#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৫
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
ঘুম ভেঙেই নিজেকে ধ্রুবর বাহুডোরে দেখে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। রাতে করা নিজের বোকামির কথা ভেবেই লজ্জা পেলাম খুব। খানিকটা অবাক হলাম ধ্রুবর ব্যবহার আর তার কথা গুলো মনে করে। সবার সামনে আমাকে তুমি সম্মোধন করলেও যখন আমরা একা থাকি তখন কখনই তিনি আমাকে তুমি সম্মোধন করেননি। কিন্তু কাল রাতে কি অদ্ভুত ভাবেই না কথা বললেন। কিন্তু কেন? আর আমিই বা কেন ওনার বুকে নিজের ঠাঁই খুঁজে নিতে চাইলাম। কেন ওনার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে চাইলাম আমি? প্রশ্ন গুলো দিশেহারা হয়ে আমার মস্তিষ্কের পুরোটা জায়গা জুড়ে ঘুরতে লাগল। তবে কোনো উত্তর এলো না মস্তিষ্ক থেকে। আমি নেড়েচেড়ে উঠলাম। ধ্রুবর বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। কিন্তু হলো তার বিপরীতে। ধ্রুব আরও শক্ত করেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন-
‘উফফ তুলতুলের আম্মু! সাপের মতো এভাবে মোচড়ামুচড়ি করছেন কেন? আমার জানামতে আমি তো কোনো নাগিন মেয়ে বিয়ে করি নি।’
ওনার কথায় ক্ষীণ রাগ নিয়ে মাথা তুলে তাকাতে চাইলাম কিন্তু সম্ভব হলো না। আমি হাল ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে শুয়ে রইলাম। দারুণ অস্বস্তি নিয়ে মিনমিনিয়ে বললাম-
‘আমাকে ছাড়ুন। আমি উঠবো।’
ধ্রুব আমাকে ছাড়লেন না বরং আমাকে লজ্জায় ফেলার মতো কিছু ভয়ংকর কথাবার্তা বলা শুরু করলেন,
‘কাল রাতে তো আমার পারসোনাল বুকের ভেতর একদম ডুকে যেতে চাচ্ছিলেন। তখন তো আমি বাধা দেইনি। তাহলে এখন কেন এতো লজ্জা পাচ্ছেন?’
আমি লজ্জা আর অস্বস্তিতে চুপ করে করে থাকলাম। ধ্রুবর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলাম না বা খুঁজতে চাইলাম না। ধ্রুব হয়তো বুঝলেন আমার মনের অনুভূতি। তিনি খুব সাবধানেই তার বাহুডোর থেকে আমাকে মুক্ত করলেন। খাঁচায় বন্দী থাকা পাখির মতোই আমি মুক্তি পেতেই ঝটপট করে উঠে বসলাম। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়েই নিজেকে ঠিক করতে ব্যস্ত হলাম। আমার এলোমেলো চুলগুলো হাত খোপা করতেই ধ্রুব আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলেন। অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-
‘আমার পারসোনাল বুকটা আপনার সাথে শেয়ার করলাম। আমার এতো বছরের যত্ন করে রাখা একান্ত ব্যক্তিগত বুকটাতে আপনার জায়গায় দিলাম। তাই বলে যে আপনি কেঁদেকেটে আমার বুক ভাসাবেন আর সারা রাত বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আমার শরীর ঝিম ধরিয়ে ফেলবেন তা তো হবে না। বুকে যেমন জায়গায় দিয়েছি তেমনি আপনারও উচিত সেই বুকটাকে সযত্নে আগলে রাখা, খেয়াল রাখা আর নিয়মিত এর ভাড়া পরিশোধ করা।’
ধ্রুবর এমন উদ্ভট কথাবার্তায় আমি বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
‘ভাড়া কিভাবে দিবো! আর আপনার অতি পারসোনাল বুকের খেয়াল আমি রাখবো কিভাবে?’
‘এখন এত কিছু জানতে হবে না। সময় হলে আমি নিজেই বলে দিবো। আপাতত আপনার নোনাজলে ভেসে যাওয়া আমার টি-শার্টটা ধুয়ে দিলেই হবে।’
ধ্রুব ভ্রুক্ষেপহীন গলায় কথা গুলো বলেই নিজের টি-শার্ট খুলতে লাগলেন। আমি বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। আমতা আমতা করে বললাম-
‘আপনি.. আপনি…!’
আমার কথা জড়িয়ে গেল। ওনাকে বলার জন্য কথা গুছিয়ে নিতে পারলান না। ধ্রুব তার নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন-
‘কি? আপনি আপনি করছেন কেন?’
আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললাম-
‘আপনি নির্লজ্জ। আপনার লজ্জা করে একটা মেয়ের সামনে এভাবে হুটহাট টি-শার্ট খুলে ফেলতে!’
ধ্রুব অবাক করা কন্ঠে বললেন-
‘আমি তো এখানে আমার বিবাহিত বউ ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে দেখছি না তুলতুলের আম্মু। তাহলে লজ্জার কি হলো এখানে? যাই হোক এই নিন টি-শার্ট সময় করে ধুয়ে রাখবেন।’
ধ্রুব তার টি-শার্ট দিয়ে আমার সাড়া মুখ ডেকে দিয়েই ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। লোকটার ভাবগতিক কিছুই বুঝতে পারছি না৷ দিন দিন যেন তার লুকিয়ে রাখা নানান ধরনের রূপ এক এক করে প্রকাশ পাচ্ছে। আমি মুখ থেকে ওনার টি-শার্ট সরিয়ে হাতে নিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম।
‘কিরে তুই কখন এলি?’
সানি তুলতুলের সঙ্গে খেলতে খেলতে এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
‘বেশিক্ষন না মিনিট দশেক হবে।’
আমি সানির পাশে বসে ভ্রু কুচকে সন্দিহান কন্ঠে বললাম-
‘সকাল সকাল এই বাসায় কি ব্যাপার!’
‘কোনো ব্যাপার না। সকাল সকাল তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেছে তাই ভাবলাম তুলতুলের সঙ্গে দেখা করে তোকে নিয়েই এখন থেকে কলেজে যাবো।’
খানিকক্ষণ বাদেই ধ্রুব এসে কুশল বিনিময় করলেন সানির সাথে। কথার এক পর্যায়ে সানি বেশ উৎসুক হয়ে বলল-
‘দুলাভাই আপনি আজ গাড়ি নিয়ে অফিসে চলে যান। অনু আর আমি আজ রিকশা করে যাবো ভার্সিটিতে। অনেক দিন একসাথে যাওয়া হয়না।’
‘এক সাথে যাবে তাহলে আমার গাড়ি দিয়ে যাও। ধুলোবালির মধ্যে রিকশা দিয়ে যাওয়ার কি দরকার!’
ধ্রুবর কথায় সানি হাসতে হাসতে বলল-
‘আমি আর অনু আগে রিকশা দিয়েই যেতাম তাই ওর ডাস্ট অ্যালার্জি নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না।’
ধ্রুব কপাল কুচকে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইলেন। ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে উদাসীন গলায় বললেন-
‘আমার বউটাকে দেখে রেখো শালি সাহেবা। আমার কিন্তু একটা মাত্রই বউ।’
ধ্রুবর কথায় সানি শব্দ করে হেসে ফেলল। রান্নাঘর থেকে মনি মা-ও হাসলেন। আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ধ্রুবর দিকে নিক্ষেপ করলাম। তবে এতে তার কোনো হেলদোল হলো না। উনি ওনার মতোই স্বাভাবিক।
বহুদিন পর সানির সাথে রিকশায় কলেজে এলাম। পুরনো স্মৃতি গুলো মনে করে খুব হাসলাম। মেয়েটা আমাকে হাসাতে পারে যে কোনো পরিস্থিতিতে। আমার মতো ইন্ট্রোভার্ট মেয়েকে মুহূর্তেই হাসাতে হাসাতে পেট ব্যথায় করিয়ে ফেলে। ভার্সিটির মাঠে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সানির কথা হঠাৎ করেই থেমে যায়। আমার হাতে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলল-
‘দোস্ত সাদাফ ভাই দাঁড়িয়ে আছে।’
আমি সানির দৃষ্টি অনুসরণ করে মাঠের অন্য প্রান্তে তাকাই। সাদাফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও এড়িয়ে গেলাম। সানিকে বললাম-
‘বাদ দে ক্লাসে চল।’
আমরা ক্লাসে চলে আসলাম। পর পর তিনটা ক্লাস শেষ হলো অথচ সাদাফ এখনও আমার ক্লাস রুমের জানালা বরাবর মাঠের সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এক মুহুর্তের জন্যেও সেখান থেকে যায়নি। আমার পাশ থেকে সানি চিন্তিত গলায় বলল-
‘অনু সাদাফ ভাই তো দেখছি পাগল হয়ে গেছে।’
আমি চুপ করে রইলাম। সানির কথার প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না। সানি আমার কাধের উপর হাত রেখে ভারি গলায় বলল-
