#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#সিজন_০২
#হালিমা_চৌধুরী
#পার্ট_০৬
সকাল থেকে দুইবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে নিধি, ইকরা তাকে সামলাতেই ব্যাস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফারিশ আর পিয়াস এসে পৌছায় নিধিদের বাসায়। মলি বেগমের নিথর দেহটা পড়ে আছে ফ্লোরে। ফারিশ এসে নিধি কে খুজতে থাকে, পরক্ষণে নিধিকে তার রুমে পাওয়া যায়। ফারিশ ধীরপায়ে নিধির দিকে এগিয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে নিধি। তার পাশেই বসে ছিল ইকরা, ফারিশ কে রুমে দেখে ইকরা সরে বসে।
“কিভাবে এসব হয়েছে বলবেন আমাকে?”
ফারিশের শীতল কন্ঠস্বর শুনে ইকরা কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“সকালে নিধি আমাকে ফোন করে বলল আন্টি অনেক অসুস্থ। উনাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবে ও। নিধি একা পারবে না তাই আমাকেও আসতে বলেছে সে। আমি এসে দেখি সব শেষ ভাইয়া! আমি কিছু করতে পারলাম না আমার বান্ধুবীর জন্য, নিধির পুরো পৃথিবী জুড়ে শুধু তার মাই ছিলো। মেয়েটা এখন কিভাবে নিজেকে সামলাবে! ও এতো মা পাগলী বলার বাহিরে!”
ইকরার কথা শুনে ফারিশের বুকটা ধক করে উঠে নিধির কথা ভেবে। সে কি মলি বেগমের রেখে যাওয়া রত্নকে যত্ন করে রাখতে পারবে? এসব ভেবেই ফারিশ নিধির দিকে তাকায়। মেয়েটা বিছানায় শুয়ে আছে, ফারিশ খেয়াল করল নিধির চোখের কোণে পানি জমে আছে। সে ঠিক কিভাবে সবকিছু সামলাবে ভেবে পাচ্ছে না। কি থেকে কি হয়ে গেলো এসব!
“নিধির চোখেমুখে পানি দিন, দেখুন জ্ঞান ফিরে কি না!”
ফারিশের কথা শুনে ইকরা নাকচ করে বলল,
“আরে না ভাইয়া, ও একদম সামলাতে পারবে না নিজেকে। নিজের সাথে কি করে বসে ও সেটার ঠিক নেই। ও যেরকম পাগলামি করেছে সকালে, তা আমি নিজের চোখে দেখেছি।”
ইকরার কথা শুনে ফারিশ বাঁধা দিয়ে বলল,
“কিন্তু তাই বলে, নিধি কে না জানিয়েই আম্মুর দাফনকাজ করবো?”
ফারিশের কথা শুনে ইকরা তার দিকে অবাক চিত্তে তাকায়, নিধির বর্ণনা অনুযায়ী সেই ফারিশের সাথে তার সামনে দাড়িয়ে থাকা ফারিশের মধ্যে তো কোনো মিল নেই। নিধি বলেছে ফারিশ অনেক রাগী, তার মা কে আন্টি ডাকে। কিন্তু সে তো দেখছে ফারিশ অনেক শান্ত! ইকরা সেসব চিন্তাকে একপাশে রেখে বলল,
“আমি নিধির ভালোর জন্যই বলেছি এসব, ও নিজেকে একদম সামলাতে পারবে না। ওর মত নরম মনের মানুষ পৃথিবীতে মনে হয় না কেউ আছে, সেখানে সে কিভাবে নিজের চোখে সহ্য করবে তার মায়ের মৃতদেহ!”
ইকরার কথা শুনে ফারিশ কিছু একটা ভেবে রুম থেকে চলে যায়।
★★
মলি বেগম কে কবর দিতে দিতে প্রায় ২ টা বেজে যায়। কবর দেওয়া শেষ করে ফারিশ আর পিয়াস নিধিদের বাসায় ফিরে আসে। বাসায় এসে ফারিশ নিধির কাছে এগিয়ে যায়। মেয়েটার এখনো জ্ঞান ফিরেনি। সে নিধির পাশে বসে তার গালে আলতো থা’প্পড় দিয়ে তাকে ডাকে। কিন্তু নিধির কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। ফারিশ ইকরা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“একটু পানি দিন তো আপু।”
ফারিশের মুখে আপু ডাক শুনে ইকরা কিছুটা লজ্জা পায়, সে তো ফারিশের শালি লাগে, আপু ডাকার কি আছে! এসব ভাবতে ভাবতেই ইকরা রুম থেকে বের হয় পানি আনতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইকরা একগ্লাস পানি নিয়ে ফিরে আসে। ইকরা পানির গ্লাস ফারিশের দিকে বাড়িয়ে দেয়। ফারিশ গ্লাস নিয়ে নিধির মুখে হালকা পানি ছিটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিধি নড়েচড়ে উঠে। সে চোখ মেলে তাকাল, চোখের সামনে পিয়াস ইকরা আর ফারিশকে একসাথে দেখে ভড়কে যায় নিধি। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিধি লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে তার মায়ের মৃতদেহ যেখানে রাখা হয়েছিলো সেখানে ছুটে যায়। হঠাৎ নিধির এমন কাজে সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। ফারিশ তাড়াতাড়ি নিধির পিছু পিছু যায়। নিধি দুই হাটু মুড়ে নিচে বসে আছে তার মায়ের রুমে। ফারিশ গিয়ে নিধির পাশে ফ্লোরে বসে তাকে একহাত দিয়ে আগলে নেয়। ফারিশ কে নিজের পাশে দেখে নিধি তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ফারিশ তাকে সামলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফারিশ নিধিকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“এভাবে ভেঙে পড়ো না নিধি, আম্মু তো সব সময় চায় তুমি হাসিখুশি থাকো। এখন যদি তুমি এভাবে কান্না করো তাহলে তিনি কতটা কষ্ট পাবে ভেবে দেখেছে!”
