মমী মেয়েটা ভারী অদ্ভুত। মাকে নিয়ে প্রথম যেদিন ওকে দেখতে যাই সেদিন ওর প্রথম অদ্ভুত ঘটনা দেখলাম। ডাইনিং টেবিলে বসে আমাদের জন্য আপেল কাটছিল। ড্রয়িং রুম থেকে মুখ দেখতে না পেলেও আমি ওর ফর্সা হাতগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। সবগুলো আপেল কেটে সুন্দর করে সে প্লেটে সাজিয়ে রাখলো। তারপর হুট করেই নিজের বাম হাতের শিরায় ছুড়ি বসিয়ে দিল। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিলো। আমরা সবাই ভয় দুশ্চিন্তায় দৌড়াদৌড়ি করলেও, আমার মা ছিলেন খুবই বিরক্ত। উনার মতে মেয়ের মাথা পুরোই নষ্ট। এই মেয়েকে বাড়ির বউ করা সম্ভব না। আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসি। আমার হাসি দেখে মা নিরাশ হন। বুঝতে পারেন যে, বিয়ে করলে তার ছেলে এই মেয়েকেই করবে।
মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “আমার বাবা যা চায় তাই হবে।”
যাইহোক, হাত কাটার সাথে সাথে সে অজ্ঞ্যান হয়ে গেল। ওর বাবা প্রায় পাগলের মত হয়ে গেলেন। মেয়েকে কোলে নিয়েই ছুটতে ছুটতে গাড়িতে উঠলেন।
দুইদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল মমীকে। আমি ওকে দেখতে যাইনি। তবে মা গিয়েছিলেন। বাড়িতে নিয়ে আসার পর আমি ওকে দেখতে গেলাম। আমাকে দেখেই সে মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
–“আমাকে পছন্দ না?
ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসেনা। আমিও থেমে থাকিনা। ওর কপালটা ছুয়ে দিয়ে কিছু বলতে গেলেই সে ঝট করে মাথা সরিয়ে নেয়। এবার সে কথা বলে।
–“আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।
–“কেন?
মমী দুইসেকেন্ড কি যেন ভাবলো। তারপর বললো,
–“ভুল বললাম হয়তো। আপনি আমাকে বিয়ে করতে পারবেন না।
আমি আবার সেই একই প্রশ্ন করি,
–“কেন?
–“আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমার স্বামী আছে।
–“তাই?
–“আপনি হাসছেন? বিশ্বাস হয়নি আমার কথা তাইনা?
–“বিশ্বাস করবোনা কেন। করছি।
–“জোর করে বিশ্বাস করতে হবেনা। একটু অপেক্ষা করুন।
আমি তাচ্ছিল্যের সাথে বললাম,
–“কেন, তোমার স্বামী আসবে নাকি?
মমী আবার আগের ভার্সনে ফিরে গেল। চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লো। হয়তো সে আশা করেছিল ওর স্বামীর কথা শুনে আমি চমকে উঠবো। আমি মনে মনে হাসলাম। প্রচন্ড ভালবাসতে পারে মেয়েটা! কিছুক্ষণ ওভাবে শুয়ে থাকার পর সে উঠে বসলো। আমি হাসিমুখে বললাম,
–“কিছু বলবে?
–“হু।
মমী বিড়বিড় করে কথা বললেও আমার বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছিলো না।
–“সামির খুব রেগে আছে আমার ওপর। হয়তো সে ভেবেই নিয়েছে আমার বিয়ে হয়ে যাবে আপনার সাথে। আমি সবকিছু সহ্য করতে পারি, কিন্তু ওর চুপ থাকা সহ্য করতে পারিনা। চারদিন ধরে সে আমার সাথে কথা বলছে না। শুধু একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকছে। ও কেমন যেন হয়ে গেছে। এর জন্য দায়ী শুধু আপনি। আপনি এক্ষুনি আমার সামনে থেকে চলে যাবেন। প্লিজ যান!”
মমী প্রায় চিৎকার করে উঠলো এবং এবার সত্যি সত্যি চমকে উঠলাম।
.
“কেন?”
