শেষ ঠিকানা পর্ব-০৫

0
410

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_৫ (বোনাস পার্ট)
#মেহরিন_রিম
_অর্নবকে হসপিটালে দেখতে পেয়ে আমরা সবাই অনেকটা অবাক হয়ে যাই কারণ আমি জানতাম ও ইতালিতে আছে। আমরা তখন অনেক টেনশন এ থাকায় ওকে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তুমি ভালো আছো জানার পর ও আমাদের সাথে কথা বলতে চায়।

হিমি মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার মা রিপার বলা কথাগুলো, মনে মনে ভাবছে,
_সেদিন উনি হসপিটালে এসেছিলেন!কই আমি দেখলাম না তো।

রিপা কিছুটা থেমে আবার বললেন,
_অর্নব সরাসরি এসে বলে ও তোমাকে বিয়ে করতে চায়। ঐ পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে এসব নিয়ে ভাবা সম্ভব ছিলো না বলে আমরা ওর থেকে কিছুটা সময় চাই। হসপিটাল থেকে ফেরার পর অর্নব আবারো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, বলেছিলো যেন তোমাকে ওর ব্যাপারে কিছু না বলি। তাই..

_তাই তোমরা আমার থেকে এসব লুকিয়ে যাবে মা? তোমাদের কাছে আমার থেকে ঐ লোকটা বেশি দামি হয়ে গেলো? বাবা তুমিও!
মায়ের কথার মাঝেই রাগী স্বরে কথাটা বললো হিমি। রিপা আবারও বললেন,
_আমরা প্রথমে বিষয়টা নিয়ে ভাবিনি হিমি। পরবর্তীতে অর্নব পারিবারিকভাবে তোমাকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠায়।

চুপ করে রইলো হিমি,বাবা মায়ের সিদ্ধান্তের উপর কখনো কিছু বলেনি হিমি। এখন যদি বাবা মা তাকে বিয়ের জন্য জোর করে, কথাটা ভেবেই ভয় হচ্ছে হিমির। মানিক সাহেব এবার বসা থেকে উঠে দাড়ালেন,হিমির কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বললেন,
_তোকে আমি কখনো কোনো বিষয়ে জোড় করিনি মা। অর্নব অত্যন্ত ভালো একটা ছেলে,প্রতিটা বাবা মা ই চায় তাদের সন্তানের জন্য যোগ্য পাত্র খুজে বের করতে। অর্নবকে তুইও চিনিস,আর আমরাও খুব ভালো করেই চিনি। ও কেমন ছেলে সেটা আমরা সবাই জানি।

কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন মানিক সাহেব। তারপর আবারো বললেন,
_তবে আমি তোকে জোড় করবো না। তুই যেই সিদ্ধান্ত নিবি সেটাই হবে।
কথাটা বলেই নিজের ঘরে চলে গেলেন মানিক সাহেব।
রিপা এবার হিমির কাছে এসে হালকা হেসে বললেন,
_আশা করি তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

রিপাও চলে গেলো সেখান থেকে। তবে একই জায়গায় রোবট এর ন্যায় বসে রইলো হিমি। বাবা মা তাকে সোজাসুজি কিছু না বললেও হিমি ঠিক ই বুঝতে পেরেছে যে, তারাও চায় হিমি বিয়েতে রাজি হয়ে যাক। তবে তারা কি করে বুঝবে হিমির মন যে এখনো অপূর্বের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরলো তার,আনমনেই বলে উঠলো,
_কেন অপু? কেন এমন করছো আমার সঙ্গে,আমি যে তোমাকে মন থেকে ভালোবেসেছি।

____
_আমাকে ডেকেছিস আপু?
হিমির ঘরে এসে প্রশ্নটা করলো হুর। হিমি জানালার পাশে বসে ছিলো। হুরের গলার আওয়াজ পেয়ে কিছুটা ঘুরে বললো,
_হুম,কথা আছে তোর সাথে।

হুর বিছানায় বসে বললো,
_হ্যা বলনা কি বলবি?

হিমি নিচের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
_অর্নব ভাইয়া হসপিটালে এসেছিলো,তুই আমাকে বলিসনি কেন?

হিমির প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেলো হুর। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের দৃষ্টি লুকোনোর চেষ্টা করতে লাগলো সে। হুরকে চুপ থাকতে দেখে হিমি এবার তার দিকে তাকিয়ে বললো,
_তোকে কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি হুর। চুপ করে থেকে আমার মাথা গরম করাস না।

হুর এবার আমতা আমতা করে বললো,
_ব বলতে গিয়েছিলাম তো,কিন্তু মা।

হিমির এবার মনে পরলো হসপিটাল এর কথা। হুর তাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল তবে মা বাধা দেওয়ায় আর বলতে পারেনি।
হুর এবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললো,
_তবে এখন যেহেতু তুই জেনেই গেছিস, তাহলে আর লুকিয়ে লাভ নেই।

হিমি ভ্রু কুচকে তাকালো হুর এর দিকে। হুর বিছানা থেকে উঠে এসে হিমির সামনে বসে বললো,
_জানিস আপু, তোকে যখন ডাক্তাররা অবজারভেসন এ রেখেছিল, অর্নব ভাইয়ার পাগলামি চোখে পরার মতো ছিল। পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিল, বারবার ডাক্তারদের থেকে তোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিলো। আমরা তো ওনার কাজ থেকে থ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কি মনে হয় জানিস আপু?

