#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#সিজন_২
#হালিমা_চৌধুরী
#পার্ট_০৮
দৌড়াতে দৌড়াতে গাড়ির সামনে এসে থামে পিয়াস আর ইকরা। দুজনেই হাঁপাচ্ছে।
“স্কুলের দৌড় প্রতিযোগিতায় যদি আমি আজকের মত এভাবে দৌড়াতাম তাহলে ওই ডাইনি বিথীর বদলে আমি ফাস্ট হতাম।”
ইকরার কথা শুনে পিয়াস তার দিকে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“বিথী কে?”
পিয়াসের কথা শুনে হুশ ফিরে ইকরার, সে নিজেকে সামলে বলল,
“স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে গেছে, স্কুলের ক্লাসমেট ছিল বিথী।”
ইকরার কথা শুনে প্রাণে বাঁচলো সে, কারণ তার বোনের নামও বিথী।
“চলুন যাই, আবার কখন কোন বিপদ জেঁকে বসে কে জানে!”
বলেই পিয়াস গাড়িতে গিয়ে বসে, ইকরাও আর দ্বিমত পোষণ না করে গাড়িতে গিয়ে বসে। ইকরা গাড়িতে বসতেই পিয়াস গাড়ি স্টার্ট দেয়।
******
রাত প্রায় তিনটা বাজে, জ্বরে নিধির গা পুড়ে যাচ্ছে। নিধির চোখ মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে, চোখ জ্বালা করছে জ্বরের তোপে। তার চোখ বেড়ে নিরবে অশ্র গড়িয়ে পড়ে। নিধি বিছানা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করে, উঠে বসতে নিতেই নিধি আবারো পড়ে যায় বিছানায়। ফারিশ তার পাশেই শুয়ে ছিল, হঠাৎ আওয়াজ শুনে সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। সে তাড়াতাড়ি করে রুমের লাইট অন করে নিধির কাছে আসে। নিধির চোখে পানি দেখে বুক ধক করে উঠে ফারিশের। সে তাড়াতাড়ি নিধির চোখের পানি মুছে দেয়। নিধির গাল স্পর্শ করে থমকে যায় ফারিশ, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে নিধির। সে আতঙ্কিত গলায় নিধি কে বলল,
“ঠিকাছো নিধি?”
ফারিশের কথা কানে গেলেও জবাব দিতে পারলো না নিধি। নিধি কে চুপ করে থাকতে দেখে ফারিশ ফের বলল,
“এই নিধি, শুনছো? কি হয়েছে তোমার?”
ফারিশের কথা শুনে নিধি তার দিকে চোখ মেলে তাকাল, তারপর ভাঙা কন্ঠে বলল,
“ল..লাইট।”
আর কিছু বলতে পারলো না নিধি, তার আগেই সে জ্ঞান হারায়। নিধির এই অবস্থা দেখে ফারিশ তো পুরো হতভম্ব হয়ে গেল। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। রাত প্রায় তিনটা বাজে, এত রাতে কোনো ডক্টর তো জীবনেও বাসায় আসবে না, তারউপর সে নিধি কে নিয়ে ডক্টরের কাছেও যেতে পারবে না, কারণ তার গাড়ি যে পিয়াস নিয়ে গেছে। চিন্তায় ফারিশের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সে তাড়াতাড়ি ফোন নিয়ে তার পরিচিত একজন ডক্টর কে কল করে। বেশ কয়েকবার কল দেওয়ার পরেও ডক্টর কল রিসিভ করে না। জীবনে প্রথম নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে ফারিশের, সে সামনে বসে থেকেও কিছু করতে পারছে না নিধির জন্য। তবুও সে হাল ছাড়লো না, নিধিকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে ফারিশ রান্নাঘরে গিয়ে পানি আনে। কিছুটা পানি নিধির মুখে ছিটিয়ে দেয় সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিধি নড়েচড়ে উঠে। নিধি জ্বরের ঘোরে বলল,
“মা পানি।”
নিধির কথা টা ফারিশের বুকে তীরের মত বাঁধে! মেয়েটা তার মা কে কতটা ভালোবাসে! অথচ এখন পরিস্থিতিটাই বা কেমন! ফারিশ চাইলেও নিধির মা কে তো আর ফিরিয়ে এনে দিতে পারবে না! সে উঠে গিয়ে নিধির জন্য পানি আনে। নিধি কে শোয়া থেকে উঠিয়ে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয় ফারিশ। তারপর পানির গ্লাস নিয়ে নিধিকে খাইয়ে দেয় সে। ফারিশ পানি নিয়ে আসে জলপট্টি দিয়ে দেওয়ার জন্য। জলপট্টি দেওয়া শেষ করে ফারিশ নিধির মাথা নিজের কোলের উপর রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“ঘুমাও, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আছি তো।”
ফারিশের এই একটা কথাতেই যেনো নিধি অনেকখানি ভরসা পেলো।
**
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে ইকরা, কিছুতেই তার ঘুম আসছে না। সে পিয়াসের শার্টটা জড়িয়ে ধরে আছে। রাতে ছেলেগুলো ইকরার ওড়না নিয়ে যাওয়ার পর পিয়াস তার শার্টটা ইকরার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। এতে ইকরা অবাক হলেও পরক্ষণে পিয়াসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। বাসায় এসে বিছানায় শুয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার মন ঠিকই পিয়াসের কাছে, ছেলেটার চোখে কোনো খারাপ দৃষ্টি ছিলো না তার জন্য! এজন্যই সে পিয়াসের প্রতি একটু বেশিই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে।