‘শোন অনু। তুই সাদাফ ভাইয়ের সঙ্গে ভালো করে কথা বল। রাগ না করে ভালো করে বুঝিয়ে বল ওনাকে। তাহলেই হয়তো উনি বুঝবেন। এভাবে আর কত দিন এড়িয়ে যাবি? ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে না উনি এত সহজে তোকে নিয়ে হার মানবে।’
আমি চুপ থেকে মনে মনে ভাবলাম সানির বলা কথা গুলো। সানিকে চোখের ইশারায় সম্মতি জানিয়ে ব্যাগ নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম। সাদাফের কাছে এসে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম-
‘তুমি এখনও যাওনি কেন সাদাফ? এখানে তো তোমার কোনো দরকার থাকার কথা না।’
‘এখনও আমার তোমাকে পাওয়া বাকি আনুপাখি।’
সাদাফের সহজ সরল জবাবে আমি হতাশ হলাম। ছোট্ট করে তপ্ত শ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বললাম-
‘আমাদের কোথাও বসে কথা বলা উচিত।’
আমার কথা শুনেই সাদাফের চোখদুটো খুশিতে চিকচিক করে উঠলো। তার বিষন্ন মুখে এক চিলতে হাসি দেখা দিল। আনন্দিত হয়ে বলল-
‘সত্যিই বলছো অনু পাখি? আমার সাথে যাবে তুমি?’
আমি কোনো জবাব না দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ভার্সিটি থেকে মিনিট পাঁচেক দূরে একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম দুজনে। রেস্টুরেন্টের এক কোণের টেবিল দখল করে চুপচাপ বসে রইলাম। আমার সামনের চেয়ারেই সাদাফ কথা বলার জন্য হাসফাস করতে লাগলো। একটা পর্যায়ে চুপ থাকতে না পেরে উত্তেজিত হয়েই বলল-
‘আমি তো ভাবতেই পারিনি ধ্রুব তোমার হাসবেন্ড। তুমি সবার কথা রাখতে বিয়ে করেছো তাই না অনুপাখি? আমি জানি তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো। আগের মতোই ভালোবাসো। তুমি কখনই আমাকে ছেড়ে নিজের ইচ্ছাতে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারো না। কাল রাতে কত করে কল দিলাম। কিন্তু তুমি ধরলে না কেন? আমাকে ব্লক করলে কেন? ধ্রুব সাথে ছিল না-কি?’
সাদাফ একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে যাচ্ছে তবুও থামছে না। অবশেষে আমি মুখ খুললাম। ভীষণ শান্ত গলায় বললাম-
‘আমাদের উপন্যাসের বইয়ের সূচনা হয়েছিল ভালোবসার রঙিন কালির আঁচড়ে। মাঝের ধূসর পাতায় লেখা ছিল কিছু অভিমান, অপেক্ষা আর হেয়ালিপনার কথা। অপেক্ষা, অভিমান আর কষ্ট আমার ছিল। একান্তই আমার। আর খামখেয়ালিপনা ছিল তোমার। তোমার অবহেলা আর হেয়ালিতে আমাদের উপন্যাসের শেষের পাতা গুলো ফাঁকাই রয়ে গেল। বিষাদে মোড়ানো একটা সমাপ্তি টানতে হলো উপন্যাসের। ভালোবাসার রঙিন কালি দিয়ে আবারও সেই সমাপ্ত উপন্যাসের শেষটা লেখা সম্ভব না। প্রকাশিত উপন্যাস আবারও নতুন করে লেখা হয়না সাদাফ। উপন্যাসের সমাপ্তিটা বিষাদময় হলেও সেটাই আমাদের মেনে নিতে হবে আজীবনের জন্য।’
আমি থামলাম। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলাম সাদাফের দিকে চেয়ে। সাদাফ মাথা চেপে ধরে মিনিট খানেক সময় নিঃশব্দে বসে থাকলো। দৃষ্টি তুলে তাকায় আমার দিকে। গম্ভীর গলায় বলে,
‘তুমি চাইলেই ধ্রুবকে ডিভোর্স দিয়ে আমার কাছে চলে আসতে পারো। তুমি তো ধ্রুবকে ভালোবাসো না। আমাকে ভালোবাসো। তাহলে ধ্রুবর সাথে কেন সংসার করবে? ভালোবাসাহীন সম্পর্ক কতদিনই বা নিজের অনিচ্ছায় টিকিয়ে রাখবে অনন্যা? ধ্রুবকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই রাজি হবে তোমাকে ডিভোর্স দিতে। ধ্রুব আমার কথা বুঝবে আমি জানি।’
চলবে….