হিমি হুরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_কি?
হুর বললো,
_অর্নব ভাইয়া তোকে খুব ভালোবাসে, ভালো না বাসলে কেউ কারোর জন্য এতটা পাগলামি করতে পারেনা আপু। তুই নিজের চোখে দেখলে বুঝতে পারতি।

নিরব হয়ে গেলো হিমি, কানের কাছে একটা কথাই বাজতে লাগলো, “অর্নব তোকে ভালোবাসে”।
হিমিকে চুপ করে থাকতে দেখে হুর কিছু বলতে যাবে তখন ই কলিং বেল বেজে ওঠে। হুর তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
_এই আপু,ম্যাম চলে এসেছে বোধ হয়। আমি যাই হ্যা।

কথায়টা বলেই ছুটে বেরিয়ে গেলো বেড়িয়ে গেলো হুর। কিন্তু হিমির মনটা যেনো আরো অশান্ত হয়ে উঠলো। হুরের বলা কথাগুলো ভাবতে লাগলো। সত্যিই কি ও কখনো নিজের চোখে অর্নবের পাগলামি গুলো দেখেনি?
হিমির মনে পড়ে গেলো কয়েক বছর আগের কথা। অর্নব হিমিকে ক্লাস এইট থেকে টেন পর্যন্ত তিন বছর প্রাইভেট পড়িয়েছিল। তবে হিমি তাকে ভাইয়া বলেই ডাকতো।
তখন হিমি ক্লাস নাইনে পড়ে, গ্রামে গিয়ে বোনেদের সাথে গাছে ওঠা শিখতে গিয়ে হাতের অনেকটা অংশ কেটে গিয়েছিল তার। সাতটা সেলাই পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। বাড়িতে ফেরার পর যেদিন অর্নব তাকে পড়াতে এসেছিল সেদিনের কথা মনে করতে লাগলো হিমি।
——-
_ফিজিক্স বই বের করো। যে ম্যাথগুলো দিয়েছিলাম শেষ করেছো সবগুলো?
ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখে কথাগুলো বললো অর্নব। হিমি একটা শুকনো ঢোক গিলল। ওড়নার আড়ালে বাম হাত লুকোনোর চেষ্টা করতে লাগলো সে। ডান হাত দিয়ে বই খাতা বের করে হোমওয়ার্ক দেখালো। অর্নবের দৃষ্টি এতক্ষনে ফোন থেকে সরে হিমির দিকে আবদ্ধ হয়েছে। কপালে ভাজ দেখা গেলো তার, হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
_কি হয়েছে ঐ হাতে?

_ক কিছু না তো ভাইয়া। আপনি দেখুন না,আমি সবগুলো করে রেখেছি।

অর্নব আবারো হিমির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
_হাত দেখাও।
হিমি ফট করে নিজের ডান হাতটা অর্নবের সামনে ধরলো।অর্নব এবার রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললো,
_হিমি আমি অন্য হাত দেখাতে বলেছি।

হিমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে হাতটা সামনে আনলো, ব্যান্ডেজ খুলে ফেলা হলেও সেলাই এর দাগ এখনো স্পষ্ট। কিছুক্ষন অর্নবকে চুপ থাকতে দেখে এক চোখ খুললো হিমি,তারপর দুটো চোখ খুলে ঢোক গিললো। এই নিরবতা যে ঝড়ের পূর্বাভাস তা হিমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। অর্নবের চোখেমুখে এতক্ষনে রাগের আভা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। রাগী চোখে হিমির দিকে তাকিয়ে উঠে দাড়ালো সে। জোড়ালো কণ্ঠে ধমকের সুরে বললো,
_বেড়াতে গিয়ে এসব করে বেরাচ্ছ তাইনা? নিজের খেয়াল তো পাগলেও রাখতে জানে কিন্তু তুমি জানো না। এসব প্ল্যান করে করা হয়েছে তাইনা? ভেবেছ যে পড়ায় ফাঁকি দিতে পারবে, আন্টি ও কিছু বলবে না। তোমার এসব ফাঁকিবাজি ধান্দা না আমার খুব ভালো করে জানা আছে হিমি।

অর্নবের ধমকে কেপে উঠলো হিমি,চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে সবটা শুনে যাচ্ছে হিমি। এতক্ষনে অর্নবের গলার আওয়াজ শুনে রিপাও সেখানে উপস্থিত হয়েছে। রিপা অর্নবের কাছে গিয়ে বললো,
_কি হয়েছে বাবা?এত বকছো যে ওকে,হিমি কিছু করেছে?