গালে হাত রেখে অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বে প্রশ্ন করলাম আমি। ছেলেটির নাম জামান। আমার ট্রেনের সহযাত্রী। একসাথেই সাথেই সিট পড়েছে। বয়স কত হবে জানিনা। পচিশ হতে পারে। আবার পয়ত্রিশ হলেও অবাক হবোনা। কনফিউজিং একটা চেহারা। জামান সাহেবের ধারণা উনি খুব ইন্টারেস্টিং একটা গল্প শোনাচ্ছেন আমাকে। কিন্তু গল্পের এতটুকু শুনে আমি ইন্টারেস্টিং কিছুই খুজে পাচ্ছিনা। জামান সাহেব আমার দিকে কিছুটা ঝুকে এসে বললেন,
–“সামির সম্পর্কে আমি সব জানতাম। মমীর সাথে ছেলেটার তিন বছরের সম্পর্ক ছিল। লুকিয়ে বিয়েও করেছিল ওরা। কিভাবে যেন বিয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। মমীর বাবা প্রচন্ড ক্ষেপে গেলেন। একসপ্তাহের মধ্যে উনি মেয়ের বিয়ের ব্যাবস্থা করে ফেললেন। যদিও বিয়ের প্রস্তাব আমার মা’ই প্রথম নিয়ে যান। মাকে নিয়ে ওদের বাসায় যাওয়ার চারদিন আগে সামিরের মৃত্যু হয়। বাসের সাথে এক্সিডেন্ট করে গুরুতর অবস্থায় তিনদিন হাসপাতালে থাকার পর মারা যায়। সামিরের ব্যাপারে আমি যে সব জানি, এটা মমীকে জানানো হয়নি। এমনকি সামির যে মারা গেছে সেটাও না! মমীর বাবা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন খুব। এমনিতেই সামিরের থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কারনে মেয়েটা আধপাগল হয়ে ছিল। তারওপর যদি ওর মৃত্যুর সংবাদ পেত তাহলে আর দেখতে হতোনা। তিনি চেয়েছিলেন যত দ্রুত সম্ভব মেয়েকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু আমার চমকে উঠার কারন সেটাই ছিল। মৃত মানুষ কিভাবে ওর সামনে আসবে?
.
আমি সোজা হয়ে বসে বললাম,
–“তারপর?
জামান সাহেব জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন,
–“আমি মমীর কাছে জানতে চাইলাম কোথায় দেখা হয়েছে? সে সংক্ষেপে বললো,
–“ছাদে।
–“কি কথা হয়েছে ওর সাথে?
–“সে আমার সাথে কথা বলছেনা। একটু আগেই বললাম।
–“তুমি ঠিক বলছো?
মমী ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালো,
–“আপনি সব জানেন, তাইনা?
আমি ইতস্তত করে বললাম,
–“হ্যা।
–“কি জানেন?
–“সামিরের সাথে তোমার সম্পর্ক আছে, বিয়ে হয়েছে এগুলো।
–“আর?
–“কই আর কিছুনা।
–“সামির কোথায় আছে সেটা জানেন?
-“না।
মমী আমার দিকে একপলক তাকিয়ে বললো,
–“এতসব জেনেও আমাকে বিয়ে করতে চান কেন? ভালবেসে ফেলেছেন? আমাকে চেনেন এই ক’দিন হলো। এত অল্প সময়ে সত্যি ভালবাসা যায়? আমিও ভালবেসেছি। তবে সেটা আপনার মত তিনদিনের পরিচয়ে নয়। তিনবছর! অনেকটা সময় তাইনা?”
.
মমী থামে। এই প্রথম একটানা এতগুলো কথা সে আমার সাথে বলল। আমি চুপ করে থাকি। কিছু বলিনা। ঠিক কতটা সময় ধরে ভালবাসি ওকে জানানো হয়না। তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বলি, ওর স্কুলে ফেলে আসা পরিত্যক্ত চুলের কাটা এখনও আমার কাছে সযত্নে আছে। ওর কলেজে হারিয়ে যাওয়া সেই ডায়েরিটা আমিই চুরি করেছিলাম। ভার্সিটিতে আমার একটাই কাজ ছিলো। মমী নামের মেয়েটিকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা। কিন্তু সে আমার দিকে ভালমত তাকাতো পর্যন্ত না। কখনো খেয়ালই করেনি! যেদিন শুনলাম সামির নামে একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে, সেদিন বাড়ি ফিরে মায়ের কোলে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে ছিলাম। বিশ্বাস করুন তখনও আমি কাদিনি। কিন্তু মা যখন জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? তখন চোখদুটো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। গলা চিরে চিৎকার বেরিয়ে এল। মূহুর্তেই মা আমাকে সামলে নেন। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
“সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। ঠিক না থাকলেও আমি ঠিক করে দেব।”
.
