#পর্ব_১
#শেষ_ঠিকানা
#লেখিকা_মেহরিন_রিম
_এমন একটা পঙ্গু মেয়েকে আমি বাড়ির বউ করে আনবো তুই ভাবলি কি করে অপু? শেষমেশ কিনা একটা অচল মেয়েকে পছন্দ করে আনলি তুই!
নিজের প্রেমিকের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে কষ্টে, অপমানে মাথা নিচু করে রইলো হিমি। দুচোখ থেকে গড়িয়ে পরছে অবাধ্য অশ্রুধারা। ছুটে বেড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করলো, তবে এই ক্ষমতা টুকুও নেই তার মাঝে। অবাক চোখে অপূর্বর দিকে তাকাতেই সে চোখ সরিয়ে নিলো। বেশ জোড় গলায় বলে উঠলো,
_মা, কি বলছো তুমি এসব? আমার সামনে তুমি এভাবে হিমিকে অপমান করতে পারোনা, তোমার কথায় আমি ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। তুমি এমন ব্যবহার করবে জানলে আমি কখনই ওকে নিয়ে আসতাম না।
ফরিদা বেগম রাগী চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
_হ্যা বলেছিলাম,তখন তো আমি জানতাম না যে আমার ছেলে এমন এক মেয়েকে পছন্দ করেছে যে কিনা নিজের পায়ে হাটতেই পারেনা। তুই আমাকে এই ব্যাপারে তো কিছু বলিসনি। এই মেয়ে পঙ্গু জানলে তো আমি কখনোই ওকে নিয়ে আসতে বলতাম না।
নিজের ব্যাপারে এমন কথা শুনে সেখানে বসে থাকা সম্ভব হলো না হিমির পক্ষে। এতক্ষন সোফায় বসে ছিলো, হাতের উপর ভর দিয়ে কোনোভাবে পাশে থাকা হুইল চেয়ারে বসার চেষ্টা করতে লাগলো সে। নিজের কাজে সক্ষম হতেই একবার অপূর্বের দিকে অশ্রুভরা চোখে তাকালো,পরক্ষণেই নিজের চোখের জলটুকু মুছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো। অপূর্ব এখনো নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে, এখানে এসে হিমিকে অপমানিত হতে হবে জানলে সে কখনোই তাকে আনতো না নিজের বাড়িতে। হিমিকে চলে যেতে দেখেই অপূর্ব ছুটে গিয়ে তার সামনে দাড়ালো। করুন সুরে বলতে লাগলো,
_হিমি প্লিজ,মায়ের হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমি আসলেই বুঝতে পারিনি এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
হিমি অপূর্বের দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো,তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
_তুমি ক্ষমা চাইছো কেনো অপু? আন্টি তো ভুল কিছু বলেনি। আমিতো সত্যিই অচল..