#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৬
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
‘সাদাফ! তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি অনেকগুলো ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছো! প্রথমত আমি তোমাকে ভালোবাসতাম এখন বাসি না। তুমি আমার না হওয়া অতীত। আমার প্রাক্তন। তোমার কারণে আমি আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ ছাড়তে পারবো না। কিছতেই না। আর দ্বিতীয়ত আমি কখনও-ই তোমার কাছে ফিরে আসবো না। আর আমি কোনো দিনও তুলতুলের আব্বুকে ডিভোর্সের কথা বলবো না।’
‘কিন্তু তুমি তো ধ্রুবকে ভালোবাসো না অনন্যা তাহলে কেন!’
আমার কথা শেষ হতেই সাদাফ গাঢ় স্বরে কথাটা বলল। তার এই কথাটা আমাকে ভাবালো। আমি আপনমনে ভাবতে লাগলাম। আমি ধ্রুবকে ভালোবাসি না তবুও কেন তার সঙ্গে থাকবো! কি কারণে থাকবো? মুহুর্তেই অনেক গুলো কারণ খুঁজে পেলাম। তার মধ্যে সব চেয়ে বড় কারণ হলো পূর্নতা। আমাদের মেয়ে পূর্নতা। ধ্রুব আর আমার মেয়ে।
‘ভালোবাসার থেকেও বেশি কিছু আছে সাদাফ। আর সেটা হলো গুরুত্ব। যা কি-না তোমার আমার ভালোবাসার মাঝে কখনই ছিল না। আমি ধ্রুবকে শ্রদ্ধা করি, বিশ্বাস করি, সম্মান করি। উনিও আমার থেকে দ্বিগুণ আমাকে শ্রদ্ধা করে। আমার অনুভূতি গুলোকে শ্রদ্ধা করে। আমার কষ্ট গুলোকে বোঝে। যখন আমি ভেঙে পরি তখন আমার দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয়। আর সব থেকে বড় কথা হলো আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি। আমাদের মেয়েকে ভালোবাসি। আমি কখনই একজন স্বার্থপর মা হতে চাই না। কারও স্বার্থপর স্ত্রী বা পুত্রবধূ হতে চাইবো না। কখনই না।’
আমি থামলাম। সাদাফ আহত চোখে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। বাহিরের কোলাহল আর আশেপাশের টেবিলে বসে থাকা মানুষগুলোর নিম্নস্বরে ফিসফিসে কথার শব্দে কেটে গেল কিছুটা সময়। ডান পাশের টেবিলে বসে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকার ঠোঁটে মিষ্টি লাজুক হাসি। মনে মনে হাসলাম আমি। আবারও তাকালাম সাদাফের দিকে। কেউ কেউ নতুন প্রেমে মত্ত আর কেউ বা বিচ্ছেদের দাহনে পোড়াচ্ছে তার মন। আবারও মুচকি হাসলাম আমি। নিয়তির খেলায় হাসলাম।
সাদাফ মাথা নিচু করেই জড়ানো কন্ঠে বলল-
‘আর কোনো আশা নেই!’