মায়ের কথা শুনে আমি ভরসা পাই ঠিকই। কিন্তু চিন্তা গুলো আমাকে ছেড়ে যায়না। মমীকে ছাড়া আমার জীবন আমি কল্পনাই করতে পারিনা। ঘুম, খাওয়া, পড়াশোনা সব গোল্লায় গেলো। অসুস্থ হয়ে কিছুদিন বিছানায় পড়ে রইলাম। এর একমাস পর মমীর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু তারআগে মা আমার কাছে এসে বসে বললেন,
–“এই মেয়ে তোর যোগ্য না বাবা। লুকিয়ে বিয়ে করেছে শুনলাম। এখন নাহয় ওর বাবা-মা মানছেনা। কিন্তু একদিন ঠিকই ওদের সম্পর্ক মেনে নেবেন। সব জেনেশুনে কিভাবে আমি এগুবো?”
আমি শান্ত কন্ঠে বললাম,
–“ছেলেটা বেচে নেই মা। মারা গেছে।
–“সেকি! কবে?
মা অতিরিক্ত রকমের চমকে উঠেন। নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হয় তখন। কারো মৃত্যুতে খুশি হওয়া কোন ভাল মানুষের কাজ নয়। কিন্তু না চাইতেও আমার খুশি লাগছে। মা কিছুক্ষন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
–“ঠিক আছে বাবা। কাল যাব ওদের বাসায়। তুই একটু কিছু মুখে দে।”
.
জামান সাহেব থামলেন। আমি বললাম,
–“বিয়ে কি হয়েছিল?
–“হ্যা। সেদিন ওদের বাসা থেকে আসার পর মমী বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেল।কোনরকম আপত্তি না করে সে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। একদম ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা হলো। ওর এই ব্যাবহার দেখে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম আমি। আর সবচেয়ে বেশি নির্লিপ্ত থাকতে দেখেছি আংকেলকে অর্থাৎ মমীর বাবাকে। মেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে এতেই তিনি মহাখুশি। শেষপর্যন্ত আমি উনাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম কিভাবে কি হলো। উনি মন খারাপ করে বললেন,
–“মেয়ের ভালোর আজ অনেক বড় মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি। বলেছি, সামির অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে কানাডা চলে গেছে। সুখেই আছে। আমার মেয়েটা আর একটা প্রশ্নও করেনি। শুধু বলল, “বিয়ের আয়োজন করো বাবা।”
আসল কারন জানতে পেরে কিছুটা শান্তি পেলাম। মমী আমার মাকে অসম্ভব পছন্দ করতো। ওর মা নেই। হয়তো আমার মায়ের মধ্যে সে নিজের মাকে খুজে পেয়েছিল। আমার মা’ও তো আর কম ভালবাসেন নি ওকে!
.
