#শেষ_পরিণতি
( সিজন ২ পর্ব ৫ )
মার কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলে যাচ্ছি।
কিন্তু নিজেকে শান্ত রেখে বললাম,
-রাজনের উপর দিয়ে কি যাচ্ছে তাতো বুঝতেই পারছো।
আর কথাটা হয়ত আমার ভালোর জন্যই বলেছে।
মাকে এটা-সেটা বুঝিয়ে চুপ করিয়ে দিলেও, মনে মনে রাজনের প্রতি ঘৃণাটা আরও বেড়ে গেলো।
আমাকে কেন বাবার বাসায় গিয়ে থাকতে বলছে সেটা আমার মোটেও অজানা নয়।
এখন মার সাথে চলে যাওয়া বড্ড বোকামি হবে।
তাছাড়া আমার শ্বাশুড়িমাও সুস্থ নন। এ অবস্থায় তাকে রেখে আমি কোথাও যাবো না।
.
.
.
প্লেটে মাজেদা বেগমের পছন্দের সব খাবার সাজিয়ে নীলিমা মাজেদা বেগমের কাছে যায়।
নিজের মাথা ওড়না দিয়ে ঢেকে মাজেদা বেগমের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলে,
-আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আপনি শীঘ্রই আন্টি থেকে আমার শ্বাশুড়ি মা হতে যাচ্ছেন।
আমি জানি আপনি আমাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু আমি ধীরে ধীরে ঠিক আপনার মন জয় করে নেবো।কি নেই আমার মাঝে! আমি অত্যন্ত রূপবতী।কাজেও ভালো। এই যে দেখুন আপনার পছন্দের সব খাবার রান্না করেছি আজ। কথাটা বলে নীলিমা খাবারের প্লেট মাজেদা বেগমের সামনে তুলে ধরে।
.
রাজন কোন একটা মেয়ের সাথে নোংরামিতে মেতে উঠেছে বিষয়টা আমি কিছুতেই নিজের ভেতরে মেনে নিতে পারছিনা। ভাবছি নীলিমাকে সবটা শেয়ার করে হালকা হবো কিনা!
পরে ভাবলাম নিজেদের ভেতরে অন্য কাউকে টেনে আনা ঠিক না৷
আমি আনমনে হাঁটতে হাঁটতে নীলিমার রুমে ঢুকলাম। পুরো বাসা প্রচন্ড অগোছালে। নীলিমার স্বভাব ই এটা। ছোটবেলার কথা মনে পরে গেলো। আমি ছোট থেকেই ওর অগোছালো রুম গুছিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখতাম। ছোট থেকেই ওকে অসম্ভব ভালোবাসা দিতাম। সবাই নাকে বড় হলে এগুলো ভুলে যায়। নীলিমা ভুলেনি। এইযে আমার প্রেগিনেন্সির সময়ে ও আমার কত হেল্প করছে! ভাবতেই চোখের কোণে একটু পানি চলে আসলো৷ আমার বোনটা সত্যিই অনেক ভালো।
পুরো রুমে- এখানে সেখানে জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে।
ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা কসমেটিকস দেখে তো মনে হচ্ছে, এর উপরে ঝড় বয়ে গেছে।
টেবিলেরও সেই একই অবস্থা।
মেয়েটা আর কতোই বা করবে। সারাদিন বাকিদের যত্ন নিতে নিতে দিনশেষে নিজের খেয়ালই রাখতে পারে না।
আমি গিয়ে ওর টেবিলটা গোছাতে লাগলাম।
টেবিলের উপর থাকা ছোট ছোট জিনিসগুলো ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে একটা নীল মলাটের ডায়েরি দেখতে পাই।
আমি ডায়েরিটা বের করে হাতে নিলাম।
উপরের মোটা কভারটা উল্টাতেই দেখলাম, বড় করে লেখা, “মৌন কথা ” তার পাশে ছোট করে নীলিমার স্বাক্ষর।
ডায়েরিটা খুলে পড়তে ইচ্ছে হলো খুব।
কিন্তু কারও পারসোনাল ডায়েরি তার অনুমতি ছাড়া ধরা ঠিক না।
পরমুহূর্তে আবার ভাবলাম, ” নীলিমাতো ছোট থেকেই আমার কাছে সব কথা শেয়ার করে। ছোট বড় সব ধরনের কথা আমাকে না বললে ওর চলতোই না। ওর জীবনে মনে হয় না এমন কোনো সিক্রেট আছে যেটা আমার জানা নেই। তাহলে এই সামান্য ডায়েরি পড়লে কি বা হবে। ”
কথাটা ভেবে আমি ডায়েরির প্রথম থেকে পড়তে শুরু করি।
ডায়েরির প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে বুঝলাম ও কারও প্রেমে পড়েছে। ছেলেটাও ওকে ভালোবাসে খুব।
কিন্তু ডায়েরিতে ওদের রিলেশনের একটা বাঁধার কথাও উল্লেখ আছে।
বাঁধাটা নাকি অনেক জটিল। যার কারণে ওরা দু’জন এক হতে পারছে না।
পরের পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা, “খুব শীঘ্রই বাঁধাটাকে উপড়ে ফেলতে চলেছি। তারপর আমাকে আর কে আটকায়!”
