#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#সিজন_২
#হালিমা_চৌধুরী
#পার্ট_১৮
পুরো রাস্তা ফাঁকা, অনেক জোরে বৃষ্টি হচ্ছে তাই সবাই দোকানে নয়তো কারো বাসার নিচে আশ্রয় নিয়েছে। এরমধ্যে পিয়াস আর ইকরা দুজনেই পড়ে আছে নিচে। পিয়াস একদৃষ্টিতে ইকরার দিকে তাকিয়ে আছে। ইকরা ভয়ে একদম চুপসে গেছে। পিয়াস ইকরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ইকরার ভেজা চুল কপালে এসে এলোমেলো হয়ে আছে, বৃষ্টির পানিতে ভিজে চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। এ যেনো নতুন এক ইকরাকে দেখছে পিয়াস। অদ্ভুত একটা ইচ্ছে এসে ঘিরে ধরেছে তাকে, ইকরার কাঁপা ঠোঁটের লেপ্টে যাওয়া লিপস্টিক গুলো মুছে দেওয়ার ইচ্ছে।
“আরে উঠুন, আমি উঠবো তো!”
ইকরার কথা শুনে হুঁশ ফিরে পিয়াসের। পিয়াস নিজের ভাবনাকে ধিক্কার জানিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। বৃষ্টি এখনো থামেনি। বরং আগের চেয়ে আরো জোরে বৃষ্টি পড়ছে। ইকরা উঠতে গিয়ে থেমে যায়। হঠাৎ পড়ে যাওয়ার কারণে কোমরে ব্যথা পেয়েছে সে। চেষ্টা করেও একা উঠে দাড়াতে পারছে না সে। ইকরা পিয়াসের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, পিয়াসও ইকরার দিকেই তাকিয়ে ছিল।
“আমার সাহায্য লাগবে নাকি?”
পিয়াসের কথা শুনে ইকরা কিছু বলে না। শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ইকরার অনুমতি না পেয়ে পিয়াসও দাড়িয়ে আছে। সেটা দেখে ইকরা কিছুটা রেগে নিজে একাই উঠতে নেয়। কিন্তু পারে না। পরক্ষণে কেউ একজন এসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“উঠে এসো।”
পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে ইকরা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সামনে তাকাতেই ভড়কে যায়। অয়ন নিজের হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছে তার সামনে। সে একবার পিয়াসের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার অয়নের দিকে তাকাচ্ছে। ইকরা কি করবে তা বুঝে উঠার আগেই পিয়াস তাকে কোলে তুলে নেয়। সে কিছুটা কঠিন কন্ঠে অয়নকে বলল,
“দেখছেন না উনার সাথে আরো একজন আছে উনাকে তোলার জন্য? তারপরেও থার্ড পার্সনের মত এখানে আসা উচিত হয়নি আপনার।”
বলেই পিয়াস ইকরা কে নিয়ে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। এদিকে পিয়াসের কথাতে অপমান বোধ করে অয়ন। সে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে৷ সে আর দাঁড়িয়ে না থেকে চলে যায়।
**
ফারিশ রুমে বসে ল্যাপটপ নিয়ে অফিসের কিছু কাজ করছিল। নিধি তার আশেপাশেও নেই অনেকক্ষণ হলো। তাই সে রুমে বসেই নিধি কে কয়েকবার ডাক দেয়৷ কিন্তু নিধির কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না সে। পরে সে নিজে উঠে নিধিকে খুঁজতে থাকে। পুরো বাড়ি খুঁজেও নিধিকে পায় না সে। পরে ফারিশ ছাদে আসে নিধিকে খুঁজতে। বাহিরে তুমল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে, কোনোমতে ফারিশ ছাদের দিকে তাকায়৷ তাতেই সে থমকে যায়। নিধি ছাদে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে৷ একদম ভিজে গেছে সে। ফারিশ আর দেরি না করে নিধির কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“কি হয়েছে নিধি?”