বিয়ের পর মমী আমার সাথে তেমন একটা কথা বলতো না। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ছিল। তবে সবসময় আমার আশেপাশেই থাকতো। আমার পছন্দ-অপছন্দ, ভাল লাগা-মন্দ লাগা সবকিছু ততোদিনে ওর মুখস্থ। এক কথায় বলতে গেলে আমাকে আমার থেকে বেশি চিনে ফেলেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম মেয়েটা আবার ভালবেসেছে, দ্বিতীয়বারের মতো প্রেমে পড়েছে। আমার তখন মনে হয় পৃথিবীতে আর কিছু চাওয়ার নেই। সব পেয়ে গেছি। এবার মরে যাই! বৃষ্টি ওর খুব পছন্দের। ঝুম বৃষ্টি হলেই তাকে ছাদে পাওয়া যায়।সেদিনও ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিলো। কিন্তু মমী ছাদ থেকে নামছিলো না। শেষমেশ কোলে করে নিয়ে আসছিলাম। সেদিন প্রথম মেয়েটা আমার চোখে চোখ রাখলো। আমিও মুগ্ধ হয়ে ওর চোখে প্রেম খুজি। কিন্তু হায়! ঐ চোখে দেখতে পেলাম রাজ্যের অস্বস্তি! ইচ্ছে করছিল ঐ অস্বস্তিভরা দুই চোখের মধ্যে দুটো ভালবাসা একে দিয়ে জিজ্ঞেস করি, “এত মায়া কেন ঐ আখিপল্লবে? সামলে রাখো, হাইজ্যাক হয়ে যাবে তো!”
একটার পর একটা হাচি দিতে দিতে সে ভেজা চুল মুছতে ব্যস্ত। আমি ব্যস্ত কন্যাকে কাছে টেনে এনে বলি,
–“বিয়ের পর আমরা কোথাও বেড়াতে যাইনি। যাবে আমার সাথে?
সে কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসে। বাচ্চাদের মতো জিজ্ঞেস করে,
–“কোথায়?
–“তুমি যেথায় চাইবে সেথায়।
সে একমূহুর্ত না ভেবে বলে উঠলো,
–“সিলেট যাবো।
আমি হতাশ হই। ভাবলাম দেশের বাইরে কোথায় যেতে বলবে। হতাশা চেপে বলি,
–“ওকে আমি এখুনি ফ্লাইটের টিকিট বুক করছি।
–“উহু, প্লেনে না। আমরা যাবো ট্রেনে।
–“জো হুকুম ম্যাডাম।
.
জামান সাহেব আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন,
–“এইযে আমি এত আগ্রহ নিয়ে আমার গল্পটা বলছি, আপনার কি মনে হয়, এতলোক থাকতে আপনাকেই কেন বলছি?
আমি ঠোঁট ওল্টে বললাম,
–“জানিনা। আপনার গল্পের তো হ্যাপি এন্ডিং হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। শেষ নাকি কাহিনী?
–“কাহিনী তো সবে শুরু হলো। শুনুন তারপর কি হলো। অনেক চেষ্টা করেও ট্রেনে প্রাইভেট কেবিন পেলাম না। শেষমেশ আমরা পাবলিক সিটেই উঠলাম। আমাদের সিটের উল্টো পাশে একজন মেয়ে আর বৃদ্ধ মহিলা আগে থেকেই বসে ছিলেন। মজার ব্যাপার হল, মেয়েটি দেখতে হুবহু আপনার মত। এজন্যই আমি জিজ্ঞেস করছিলাম আপনার কোন জময বোন আছে কি-না। যাইহোক, মমী জানালার পাশে বসে খুব দুশ্চিন্তা করছিলো। আমার ইনহেলারটা আনা হয়নি। হঠাৎ যদি শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাহলে সে কি করবে? আমি ওর মন ডাইভার্ট করার জন্য বললাম,
–“ক্ষিদে পেয়েছে। আছে কিছু?
মমী তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে রান্না করে আনা পায়েসের বক্সটা বের করলো। সাথে একটা চিঠি। মমী হেসে বললো,
–“জামান শুনো! খেতে খেতে এই চিঠিটা পড়বে। ঠিক আছে?”
আমি বললাম, “তুমি আমার জন্য চিঠি লিখেছ? ওয়াও!”
উত্তরে মমী কিছু বললো না। অল্প হাসলো শুধু। আমি পায়েস খেতে খেতে চিঠি পড়া শুরু করলাম।
.