আমি খানিকটা সময় চুপ থেকে শান্ত ভঙ্গিতে বললাম-
‘তোমার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো খুব সুন্দর ছিল। মধুর ছিল। তুমি দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর আমার লাইফে ছিলে এ নিয়ে আমার কোনো রিগ্রেট নেই। তবে আমি চাই না ভবিষ্যতে তোমার প্রতি আমার মনে তিক্ততা কিংবা ঘৃণা চলে আসুক। আমি চাই না তোমার জন্য আমার চরিত্রে দাগ লাগুক। বিয়ের পরও প্রাক্তনের সাথে সম্পর্ক রেখেছি বলে মানুষ আমার দিকে আঙুল তুলুক। তুমি যদি সত্যিই আমার ভালো চাও তাহলে আর কখনও আমার সামনে ভালোবাসার দাবী নিয়ে এসো না। কলেজে এসে এভাবে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকো না সাদাফ।’
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। শান্ত চোখে চাইলাম সাদাফের দিকে। সে আগের মতোই মাথা নত করে বসে আছে। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ব্যাগ নিতে নিতে বললাম-
‘জানো তো সাদাফ ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অবহেলার মুহুর্ত গুলো বিষের মতো বিষাক্ত হয়। তাই পরের বার কাউকে ভালোবাসলে তাকে অবহেলা করো না। তার কষ্টের সময় কিছু করতে না পারলেও অন্তত তার মাথায় একটু ভরসার হাত রেখো। আসছি। ভালো থেকো।’
আমি বেরিয়ে এলাম। সাদাফকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনে। পেছনে ফেলে গেলাম বিষাদময় অতীত। ভার্সিটির সামনে এসেই ধ্রুবকে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখলাম। মুখোমুখি হলাম আমার বর্তমান আর ভবিষ্যতের সাথে। আমার কপালের সূক্ষ্ণ ভাঁজটা চলে গেল৷ ঠোঁটের কোণে ফুটলো তৃপ্তিময় হাসির রেখা। আমাকে দেখে ধ্রুব সহজ ভঙ্গিতে হেসে বললেন-
‘গাড়িতে উঠে বসুন।’
ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো না আমি কোথায় গিয়েছিলাম। জানতে চাইলো না কোনো কিছুই। আমি চাচ্ছি উনি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করুক। তাই আর আমি গাড়িতে উঠে বসলাম না। দাঁড়িয়ে থাকলাম আগের মতোই। ধ্রুব ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে আমার দিকে তাকায়। আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-
‘আপনাকে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল। আমার অতীত নিয়ে। আর আমার প্রাক্তন নিয়ে।’
ধ্রুব কিছু বলার আগেই ধ্রুবর পেছনের রাস্তা দিয়ে রাফিন ভাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। কন্ঠে অস্থির ভাব নিয়ে হড়বড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
‘কেমন আছেন ভাবি? সাদাফকে দেখেছেন? কতক্ষণ ধরে ওকে খুঁজে যাচ্ছি।’
আমি থমকে গেলাম। অপ্রস্তুত হয়ে তাকালাম ধ্রুবর দিকে। সে আগের মতোই স্বাভাবিক। বাঁকা হয়ে রাফিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ইতস্তত করে করে বললাম-
‘সামনের রেস্টুরেন্টে।’
রাফিন ভাই হন্তদন্ত হয়ে চলে যেতে নিলেই ধ্রুব তাকে ডাকলেন-
‘এই যে শুনুন। ভাবির সাথেই কথা বলে চলে যাবেন! ভাইয়ের সাথে পরিচিত হবে না!’
সাদাফ থতমত খেয়ে যায়। একবার আমার দিকে আরেকবার ধ্রুবর দিকে চেয়ে মিনমিনিয়ে বলল-
‘অহহ আপনিই ধ্রুব? সাদাফ বলেছিল আপনার কথা। আচ্ছা অন্যদিন পরিচিত হবো। আজ একটু তাড়া আছে।’
রাফিন ভাই চলে গেলেন ব্যস্ত পায়ে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম হতভম্ব হয়ে। ধ্রুব গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললেন-
‘এখানে না দাঁড়িয়ে থেকে চলুন অন্য কোথাও যেয়ে কথা বলি।’
আমি চুপচাপ ধ্রুবর কথা মতো গাড়িতে উঠে বসলাম। ধ্রুব এবারও কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কেন রাফিন ভাই আমাকে ভাবি ডাকলেন! কেন সাদাফের খবর আমি জানি! কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। বেশ খানিকটা পথ নিস্তব্ধতায় পাড় হলো। ধ্রুব ড্রাইভিং করছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। আমি কিছুক্ষণ হাসফাস করতে করতে বললাম-
‘আপনি সব জানতেন তাই না!’
ধ্রুব কোনো জবাব দিলেন না। আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। যেন তিনি একাই এই গাড়িতে বসে আছেন। আমি নামক কোনো ব্যক্তি তার পাশে নেই। তিনি আপনমনেই গাড়ি ড্রাইভ করছেন। হঠাৎই একটা ব্রিজের পাশে এসে গাড়ি থামালেন। আমার দিকে ঘুরে সহজ গলায় বললেন-
‘হ্যাঁ জানি তো। আগে থেকেই জানি।’
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম-
‘সব জেনেও এতদিন কিছু বললেন নি কেন?’
‘কিছু বলেনি কারণ আমার বিশ্বাস ছিল আপনি নিজেই সব কিছু ঠিক করে নিবেন। মনে হচ্ছে সব ঠিক হয়ে গেছে। কি হয়নি ঠিক!!’
