#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_২
#মেহরিন_রিম
নীল রঙের শাড়ি পরে ড্রেসিং টেবিল এর সামনে বসে আছে হিমি, হুর তাকে শাড়ি পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। মায়ের কথা কানে আসতেই বুঝতে পারলো পাত্রপক্ষ এখনি চলে আসবে। সবকিছু যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে হিমির,কে বা কারা তাকে দেখতে আসছে কিছুই জানেনা সে। এক ঘণ্টা যাবৎ মা আর বোনকে জিজ্ঞেস করলেও তারা স্পষ্টভাবে কিছুই বলেনি।
হিমি হুইল চেয়ার নিয়ে কিছুটা পিছনে এসে বিছানার পাশের টেবিল থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিলো। অপূর্বের নম্বর বের করে অনেক্ষন তাকিয়ে রইলো সেদিকে,তারপর ফোনটা অফ করে একই জায়গায় রেখে দিলো। কিছুটা সামনে এগোতেই আবারো কিছু একটা চিন্তা করে পিছনে এলো হিমি। ফোনটা হাতে নিয়ে কল দিলো অপূর্বের নম্বরে,বেশ কিছুক্ষন রিং হলেও অপর প্রান্ত থেকে কেউ কলটা রিসিভ করলো না। ফোনটা কানে থাকা অবস্থাতেই চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হিমি। অত:পর ফোনটা আগের স্থানে রেখে আবারো ড্রেসিং টেবিল এর সামনে এলো। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখলো কিছুক্ষন, আহামরি সুন্দর না হলেও হালকা সাজে বেশ মানিয়েছে তাকে। সবাই বলে ওর চেহারায় অন্যরকম মায়া আছে।
মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে হালকা হাসলো হিমি, মানুষের মুখে বর্তমানে নিজের সম্পর্কে কিছু শুনতেও ইচ্ছে হয়না তার। অপূর্ব ও তো এক সময় তাকে নিয়ে কতো কিছু বলতো, নিজের গুণাগুণ শুনতে খারাপ লাগতো না হিমির। কলিং বেল এর আওয়াজে চিন্তাভঙ্গ হলো হিমির। তবে এই নিয়ে সে বেশিকিছু ভাবছে না। এর আগেও একবার পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল তাকে, তবে হিমির পায়ের কথা জানতে পেরে তারা তখন ই চলে যায়। হিমি ভাবছে হয়তো এবারো তেমন কিছুই হবে।
একইভাবে রুমে বেশ কিছুক্ষন বসে রইলো হিমি, তবে অবাক করা বিষয় ত্রিশ মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পরও কেউ ওকে ডাকতে আসেনি। হিমি ভাবলো হয়তো তার পায়ের কথা শুনে সবাই চলে গেছে। তাচ্ছিল্যের সূরে হাসলো কিছুক্ষন।
হিমির জীবনটা এমন ছিলোনা। আর পাঁচটা মানুষের মতো সেও হাটতে পারতো,দৌড়াতে পারতো। প্রচুর চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে হিমি, একজায়গায় স্থির থাকা তার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব কাজ ছিলো। হিমির এই চঞ্চলতাই ছিল অপূর্বের সবচেয়ে পছন্দের।
এত হাসিখুশি মেয়েটার জীবন বদলে যায় একটা দিনের ব্যাবধানে। বাইকে চড়তে সে বরাবরেই কিছুটা ভয় পেতো, কে জানতো এই বাইকই একদিন তার কাল হয়ে দাঁড়াবে!
এক বছর আগে এক বাইক এক্সিডেন্ট এর ফলে হিমির পা দুটো অকেজো হয়ে যায়, অপারেশন এর সুযোগ থাকলেও তাতে অনেকটা রিস্ক ছিল। অপারেশন সাকসেসফুল না হলে হিমির পা দুটো বাদ দিতেও হতে পারে। এমন কথা শুনে মানিক সাহেব আর ঝুঁকি নেননি। তখন থেকেই হিমির জীবন বন্দি হয়ে যায় হুইল চেয়ারের মাঝে। সারাদিন ছোটাছুটি করে বেড়ানো হিমিকে এখন সামান্য কাজেও অন্যের সাহায্য নিতে হয়।
তবে সেই কঠিন মুহূর্তেও অপূর্ব হিমির পাশে ছিলো। হিমির দু হাত ধরে সেদিন সে বলেছিল,
_যাই হয়ে যাক না কেন,আমি তোমার পাশে আছি।
কথাটা ভেবে কিছুটা হাসি পেলো হিমির। এর মাঝেই তার মনে হলো ড্রইং রুম থেকে কিছু কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। হিমির ঘর এখন নিচেই, এক্সিডেন্ট এর পরই তার ঘর উপর থেকে শিফট করে নিচে ঠিক করা হয়েছে।
হিমি নিজের ঘরের দরজার কাছে যেতেই চলতে থাকা কথা বার্তা কিছুটা শুনতে পেলো। হালকা পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কারা এসেছেন, তবে একজন মহিলা এবং তার সঙ্গে হিমির বয়সী একটি মেয়ে ছাড়া নতুন কাউকে দেখতে পেলো না।
হিমি শুনতে পেল সেই মহিলা তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলছেন,
_দেখুন,আপনারা তো সবটাই জানেন। দয়া করে আর আপত্তি করবেন না।
প্রতিত্তরে রিপা বললেন,
_আমি বুঝতে পারছি আপা,তবে আমার মেয়ের সিদ্ধান্ত ব্যতীত আমি কিছুই বলতে পারবো না।
মহিলা এবার খানিকটা করুণ সূরে বললেন,
_আমার ছেলেকে আমি একবার হারিয়েছি, আর হারাতে চাইনা। হিমিকে ও ঠিক রাজি করিয়ে নেবে,আপনি এ বিষয়ে চিন্তা করবেন না।
রিপা এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হুরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
_যা তো হিমিকে ডেকে নিয়ে আয়।
হুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই সেই মহিলা তাকে বাধা দিয়ে বললেন,
_তার কোনো দরকার নেই আপা, আমি আপনার সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি। আমি বিয়ে পাকা করেই মেয়েকে দেখবো নাহয়।
রিপা তার উদ্দেশ্যে বললেন,
_আপনার দিকটা আমি বুঝতে পারছি,তবে আমাদের কিছুটা সময় দরকার। আমি তো আমার মেয়েকে চিনি, ও এত সহজেই রাজি হবেনা তাও জানি। তাই আরকি..
উক্ত মহিলা এবার হালকা হেসে বললেন,
_আপনার সিদ্ধান্তকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি। আপনারা সময় নিন,আমার কোন আপত্তি নেই। আমরা বরং আসি আজকে।
কথাটা বলেই সেই মহিলা মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেলেন।কথাগুলো স্পষ্ট না শুনতে পেলেও কিছুটা শুনতে পেরেছে হিমি। রিপা বসা থেকে উঠে দাড়াতেই তার চোখ পরে হিমির দিকে,তিনি বুঝতে পারলেন হিমি এতক্ষন তাদের তাদের কথা শুনেছে। তবে কতটা শুনতে পেয়েছে তা আন্দাজ করতে পারলেন না।
মাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হিমি দরজার সামনে থেকে সরে গেলো। ভিতরে গিয়ে তাদের কথার অর্থ খুজতে লাগলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো,
_আমার সঙ্গে তার ছেলেকে হারানোর কি সম্পর্ক আছে? তার ছেলে কি আমাকে চেনে? আর সে আমাকে রাজি করিয়ে নেবে বলতে উনি কি বোঝালেন?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের পরিচিত ছেলেদের কে মনে করতে লাগলো। তবে তাদের কাউকেই সন্দেহ হলোনা হিমির। অপূর্বের সঙ্গে রিলেশন শুরু হওয়ার পর থেকে খুব একটা ছেলেদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ও করেনি। ভার্সিটির ক্লাসমেট দের মধ্য থেকেও কাউকেই এমন মনে হয়নি হিমির।
কথাগুলো চিন্তা করতেই অপূর্বর কথা মাথায় এলো হিমির। বেড এর পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিয়েই দিবার নম্বরে কল দিলো।
কল টা রিসিভ হতেই বলতে লাগলো,
_কোনো খবর পেলি অপুর?