এপর্যন্ত পড়ে আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। ডায়েরী থেকে আমাকে জানতে হবে কেনো
নীলিমা প্রেম করছে এমনকি ওর ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করার কথা ভাবছে!
রিলেশনের মাঝে আবার একটা সমস্যাও আছে সেটাও আমার সাথে শেয়ার করলো না!
কাজটা একদম ঠিক করেনি নীলিমা। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন।
ডায়েরিতে এপর্যন্ত কোথাও ছেলেটার নাম খুঁজে পেলাম না। আমি আরেকটা পৃষ্ঠা উল্টাতে যাবো ঠিক তখনই আমার কানে কিছু একটা ভাংগার শব্দ ভেসে এলো। শব্দটা আমার শ্বাশুড়িমার রুম থেকেই এসেছে বলে মনে হচ্ছে।
আমি ডায়েরিটা ড্রয়ারে রেখে কি হয়েছে দেখার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
দ্রুত শ্বাশুড়ি মায়ের রুমে গিয়ে দেখি ফ্লোরজুড়ে, খাবার ও ভাঙ্গা প্লেটের টুকরো ছড়িয়ে আছে। নীলিমা সেগুলো ক্লিন করছে।
আমি নীলিমাকে প্রশ্ন করি,
-কি হয়েছে, এসব ভাঙলো কি করে?
আমার প্রশ্নের উত্তরে নীলিমা বলে,
-আন্টির জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু রুমের ঢোকার সময় পা পিছলে পড়ে গেছে সব।
আমি ক্লিন করে ফেলছি এক্ষুনি।
-“আচ্ছা আমি তাহলে শ্বাশুটড়িমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি আবার।” বলে খাবার আনতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম।
_____________________
( গল্পের এ অংশটি তৃতীয় পুরুষে লেখা)
তুবা চলে যেতেই নীলিমা হাত থেকে সবকিছু রেখে মাজেদা বেগমের দিকে ঝুঁকে বলে,
-বেশি জিদ আর দেমাগ কোনোটাই কিন্তু ভালো না। আমার হাত থেকে খাবারের প্লেট ফেলে দিয়ে কিন্তু আপনি বিরাট ভুল করেছেন। তবে আমি রাগ করিনি। আপনাকে ভালোবেসে আপনার মন জয় করে নিব। বলে মাজেদা বেগমের কপালে চুমু খায়। মাজেদা বেগম ভ্রু কুচকে নাক মুখে প্রচন্ড ঘৃণা ফুটিয়ে তোলেন।
রাগে তার চোখ দু’টো লাল টকটকে হয়ে গেছে।
নীলিমা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সবকিছু পরিষ্কার করে করে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
_____________________
প্লেটে খাবার নিয়ে আমি আমার শ্বাশুড়িমাকে খাইয়ে দিলাম।
খাবার খাওয়ানো শেষে তাকে ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী মেডিসিন খাইয়ে দেই।
অতঃপর তাকে ঘুম পাড়িয়ে আমি নীলিমার কাছে চলে যাই।
ওকে বলি,
-তোর সাথে আমার কথা আছে।
-কি কথা?
আমি গম্ভীর গলায় নীলিমাকে বললাম,
-এখন কি তুই আর আমাকে বন্ধু মনে করিস না?
নীলিমা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-আমি মনে কষ্ট পেয়েছি খুব। তোর থেকে আমি এটা আশা করিনি।
আমার কথা শুনে নীলিমা আমার দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
আমি কন্ঠে গম্ভীরতা টেনে বললাম,
-তোর ডায়েরিটা আমি পড়েছি।পড়ে খুব অবাক হয়েছি জানিস তো!
