কি শুরু করলেন সকাল সকাল? এভাবে তো তুলতুলও আমাকে ডেকে ওঠায় না।’
আমি কোনো জবাব না দিয়ে ওনার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে আসলাম। গাছ গুলোর সামনে দাঁড় করিয়ে আনন্দিত গলায় বললাম-
‘দেখুন আমি আমার দায়িত্ব পূরণ করেছি। গাছের ঠিক মতো যত্ন নিয়েছে আর এখন দেখুন ফুলও ফুটে গেছে।’
ধ্রুব চুপচাপ কিছুক্ষন গাছের দিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। আড়মোড়া ভেঙে আমার দিকে শীতল চাহনি দিয়ে বললেন-
‘হুম দায়িত্ব নেওয়া শিখেছো এখন শুধু ফুলগুলো সব ভালোবাসা হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। ফুলের স্নিগ্ধতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলার পালা সানসাইন।’
চলবে….
#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৯
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
‘তুলতুলের আম্মু একটু এদিকে আসুন তো।’
ধ্রুবর গলা ফাটানো ডাকে আমি দ্রুত পায়ে ছুটে আসলাম রুমে। ধ্রুব তার ঘামে ভেজা শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়। দু হাত দু’দিকে ছড়িয়ে রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে রাখা। পা দুটো বিছানার বাহিরে ঝুলছে। যেন কোনো বলহীন শরীর পরে আছে। আমি কিছুটা এগিয়ে এসে সহসা উদ্ধিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলাম-
‘কি হলো ডাকছেন কেন? কিছু লাগবে?’
গত দু’দিন ধরে ভীষণ গরম পরেছে। উত্তপ্ত সূর্যের রশ্মি কাঁটার মতো বিঁধে যেতে চায় শরীরে। দিনের শেষ বেলাতেও এসে থেকে যায় প্রখর রোদের রেশ। ধ্রুব অফিস থেকে আসার মিনিটখানেক আগেই কারেন্ট গেছে। আধঘন্টা হতে চলল অথচ এখনও কারেন্ট আসার নাম নেই। তিনদিন ধরে গাড়ি না থাকায় এই তীব্র গরমেই রিকশায় যাতায়াত করছে সে। আব্বু বাসার গাড়ি নিয়ে সিলেট গেছে। আর অফিসের গাড়ি সে নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করতে নারাজ। নারী কর্মচারীদের জন্য রাখা গাড়ি যদি সে নিজেই ব্যবহার করে তাহলে রাতবিরেতে অফিসের মেয়েদের বাসায় পৌঁছে দেওয়ায় ঝামেলা হবে। অফিসের মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়েও ধ্রুব বেশ সচেতন। এই নির্লিপ্ত মানুষটা যেন সব কিছুরই খেয়াল রাখে। নিজের অসুবিধে হলেও অন্যদের যেন কোনো অসুবিধে না হয়।
ধ্রুব উঠে দু’হাত পেছনের দিকে ভর দিয়ে বসলেন। তার শার্টের উপরে তিনটা বোতাম খোলা। বুকে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। ক্লান্তিমাখা তার মুখ। ঠোঁটের কোণে তরল ভঙ্গির হাসি। তার বড় বড় চোখের ক্লান্তিমাখা বিষন্ন চাহনি স্থির করলেন আমার চোখে। ঠোঁট নাড়িয়ে অলস ভঙ্গিতে বললেন-
‘কেন! কোনো কারণ ছাড়া আপনাকে ডাকা বারণ বুঝি?’
আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম-
‘না না তা কেন হবে! আসলে তুলতুলকে খাওয়াচ্ছিলাম তো তাই আরকি।’
ধ্রুব উঠে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ওনাকে কাছে আসতে দেখেই ভীষণ অস্বস্তিতে দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। তিনি ঝুঁকে তার মুখ নিয়ে এলেন আমার কানের কাছে। ফিসফিসিয়ে বললেন-
‘শুধু কি মেয়ের খেয়াল রাখলেই হবে? মেয়ের আব্বুকেও তো একটু সময় দিতে হবে।’
ধ্রুবর এতটা কাছে আসা আর তার ফিসফিসিয়ে কথা বলায় আমার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এলো। বুকের ধুকপুকানি তীব্রভাবে বেড়ে যেতে লাগল। পাজরের হাড়গোড় ভেঙে এখনই যেন হৃদপিণ্ডটা লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভ্যাপসা গরমেও শরীরে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় শুকনো ঢোক গিললাম। মাথা তুলে চোখ দুটো বড় বড় করে চাইলাম। লজ্জা মিশ্রিত দৃষ্টি যেয়ে স্থির হলো ধ্রুবর ঘামার্ত বুকে। চিরচেনা সেই পুরুষালী গন্ধ। যে গন্ধে এখন প্রতিদিন সকালেই আমার দেহের প্রতিটি লোমকূপ শিউরে ওঠে। চারদিন যাবৎ ঘুম থেকে উঠেলেই এই ঘামার্ত বলিষ্ঠ বুকে নিজেকে খুঁজে পাই৷ রাতে দুজন দু’পাশে ঘুমালেও ঘুম ভাঙতেই নিজেকে ধ্রুব বাহুডোরে বন্দী অবস্থায় আবিষ্কার করি। কখন আর কিভাবে এমনটা হয় তা আমার জানা নেই৷ রহস্যময় হয়ে থাকে আমার প্রতিটি সকাল।
‘এই যে তুলতুলের আম্মু! কোথায় হারিয়ে গেলেন?’
আমার ধ্যান ভাঙলো। আগ্রহ নিয়ে চাইলাম ধ্রুবর দিকে। আমার থেকে দুয়েক পা দূরত্বেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ঠোঁটের কোণের মৃদু হাসিটা প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে পরলো চিবুকে সহ সাড়া মুখে। আমাকে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে শুধালেন,
‘এটা আপনার জন্য।’
আমি তার হাতের ব্যাগটার দিকে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম-
‘কি এটা?’
‘আপনার জিনিস আপনি নিজেই খুলে দেখুন।’
ধ্রুব আমার হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েই পূনরায় বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পরলেন। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে ব্যাগ খুলে দেখলাম। ধ্রুবর দিকে চোখ বড় বড় তাকিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে বললাম-
‘নতুন ফোন! কিন্তু ফোন দিয়ে কি করবো আমি?’
‘সেদিন তো একটা ফোনের হ’ত্যা করলেন। তাই দ্বিতীয় হ’ত্যা কার্য সম্পূর্ণ করার জন্য এটা এনে দিলাম। নিশ্চিন্তে পরিকল্পনা করে তারপরেই হ’ত্যা করবেন। তেমন কোনো তাড়াহুড়ো নেই।’
ধ্রুবর রসিকতায় আমি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম-
‘আমার সাথে এসব রসিকতা না করলে কি ভালো লাগে না?’
ধ্রুব জবাব দিলেন না। সব সময়ের মতোই হাসলেন। আমি হতাশ হয়ে মিহি কন্ঠে বললাম-
‘আমার তো ফোনের দরকার ছিল না। শুধু শুধু কেন টাকা নষ্ট করে ফোন কিনে আনলেন আপনি?’
ধ্রুব উঠে আবারও আমার কাছে আসলেন। গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন আমার প্রশ্নাত্মক চোখের দিকে। ঘামে কপালে লেপ্টে থাকা আমার চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে উদাসীন গলায় বললেন-
‘এখন দরকার না থাকলেও কিছুদিন পর দরকার হবে। তোমার জন্য না হলেও আমার ভীষণ প্রয়োজন পরবে সানসাইন।’
ধ্রুব রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি ওনার কথার মানে না বুঝে বিমূঢ় দৃষ্টি তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলাম। মাঝেমধ্যে খুব অদ্ভুত আচরণ করেন উনি। ভীষণ প্যাচানো ধরনের কথাবার্তা বলে আমার মাথা এলোমেলো করে দেন। আমি কিছুই বুঝি না ওনার এমন প্যাচানো কথা। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।
‘অনু আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
খাবার টেবিলে মনি মা’র গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে মাথা তুলে তাকালাম। সহসা খানিক কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম-
‘কিসের সিদ্ধান্ত মনি মা!’
