#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#সিজন_২
#সূচনা_পর্ব
#হালিমা_চৌধুরী
১.
বিয়ের পাত্র হিসেবে নিজের অফিসের বস মেহরাব ফারিশ শিকদার কে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় নিধি! দ্বিধাদ্বন্দ্ব তার চেহারায় মিশে আছে ভয়ে। নিধিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার মা মলি বেগম মেয়েকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন,
“কি হচ্ছে কি নিধি? কবুল বলছো না কেনো?”
মলি বেগমের কথা শুনে হুশ ফিরে নিধির, সে অসহায় অনুভব করল। তাকে যদি বলা হতো, একটা বেকার ছেলেকে বিয়ে করে নাও, তাহলে সে নির্দ্বিধায় বিয়ে করে নিতো। তবুও এই বদমেজাজি বাউণ্ডুলে ছেলেটাকে বিয়ে করতে চায় না সে।
ছোট একটা রুম, তার মধ্যে ৫ জন মানুষ নিধির পানে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। নিধি ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে একনাগাড়ে। ৫ জন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ নিধির দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে। নিধির মা তাকে বুঝিয়ে যাচ্ছে কবুল বলার জন্য। কিন্তু সে কবুল না বলে ফুপিয়ে কান্না করে যাচ্ছে। নিধির কাজে বিরক্ত হয়ে এক সময় ফারিশ খাটের উপর থাকা মিষ্টির প্লেটটা নিচে ছুড়ে মেরে রেগে বলল,
“এই মেয়ে, সমস্যা কি তোমার? আমি কি তোমাকে জোর করে বিয়ে করছি যে তুমি কবুল বলছো না? ন্যাকামি করছো তুমি?”
ফারিশের ধমক খেয়ে নিধির কান্না থেমে যায়, এদিকে ফারিশের আচরণে মলি বেগমের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তিনি মুখে কিছু প্রকাশ করলেন না। পরিবেশ টা এখন একদম নিস্তব্ধ, রুমের মধ্যে ফারিশ আর তার বন্ধু আর বন্ধুর বউ, বিয়ে পড়ানোর জন্য হুজুর আছে। রাগে থরথর করে কাঁপছে ফারিশ! ফারিশ কে এভাবে রেগে যেতে দেখে তার বন্ধু সাদিফ মলি বেগমের উদ্দেশ্য বলল,
“আন্টি, বিয়ে টা কি পড়ানো শুরু করবে হুজুর?”
মলি বেগম বলল,
“জি শুরু করুন!”
হুজুর বিয়ে পড়ানো শুরু করল, ফারিশ কে কবুল বলতে বলার সাথে সাথে সে কবুল বলে দেয়। এবার নিধির কবুল বলার পালা, কবুল বলার আগে নিধি একবার ফারিশের দিকে তাকায়। ফারিশের এলোমেলো চুলগুলো আজকে পরিপাটি, পরনে ধূসর রঙের পাঞ্জাবি। ফারিশের দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ, নিধি তার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবুল বলল। তখন রুম জুড়ে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে। বিয়ে শেষ হতেই হুজুর চলে যায়, তার কিছুক্ষণ পরেই ফারিশ আর তার বন্ধু রা চলে যায়। থেকে যায় শুধু নিধি আর তার মা। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও নিধি তার শ্বশুর বাড়ি না যাওয়ার কারণ, সে বিয়ে করার আগেই তার মা কে বলেছিল, সে এখনই শ্বশুর বাড়ি যেতে চায় না। পাত্রপক্ষ আপাতত বিয়েটা পড়িয়ে রাখতে পারে চাইলে। তাহলে সে রাজি হবে। মলি বেগমও তেমনই পাত্র খুজলেন মেয়ের জন্য। অল্প সময়ের মধ্যে একটা ভালো ঘরের সমন্ধ পেয়েও গেলেন তিনি। তাই আর দেরি না করে বিয়ের আয়োজন শুরু করে মলি বেগম। ছেলের পরিবারের কেউ নেই, তবুও রাজি হলেন মলি বেগম। বিয়ের আগে অন্য সব পাত্রদের মত নিধিকে দেখতে আসেনি ফারিশ। একদম বিয়ের দিন এসেছে সে।