“জামান,
তুমি আমার প্রিয় হতে পারোনি এখনও। কখনো হতেও পারবে না। তাই ওই শব্দটি ব্যাবহার করলাম না। আমার “প্রিয়” আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু আমি ওকে ভুলে যাইনি। প্রিয়দের ভুলা যায়না।
বিয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর বাবা আমার মোবাইল কেড়ে নিলেন। দুইদিন সামিরের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। তারপর কি মনে করে বাবা আবার নিজেই মোবাইলটা ফেরৎ দিয়ে দিলেন। আমি তখন পাগলের মতো সামিরকে কল করছিলাম। বাট ফোন অফ! ওর বেস্ট ফ্রেন্ড শাহিন ভাইকে যখন কল দিতে যাবো, তখনই তুমি উদয় হলে তোমার মাকে নিয়ে। মাথায় রক্ত উঠতে বেশি সময় লাগলো না আমার।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর বাবা আমাকে তার পাশে বসিয়ে বলেছিলেন, সামির আমার থেকে অনেক ভালো একটা মেয়েকে বিয়ে করে কানাডা চলে গেছে। আমিও যেন নিজের জীবনটা গুছিয়ে নেই। আমি মনে মনে হাসলাম। মেয়ের জীবণ গুছাতে গিয়ে তিনি কত সুন্দর গুছিয়ে মিথ্যে বলছেন! তাও এমন একটা মানুষের নামে যে কি-না পৃথিবীতেই নেই। বাবা এত বোকা কেন বলতো? উনি কি করে ভাবলেন যে এত বড় সত্য এভাবেই চাপা থাকবে! তার ওপর কি বিশ্রী মিথ্যা গল্প সাজিয়েছেন! তুমিই বলো, মৃত মানুষদের নিয়ে মিথ্যা বলা কি ঠিক?
আমি জানি তুমি অবাক হও কম। সামির মারা গেছে এটা আমি জেনে ফেলেছি। তাও তুমি অবাক হচ্ছোনা। কত সুন্দর পায়েস খাচ্ছো।
তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই, আমি বলেছিলাম সামিরের সাথে আমার ছাদে দেখা হয়েছে। তুমি তখন চমকে উঠেছিলে। তোমার চমকানো দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আসলেই সব জানো। আমি ইচ্ছে করেই মিথ্যা বলেছিলাম। যাতে তুমি আমার ভুলটা ধরিয়ে দাও। ভেবেছিলাম হয়তো তুমি আমাকে সব বলবে। কেনো বলবেনা, ভালবাসো না আমায়? ভালবাসার মানুষের কাছে কিছু লুকাতে হয়না। কিন্তু তুমি কিছুই বললেনা।
যাইহোক মূল কথায় আসি।হাত কেটে আমি যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম, কাকতালীয়ভাবে জীবনের শেষ কয়টা দিন সামির সেই হাসপাতালেই কাটিয়েছিল। গোলগাল চেহারার নার্স মেয়েটা তোমার মা’কে দেখে যারপরনাই অবাক হলো। একবার আমাকে এসে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, উনি কে? তখনও মেয়েটা হয়তো কিছু বলতো না, যদিনা আমার মোবাইলের স্ক্রিনে সে সামিরের ছবি দেখতো। ভীতু স্বভাবের সেই নার্সটা আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
–“এই ভাইজানকে আমি চিনি আপা। এই হাসপাতালেই মারা গেছে। কিন্তু একমাত্র আমি জানি উনার মারা যাওয়ার কথা ছিলনা। ঐ বুড়ো মহিলা নিজের হাতে অক্সিজেন মাস্ক খুললো, স্যালাইন বন্ধ করে দিলো! সন্ধ্যার আবছা আলোয় দেখা সেই মুখ আমি কোনদিনও ভুলবোনা। ঘটনা শুধু আমিই দেখছিলাম। আমি ব্যাপারটা ভাল করে বুঝার আগেই ফোন আসলো, আমার মেয়েটা পুকুরে ডুবে গেছে। বাবার সাথে গ্রামে বেড়াতে গেছিলো। আমার আর কোন হুশ ছিলোনা আপা। গ্রাম থেকে ফিরে এসে শুনি ছেলেটা মারা গেছে। বড় স্যার ব্যাপারটা বুঝেও কেন এড়িয়ে গেলেন আমি জানিনা আপা।” “–
নার্স মেয়েটার কি হলো জানিনা। হঠাৎ আমার হাত-পা ধরে কাদতে কাদতে বলল যেন ওর কথা কাউকে না বলি। আমি ওকে আশ্বস্ত করলাম। সে অভয় পেয়ে চলে গেল।
তোমার মা কেন এই কাজটি করলেন আমি ঠিক জানিনা। আর জানতে চাইওনা। আমি শুধু জানি তিনি আমার প্রিয়’কে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। ব্যাস!
বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম তোমার মায়ের কারণেই। তবে সেটা উনাকে ভালবেসে নয়, তীব্র ঘৃণা থেকে। উনি আমার কাছ থেকে আমার পছন্দের মানুষটাকে কেড়ে নিয়েছেন। আমার তখন কেমন অনুভূতি হয়েছিল সেটা উনি জানেন না। কিন্তু আমি উনাকে জানাতে চাই। প্রিয় মানুষগুলোকে কেউ দূরে সরিয়ে দিলে কেমন লাগে সেটা উনার জানার খুব দরকার। পায়েসটা কেমন হয়েছে জামান? জীবনের শেষ খাবারের স্বাদ কেমন হয়? অমৃত?”–
.
বৃষ্টির ঝাপটা আমার চোখে মুখে পড়তেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঝাপসা দৃষ্টিতে একবার সামনের সিটে চোখ বুলালাম। কিন্তু জামান নামের ছেলেটাকে দেখতে পেলাম না। একমিনিট ঝিম মেরে বসে থাকার পর আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। সবসময় আমি নিজেকে নিয়ে অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এই স্বপ্ন দেখার মানে কি?
–“ট্রেনে বসে ভালই তো ঘুমাস!
মায়ের গলা শুনতে পেলাম। জানালাটা টেনে দিতে দিতে তিনি কথা বলছেন। ট্রেন এখনও ছাড়েনি। ট্রেন ছাড়ার এক ঘন্টা আগে এসে বসে থাকা আমার অভ্যাস। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। মা বকবক করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমি ভাবছি স্বপ্নটার কথা। ব্যাক্তিগতভাবে জামান নামের কাউকে চিনিনা আমি। সম্পুর্ণ অচেনা কাউকে স্বপ্নে দেখা যায়? যায়তো! একটু আগেই দেখলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল? ছেলেটার কিছু হয়েছিল? আমার সকল ভাবনা উপেক্ষা করে আমাদের পাশের সিটে একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে এসে বসলো। এরা দুজন যে স্বামী-স্ত্রী এটা বুঝতে আমার বাকি রইলো না। ছেলেটা একবার আমার দিকে তাকালো। আমি এমনভাবে হা করে তাকিয়ে ছিলাম যে সে তাকাতে বাধ্য। মেয়েটা জানালার পাশে বসে বিশাল ব্যাগের চেইন খুলতে শুরু করেছে। পায়েসের বক্স আর একটা কাগজ বের করে দুটোই জামানের দিকে এগিয়ে দিল। ঘটনাগুলো যেন অতিদ্রুত ঘটছে। আচ্ছা আমি এত শিওর হচ্ছি কি করে যে ওই ছেলেটার নামই জামান? আমার মনের সন্দেহ দূর করতেই যেন মেয়েটা বলে উঠলো,
–“জামান শোনো! খেতে খেতে এই চিঠিটা পড়বে। ঠিক আছে?”
আমার কেমন জানি দম বন্ধ লাগছে। সেখান থেকে উঠে আমি ওয়াশরুমে চলে গেলাম। স্বপ্ন নিয়ে অতিরিক্ত ভাবার কারনেই এমনটা হচ্ছে। চোখে মুখে পানির ঝটকা দিয়ে মনে মনে নিজেকে বুঝালাম, “দিনে দুপুরে হ্যালুসিনেসন দেখতে হয়না তানি! হ্যালুসিনেসনের জন্যে রাতের বেলাই উপযুক্ত। বাড়িতে গিয়ে নাহয় ইচ্ছেমত হ্যালুসিনেসনে ওদের দেখো। এখন সিটে গেলে তুমি অবশ্যই ওদের দেখতে পাবেনা। ঠিক আছে? ওয়েল, দ্যাটস গুড!”
.