‘দু’দিন পর থেকে তুই তোর মা’র বাসায় থাকবি। ধ্রুব তোর সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে দু’দিন পর তোকে ওই বাসায় দিয়ে আসবে।’
আমি হতভম্ব হয়ে স্থির বসে রইলাম। অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে কখনো মনি মা, কখনো ধ্রুব আর কখনও আব্বুর দিকে তাকাতে লাগলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম পরিস্থিতি। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। সবাইকে স্বাভাবিক লাগছে। এ বিষয়ে আমি অবগত না থাকলেও তাদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক আগেই আলোচনা হয়েছে তা তাদের ভাবগতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি নিজেকে যথাসাধ্য সামলিয়ে নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম-
‘কি বলছো মনি মা? ওই বাসায় কেন থাকবো?’
মনি মা জবাব দিলেন না। আমি উত্তরের আশায় ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকালাম। ধ্রুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই খাচ্ছেন। মনি মা আর আমার কোনো কথাই যেন তার কানে যাচ্ছে না। মনি মা তার আচল দিয়ে তুলতুলের মুখ মুছে গম্ভীরমুখে বললেন-
‘যা বলছি ঠিক বলছি। পাঁচ দিন পর তোর এক্সাম। এখানে থাকলে তোর পড়াশোনা কিছুতেই হবে না। সারাক্ষণ তুলতুলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবি। পরিক্ষার পড়া কিছুই পড়তে পারবি না৷ বিয়ের জন্য পড়াশোনায় এমনিতেও অনেক পিছিয়ে গেছিস৷ তা ছাড়া এখান থেকে তোর ভার্সিটি অনেকটা দূর হয়ে যায়৷ প্রতিদিন এতটা পথ জার্নি করে পরিক্ষা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। তাই আমি ঠিক করেছি পরিক্ষা শেষ না হওয়া অব্দি তুই ওই বাসায় থাকবি।’
আমি ভড়কে গেলাম। ভীষণ অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। তুলতুল আর বাকি সবাইকে ছাড়া থাকবো ভেবেই বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। গলার স্বর আটকে গেল। কি বলবো না বলবো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। দলা পাকিয়ে গেল সব কিছু। চোখদুটো ভীষণ আবেগে ঝাপসা হয়ে এলো৷ মনি মা আমার প্রতিত্তোরে অপেক্ষা করলেন না। তুলতুলকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন রুমে। আমি আহত দৃষ্টিতে একবার ধ্রুবর দিকে দিকে আরেকবার আব্বুর দিকে তাকালাম। আব্বু খাওয়া শেষে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-
‘মন খারাপ করিস না মা। তোর মা এসব নিয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস। নিজের সিদ্ধান্তে সব সময়ই অটল থাকবে। কারও কোনো কথাই শুনবে না।’
একে একে সবাই চলে গেল। আমি এখনও স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। ধ্রুবও কিছু বললেন না। একবারও মনি মা’কে বাধা দিলেন না। আমাকে আশ্বস্ত করার জন্যেও কিছু বললেন না। কেন এমন নিষ্ঠুরতা করছেন আমার সাথে? আমি কোনো রকম ডাইনিং টেবিলের সব কিছু গুছিয়ে ড্রয়িং রুমে আসলাম। ধ্রুব আর আব্বু সোফায় বসে অফিসের কাজ নিয়ে আলোচনা করছেন। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মনি মা’র রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। দরজার কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালাম। ভয় করছে খুব। বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে তীব্র গতিতে। চেনা মানুষটাকেও ভীষণ অচেনা লাগছে। ভয় লাগছে। আমি ইতস্তত করে বললাম-
‘মনি মা আসবো?’