ফারিশের কন্ঠস্বর শুনে চোখ তুলে তাকায় নিধি। নিধির মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা কেঁপে উঠল ফারিশের। নিধির চোখ লাল হয়ে আছে। ফারিশ নিধির বাহু ঝাঁকিয়ে বলল,
“এই মেয়ে, কাঁদছো কেনো? আমি কি কিছু করেছি? কি হলো কথা বলছো না কেনো?”
ফারিশের কথা শুনে নিধির কান্নার গতি আরো বেড়ে যায়। সে কান্নাভেজা চোখে ফারিশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মায়ের সাথে অনেকদিন কথা হয় না, কোথায় যে চলে গেলো আমাকে রেখে!”
নিধির কথা শুনে ফারিশ বুঝতে পারল নিধির তার মায়ের কথা মনে পড়ছে। সে নিধিকে কে ধরে উঠায় নিচ থেকে। তারপর নিধিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
”মানুষ মরণশীল, কেউ এই পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকবে না নিধি। সবাইকেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে। তুমি, আমি সবাইকে। কেউ বাদ যাবে না। এই যে, তুমি এখন কাঁদছো। তা দেখে মায়ের খারাপ লাগছে না বুঝি? তুমি কাঁদলে তো মা ও কষ্ট পায়।”
ফারিশের কথা শুনে কিছু বলে না নিধি, সে ফারিশের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে যাচ্ছে।
★★
অন্ধকার রুমে কাঠের একটা চেয়ারে জলন্ত সিগারেট হাতে নিয়ে বসে আছে অয়ন। রাগে গজগজ করছে সে। ইকরার মত সুন্দরী মেয়ের উপর তো তার প্রথম দিনই নজর পড়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে ইকরার পাশে সে কিছুতেই পিয়াসকে মেনে নিতে পারছে না। এসব ভেবেই সে জলন্ত সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় নিচে। তার কিছুতেই মনে শান্তি লাগছে না। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। হঠাৎ তার ফোনটা বেজে ওঠে। অয়ন পকেট হাতড়ে নিজের ফোন বের করে দেখে তার বাবা কল দিয়েছে। সে কল রিসিভ করে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“কি দরকার সরকার সাহেব?”
অয়নের কথা শেষ হতেই অপর পাশ হতে জলিল সরকার চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“বাবা কে সম্মান করতে শেখো, আর তোমাকে যেই কাজটা দিয়েছি সেটা কতদূর?”
জলিল সরকারের কথা শুনে অয়ন তাকে শান্ত সুরে প্রশ্ন করে,
“কোন কাজ টা?”
“নিধির।”
জলিল সরকারের মুখে নিধির নাম শুনে রেগে যায় অয়ন।
“নিধি মাই ফুট, এই মেয়ের নাম আর আমাকে বলবেন না। আপনার সম্পদ, নিধি সবকিছু কে আপনি খুঁজে নেন আব্বা। আমি পারবো না এসব করতে। নিজের স্বার্থের জন্য আপনি আমাকে ইউজ করতে পারেন না।”
অয়নের কথা শুনে আঁতকে ওঠেন জলিল সরকার। তিনি ছেলেকে ধমকের গলায় শুধালো,
“অ্যাই কি বলছিস এসব? কেনো পারবি না তুই? আমার বাপ নিধির বাবাকে যা সম্পদ দিয়েছে তা আমার আর তারেকের টা যোগ করলেও তার সমান হবে না। তোকে যা বলেছি তাই করবি। নাহলে তোকে ছেলে হিসেবে গণ্য করবো না আমি। তাই যা বলছি তাই কর চুপচাপ।”
জলিল সরকারের কথা শুনে অয়ন চেঁচিয়ে বলল,