★
নিধিদের দুই রুমের ছোট একটা বাসা, তবুও সেটা রঙচটা! সাথে একটা বারান্দা আছে। সেটা থেকে রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়। তার বাবা মারা যাওয়ার পর মা কে নিয়ে এই বাসায় উঠেছে সে, মা অসুস্থ আর বাবা না থাকায় নিধির উপরই সংসারের দায়িত্বটা এসে পড়ে। অনেক কাঠখোট্টার পর একটা চাকরি যোগাড় করতে পেরেছে সে। প্রথম বছর সে চাকরিটা নিয়ে খুশিই ছিল, কারণ তাদের কোম্পানির মালিক অনেক অমায়িক ছিলেন। নিধিকে একদম মেয়ের মত ভালোবাসতেন রাহুল শিকদার। কিন্তু হুট করে রাহুল শিকদারে মৃত্যু হয়, তারপর নিধির জীবনে নেমে আসে অমাবস্যা। অফিসের দায়িত্ব এসে পড়ে রাহুল শিকদারের একমাত্র বদমেজাজি বাউণ্ডুলে ছেলে ফারিশ শিকদারের উপর! ছেলেটা না পারতে অফিসের দায়িত্ব টা নিয়েছে নিধির মনে হতো! নুন থেকে চুন খসলে অযথা রাগারাগি করে ফারিশ। সেই বদমেজাজি ছেলেটার সাথে নাকি তার বিয়ে হয়েছে! আর ফারিশই বা কি ভেবে তাকে বিয়ে করল? ফারিশের লেভেলের সাথে তো তার লেভেল যায় না! এসবই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবছিল নিধি।
“কি রে, বৃষ্টি হচ্ছে তো। দাড়িয়ে আছিস কেনো এখানে?”
মলি বেগমের কথা কানে যায় না নিধির, সে একমনে বাহিরে দিকে তাকিয়ে আছে। নিধিকে নিরুত্তর দেখে মলি বেগম তার কাঁধ ঝাকিয়ে তাড়া দিল,
“খেতে আয় মা, কারেন্ট চলে যাবে মনে হচ্ছে। যা বাতাস হচ্ছে বাহিরে। কারেন্ট চলে গেলে আর অন্ধকারে খেতে পারবি না। তুই আয়, আমি ভাত দিচ্ছি।”
বলেই মলি বেগম রুমে চলে যায়। নিধি চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। নিজেকে সামলিয়ে রুমে গিয়ে মায়ের পাশে বসে সে। দুনিয়াতে নিধির আপন বলতে এখন শুধু তার মা রয়েছে, আর কেউ নেই। সারাদিন অফিস শেষ করে অসুস্থ মায়ের সেবা করতে হয় নিধির, এখন মলি বেগম কিছুটা সুস্থ আছেন। মলি বেগম আপন মনে মেয়ের জন্য খাবার বাড়তে ব্যাস্ত, নিধি একদৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কি নিষ্পাপ চেহারা তার মায়ের, এই নিষ্পাপ চেহারার মানুষটি নাকি সারাবছর এত অসুস্থ থাকে! কেউ বিশ্বাস করবে এটা?
**
সকাল সাড়ে সাতটা বাজে, নিধি এখনো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। মলি বেগম মেয়েকে তড়িঘড়ি করে ডেকে তুলেন। বৃষ্টির কারণে পরিবেশ টা নিস্তব্ধ, সেই উপলক্ষ্যেই নিধির এত ঘুম আজ। সে ভুলেই বসেছে তার যে অফিসে যেতে হবে। মলি বেগম ডাকার সাথে সাথে নিধি উঠে ছোটাছুটি করে রেডি হতে থাকে। অফিস শুরু আটটা থেকে, এখন অলরেডি সাড়ে সাতটা বাজে। নিধির বাসা থেকে অফিস যেতে আবার ১৫ মিনিট লাগে! নিধিকে তড়িঘড়ি করে রেডি হতে দেখে মলি বেগম বলল,
“অফিস যাচ্ছিস কেনো? আজকে অন্তত ছুটি নিতে পারতি তো!”
নিধি তড়িঘড়ি করে নিজের ব্যাগ নিতে নিতে বলল,
“তা আমি কি ছুটি চাইনি নাকি? ওই বাউণ্ডুলে টা ছুটি দিলে তো আমি ছুটি নিবো!”
মলি বেগম বলল,
“এমন করে কথা বলছিস কেনো মা? হাজার হোক, ছেলেটা এখন তোর স্বামী হয়।”
নিধি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“উনি অফিসে আমার কোনো বর টর নয়, আর বাদ দাও তো উনার কথা। ধুর, আজকের দিনটাই খারাপ যাবে আমার!”