‘আমার রুমে আসতে অনুমতি নেওয়া শুরু করলি কবে থেকে? থাপ্পড় খেতে না চাইলে চুপচাপ এসে বস এখানে।’
মনি মা দারুণ বিরক্তি নিয়ে কথা গুলো বললেন। তবে একবারের জন্যেও আমার দিকে ফিরে তাকালেন না। আমি থমথমে পায়ে রুমে এসে বিছানার এক পাশে কাচুমাচু হয়ে বসলাম। অনেক কথা বলার আছে। তবে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না। মনি মা তুলতুলের মাথায় তেল দিতে দিতে সহজ গলায় বললেন-
‘আমি জানি তুই কি বলতে চাচ্ছিস। কিন্তু তার আগে আমার কিছু কথা আছে তোকে বলার জন্য। সে গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবি তারপর তোর যা ইচ্ছে হয় করিস।’
চলবে…
#শেষ_রাত
#পর্বঃ২০
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
‘আমি তোকে কখনো মোহনার থেকে আলাদা মনে করিনি অনু৷ তোর জন্মের পর দিনের বেশির ভাগটা সময় তুই আমার কাছে আর মোহনার কাছেই ছিলি। যদিও বা ধ্রুবর আব্বুর বিজনেসের জন্য আমরা সপরিবারে সিলেট চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোর আম্মুর কাছে প্রায়ই তোর খোঁজ নিতাম। তুই হয়তো জানিস না মোহনা বিয়ে করেছিল ভালোবেসে। তবে বিয়ের পর সেই ভালোবাসা আর বেশিদিন ছিল না। শ্বশুর বাড়ির নানান ঝামেলায় আমার মেয়েটা মানসিক ভাবে ভেঙে পরেছিল। তাই হয়তো তুলতুলকে জন্ম দেওয়ার সময় বেঁচে থাকার জন্য মানসিক শক্তিটুকু পায়নি। হাঁপিয়ে উঠেছিল নিজের জীবন নিয়ে। তাই হয়তো হার মেনে নিয়েছে।’
মনি মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। খানিক্ষন চুপ থেকে আবারও বলতে লাগলেন-
‘তোকে আমি সেদিন পার্কে দেখা মাত্রই চিনে ফেলেছিলাম। তোর ওভাবে ভেঙে পরা দেখে মনে হচ্ছিল আমি মোহনাকেই দেখছি। ভীষণ কষ্ট হয়েছিল সেদিন। কিন্তু তুলতুলের জন্য তোকেই নিজের ছেলের বউ করে নিয়ে আসতে হবে সেটা ভাবিনি। তুই যখন ছোট ছিলি তখন নিছকই মজার ছলে তোর মাকে বলেছিলাম তোর সাথে ধ্রুবর বিয়ে দিবো। কথাটা সত্যি হয়েছে। মনি আন্টি থেকে মনি মা হয়েছি। তবে তোকে কখনোই আমি ছেলের বউ হিসেবে দেখিনি। সব সময় নিজের মেয়ে মনে করেছি। তাই আমি তোর বিষয়ে কোনো হেয়ালি করতে চাই না। মোহনার খুব ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কিন্তু বিয়ের পর এত ঝামেলা আর মানসিক চাপের জন্য তা আর হয়নি। এই জন্যই আমি চাই না তোর বেলাও সেরকম কিছু হোক। আমি চাই তুই তোর পড়াশোনা ঠিক মতো চালিয়ে যা। তারপর না-হয় সংসারে মন দিস তখন আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। আশাকরি তুই আমাকে ভুল বুঝবি না।’
আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম মনি মা’র দিকে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন তিনি। বরাবরের মতোই লুকানোর চেষ্টা করলেন তার সকল কষ্ট। সকল ব্যথা। সব সময় সবাইকে ধমকের উপরে রাখা এই সাহসী নারীরও কষ্ট আছে। চোখ ভিজে আসার মতো বিষন্নতায় ঘেরা কিছু আবেগ আছে। মেয়ে হারানোর কষ্টে কাতর হয়েও সবার মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে শক্ত রাখার দারুণ ক্ষমতা আছে। এক যুগ পর দেখা হলেও ঠিক সেই আগের মতোই মমতায় জড়িয়ে নেওয়ার মতো অসীম ভালোবাসা আছে তার বুকে। এই মানুষটা শুধুই ভালোবাসার৷ যাকে শুধু এবং শুধুই ভালোবাসা যায় কখনও ভুল বুঝা যায় না।
আমি নিঃশব্দে তুলতুলকে মনি মা’র কোল থাকে নামিয়ে আমি নিজেই মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। তুলতুল হামাগুড়ি দিয়ে এসে আমার বুকের সাথে মিশে শুয়ে রইলো। আমি জড়িয়ে ধরলাম তাকে। মনি মাও আমার মাথায় রাখলেন। পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি নিশ্চুপ থেকেই উপলব্ধি করলাম মনি মা’র নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আর আমার বুকের সাথে জড়িয়ে রাখা তুলতুলের প্রতি নিজের দূর্বলতা৷ এই মানুষ গুলো ছাড়া আমি অচল। তাদের ভালোবাসা ছাড়া আমার আর কিছু নেই।
‘ ডাইনিং টেবিলে আমাদের সামনে গম্ভীর গম্ভীর কথা বলার পর এখানে এসে এত ভালোবাসা আসলো কিভাবে? তা তোমার সব রাগী রাগী ভাব কি শুধু আমার সামনেই দেখাও না-কি মনি?’
আব্বুর কথায় মনি মা তীক্ষ্ণ চোখে ওনার দিকে তাকালেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন-
‘আপনারা বাপ ছেলে যেমন আপনাদের সাথে তেমন করেই কথা বলি বুঝলেন!’
আব্বু কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম-
‘থামো তোমরা। আমি এখান থেকে যেয়ে নেই তারপর আবার শুরু করো কেমন!’
আমি মনি মা’র কোল থেকে মাথা তুলে উঠে বসতেই খেয়াল করলাম তুলতুল ঘুমিয়ে পরেছে। আমি খুব সাবধানে তুলতুলকে কোলে নিয়ে বেড রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। পেছন থেকে মনি মা আর আব্বুর ঝগড়া শোনা গেল। আব্বুও পারে বটে। সারাক্ষণ মনি মা’কে না ক্ষেপালে তার হয়তো ভালোই লাগে না। ইচ্ছে করে মনি মা’কে রাগায়। আর মনি মা সবটা জেনেও কৃত্রিম রাগ নিয়ে আব্বুর সাথে ঝগড়া করে। এটাই হয়তো তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এভাবে ঝগড়া করেই হয়তো কাটিয়ে দিবে সারাজীবন।
চোখের পলকের শেষ হয়ে এলো দু’দিন। ধ্রুব নিজেই আমার সকল বই খাতা আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গাড়িতে নিয়ে রাখছেন। তার মধ্যে বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়নি দু’দিনে। আমার চলে যাওয়া নিয়ে আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। পুরোটা সময় ছিল স্বাভাবিক। আমি চলে যাওয়াতে কি তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই?? উনি কি এমনটাই চেয়েছিলেন! এতেই কি খুশি! না-কি অন্য কিছু!! আমিই বুঝতে ভুল করছি!