অর্নব রিপার দিকে তাকিয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ এর চেষ্টা করে বললো,
_ওকে একটু শাসন করুন আন্টি,আমার কথা তো ওর কানে যায়না। এত ছোটাছুটি করলে ব্যাথা তো পাবেই। বাম হাত কেটেছে বলে ঝামেলা হচ্ছে না,ডান হাত কাটলে কি হতো বুঝতে পারছেন? এক দুমাস এর জন্য সব পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিতেন তিনি। এভাবে চললে তো রেজাল্ট ভালো করতে পারবে না আন্টি, লাস্ট এক্সাম এ যা রেজাল্ট করেছে তার চেয়ে আরো বেশি আশা করা যায় ওর থেকে।এখনো ফাঁকিবাজি করলে তো চলবে না তাইনা!
কথাটা বলে অর্নব রাগী চোখে একবার হিমির দিকে তাকিয়েই বেড়িয়ে গেছিলো বাসা থেকে।

———-
সেদিন অর্নবের ব্যাবহারে রাগ হয়েছিলো হিমির,কষ্ট ও পেয়েছিলো প্রচুর। তবে আজ যেন সেই অদ্ভুত ব্যাবহারের কারণ অন্য কিছুই মনে হচ্ছে হিমির কাছে। মনে মনে ভাবতে লাগলো,
_উনি কি আসলেই আমাকে ভালোবাসেন! না না, যদি তেমনটাই হতো তাহলে তো আমাকে বলতেন উনি।

চোখ বন্ধ করে নিলো হিমি। এই মুহূর্তে ঘুমের ভীষণ প্রয়োজন তার,এই কয়েক ঘন্টাই যেন সব চিন্তা থেকে দূরে থাকতে পারে সে। আবারো রাত পেরিয়ে সকাল আসবে,আর সেই সঙ্গে চিন্তার পাহাড় নেমে আসবে তার মাথায়।

_____
রাতের আধার এখনো সম্পূর্ন কাটেনি। বাড়ির পাশের পুকুর পারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অপূর্ব। ঘুম নামক বস্তুর সঙ্গে তার বিরাট দূরত্ব তৈরি হয়েছে এই কদিনে।
ফরিদা বেগম পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
_অপু,এখানে কি করছিস তুই?

পিছনে তাকালো না অপূর্ব, মায়ের প্রশ্নের উত্তর ও দিলোনা সে। ফরিদা বেগম এবার অপূর্বের পাশে এসে তার কাধে হাত দিয়ে বললো,
_অপু,মায়ের উপর এভাবে রাগ করে থাকতে নেই বাবা। আমি যা করছি তোর ভালোর জন্যই তো করছি নাকি।

এক হাত দিয়ে কাধ থেকে মায়ের হাতটা সরিয়ে দিলো অপূর্ব। মায়ের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
_হাহ..এটাই তো মা। আমি না সবসময় জেনে এসেছি মায়েরা সন্তানদের মনের কথা বুঝে যায়,অথচ তোমার কথা চিন্তা করে দেখো। নিজের ছেলের খুশিটাই তুমি কেড়ে নিচ্ছো।

_অপু..তুই এই কথাটা বলতে পারলি আমাকে। এত কষ্ট করে তোকে বড় করেছি আমি।

অপূর্ব তার মায়ের দু কাধে হাত রেখে করুণ সুরে বললো,
_আমি জানি মা, আর সেই কারনেই তোমার কথার অভাধ্য হওয়ার সাধ্য আমার নেই। তুমি এতদিন ধরে যেভাবে আমাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে চলেছো, এটা আমি তোমার থেকে কখনো আশা করিনি মা।

ফরিদা বেগম চোখের জল মুছে ছেলের দিকে তাকালেন। অপূর্বর ও চোখের কোণে অশ্রুরা ভিড় জমিয়েছে,গড়িয়ে পড়ার আগেই তা মুছে নিলো সে। মায়ের দিকে তাকিয়ে আবারো বললো,
_তুমিতো এমন ছিলেনা মা, আমিতো আমার মাকে চিনি। আমার মা আমার সুখটাকেই আমার থেকে কেড়ে নিচ্ছে, এটা আমি মানতে পারছি না মা।
অপূর্ব আবারো তার মায়ের দু কাধে হাত দিয়ে বললো,
_তুমি এমন কেনো হয়ে গেলে মা? এতটাই বদলে গেলে যে নিজের ছেলের ভালোটাই তুমি বুঝতে পারছো না।

ফরিদা বেগম চুপ করে রইলেন। অপূর্ব তার কাধ থেকে হাত সরিয়ে নিলো। নিজের চোখের জল লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করে চলে গেলো সেখান থেকে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে