#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#সিজন_২
#হালিমা_চৌধুরী
#পার্ট_১১
সময়টা দুপুর ১টা, ফারিশ অফিস থেকে বের হয়ে নিধিদের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়। নিধিদের বাসার সামনে এসে ফারিশ গাড়ি থামায়। ফারিশ গুটিগুটি পায়ে হেঁটে দরজার সামনে এসে দাড়ায়। বাড়ির সদর দরজাটা খোলা পড়ে আছে। এতে ফারিশের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সে বাসার ভিতরে প্রবেশ করে নিধি কে ডাকতে থাকে। কিন্তু নিধির সাড়াশব্দও নেই। পুরো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও নিধিকে পায় না ফারিশ। ঘরের সব জিনিস উলোটপালোট হয়ে আছে। সবটা যে নিজের করা বোকামির জন্য হয়েছে সেটা ফারিশ বুঝতে পেরে মাটিতে বসে ডুকরে কেঁদে উঠে।
“আমি আমার কথা রাখতে পারিনি সালেহা মা, আমি আপনার মেয়ে কে দেখে রাখতে পারিনি। আমি একটা দায়িত্বহীন ছেলে, আমার আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল। আমি কিছু করতে পারলাম না নিধির জন্য।”
হঠাৎ ঘাড়ে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে থমকে যায় ফারিশ। সে তাড়াতাড়ি নিজের চোখের পানি মুছে পিছনে ঘুরে তাকায়।
“কি হয়েছে ভাইয়া? আপনি কাঁদছেন কেনো?”
ইকরার কথা শুনে ভড়কে যায় ফারিশ, না চাইতেই ফারিশের চোখে পানি চলে আসছে। মনে হচ্ছে অমূল্য কিছু একটা সে হারিয়ে ফেলছে!
“নননিধি…. ”
এতটুকু বলতেই ফারিশের কথা থেমে যায়, সে আর কিছু বলতে পারল না।
“নিধির কি হয়েছে? কোথায় ও? কি হয়েছে বলুন না ভাইয়া?”
“আমি ওকে বাসায় রেখে অফিসে গিয়েছি, এখন এসে ওকে খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। ঘরের সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ এসেছে এখানে!”
ফারিশের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় ইকরা। সে অবিশ্বাস্য চোখে ফারিশের দিকে চেয়ে আছে।
“কিন্তু কে আসবে এখানে? আর নিধিই বা না বলে কোথায় গেছে?”
“আমি জানি না কে এসেছে, তবে আমি শিওর যে নিধি ইচ্ছে করে বাড়ির বাহিরে যাবে না। আমার ওকে খুঁজতে যেতে হবে।”
“কিন্তু এত বড় একটা শহরে কিভাবে আপনি নিধিকে খুঁজে পাবেন?”
ইকরার কথার জবাব দেয় না ফারিশ, সে মলিন চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে দরজার পাশে পড়ে থাকা একটা ব্রেসলেটের উপর। ফারিশ তড়িঘড়ি করে ব্রেসলেট টা নিচ থেকে উঠিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। গভীর মনোযোগ দিয়ে ফারিশ কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছে দেখে ইকরাও সেই জিনিসের দিকে তাকায়। ফারিশের হাতে থাকা ব্রেসলেট টা ইকরা ভালো করে দেখে চমকে যায়।
“আরে, ওটা তো ওই হসপিটালের ছেলেটার ব্রেসলেট।”
ইকরার কথার মানে বুঝতে না পেরে ফারিশ তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। তা বুঝতে পেরে ইকরা আমতা আমতা করে বলল,
“না মানে, হসপিটালের ছেলেটার হাতেও এই রকম ব্রেসলেট ছিল তো তাই বললাম আরকি।”
ইকরার কথা কানে না নিয়ে ফারিশ ব্রেসলেট টার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটা নিশ্চয় এই ঘরে আসা তৃতীয় ব্যাক্তির ব্রেসলেট। চো’র তো কাঁচা খেলোয়াড়। ভালো করে চু’রিই করতে পারলো না। উল্টো প্রমাণ ফেলে চলে গেলো।”
ফারিশের কথা সব ইকরার মাথার উপর দিয়ে যায়। সে ফারিশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি চু’রি করেছে? চোর কে?”
“এই বাসার সবচেয়ে দামী জিনিসটা চু’রি করেছে, আর চোর হলো সেই যে ঘরের সবচেয়ে দামী জিনিসটা নিয়ে গেছে।”
বলেই ফারিশ বাসা থেকে হনহন করে বের হয়ে যায়। আর ইকরা বোকার মত দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে। ফারিশের কোনো কথাই সে বুঝতে পারেনি।
***
বিকাল প্রায় ৫ টা বাজে, ইকরা আনমনে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। নিধি যে বড় কোনো বিপদে পড়েছে সেটা ইকরা এখন বুঝতে পেরেছে। দুপুরে ফারিশের কথা না বুঝলেও এখন বুঝতে পেরেছে সে যে নিধির বিপদের কথাই তাকে বলেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই রাস্তা পার হচ্ছিল ইকরা। হঠাৎ একটা গাড়ি জোরে ব্রেক কষে ইকরার সামনে। গাড়ির নিচে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে যায় ইকরা।
“আরে আন্টি, দেখে হাঁটবেন তো। এতো বেখেয়ালি ভাবে রাস্তা পার হলে হবে?”
হঠাৎ কারো মুখ থেকে আন্টি ডাক শুনে হতভম্ব হয়ে যায় ইকরা। সে কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিটির দিকে তাকাতেই আরেক দফা অবাক হয়। ইকরার সামনে থাকা ছেলেটা নিজেও অবাক হয়।
“আমাকে কোন দিক দিয়ে আপনার আন্টি মনে হয় ভাই?”