বলেই নিধি রাস্তায় এসে দাড়ায়, রিক্সার জন্য অপেক্ষা করতে করতে পাঁচ মিনিট অতিক্রম হয়ে যায়, কিন্তু নিধি আর রিক্সা পায় না। অফিসে গেলে যে তাকে কি বিপদের সম্মুখীন হতে হবে সেটা ভেবেই নিধির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সে আর কোনোকিছু না ভেবে হাঁটা শুরু করে দেয়। হঠাৎ দ্রুতগতিতে একটা গাড়ি নিধির পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই নিধি পুরো কাদা পানিতে মাখামাখি হয়ে যায়। বৃষ্টি হওয়াতে রাস্তায় পানি জমেছে। গাড়ি দ্রুতগতিতে চলাতে রাস্তার পানি সব নিধির গায়ে এসে পড়ে, সে পানিতেই ভিজে টইটম্বুর হয়ে যায় নিধি। সে খেয়াল করে দেখলো গাড়িটা আর কারো নয়, তারই বস ওরফে তার বিয়ে করা বর মেহরাব ফারিশ শিকদার। মূহুর্তের মধ্যেই নিধির প্রচন্ড রাগ হয় ফারিশের উপর, ইচ্ছে করে তাকে ভিজিয়ে দিয়েছে আবার অফিসে গেলেও বকাঝকা করবে! প্রচন্ড রাগ নিয়েই নিধি বাড়িতে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে আবার অফিসের উদ্দেশ্য রওনা দেয়। অফিসে আসতে আসতে ৮:৪৫ বেজে যায়। নিধি এবার আর ভয় না পেয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে বসে। আজকে আর সে ভয় পাচ্ছে না, কারণ ফারিশের জন্যই নিধির দেরি হয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেই নিধি ফাইল নিয়ে বসে। হঠাৎ তার কেবিনের দরজা নক করে একজন কর্মচারী বলল,
“ছোট স্যার ডেকেছে আপনাকে!”
বলেই কর্মচারীটি চলে যায়, নিধি সেসবে পাত্তা না দিয়ে নিজের মনে কাজ করে যাচ্ছে। আবারো কেউ একজন নক করে দরজায়, নিধি এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
“আরে ভাই বললাম তো আসছি, তারপরেও কেনো এত ডাকছেন? হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে কোনো নবাব ডাকছে আমা…”
বলতে বলতে দরজায় দিকে ফিরে ফারিশ কে দেখে হকচকিয়ে গেল নিধি। সে তো ভেবেছিলো কোনো কর্মচারী এসেছে হয়তো, সেই জায়গায় বস নিজেই এসেছে! নিধির চুপসে যাওয়া মুখ দেখে বাঁকা হাসে ফারিশ, সে আরাম করে দরজায় হেলাল দিয়ে দাড়িয়ে বলল,
“কি হলো, থেমে গেলে কেনো? পুরো বাক্যটাকে সমাপ্ত করে মুক্তি দাও, আমিও শুনি একটু!”
ফারিশের কথা শুনে নিধির মুখে তিমির নেমে আসে৷ সে ইনিয়েবিনিয়ে বলল,
“না মানে, স্যার কেনো ডেকেছেন?”
ক্ষণিকের জন্য চোখ বুজেছিলো তন্ময়, নিধির কথা শুনে চোখ মেলে তাকাল সে।
“চু’মু খাবো, তাই ডেকেছি।”
ফারিশের কথা শুনে বিষ্ময়ে নিধির মুখ হাঁ হয়ে যায়। লজ্জায় সে এখনই আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে! সে কিভাবে মুখোমুখি হবে ফারিশের? নিধিকে এভাবে হাঁ করে থাকতে দেখে ফারিশের কপাল কুঁচকে এলো!
“স্টুপিড কোথাকার!”
বলেই ফারিশ চলে যায়, আর এদিকে নিধি ঘোরের মধ্যে চলে যায়। না জানি কেনো তাকে ডেকেছে এই লোকটা! যাবে নাকি যাবে না ভেবে ভেবে সে ফারিশের কেবিনের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।
চলবে?
শেষ বিকেলের প্রণয় সিজন-০১ পড়তে লেখাটির উপর ক্লিক করুন।