আমি লম্বা দম নিয়ে আমাদের সিটে গেলাম এবং দেখলাম আমার মা আয়েশ করে ওদের সাথে বসে পায়েস খাচ্ছে। আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। মায়ের হাত থেকে পায়েসের বাটিটা প্রায় ছিনিয়ে নিলাম। আমার এই আচরণে মেয়েটা বেশ অবাক হলো বোধহয়। আহত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
–“আসলে মায়ের ডায়েবেটিসের সমস্যা আছে।”
ইতস্ততভাবে বললাম আমি। মা আমার আচরণে হতাশ হয়ছেন। লোভাতুর দৃষ্টিতে বাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। বেশ খানিকটা খেয়ে ফেলেছেন। কপাল থেকে ঘাম বেয়ে থুতনি দিয়ে পড়ছে আমার। আমি উদ্বেগ নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। আসলে আমি বুঝতে পারছিনা আমার এখন কি করা উচিত। ঐ ছেলেটাকেও বাধা দেব? কিন্তু কেন? কারনটা বলতে গেলে নির্ঘাত আমাকে পাগল ভাববে। নিজেকে পাগল প্রমাণ করার কি দরকার? আমি ঘড়ি দেখলাম। ট্রেন ছাড়তে এখনও দুইমিনিট বাকি। মাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমরা ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। পাশেই পরিচিত একজন ডাক্তার আংকেল আছেন। মাকে উনার কাছে নিয়ে গেলাম। আংকেল খুশিতে সবগুলো দাত বের করে বললেন,
–“আজকালকার দিনে এত কেয়ারিং সন্তান দেখাই যায়না। মাকে নিয়ে কত চিন্তা তোমার। তবে এত চিন্তার কোন কারন নেই। তোমার মা একদম ফিট এন্ড ফাইন আছেন।”
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মা ঠিক আছেন মানে জামান ছেলেটাও ঠিক আছে। শুধু শুধু চিন্তা করছিলাম। কিন্তু তারপরও একরাশ বিষন্নতা আমাকে ছেয়ে গেল। মনের ভেতরটা খুতখুত করতেই থাকলো।
.
.
–“তুই বলছিস তোর স্বপ্নের সাথে ট্রেনের ঐ ঘটনার মিল আছে! আর আমি এটা বিশ্বাস করবো?
আমার কথা শুনার পর আপুর প্রথম বাক্য ছিল ওটা। টেবিলের ওপর “স্বপ্ন দেখা” বিষয়ক একটা বই দেখে খুব আগ্রহ নিয়ে বসেছিলাম। কিন্তু আপুর কথা শুনে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বিরক্ত কন্ঠে বললাম,
–“বিশ্বাস না করার কি আছে?আমি কি বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলবো তোমাকে?
–“কিন্তু আমিতো কোন মিল খুজে পাইনা। চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী পায়েসে বিষ থাকার কথা। সেরকম কিছুইতো হয়নি। আর ছেলেটাও মারা যায়নি।
–“চিঠিতে কি লেখা ছিল “এই খাবারে বিষ আছে”?
আপু থতমত খেয়ে বললেন,
–“না। তা অবশ্য নেই।
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
–“পরেরদিন সকালে নিউজপেপারে খবরটা পাই আমি। ছেলেটা মারা গিয়েছিলো।”
আপু আৎকে উঠে বললেন,
–“বলিস কি?
–“হু।
–“এখন আবার এটা বলিস না যে পায়েস খেয়ে মারা গেছে। আমি বিশ্বাস করছিনা।
–“আমি এটা বলছিও না। কারন ওর মৃত্যু হয়েছে শ্বাসকষ্ট প্লাস হার্ট এট্যাকে।
–“ও।
ভাবতে ভাবতে আপু বললেন,
–“কিন্তু আমি একটা ব্যাপার বুঝলাম না। মমী যদি কিছু না করেই থাকে তাহলে সে কিভাবে জানলো যে ওটাই ওর শেষ খাবার?