‘চলো তুলতুলের আম্মু। গাড়িতে সব কিছু রাখা হয়ে গেছে।’
ধ্রুবর কথায় আমি আহত দৃষ্টিতে একঝলক তার মুখপানে তাকালাম। দৃষ্টি সরিয়ে স্থির করলাম মনি মা’র দিকে। ঠোঁট প্রসারিত করে মলিন হাসলেন মনি মা। আমি তৎক্ষনাৎ ওনাকে জড়িয়ে ধরলাম। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সবাইকে ছেড়ে যেতে। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। মনি মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-
‘ধুর বোকা মেয়ে। এভাবে মন খারাপ করছিস কেন? মনে হচ্ছে আমি একেবারের জন্য তোকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। মাত্র তো কয়েকদিনের ব্যাপার। আর তা ছাড়া তোর বন্ধের দিন আমি তো যাবোই তুলতুলকে নিয়ে। আর আমি যেতে না পারলেও ধ্রুব তোকে নিয়ে আসবে। তারপর পরিক্ষা শেষ হলে একেবারেই নিয়ে আসবো। মন খারাপ করিস না।’
আমি মাথা নাড়িয়ে জোরালো কন্ঠে বললাম-
‘নিজের খেয়াল রেখো মনি মা। আর তুলতুলকেও দেখে রেখো।’
আমি মনি মা’কে ছেড়ে তুলতুলকে কোলে নিলাম। তুলতুল হাসছে। মেয়েটা সব সময়ই হাসি খুশি থাকে। আচ্ছা আমাকে না পেলে কি কান্না করবে? এতগুলো দিন আমাকে না দেখে ভুলে যাবে না তো!!
তুলতুল আমার গালে তার ঠোঁট ঘষছে। আস্তে আস্তে করে কামড় দিচ্ছে আমার গালে। আমি হাল্কা হেসে তুলতুলের গালে চুমু দিয়ে বললাম-
‘মাম্মা খুব তাড়াতাড়ি এসে পরবে তুলতুল। একদম কান্না করবে না ঠিক আছে?’
তুলতুলে হাত তালি দিয়ে থেমে থেমে অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করলো-
‘মাম্মা ঘুরে.. যাবো।’
ধ্রুব তাড়া দিতেই মনি মা তুলতুলকে আমার কোল থেকে নিতে চাইলো। তবে তুলতুল যাচ্ছে না। শক্ত করে ঝাপটে ধরে আছে আমাকে। মনি মা বেশ কয়েক বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তুলতুল কিছুতেই আমাকে ছাড়তে রাজি না। আর কোনো উপায় না পেয়ে জোর করে আমার কাছ থেকে নিয়ে নিলো তুলতুলকে। সাথে সাথেই তুলতুলের কান্না শুরু হলো। চেচিয়ে চেচিয়ে বলে উঠলো- ‘মাম্মা ঘুরে যাবো। মাম্মা ঘুরে যাবো।’
আমার মন খারাপ হলো ভীষণ৷ মেয়েটা হয়তো ভেবেছিলো আমি তাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। মনি মা তুলতুলের কান্না থামানোর চেষ্টা করতে করতে বললেন-
‘তোরা যা আমি ওকে সামলাচ্ছি। আর অনু তোর তুলতুলকে নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হবে না। ওর কান্না একটু পরেই থেমে যাবে।’
আমি কিছুই বললাম না। পুরোটা সময় চেয়ে থাকলাম তুলতুলের দিকে। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কান্না করছে তুলতুল৷ আমার কাছে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। জেদ দেখাচ্ছে। চোখের জলে সারা মুখ লেপ্টে গেছে। সাথে সাথেই মুখ লাল হয়ে গেছে তার। আমি এগিয়ে যেতে নিলেই ধ্রুব আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেন। আমাকে গাড়িতে বসিয়ে দিতে দিতে বললেন-
‘সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তুলতুলের আম্মু। তাড়াতাড়ি বসুন তো। আমাকে আবার রাতে একবার অফিসে যেতে হবে।’
আমি বসলাম। গাড়ি ছাড়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তাকিয়ে থাকলাম বাড়ির দিকে। দূরত্ব বাড়ছে সেই সাথে চোখের আড়াল হচ্ছে সব কিছু। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। না চাইতেও চোখে জল আসলো। অনিচ্ছাতেই সেই জল গড়িয়ে পারল গাল বেয়ে।
‘আমার জানা মতে মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় কান্না করে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে সেটা উল্টো হচ্ছে কেন? বাপের বাড়ি যাচ্ছেন ভেবে তো আপনার খুশিতে নাচানাচি করার কথা। তা না করে ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করছেন। এটা কেমন কথা?’