ইকরার কথা শুনে পিয়াশ কিছুটা ঘাবড়ে যায়। সে কোনোকিছু না ভেবে চট করে বলে বসলো,
“না মানে, আপনি বুড়ো মানুষের মত ঝুকে ঝুকে হাঁটছিলেন তো তাই মনে হলো। আমি ভালো করে খেয়াল করিনি ওই আন্টি যে আপনিই ছিলেন।”
পিয়াসের কথা শুনে ইকরার মেজাজ বিগড়ে যায়, সে রাগী চোখে পিয়াসের দিকে তাকাতেই পিয়াস আমতা আমতা করে বলল,
“রাগ করছেন কেনো বেয়াইন?”
পিয়াস কে অবাক করে দিয়ে ইকরা মাঝরাস্তায় কাঁদতে শুরু করে। এতে পিয়াস কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
“আরে করছেন টা কি? আমি আর জীবনেও কাউকে আন্টি ডাকবো না, দয়া করে এবার একটু থামুন। নাহলে লোকজন আমাকে এখানে গণধোলাই দিবে কিন্তু।”
“নিধি কে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বিকাল হয়ে গেলো অথচ এখনো নিধুরও কোনো খোঁজ নেই ভাইয়ার ও কোনো খোঁজ নেই।”
ইকরার কথা শুনে পিয়াশ হেসে ফেলল।
“আরে মানুষ সিরিয়াসলি একভাবে কাঁদে, আর ন্যাকামি করে একভাবে কাঁদে। আপনি দেখি কোনো ভাবেই কাঁদতে পারেন না। আগে কোনো ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে কান্না করার উপরে কোর্স নিন, তারপর রাস্তাঘাটে এসে কান্না করবেন। নাহলে মানুষজন দৌড়ে পালাবে আপনার কান্না দেখে। আর ফারিশ তো নিধির বাসায় এসেছিল, হয়তো দুজন কোথাও ঘুরতে বের হয়েছে।”
পিয়াসের কথা শুনে রেগে যায় না ইকরা, বরং সে ঠান্ডা মাথায় পিয়াস কে পুরো ঘটনা টা খুলে বলে।
★★
চেয়ারে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে নিধি। এতক্ষণ সে অচেতন ছিলো, মাত্র চেতনা ফিরেছে। চারদিকে তাকিয়ে ভয়ে কেঁপে উঠে সে। পুরো রুম জুড়ে একটা মাত্র জানালা, তাও অনেক উপরে। শুধুমাত্র আলো প্রবেশের জন্য যে জানালাটা ব্যবহৃত হয় তা বুঝাই যাচ্ছে। পুরো রুম জুড়ে একটা কাঠের চৌকি, অদূরেই পড়ে আছে একটা টেবিল। কাঠের টেবিলের উপরে একটা জগ আর একটা স্টিলের গ্লাস রাখা। আর একটা মাত্র চেয়ার যেখানে নিধিকে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না সে এখানে কি করছে? তীব্র মাথা যন্ত্রণার জন্য কিছু মনে করতে পারছে না সে। হঠাৎ ঠক করে রুমের দরজাটা খুলে যায়। এতে নিধি ভয়ে শিউরে উঠে। কেউ একজন হেঁটে নিধির দিকেই এগিয়ে আসছে, অজানা আতংকে নিধি ভয়ে জবুথবু হয়ে যায়। কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিটি নিধির সামনে এসে থামে। দরজা হালকা খোলা থাকায় অন্য রুম থেকে কিছুটা আলো প্রবেশ করেছে এই রুমে। সামান্য এই আলোর মধ্যে নিধি ছেলেটা কে সেটা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু সে ব্যর্থ হয়, মাথা ব্যথার জন্য সে কিছুই ভাবতে পারছে না। পিনপতন নীরবতার অন্তিম ঘটিয়ে রুমে আসা ছেলেটা হো হো করে হাসতে থাকে। এতে নিধি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে নিভু নিভু সুরে বলল,
“অয়ন ভাই আপনি?”
নিধির কথা শুনে অয়ন হাসি থামিয়ে নিধির দিকে তেড়ে এসে তার সামনে হাটু গেড়ে বসে নিধির চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“হ্যাঁ, তোর অয়ন ভাই আমি। ভুলে গেছিস একটু আগে ঘটা সব ঘটনা? মনে কর।”
বলতে বলতে অয়ন নিধির হাতের বাঁধন খুলে দেয়। দুপুরে ঘটা সব ঘটনা এতক্ষণে মনে পড়ে নিধির। দুপুরে অয়ন এসে নিধিকে জোরাজুরি করে বাসা থেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ পরে নিধি যখন কোনোমতেই যেতে চাচ্ছিল না, তখন নিধির মুখে স্প্রে করা রুপাল চেপে ধরে তাকে অজ্ঞান করে দেয় অয়ন, তারপর, তারপর আর কিছু মনে করতে পারে না নিধি। সে অয়নের দিকে রাগি চোখে তাকাতেই অয়ন ভয় পেয়েছে এমন ভাব করে বলে,
“আরে নিধু পাখি, আমি যে ভয় পেয়েছি। ইশ রে, আজকে নিধু পাখি টা আমার হবে। আজকে আর কেউ আটকাতে পারবে না আমাকে, এখানে তোর ওই সো কোল্ড ভাড়া করা ছেলেটা নেই যে তোকে বাঁচাবে। এখানে শুধু আমি আর তুই।”
বলেই অয়ন নিধিকে টেনে নিয়ে যায় অন্য একটা রুমে। রুমে নিয়ে গিয়ে নিধিকে বিছানায় ধা’ক্কা দিয়ে ফেলে দেয় অয়ন।
চলবে?