আমার কথা শুনে নীলিমা অনেকটা ঘাবড়ে গেলো।
এক হাত দিয়ে আরেক হাতের আঙ্গুল কচলাতে শুরু করলো। নীলিমার কপাল বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ছুটছে।
ওর এমন অবস্থা দেখে আমি হেঁসে দিয়ে বললাম,
-আরে নীলিমা রিল্যাক্স। এতটুকু বিষয় নিয়ে এতো হাইপার হওয়ার কি আছে?
আমি জানি পরিস্থিতি ঠিক থাকলে তুই আমাকে জানাতি। তবে, আমি কিন্তু পুরো ডায়েরিটা পড়তে পারিনি।
কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে রেখে দিয়েছি। বাকিটা এখন তোর মুখ থেকে শুনবো।
আমার কথা শুনে নীলিমা লম্বা একটা শ্বাস নিলো।
টেবিলের উপর রাখা পানিভর্তি গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নিলো।
আমি আবারও বললাম,
-ছেলেটার নাম কি রে? পেশায় কি করে? আর তুই লিখেছিস যে, তোদের সম্পর্কে কোনো একটা সমস্যা আছে, যার কারণে তোরা এক হতে পারছিস না। কি সেই সমস্যা আমাকে বল!
দেখি আমি হেল্প করতে পারি কি না।
আমার কথার উত্তরে নীলিমা বললো,
-সত্যি বলছিস তুই হেল্প করবি আমাদের?
-হ্যা! করব না কেন?আমার লক্ষী বোনটার খুশির জন্য সব করতে রাজি। তাছাড়া আমি অনেক ভালোবাসার টিপস জানি। আমার টিপস ফলো করলে তোর ভালোবাসার মানুষ তোকে পাগলের মতো ভালোবাসবে।
দেখিস না রাজন আমাকে কতো ভালোবাসে।
(নীলিমাকে রাজনের কথাটা বলে, মনে মনে বললাম, আল্লাহ রাজনের মতো চরিত্রহীন জীবনসঙ্গী কাউকে না দিক।)
আমাদের কথা চলার মাঝেই কলিংবেল বেজে ওঠে।
আমি নীলিমাকে বলি, রাজন এসেছে মনে হয়।
শয়তানের নাম নিলাম, তো শয়তান হাজির।
নীলিমা আমার কথা শুনে বলে,
-কি বললি?
-কিছু না তুই যা দরজা টা খুলে দিয়ে আয়। আমাকে কিন্তু সময় করে বলবি একদম শুরু থেকে তোর প্রেমের গল্প।
নীলিমা বের হতে গিয়ে আবার ফিরে এসে আমার হাত ধরে বলে,
-তুবা প্রমিস কর, সমস্যাটা সমাধান করতে তুই আমাকে হেল্প করবি! আমার ভালোবাসার মানুষটাকে আমাকে পাইয়ে দিবি!
আমি নীলিমার হাত শক্ত করে ধরে বলি,
-প্রমিস করলাম। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
আমার কথায় নীলিমা খুশি হয়ে চলে গেলো।
.
.
.
মুখের উপর নরম কিছুর প্রবল চাপ প্রয়োগে বুঝতে পারলাম
মুখের উপর কেউ পূর্ণ শক্তি দিয়ে বালিশ চেপে ধরেছে। আমি নিজেকে মুক্ত করার অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।
হঠাৎ আমার কানে রাজনের কন্ঠ ভেসে এলো,আমি নিজের কাননে বিশ্বাস করতে পারছি না।
আর যাইহোক রাজন আমাকে খুন করতে চাইবে এটা আমি ভুলেও ভাবিনি।
কিন্তু না ভাবলেও এটাই সত্যি যে, আমি হয়ত আর কয়েক সেকেন্ড বেঁচে থাকবো।
তার থেকে কষ্টের কথা হলো এটা ভেবে যে, আমার মৃত্যুর কারণ “রাজন” যাকে আমি নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসতাম।
নিশ্বাস ফুরিয়ে আসায় গলা থেকে গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে আমার।
তবুও নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছি আমি।
শেষ পর্যন্ত পারবো কি না জানি না।
তবুও বাঁচার লড়াই করে যাচ্ছি আমি।
.
.
.
চলবে
– Tuba Binte Rauf