আমি অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালাম ধ্রুবর দিকে। নির্বিকার ভঙ্গিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। কান্নার মাঝেও ক্ষীণ রাগ এসে ঝাপটে ধরলো আমাকে। বিরক্তিতে কপাল কুচকে এলো আমার। কান্না থামিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। ধ্রুব আমার চাহনি বুঝতে পেরে আড় চোখে পর পর কয়েকবার তাকালেন। গলা পরিষ্কার করে মিনমিনিয়ে বললেন-
‘আমি কি করলাম? আমাকে রাগ দেখাচ্ছেন কেন? চোখ দেখে তো মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই আমাকে ঝলসে দিবেন। আপনার দৃষ্টিতে পুড়ে ছারখার করে দিবেন আমাকে।’
‘আপনি কি থামবেন তুলতুলের আব্বু? আমাকে না রাগালে আপনার ভালো লাগে না তা-ই না?’
আমার কঠিন বাক্য ধ্রুবকে তেমন একটা প্রভাবিত করলো না। তিনি তার মতোই স্বাভাবিক। কোনো হেলদোল হলো না তার মাঝে। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে রইলাম। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল৷ ধ্রুব বেশিক্ষণ থাকলেন না। সবার সাথে কুশল বিনিময় কিরেই আবারও বেরিয়ে পরছেন যাওয়ার জন্য। আম্মু’র কথা মতো আমিও ধ্রুবর পেছন পেছন গেইট পর্যন্ত আসলাম তাকে বিদায় জানাতে। হঠাৎ করেই ধ্রুব আমার দিকে ফিরে তাকালেন। দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে শীতল কন্ঠে বললেন-
‘আসুন আমাকে একটা টাইট হাগ দিন।’
আমি বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকে চাইলাম। রাত বাতির নিয়ন আলোয় তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো ঝলঝল করছে সোডিয়ামের আলোয়। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি। আমি সহসা অবাক করা কন্ঠে প্রশ্ন করলাম-
‘মানে কি বলছেন?’
ধ্রুব হাসলেন। বরাবরের মতোই শান্ত গলায় বললেন-
‘তাড়াতাড়ি আসুন আমাকে একটা হাগ দিয়ে দিন। আমি চলে যাচ্ছি৷ তুলতুলকে কাঁদিয়ে এসেছেন। আমি গেলেই তো মেয়েটা জিজ্ঞেস করবে তার মাম্মার কথা। তখন আমি না হয় আপনার পক্ষ থেকে একটা টাইট হাগ দিয়ে দিবো। কিন্তু আমার কাছে তো মায়েদের মতো অসাধারণ মমতা আর তার গায়ের গন্ধ নেই। তাই আপনার কাছ থেকে একটু মমতা আর গায়ের গন্ধ নিজের সাথে করে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।’
আমি হতবাক হয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম। বাকরুদ্ধ অবস্থা আমার। কি বলবো ওনাকে! জড়িয়ে ধরবো কি-না সেটাও বুঝতে পারলাম না। আমার দুর্বল মস্তিষ্ককে আর কষ্ট করে কিছু ভাবতে হয়নি। তার আগেই ধ্রুব আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। নিঃশব্দে মুখ গুজে দিলেন আমার ঘাড়ে। আমি থমকে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগলাম রাস্তার আশেপাশে কেউ আছে কি-না। ভাগ্য সহায় হলো। রাস্তায় একটি মানুষও দেখা গেল না। পুরো ফাঁকা নির্জন রাস্তা। আমি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে ধ্রুবর পিঠে আলতো করে হাত রাখলাম। ধ্রুবর নেড়েচেড়ে উঠলেন। আমার ঘাড়ের কাছে থাকা তার ওষ্ঠদ্বয় যুগল নাড়িয়ে অত্যন্ত নরম গলায় বললেন-