*
বেলকনিতে দাড়িয়ে আছে পিয়াস, একদিনের ব্যবধানে সে একের পর এক খারাপ খবর পাচ্ছে। প্রথমে নিধি কে সে পছন্দ করে এটা টের না ফেলেও ফারিশ যখন জানালো নিধি তার বউ তখন থেকে সে বুঝছে নিধি কে যে সে পছন্দ করত মনে মনে। সেই ঘটনাতে নিজেকে সামলে নিলেও আবার নিধির মায়ের মৃত্যুতে সে ব্যথিত। চাইলেও সে একটু নিধিকে স্বান্তনা দিতে পারেনি। নিধির জন্য তো সে নিজের বন্ধুত্বটা নষ্ট করতে পারবে না। আর এখন চাইলেও নিধি তার হবে না। তাই নিজেকে সামলে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। চেষ্টা করলে ভুলে থাকতে ঠিকই পারবে সে। এটাই তার বিশ্বাস। পিয়াস বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে, হঠাৎ কিছু মনে পড়াতে সে নিজের প্যান্টের পকেট হাতড়ে একটা কানের ঝুমকো বের করে। ঝুমকোটা ইকরার, দৌড়ানোর সময় কান থেকে খুলে পড়ে যায়। পিয়াস সেটা কুড়িয়ে নিলেও ইকরা কে আর ফেরত দিতে তার মনে ছিল না। আবার দেখা হলে দিয়ে দিবে সেই ভেবেই নিজের কাছে রেখেছে ঝুমকোটা। রাত অনেক হয়েছে, পিয়াস আর বেলকনিতে দাড়িয়ে না থেকে রুমে চলে যায় ঘুমানোর জন্য।
★★
সকাল প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, ফারিশ আজকে আর অফিসে যায়নি। নিধিদের বাসায় রয়েছে নিধির সাথে। নিধির জ্বর এখন কিছুটা কমেছে, তবে পুরোপুরি সুস্থ হয়নি এখনো সে। ফারিশ বাহিরে যায় নাস্তা আনার জন্য, নিধি তো ব্রেকফাস্ট তৈরি করার মত অবস্থাতে নেই। সে নিজেও বানাতে পারে না। তাই দোকানই তার শেষ ভরসা। পনেরো মিনিটের মধ্যে খাবার নিয়ে বাসায় আসে ফারিশ। বাসায় এসে তো ফারিশ পুরো থমকে যায়। নিধি সোফায় বসে আছে, তার পাশেই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা নিধি কে মনে হচ্ছে ধমকাচ্ছে কোনো কারণে। ফারিশ আর দেরি না করে নিধির দিকে এগিয়ে যায়। নিধি ভয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে। ফারিশ নিধির পাশে বসে তাকে বলল,
“ভয় পাচ্ছো কেনো নিধি? কে এই ছেলে?”
ফারিশের কথা শেষ হওয়ার আগেই ছেলেটি ফারিশের কলার চেপে ধরে নিধির পাশ থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“এই তুই কে রে? তুই আমাদের মধ্যে কথা বলার কে?”
ছেলেটির কথা ফারিশের কানে গিয়েছে কি না সন্দেহ আছে, কারণ সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার কলারে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকা ব্যাক্তির দিকে তাকিয়ে আছে। সে একপ্রকার হুঙ্কার দিয়ে বলল,
“কলার ছাড় বলছি, নাহলে কিন্তু জীবিত ফিরতে পারবি না বাড়িতে।”
ফারিশের কথা শুনে হো হো করে হাসতে থাকে ছেলে টা। নিধি আতঙ্কিত চোখে দুজনের পানে চেয়ে আছে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নিধি ছেলেটিকে অনুনয় করে বলল,
“আপনি প্লিজ চলে যান অয়ন ভাই, এতোদিন যেহেতু কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। এখনও কেউ আমাদের খোঁজ নিতে হবে না। আমি আর এসব নিতে পারছি না প্লিজ!”
নিধির কথা শুনে অয়ন ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
“চাচার যে গ্রামে জমি রয়েছে সেগুলো তোর নামে, তাছাড়া আব্বু তো বলেছে আমি যেনো তোকে বিয়ে করি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও তোর ওই বুড়ি মা এসব হতে দেয়নি। এখন তো বুড়িটা বিদায় হয়েছে। আর কোনো বাঁধা নেই।”
বলেই বাঁকা হাসে অয়ন। পুরো ব্যাপারটা যেনো ফারিশের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা নিধির মা কে নিয়ে এভাবে কথা বলাতে রেগে যায় ফারিশ।
“তুই ভাবলি কি করে নিধি তোকে বিয়ে করবে?”
ফারিশের কথা শুনে অয়ন ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকায়। সে নিধির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই মা* টা কে রে নিধি? শহরে এসে নতুন জুটিয়েছিস নাকি?”
বলেই অয়ন নিধির হাত চেপে ধরে। তা দেখে ফারিশ রাগে থরথর করে কাঁপছে। এতোক্ষণ নিজেকে সামলে রাখতে পারলেও এখন আর পারছে না সে। ছেলেটার কতো বড় সাহস সে নিধির হাত স্পর্শ করেছে! ছেলেটার কি অবস্থা করবে সে নিজেও ভেবে পাচ্ছে না।
চলবে?
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]