ধ্রুব তার ভ্রু জোড়া নাচিয়ে কিছুটা ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। আমি সরু চোখে ওনাকে দেখলাম। বরাবরের মতোই তার ঠোঁটে সহজ সরল হাসি। এই হাসির পেছনে যে মানুষটা আরও কত কিছু লুকিয়ে রেখেছেন এক মাত্র আল্লাহ তায়ালা আর তিনি নিজেই জানেন। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করলাম-
‘সাদাফের সাথেই আমার সম্পর্ক ছিল এটা কবে থেকে জানেন?’
‘বিয়ের আগে আগে থেকেই জানি। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিলাম যেদিন সাদাফ আপনার হাত ধরেছিল ভার্সিটির মাঠে সেদিন। তোমাদের দেখে আমি চলে এসেছিলাম। তোমাদের মাঝে কথা বলতে চাইনি৷ কারও ব্যাক্তিগত আলাপে না যাওয়াটাই বেটার মনে করেছি। আর আপনি নিজেই সামলে নিতেন তাই চলে এসেছিলাম।’
ধ্রুবর কথা প্রচন্ডরকম অবাক হলাম। বিস্মিয়ের চোখের ওনার দিকে চেয়ে গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
‘বিয়ের আগে জেনেছেন মানে? কাছ থেকে জেনেছেন? সাদাফের কথা তো তেমন কেউ জানতো না।’
ধ্রুবর সোজা হয়ে বসলেন। রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন-
‘বলেছে খুব কাছের একজন। আপনার খুব প্রিয় একজন মানুষ।’
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম কে হতে পারে সেই মানুষ যে কি-না আমাদের সম্পর্কে জানে। সানি? নাহ ও তো ধ্রুবকে চিনতোই না। তাহলে কি ভাইয়া? তবে ভাইয়ার সাথেও তো ধ্রুবর তেমন একটা পরিচয় ছিলো না। তাহলে আর কে হতে পারে? আমি কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে বললাম-
‘বলুন না কে বলেছে আপনাকে এসব?’
চলবে….
#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৭
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
‘আম্মু বলেছে মানে আপনার মনি মা।’
ধ্রুবর জবাবটা যেন মেঘহীন আকাশে শুকনো বজ্রপাতের মতো শোনালো। আকাশ থেকে পড়ার মতো বিস্মিত হলাম আমি। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবর মুখের দিকে। আমার চমকে যাওয়াতে মৃদু হাসলেন তিনি৷ তবে কিছু বললেন না খুব স্বাভাবিকভাবেই বসে থাকলেন। আমার মস্তিষ্ক তার সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে অচল হলো। মনি মা কিভাবে জানেন! আর এতদিন কি ভেবেছেন আমাকে নিয়ে! এসব নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে পারলাম না৷ অনুশোচনা আর লজ্জাবোধে গলার স্বর আটকে গেল কণ্ঠনালীতে। অপরাধ বোধে চোখের দৃষ্টি হলো নত। ধ্রুব আমার গালে আঙুল দিয়ে গুতো দিতেই আমার হুশ ফিরলো৷ আমি ভ্রু কুচকে ওনার দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গেই উনি বাঁকা দাঁত বের করে মন কাড়া একটা হাসি দিলেন। তিনি সব সময় এভাবে বাঁকা দাঁত বের করে হাসেন না। বেশিরভাগই মৃদু হাসেন তাই এই বাঁকা দাঁত বেশি একটা দেখাও যায় না। আমি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলাম-
‘মনি মা কিভাবে জানেন? আপনার এত এত রহস্য ভালো লাগছে না আমার৷ দয়া করে সব কিছু খুলে বলুন তো।’
ধ্রুব আমার কথার অন্য মানে বের করলেন। দুষ্টু হাসি দিয়ে রসিকতা করে বললেন-
‘ছিঃ এসব কি বলছেন? আমাকে সব খুলে কথা বলতে বলছেন!! ছিঃ ছিঃ লজ্জা করে না আপনার!’
ধ্রুবর কথার ভাবার্থ বুঝতে আমার সেকেন্ড কয়েক সময় লাগলো। ওনার কথা বুঝতেই মনে মনে একটা কথা বললাম- ‘অসভ্য লোক’। আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম মানুষটার দিকে। তিক্ত গলায় বললাম-
‘রসিকতা করছেন আমার সঙ্গে!’
‘আপনি কি আমার বিয়াইন না-কি যে আপনার রসিকতা করবো?’
