#শেষ_পরিণতি
সিজন ২
পর্ব ৪
আচমকা জানালার ওপাশে ধপাস করে কিছু পড়ার শব্দে আমি লাফিয়ে উঠলাম।
বিছানা থেকে উঠে জানালা খুলে বাহিরে তাকাই।
অন্ধকারে কিছু দেখতে না পেয়ে টর্চের আলো ফেলতেই আমি শিউরে উঠি।
জানালার পাশে একটা রক্তাক্ত দেহ দেখে চিৎকার করে উঠলাম।
চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এল আমার কাছে।
হাজারটা প্রশ্ন করা শুরু হয়েছে। কিন্তু যে দৃশ্য দেখেছি তাতে ভয়ে ভেতরটা আমার জমে গেছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে আমি ফ্লোরে বসে পরি।
চিৎকার করার কারণ জিজ্ঞেস করছে সবাই কিন্তু আমি মুখে কিছু বলতে না পেরে হাত দিয়ে জানালার দিকে ইশারা করলাম।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সবাই চমকে উঠলো।
রক্তাক্ত দেহটা আর কারও না।
আমার শ্বাশুড়ি মাজেদা বেগমের।
আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
ব্যথা এখনো সম্পূর্ণ সারেনি আমার,
এ অবস্থায় কোনোভাবেই বাইরে বের হওয়া সম্ভব না।
আমি বিছানার উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে দ্রুত রাজনকে কল করি।
কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে রাজন।
আমি কম্পিত কন্ঠে তাকে দুঃসংবাদটা জানাই।
ও বললো..
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এম্বুলেন্স খবর দিতে।
সবাই মিলে ধরাধরি করে শ্বাশুড়ি আম্মাকে এম্বুলেন্সে তোলে।
মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন তিনি।
রক্তে ভিজে গেছে তার জামাকাপড়।
মাকে এমন অবস্থায় দেখে আমি নিজেকে একটুও শান্ত রাখতে পারছি না।
তাকে হাসপাতালে এডমিট করানো হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আমার নিজের ভেতরে একটা চিন্তা এসে ভর করে। কেউ যেন আবার আমার বাচ্চাকে নিয়ে কথা না তোলে.. ও দুনিয়ায় আসতে না আসতেই বিপদ আসা শুরু করেছে রাজনের পরিবারের উপর।বেবীটাকে আবার খারাপ ভাগ্যের অশনি সংকেত না ভাবে কেউ। আমি আমার পেটে পরম মমতায় হাত বুলাই। এদিকে বুকের উপরে চাপা পরে আছে কষ্টের পাহাড়।
রাজনও খুব ভেঙে পড়েছে।
ওর জন্য আমার মায়া হচ্ছে খুব।
মাজেদা বেগমের দেহ থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য তাকে রক্ত দিতে হয়েছে।কিন্তু তার জ্ঞান এখনো ফেরেনি।
লাইফ সাপোর্ট এ রাখা হয়েছে তাকে।
দুদিন বাদে মাজেদা বেগমের জ্ঞান ফেরে। ডাক্তার জানায়, তিনি এখন বিপদমুক্ত। তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। তবে উপর থেকে নিচে পরে যাওয়ার সময় আঘাতটা ওনার মাথাতে বেশি লেগেছে।তাই উনার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে অনেক দেরী হতে পারে।
হাত পায় মাথায় ব্যান্ডেজ এবং ড্রেসিং করা অবস্থায় মাজেদা বেগমকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। তাকে দেখাশোনা করার জন্য নিয়োগ দেয়া হলো একজন নার্সকেও।নার্সের নাম ঝুমা।
যেদিন শ্বাশুড়ি মা কে নিয়ে আসা হলো বাড়িতে আমি তার কাছ থেকে এক মুহূর্তের জন্য ও উঠিনি। তিনি চোখ মেলে শুয়ে থাকেন শুধু৷ নড়তে পারেন না। কিছু বলতে পারেন না। মাঝে মাঝে চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে দেখা যায়৷ মনে একটা প্রশ্ন সবার ই উঁকি দিচ্ছে।শ্বাশুড়ি মা ছাদের রেলিং থাকা সত্তেও নিচে পড়লেন কিভাবে! এর পেছনে কার হাত আছে! তবে কাউকে সন্দেহ করে ঝামেলা সৃষ্টি করার চেয়ে শ্বাশুড়ি আম্মার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা করা ভালো। তার মুখ থেকেই সবটা জানা যাবে।