অপর পাশ থেকে দিবা কিছুটা বিরক্তির সুরে বললো,
_আমিতো আপনার এসিস্টেন্ট তাইনা! নিজের কাজকর্ম বাদ দিয়ে আপনার প্রেমিক পুরুষকে খুজতে বের হবো আমি!
হিমি এবার করুন সুরে বললো,
_প্লিজ দিবু এমন করিস না। এতগুলো দিন হয়ে গেলো অপুর কোনো খোজ নেই। তুই প্লিজ একটু খোজ নে।
দিবা এবার স্বাভাবিকভাবে বললো,
_অনেকজন কেই জিজ্ঞেস করেছি, কেউই কিছু বলতে পারছে না। আমি আরো কয়েকজন কে বলে রেখেছি, কোনো খবর পেলে জানাবে বললো।
হিমি খানিকটা চিন্তিত সুরে বললো,
_আমার এবার খুব টেনশন হচ্ছে দিবু, ওর কোনো ক্ষতি হয়নি তো?
দিবা হিমির অবস্থাটা বুঝতে পেরে ওকে স্বাভাবিক করার জন্য বলল,
_কিচ্ছু হয়নি ওনার,দেখ গিয়ে কোন চিপায় লুকিয়ে আছে।
হিমি বিরক্ত হয়ে বললো,
_দিবু প্লিজ!
কলটা কেটে দিলো হিমি। বিরক্ত হয়ে ফোনটা টেবিলে রাখতে যাবে সেই মুহূর্তে তার হোয়াটসঅ্যাপ এ আননোন নম্বর থেকে একটি মেসেজ আসে। হিমি মেসেজ এর উপর ক্লিক করলো। সেখানে লেখা আছে,
_কি ব্যাপার হিমপরি, আমাকে রিজেক্ট করে দিলে বুঝি?
কথাটা মাথার উপর দিয়ে গেলো হিমির। সে আবার কাকে রিজেক্ট করলো? আর এই লোকটাই বা কে?
হিমি ভ্রু কুচকে মেসেজ এর রিপ্লাই দিলো,
_কে আপনি? আমি আপনাকে রিজেক্ট করতে যাবো কেন?আমিতো আপনাকে চিনি ই না, আর আপনি আমার নম্বর ই বা পেলেন কোথায়?
মেসেজ সেন্ড হওয়ার দশ সেকেন্ড এর মাথায় রিপ্লাই এলো,
_আরে আরে এত প্রশ্ন একসঙ্গে করলে তো চলবে না। বাকি রইলো নম্বর এর কথা, শুধু নম্বর নয় তোমার সকল খবর ই আছে আমার কাছে।
লোকটার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছে না হিমি। নিজে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরো একটি মেসেজ এলো। আর তাতে লেখা আছে,
_বিয়েতে রাজি হয়ে যাও হিমপরি।
এবার যেনো সবটা পরিস্কার হলো হিমির কাছে। তার মানে এই লোকটার মা ই এসেছিলো বাড়িতে। বেশ রাগ হলো হিমির। মেসেজের এ লিখলো,
_ওহ আচ্ছা, তাহলে আপনি ই সেই লোক। বিয়েটা মামা বাড়ির আবদার বুঝি? আমি আপনাকে চিনিনা জানিনা,হুট করে বিয়েতে রাজি হয়ে যাবো?
বিপরীত পাশ থেকে রিপ্লাই এলো,
_লেটস সি…
মেসেজ টা সেন্ড করে বিপরীত পাশে থাকা লোকটা বাকা হাসলো। ফোনে হিমির একটা ছবি বের করে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
_ “তুমি শুধু আমার হবে হিমপরি,
শুধুই আমার”
অন্যদিকে হিমি আরও বেশ কিছু মেসেজ দিলো লোকটাকে তবে কোনো রিপ্লাই এলোনা। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে ফোনটা রেখে দিলো। লোকটার লাস্ট মেসেজ এর কথা চিন্তা করে মনে মনে বললো,
_উনি কি আমাকে হুমকি দিলেন!
___
রাতের খাবার শেষে বিছানায় বসে লোকটার সম্পর্কে চিন্তা করছে হিমি। তার মাঝেই দিবার কল এলো। হিমি পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করতেই দিবা বলতে লাগলো,
_অপূর্বের খোজ পাওয়া গেছে হিমি…
চলবে।