ধ্রুবর পালটা জবাবে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। উনি এবার শব্দ করেই হাসলেন। পুরো গাড়ি রঞ্জিত হলো তার হাসিতে। আমি বিরক্তি নিয়ে ওনার হাসি মুখে স্থির চেয়ে থাকলাম। দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। হতাশ হয়ে ক্লান্ত গলায় বললাম-
‘মজা না করে যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন প্লিজ।’
ধ্রুব হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসলেন। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে শীতল চাহনি দিয়ে বললেন-
‘সেদিন পার্কে আম্মু হয়তো আপনাদের কথা শুনেছিল। বাসায় এসে আমার আর সাদাফের ট্যুরের ছবি দেখিয়ে বলল সাদাফ আপনাকে কষ্ট দিয়েছে। আপনাকে একা রেখে চলে গেছে। আরও নানান কথা বলে সাদাফের প্রতি ভীষণ আক্ষেপ আর রাগ প্রকাশ করেছে। আমি আম্মুর কথা বিশ্বাস করিনি। তবুও একবার সাদাফের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর নাম্বার বন্ধ থাকায় আর কথা হয়নি। পরে এসব নিয়ে আর কোনো মাথা ঘামাইনি। তবে দিন দিন আপনার প্রতি তুলতুলের পাগলামি দেখে আম্মু একদিন হঠাৎ করেই আমাদের বিয়ের কথা বললেন। আমি সেটাও গুরুত্ব দেইনি। ভেবেছিলাম আপনি যেহেতু অন্য কাউকে ভালোবাসেন তাই হয়তো বিয়েতে রাজি হবেন না। কিন্তু আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে আপনি বিয়েতে রাজি হলেন। আর সেদিনই আম্মু আমাকে বলে দিয়েছিল আমি যেন আপনার থেকে দূরে দূরে থাকি। স্বামীর অধিকার না খাটাই। আপনাকে যেন অতীত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সময় দেওয়া হয়। আপনাকে আপনার মতো করে থাকতে দেওয়া হয়। আরও অনেক অনেক হুকুম দিয়েছিল। আর সে জন্যই ওদিন রেস্টুরেন্টে ওসব শর্ত দিয়েছিলাম যেন আপনি নিজেই নিজেকে আমার থেকে দূরে রাখেন।’
ধ্রুব কথা গুলো শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম স্থির হয়ে। মনি মা সব জানেন বলেই কি আমাকে সব কিছুতে এত এত ছাড় দিয়েছেন? আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেই কথার ঝুলি খুলে বসেছে। সব সময় আমাকে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বলেছে। আমাকে মনমরা থাকতে দেখে তুলতুলকে আমার কোলে এনে দিয়েছে। আমার নিজের প্রতি অবহেলায় কড়া গলায় শাসন করেছেন। সংসার নামক কোনো দায়িত্বের যাতা কলে আমাকে পিশে যেতে দেয়নি। নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় দিয়েছে। একটা মানুষের কি আদোও এতটা ভালো হওয়া উচিত! এই স্বার্থপরের দুনিয়ায় কি আদোও এতটা ভালো মনের মানুষ হওয়া মানায়? আমি কোনো উত্তরই খুঁজে পেলাম না। আচমকাই হাতে টান অনুভব করলাম। আমি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম ধ্রুব বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।
‘বারিয়ে আসুন। একটু হাঁটাহাঁটি করি।’
আমার প্রতিত্তোরে অপেক্ষা না করেই ধ্রুব আমার হাত ধরে আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলেন। ফাঁকা ফ্লাইওভার ব্রিজ। নিচে ছোট খাটো একটা নদী। মতুন ব্রিজ তাই হয়তো গাড়ি চলাচল খুবই কম। মিনিট খানেক পর পর একটা দুটো করে গাড়ি শাই শাই শব্দে চলে যাচ্ছে। আমরা বেশ খানিকটা সময় ব্রিজের পাড় ধরে হাঁটলাম। পুরোটা সময় ছিলাম নিশ্চুপ। কথা বলার মতো কোনো কিছুই খুঁজে পেলাম না আমি। আমার নিশ্চুপতা দেখে ধ্রুব হাঁটতে হাঁটতে শান্ত গলায় বললেন-
‘যেদিন আপনি তুলতুলের জন্য নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন। সেদিনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম আপনি কখনও তুলতুলকে ছেড়ে যাবেন না। সাদাফ ফিরে এলেও না। আপনার প্রতি আমার আর আম্মুর যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল। তাই আপনাকে কখনও আপনার অতীত নিয়ে কিছু বলিনি আর আপনার মনের উপর জোর খাটাইনি। তাই এসব নিয়ে বেশি ভাববেন না।’
আমি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ধ্রুবর কথা গুলো মন দিয়ে শুনলাম। গলার স্বর নামিয়ে মিহি কন্ঠে বললাম-
‘আমি কি এসব কিছুর যোগ্য!’