রাত ৩ টা বাজে।আমি শ্বাশুড়ি আম্মার পাশে বসে আছি।
কিন্তু হঠাৎ পেটে ব্যথা ওঠায় আমার জন্য আর বসে থাকা সম্ভব হচ্ছিলো না।
পেটে হাত দিয়ে আমি কাতরে উঠলাম। ঝুমা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। আমার কাতরানোর শব্দে চলে আসলো নীলিমাও।
নীলিমা এসে আমার হাত ধরে বললো,
-আমি তোকে শুরু থেকেই বলেছি এখানে তুই এসে বসে থাকিস না। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
তুই তোর রুমে যা।আমি আর ঝুমা মিলে আন্টির দেখাশুনা করব। আমি ধীর পায়ে উঠে আমার রুমে রুমে এসে শুয়ে পরি।
সকাল ৯ টায় নীলিমার ডাকে আমার ঘুম ভাঙে।
ও প্লেটে করে নাস্তা নিয়ে এসেছে।
-উফ নীলিমা! তোকে কতবার বলেছি এতোকিছু তোর করতে হবে না। এসবের জন্য বাসায় তো লোক আছে, তাই না! তুই এতো কষ্ট করিস এটা আমার ভালো লাগে না।
নীলিমা হাত থেকে নাস্তার ট্রে টেবিলের উপর রেখে আমাকে বলে,
-তোর প্রতি ডাক্তার এক্সট্রা কেয়ার নিতে বলেছেন।
খাবারদাবারের দিকেও নজর রাখতে বলেছেন।
বুয়ারা অনেক তেল ঝাল ও মসলা দিয়ে রান্না করে সবকিছু, আমি চাই না তুই এসব খা।
তাইতো নিজ হাতে তোর জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার বানিয়েছি।
– আমি একটু হেঁসে দিয়ে বলি, তুই সত্যি একটা লক্ষী মেয়ে। আম্মার উপর আমার উপর সমানে খেয়াল রাখছিস। এটা কিন্তু অতোটা সহজ না।
তোর মতো একটা বোন পেয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করি।
আমার কথা শেষে নীলিমা আমার হাত ধরে বললো,
-তুবা তুই কি চাস আমি সারাজীবন তোর পাশে থাকি?
আমি হেঁসে দিয়ে বললাম,
-অবশ্যই চাই। কিন্তু মেয়েদের জীবনটা অনেক ভিন্ন রে। চাইলেই কি আর সারাজীবন রাখতে পারবো তোকে?
এইযে দেখ আমারও তো আসতে হয়েছে মা বাবা সবাইকে ফেলে। এমন তো তোরও একদিন যেতে হবে।
আমার কথার প্রতি উত্তরে নীলিমা বললো,
-কিন্তু তুই চাইলে আমি সারাজীবন তোর সাথে থাকতে পারি। তারজন্য আমি তোর কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি, তুই যদি রাজি হয়ে যাস আমরা সারাজীবন একসাথে থাকতে পারবো।
নীলিমার কথায় আমি বেশ অবাক হই।
ভ্রু কুঁচকে ওকে প্রশ্ন করি,
-কেমন প্রস্তাব?
আমার প্রশ্নের উত্তরে নীলিমা কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই আমার নিজের মা এসে বলেন,
-তুবা ডাক্তার এসেছেন।
তোর শ্বাশুড়িকে নাকি একটা ইনজেকশন দিতে হবে।
ডাক্তারের কথা শুনে নীলিমা তাড়াতাড়ি উঠে রুম থেকে উঠে চলে গেলো।
আমি মাকে প্রশ্ন করলাম,
-ডাক্তার বলেছিলেন মায় ব্যাথায় ছটফট করলে ওনাদের জানাতে।কিন্তু তেমন কিছুতো হয়নি। হঠাৎ কিসের ইনজেকশন?
-হবে হয়ত কোনোকিছুর জন্য । ডাক্তার তো আর না বুঝে আসেন নি”
আমি মার কথায় সম্মতি জানিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আমার শ্বাশুড়ির রুমের দিকে চলে যাই।
কিন্তু মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে।নীলিমা
কোন প্রস্তাবের কথা বলতে চাচ্ছিলো আমাকে? যেটা মেনে নিলে ও আমার সাথেই থাকতে পারবে আজীবন!
.
আমার শ্বাশুড়ির রুমের সামনে গিয়ে শুনতে পাই, নীলিমা এবং ডাক্তার সাহেব কোনো একটা বিষয় নিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে।
আমি রুমে ঢুকতেই উভয়ে চুপ হয়ে গেলেন।
আমি ডাক্তার সাহেবকে বললাম,
-মার অবস্থা কেমন ?