ফারিশের কথার জবাব দেয় না নিধি, সে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ফারিশ নিধিকে ধরে তার রুমে নিয়ে আসে। নিধির কান্না থেমেছে, তবে সে একদম শান্ত হয়ে যায়। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছে না।
**
রাত প্রায় আটটা বাজতে চলেছে, নিধির কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে চুপচাপ রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ফারিশও তার পাশেই বসে ছিল। হঠাৎ তাদের রুমের দরজা খোলার আওয়াজ শুনে নড়েচড়ে বসে ফারিশ। ইকরা এসেছে রুমে, সে এসে নিধির পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোর সাথে থাকতে চেয়েছি আজ, কিন্তু আব্বু চলে যাওয়ার জন্য বারবার ফোন দিচ্ছে। আমি একদম ফোন বন্ধ করে রেখে দিয়েছি, বন্ধুর বিপদে বন্ধু থাকবে। তারজন্য এতো বাঁধা দেওয়ার কি আছে! আমার হিটলার বাপ বলে কথা, বাঁধা তো দিবেই।”
ইকরার কোনো কথারই প্রভাব পড়লো না নিধির উপরে। ইকরা কিছুক্ষণ নিধির পানে চেয়ে ছিল, কিছু বলবে নিধি এই আশায়।
“আপনি বরং চলে যান আপু, কোনো বাবা মা চায় না তাদের মেয়ে বাহিরে রাত কাটাক। আর নিধির পাশে আমি তো আছি।”
ফারিশের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় ইকরার। সে বাহানা দেওয়ার জন্য বলল,
“আমি এত রাতে একা বাড়িতে যেতে পারবো না, তারচেয়ে আমি বরং এখানেই থাকি।”
কিন্তু ইকরার ভাবনায় এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে ফারিশ বলল,
“পিয়াস ও তো এখন বাড়ি চলে যাবে, আপনি বরং ওর সাথেই বাড়িতে চলে যান। ও আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিবে।”
বলে ফারিশ আর ইকরার জবাবের আশা না করে পিয়াস কে ডাকে। পিয়াস রুমে আসতেই ফারিশ তাকে বলল,
“তুই তো বাসায় যাবি, সাথে উনাকে একটু উনার বাসায় নামিয়ে দিস।”
পিয়াস আপত্তি করে বলল,
“কিন্তু আমি তো উনার বাসা চিনি না।”
পিয়াসের কথা শুনে ফারিশ ইকরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি ওকে আপনার বাসার এড্রেস দিয়ে দেন। তাহলেই তো হয়। আর পিয়াস যা বলছি তাই কর।”
ফারিশের কথা ফেলতে পারে না পিয়াস, সে ইকরাকে আসতে বলে বের হয়ে যায়। ইকরা নিধির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
পুরো বাসায় শুনশান নীরবতা, নিধি আর ফারিশ ছাড়া বাসায় আর কেউ নেই। নিধি বিছানার একপাশে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। ফারিশ একবার নিধি কে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নেয়। নিধির মুখটা শুকিয়ে গেছে একদম। সারাদিন সেও কিছু খায়নি, নিধিও কিছু খায়নি। তাই ফারিশ ফোন হাতে নিয়ে খাবার অর্ডার দেয় অনলাইনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার দিয়ে যায়। ফারিশ খাবার রিসিভ করে নিধিদের রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট খুঁজে। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর প্লেট পায় সে। ফারিশ প্লেট নিয়ে তাতে খাবার বেড়ে নিধির রুমের দিকে যায়। রুমে এসে ফারিশ খাবারের প্লেটগুলো টি-টেবিলের উপর রেখে নিধির পাশে এসে তাকে ডাক দেয়।
“নিধি।”
ফারিশের কথা শুনে চোখ মেলে তাকাল নিধি। তা দেখে ফারিশ শান্ত গলায় বলল,
“উঠো তো, লক্ষী মেয়ের মত খাবার খেয়ে নাও। নাহলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
ফারিশের কথা শুনে নিধির মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। এতে ফারিশ বাধ্য হয়ে নিজেই নিধিকে উঠিয়ে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়। সে খাবারের প্লেট নিধির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“চুপচাপ খেয়ে নাও।”
নিধির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ফারিশ নিজেই খাবার মেখে নিধির মুখের সামনে ধরে বলে,
“জীবনে প্রথম বার শ্বশুর বাড়িতে এসেছি, আর তুমি আমাকে না খাইয়ে রাখার চিন্তাভাবনা করছো!”
ফারিশের কথা শুনে নিধি তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। তা দেখে ফারিশ ফের বলল,
“না মানে, তুমি নিজে না খেয়ে কি বুঝাচ্ছো? যেনো আমিও না খেয়ে থাকি।”
ফারিশের কথা শুনে নিধি অবাক হয়, সে তো ভুলেই বসেছে তার বাড়িতে যে এখন একটা রাগী নবাব রয়েছে, যার দেখাশোনার দায়িত্ব তার।
“এতক্ষণ ধরে মুখের সামনে খাবার ধরে রেখেছি, হাঁ করো তো। তোমাকে খাইয়ে দিয়ে আমি খাবো। প্রচুর খুধা লেগেছে আমার!”
ফারিশের কথা শুনে নিধি খাবার মুখে নেয়। এতে বিজয়ের হাসি হাসে ফারিশ, সে যেনো বিশ্বজয় করে ফেলেছে!
চলবে?
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]