‘একটা কথা মনে রেখো সানসাইন, দূরত্ব সব সময় শুধু কষ্টদায়ক হয় না। কিছু কিছু দূরত্ব কষ্টের ফল হিসেবে অনেক কিছু ফিরিয়ে দেয়। ভালোর জন্যেও মাঝে মাঝে দূরত্বের প্রয়োজন হয়।’
ধ্রুব তার কথা শেষেই আলতো করে তার ওষ্ঠদ্বয় আমার ঘাড়ে ছুঁয়ে দিলেন। আমি কেঁপে উঠলাম। পুরোপুরি ঘটনা বুঝে মস্তিষ্ক সচল হয়ে ওঠার আগেই গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ পেলাম। ধ্রুব চলে গেছে। তার গাড়ি দৃষ্টির আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি তাকিয়ে থাকলাম। শূন্য রাস্তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে যন্ত্রের মতো পা ফেলে ফিরে আসলাম বাসায়।
কেটে গেল আরও দু’দিন। পড়াশোনায় নিজেকে সারাক্ষণ ডুবিয়ে রাখলাম। সকল চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে শুধুই বই পড়ালাম। পরিক্ষার প্রস্তুতি নিলাম। এত এত ব্যস্ততার মাঝেও কিছু কিছু জিনিসের অনুপস্থিতি আমার দীর্ঘ শ্বাসের কারণ হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে খালি বিছানায় দেখে বুক চিড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়েছে। খাবার টেবিলে বসে মনি মা, তুলতুল আর আব্বুকে দেখতে না পেয়ে মন খারাপ হয়েছে। বারান্দায় এসে ধ্রুবর বেলি গাছ না দেখে বুকে তীব্র হাহাকার অনুভব করেছি। সারা বাড়ি জুড়ে তুলতুলের ছুটোছুটি করা আর মাম্মা ডাক শোনা ভীষণ মিস করেছি। মনি মা আর তুলতুলের সঙ্গে দু’দিন কথা হলেও ধ্রুবর সঙ্গে কথা হয়নি। ধ্রুবর দেওয়া ফোন দিয়েই কথা বলেছি মনি মা’র সাথে। তবে ধ্রুবকে কল দেওয়ার সাহস আর কারণ কোনোটাই খুঁজে পাইনি।
কলিং বেলের শব্দ পেলাম তবুই গেলাম না। আম্মু আছে, ভাইয়া আছে তারাই খুলবে। আমি আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলাম ফাঁকা বারান্দায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার আকাশ। কালো মেঘে ঢেকে আছে। কিছুক্ষণ বাদেই বৃষ্টি নামবে বোধহয়।
মিনিট পাঁচেক পর কেউ একজন দরজা ঠেলে রুমে আসলো। শব্দ পেলেও আমি তবুও পেছন ফিরে তাকালাম। ভাবলাম আম্মু হয়তো এসেছে পড়াশোনার খোঁজ নিতে। কিন্তু আমার ধারনা ভুল হলো। পুরুষালি কন্ঠে কেউ একজন ডাকলো আমায়-
‘তুলতুলের আম্মু?’
আমি চমকে গেলাম। দ্রুত রুমে এসে দেখলাম ধ্রুব বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে। আমাকে দেখা মাত্রই বুকে হাত দিয়ে অস্ফুটস্বরে থেমে থেমে বললেন-
‘আমার বুকে ভীষণ ব্যথা করছে তুলতুলের আম্মু। কিছুটা হয়েছে আমার বুকে। আমি টের পাচ্ছি সেই জিনিসটার উপস্থিতি। মাঝেমধ্যে ভীষণ ভারী হয়ে যায় বুক তখন তীব্র যন্ত্রণা করে। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আমার খুব ভয়ংকর কিছু হয়েছে আমি বুঝতে পারছি তুলতুলের আম্মু।’
ধ্রুব কথা গুলো বলেই হাঁপাতে শুরু করলেন। বুকে হাত দিয়ে বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি।
চলবে…