ডাক্তার বললেন,
-অবস্থা কেমন তো এখনই বলা সম্ভব নয়।
আশা করছি সব স্বাভাবিক হবে শীঘ্রই।
এখন যে মেডিসিনটা দিলাম এতে রোগীর প্রেসার ঠিক থাকবে।
তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই।
আমি ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে শ্বাশুড়ির পাশে গিয়ে বসি।
“পেসেন্ট কথা বলতে পারলে সাথে সাথে আমাকে জানাবেন” বলে ডাক্তার চলে গেলেন।
.
.
.
বিকাল চারটার দিকে আমার শ্বাশুড়ি একটু নড়েচড়ে ওঠেন। আমি তার মাথার কাছে গিয়ে বসি।
মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে করে “মা” বলে ডাক দেই।
তিনি চোখ মেলে তাকান। আমি তাকে বলি,
-এখন আপনার শরীর কেমন লাগছে মা?
তিনি কোনো উত্তর দিলেন না।
আমি তার হাত ধরে বললাম,
-আপনার কি অনেক কষ্ট হচ্ছে?
তিনি তবুও কিছু বললেন না।
তার দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে। তাকে কাঁদতে দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।
রাজন শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
-তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?
রাজনের কথার উত্তরে মা বাম হাত দিয়ে ইশারায় কিছু বোঝাতে চাইলেন।
আমরা কেউ কিছু সঠিকভাবে বুঝলাম না।
উল্টো রাজন একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না।
এর ঠিক দু’দিন পরে ডাক্তার জানালো-
মাজেদা বেগম এর এক হাত এবং এক পা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। বাকি একটি হাত ও পা সচল আছে। মাথায় আঘাত লাগায় বেশকিছু নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে তিনি কথাও বলতে পারবেন না। সমস্যাগুলো স্থায়ী না হলেও ঠিক কতোদিন এমন থাকবে সেটা কারো জানা নেই।
এসব খবর শোনার পরে সবার মনে
বিষন্নতা নেমে এলো।পুরো বাড়ির প্রাণ ছিলেন মাজেদা বেগম।
তিনি যদি এভাবে নিরব হয়ে যান, বাসার সবাই ভালো থাকবে কি করে!
ভারাক্রান্ত মনে আমি এবং মা বসে ছিলাম আমার শ্বাশুড়ির রুমে।
নীলিমা কিচেনে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত।
আমার মনটা ভীষণ খারাপ। ক’দিন ধরে যা হচ্ছে এতে মন ভালো থাকারও কথা না। এর মাঝে আমার মা
আমাকে বললেন,
-সত্যি করে একটা কথা বলতো, রাজন আর তোর মাঝে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে?
আচমকা এমন প্রশ্নের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,
-হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করছো মা?
-কেন বলছি সেটা পরের কথা আগে বল, তোদের মাঝে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম “না”
মা আবার আমাকে বললেন,
-তাহলে যাওয়ার আগে আমাকে রাজন ওই কথাটা কেন বললো?
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-কোন কথা?
-আমাকে বললো, “তুবাও অসুস্থ, এদিকে মাও অসুস্থ। নীলিমা তো দু’জনকে একসাথে দেখাশোনা করতে পারবে না, আর আপনিও তো বেশিদিন এখানে থাকতে পারবেন না। এর থেকে বরং আপনি তুবাকে আপনার বাসায় নিয়ে যান। বেবি না হওয়া পর্যন্ত না হয় ওখানেই থাকলো”
রাজনের কথা শুনে আমি অনেক অবাক হয়েছিলাম জানিস তো মা, যেই রাজন তোকে ১ দিনের জন্য দূরে রাখতো না, সেই রাজন আজ এই কথা বললো! আমার মনে হচ্ছে, আমি এ বাসায় থাকছি এটাও বোধহয় ও পছন্দ করছে না।
মার কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলে যাচ্ছি।
কিন্তু নিজেকে শান্ত রেখে বললাম,
-ওর উপর দিয়ে কি যাচ্ছে তাতো বুঝতেই পারছো। আর কথাটা হয়ত আমার ভালোর জন্যই বলেছে।
মাকে এটাসেটা বুঝিয়ে চুপ করিয়ে দিলেও, মনে মনে রাজনের প্রতি ঘৃণাটা আরও বেড়ে গেলো।
আমাকে কেন বাবার বাসায় গিয়ে থাকতে বলছে সেটা আমার মোটেও অজানা নয়।
.
.
.
চলবে
লেখিকা- Tuba Binte Rauf