ধ্রুব তার হাঁটা থামিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। খানিকটা ঝুঁকে মুখোমুখি হয়ে আমার মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-
‘অবশ্যই যোগ্য। আর যোগ্য বলেই তো বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছো সানসাইন। কোনো ঝামেলা না করে সব কিছু কত সুন্দর করে সামলিয়ে নিয়েছো। তুমি চাইলেই আমাদের অগোচরে সাদাফের সাথে রিলেশন রাখতে পারলে। আমাদের ছেড়ে ওর কাছে চলে যেতে পারতে। কিন্তু তুমি তা করনি। তুমি তা-ই করেছো যা তোমার কাছে সঠিক মনে হয়েছে।’
কেউ আমার উপরে এতটা বিশ্বাস করে ভেবেই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এখনই বোধহয় গড়িয়ে পরবে চোখের জল। কান্না করতে ইচ্ছে হলো খুব। মুখ গুজে কান্না করার জন্য ধ্রুবকেও পেলাম সামনে। কোনো দ্বিধাবোধ না করেই ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুজেই কান্না করে দিলাম। নিঃশব্দে চোখের জল বিসর্জন দিতে লাগলাম। ধ্রুব বোধহয় সব সময়ের মতোই মৃদু হাসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ধিরে ধিরে। আমার নিঃশ্বাস গাঢ় হতে লাগল। কান্নাজড়িত গলায় থেমে থেমে বললাম-
‘আমাকে এতটা বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ। আপনি অনেক ভালো।’
ধ্রুব হাসতে হাসতে বললেন-
‘ভালো না হলেই কি বার বার আমার পারসোনাল বুকটাকে সাগর বানাতে দেই না-কি!’
দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে অথচ কলিং বেল বাজাতে সাহস পাচ্ছি না। চেনা মানুষকেই আজ আবারও নতুন করে চিনলাম তাই কিছুটা ইতস্ততবোধ করছি। আকাশ-পাতাল চিন্তাভাবনা করে অবশেষে কলিং বেল বাজালাম। কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই মনি মা দরজা খুললেন। আমাকে দেখেই বিরক্তি নিয়ে বললেন-
‘দেরি করলে কেন আজ? খাবার খেয়েছিস নাকি না খেয়েই বাদরটার সাথে ঘুরেলি? যে বেখেয়ালি একটা ছেলে জন্ম দিয়েছি মনে হয় না তোর আর তার নিজের খাবার-দাবারের প্রতি কোনো খেয়াল আছে। পুরো বাপের ফটোকপি হয়েছে।’
আমি মনি মা’র সকল কথা অগ্রাহ্য করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে। মনি মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন-
‘কিরে অসুস্থ লাগছে! না-কি মন খারাপ কোনটা?’
আমি জবাব দিলাম না। চুপ করে কিছুক্ষন মনি মা’কে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। মিনিটখানেক পর ওনাকে ছেড়ে সোজা হয়ে হাসি দিয়ে বললাম-
‘কিছু না। তুমি খুব ভালো মনি মা।’
মনি মা তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
‘তুইও দেখি ওই বাপ-ছেলের মতোই হচ্ছিস। পাম দেওয়া শিখে যাচ্ছিস। আমাকে এসব পাম দিয়ে কোনো লাভ নেই। যা হাত মুখ ধুয়ে আয় আমি খাবার দিচ্ছি।’
মনি মা চলে গেলেন রান্নাঘরে। বিরক্তি নিয়ে এটা ওটা বলেই যাচ্ছেন একের পর এক। আমি সেদিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলাম। এরা মা ছেলে দুজন এতটা স্বাভাবিক থাকে কিভাবে সবসময়! সব কিছু জেনেও এমন একটা ভাব যেন তারা কিছুই জানে না। এসব কি আমাকে অস্বস্তিতে না ফেলার জন্যই করেন? আমি হাসি মুখে চলে গেলাম রুমে। আবারও যেন নতুন করে সব কিছু শুরু হলো। পুরো বাড়িটাই যেন নতুন নতুন মনে হতে লাগলো। মনের ভেতর আলাদা এক প্রশান্তি অনুভব করলাম। এই বাড়ির মানুষ গুলো সাথে থাকলে আমি কখনোই ভেঙে পরবো না। এক এক জন আমার ডাল হয়ে আগলে রেখেছে আমাকে। প্রকাশ্র নয় অগোচরেই আমাকে আগলে রেখেছে প্রতিটা সময়।
চলবে…