–” ওরই তো জানার কথা। কারন পরোক্ষভাবে এই মৃত্যুর সাথে মমীই জড়িত।
–“মানে বুঝলাম না।
বই বন্ধ করে আমি টেবিল ছেড়ে উঠলাম। তারপর আপুর পাশে বসে বললাম,
–“বিষ পায়েসে না, চিঠির মধ্যে ছিল। চিঠি পড়ার পর সবার প্রথম যে কথাটা মাথায় আসবে সেটা হচ্ছে, পায়েসে কিছু একটা মেশানো আছে। আমিও প্রথমে সেটা ভেবে মাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। যাইহোক, জামান ততোক্ষনে বেশ খানিকটা খেয়ে ফেলেছিল। ওর মাথায় ঢুকে গিয়েছিল যে সে বিষ জাতীয় কিছু খেয়ে ফেলেছে। তারপর শুরু হয় ওর শ্বাসকষ্ট। ইনহেলারটা ইচ্ছে করেই আনা হয়নি। ইনহেলার না পাওয়া এবং বিষের ব্যাপার, দুই মিলিয়ে জামান প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে সে হার্ট এট্যাক করে। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো সে বেচে যেত। কিন্তু মমী এটা করেনি। কৌতুহলী হয়ে আমি জামান সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনেছি। এমনিতেই সে ছিল “প্যানিক ডিসঅর্ডারের” রোগী। একধরনের মানষিক রোগ যাকে বলে। যারা অল্পতেই ভয় পায়, উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বিয়ের পর মমী খুব ভাল করেই জামানকে অব্জার্ভ করে। কিভাবে কি করতে হবে সে ভাল করেই জানতো।”
.
আপু কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর বললেন,
–“তারমানে ওর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুটার ব্যাপারে তুই ছাড়া আর কেউই জানেনা?
আমি আঙুলে চুল পেচাতে পেচাতে বললাম,
–“উহু, আমি নিশ্চিত আরেকজন জানে। মমী নিজে থেকেই তাকে জানাবে।
–“কাকে?
এবার আমার সত্যিই বিরক্ত লাগছে। হাই তুলতে তুলতে বললাম,
–“অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাও।”
.
স্যান্ডেল পড়ে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। ভরা পূর্নিমার এই রাতে আমি ভাবছি, ট্রেনে ঘটা সেই ঘটনা, সেই মুহূর্ত অথবা সেই দৃশ্যটা কি আমার জন্যেই থমকে ছিলো? কি জানি! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি আমি। পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে প্রকৃতি আমার সাথেই কেন এই রহস্য শেয়ার করলো, সেও এক রহস্য ……..!
We use cookies on our website to give you the most relevant experience by remembering your preferences and repeat visits. By clicking “Accept All”, you consent to the use of ALL the cookies. However, you may visit "Cookie Settings" to provide a controlled consent.
This website uses cookies to improve your experience while you navigate through the website. Out of these, the cookies that are categorized as necessary are stored on your browser as they are essential for the working of basic functionalities of the website. We also use third-party cookies that help us analyze and understand how you use this website. These cookies will be stored in your browser only with your consent. You also have the option to opt-out of these cookies. But opting out of some of these cookies may affect your browsing experience.
Necessary cookies are absolutely essential for the website to function properly. These cookies ensure basic functionalities and security features of the website, anonymously.
Cookie
Duration
Description
cookielawinfo-checkbox-analytics
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Analytics".
cookielawinfo-checkbox-functional
11 months
The cookie is set by GDPR cookie consent to record the user consent for the cookies in the category "Functional".
cookielawinfo-checkbox-necessary
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookies is used to store the user consent for the cookies in the category "Necessary".
cookielawinfo-checkbox-others
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Other.
cookielawinfo-checkbox-performance
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Performance".
viewed_cookie_policy
11 months
The cookie is set by the GDPR Cookie Consent plugin and is used to store whether or not user has consented to the use of cookies. It does not store any personal data.
Functional cookies help to perform certain functionalities like sharing the content of the website on social media platforms, collect feedbacks, and other third-party features.
Performance cookies are used to understand and analyze the key performance indexes of the website which helps in delivering a better user experience for the visitors.
Analytical cookies are used to understand how visitors interact with the website. These cookies help provide information on metrics the number of visitors, bounce rate, traffic source, etc.
Advertisement cookies are used to provide visitors with relevant ads and marketing campaigns. These cookies track visitors across websites and collect information to provide customized ads.