“আপনি নিজের ভাইকেই বাড়ি ছাড়া করেছেন। নিজের ভাইকে তার যোগ্য সম্মানটুকু দেননি। সেই আপনি আর আমাকে কি গণ্য করবেন? আমিই তো আপনাকে গণ্য করবো না এখন থেকে। আমি আপনাকে আজ থেকে বাবা হিসেবে মানি না। অনেক হয়েছে আপনার বাহাদুরি, নিজেই নিজের বাহাদুরি নিয়ে থাকেন। নিধি আপনার বাপের সম্পদের দিকে চোখ তুলে তাকাবেও না। তার বরের পা ধোয়া পানি দিয়েও আমাদের এরকম দশটা গ্রাম কেনা যাবে। সো আমাকে আর কখনো কোনো অনৈতিক কাজ করার কুপরামর্শ দিবেন না। মাইন্ড ইট।”
কথাগুলো একদমে বলে অয়ন থামে। সে কল কেটে মোবাইল টা ছুঁড়ে মারে দেয়ালের দিকে। মূহুর্তের মধ্যেই মোবাইল টা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
***
পিয়াসের গাড়ি এসে থামে ইকরাদের বাড়ির সামনে। পিয়াস ইকরা কে ইশারা দিয়ে বুঝায় তার বাড়ি চলে এসেছে। তাই ইকরা আর দেরি না করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। ইকরা গাড়ি থেকে নেমে যেতে উদ্যত হয়েও থেমে যায়। সে পিছনে ঘুরে পিয়াস কে বলল,
“বিয়ে করবেন আমায়?”
ইকরার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় পিয়াস। সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি ইকরা তাকে এসব বলবে। তাই সে একদৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে ইকরার দিকে তাকিয়ে আছে। পিয়াসের অবাক হওয়ার কারণ জানে ইকরা, সে উত্তরও তৈরি করে রেখেছিল পিয়াসের জন্য। তাই সে শান্ত কন্ঠে বলা শুরু করল,
“ভালোবাসতে কি কারণ লাগে জানা নেই আমার, কত সময় লাগে কিছু জানা নেই আমার৷ তবুও আপনাকে দেখার পর থেকে আমার মাঝে অদ্ভুত এক পরিবর্তন ঘটে। আপনাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে, আপনার কথা শুনতে ইচ্ছে করে। আপনাকে নিয়ে হাজার বছর বাঁচার ইচ্ছে জাগে। এসব কে কি করে দমিয়ে রাখবো আমি? দেখুন আপনি আমাকে ভালোবাসেন না জানি, কিন্তু আমাকে বিয়ে করে নিন প্লিজ। আমাকে ভালোবাসতে হবে না, শুধু আমি আপনাকে ভালোবাসবো এই সুযোগ টুকু দিন প্লিজ। আমাকে না করবেন না। আপনাকে ছাড়া বেঁচে থাকবো আমি, কিন্তু আমার ভেতরের সেই চঞ্চল মেয়েটা হয়তো মরে যাবে। এসব বলাতে আপনি আমাকে হয়তো খারাপ মেয়ে ভাবতে পারেন, নির্লজ্জ্ব ভাবতে পারেন। তাতেও আমার কোনো আফসোস নেই। ভালোবাসার মানুষ কে নিজের করে পেতে হলে একটু নির্লজ্জ্ব হতেই হয়। ভালোবাসার ক্ষেত্রে ছেলেরাই আগে প্রপোজ করবে এটার কোনো মানে নেই।”
কথাগুলো বলতে বলতে ইকরার শুষ্ক চোখ বেড়ে একফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। পিয়াস মনোযোগ দিয়ে ইকরার কথা শুনছিল এতক্ষণ। ইকরার কথা শেষ হতেই সে বলল,
“আমার লেট হচ্ছে, যাই।”
পিয়াসের কথা শুনে ইকরা তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমি আপনাকে এখনই বলছি না কোনো সিদ্ধান্ত নিতে। আপনি ভেবে তারপর আপনার সিদ্ধান্ত জানিয়েন আমাকে৷ আমি আপনার পথ চেয়ে থাকবো।”
ইকরার কথা শুনে থামে না পিয়াস। সে গাড়িতে উঠে নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা দেয়৷ আর ইকরা তার যাওয়ার পানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
চলবে?