গলা ধরে এলো হিমির, তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
_আমাকে যেতে দাও প্লিজ।
অপূর্ব এবার হিমির সামনে হাটু গেড়ে বসে বললো,
_এভাবে চলে যেওনা প্লিজ। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।
অপূর্ব উঠে দাড়াতেই পিছন থেকে তার মা বলে উঠলো,
_একদম না অপু,ঐ পঙ্গু মেয়ের সঙ্গে তুই একদম যাবি না।
আর কিছু শুনতে পেলোনা হিমি। কানের কাছে ‘পঙ্গু’ শব্দটা বাজতে লাগলো,অপূর্ব তার মাকে কিছু বললো কিনা জানা নেই হিমির। কোনোরকম নিজেকে সামলে অপূর্বর পাশ থেকে চলে এলো সে।
——-
চোখ বন্ধ করে নিলো হিমি,চোখে থেকে গড়িয়ে পরলো অশ্রু। চোখ খুলতেই নিজের মাথার উপর ফ্যান ঘুরতে দেখিতে পেলো সে। মাথা সামান্য ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই জানালার সাদা পর্দার দিকে চোখ পড়লো তার,সম্পূর্ন না হলেও সামান্য সূর্যের আলো রুমে এসে পরছে। নিজের হাতের ব্যান্ডেজ এর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হিমি। বর্তমানে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে সে,সেদিনের ঘটনার পর নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল হিমি।
সোফায় ঘুমিয়ে থাকা নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগলো হিমির। নিজের উপর চরম বিরক্তি লাগলো তার। সে এতো নরম মনের মেয়ে নয়,তবে সেদিন কি করে এতো বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললো ভেবে পায়না হিমি। মানুষের কথা শুনতে শুনতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে, ফরিদা বেগমের কথায় সেদিন তাৎক্ষণিক ভাবে কষ্ট পেলেও তার কারণে এমন একটা পদক্ষেপ সে গ্রহণ করেনি। হিমি ভেবেছিল অপূর্ব হয়তো তাকে ফোন করবে,তবে এমনটা হয়নি। বেশ অবাক হয়েছিলো হিমি, দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেও অপূর্বর থেকে কোনো মেসেজ,কল কিছুই পায়নি সে। তার ফলেই এমন একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল।
হিমির চিন্তার মাঝেই কেবিনে প্রবেশ করলো তার বাবা। হিমিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো মানিক সাহেব। হাতে থাকা ঔষধগুলো পাশে রেখে মেয়ের মাথার কাছে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। হিমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,
“এখন কেমন লাগছে মা?”
হিমি তার বাবার দিকে না তাকিয়েই বললো,
“ভালো বাবা।”
বাবার দিকে তাকানোর সাহস টাও অর্জন করতে পারলো না হিমি,নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে তার। একটা ছেলের জন্য কিনা নিজের পরিবারকে এতটা কষ্ট দিলো সে।
মানিক সাহেব একটু পর বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষন পর তার মা এসে তাকে খাইয়ে দিলো। তার মাঝেই কেবিনে প্রবেশ করলো হুর। হিমির ছোট বোন সে, হুর কেবিনে ঢুকেই দৌড়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
_তুই এমন কেনো করলি আপু?জানিস আমি কতো ভয় পেয়ে গেছিলাম।
হিমি কিছু বলার আগেই তার মা রিপা বলে উঠলেন,
_আহ হুর! কি হচ্ছে এসব হ্যা, ওকে এখন এতো প্রশ্ন করতে হবেনা।
হুর তবুও মায়ের কথার তোয়াক্কা না করে বলতে লাগলো,
_জানিস আপু সকালে…
কথা শেষ করতে পারলো না হুর,মায়ের চোখ রাঙানো দেখে থেমে গেলো সে। হিমি এবার হুর এর দিকে তাকিয়ে বলল,
_কি বলছিলি বল,কি হয়েছে সকালে?
হুর একবার মায়ের দিকে তাকালো তারপর আবার হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
_কিছু না আপু,তুই খেয়ে নে।
কথাটা বলেই হুর বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে, কিছুক্ষন পর মেয়েকে খাইয়ে রিপাও কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। হুরের কথাটা নিয়ে বেশি একটা ভাবলোনা হিমি, বর্তমানে তার মাথায় অপূর্বের কথা ঘুরছে। তার এই খবরটা নিশ্চই এতক্ষনে অপূর্বের কাছেও পৌঁছে গেছে। হিমি ভেবেছিলো অপূর্ব হয়তো তার অবস্থা জেনে ছুটে আসবে, কিন্তু আবারো তার চিন্তা ভুল প্রমাণিত হলো। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো,এখনো অপূর্ব আসেনি।
___
হিমির সামনে চেয়ারে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে দিবা। সে এভাবে বসে আছে আরও বিশ মিনিট আগে থেকে। হিমি এবার বিরক্তির সুরে বললো,
“তুই কি এখানে রোবটের মতো বসে থাকতে এসেছিস?”
দিবা এবার হিমির দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বললো,
_তো কি করবো?তোকে মাথায় তুলে নাচবো?এই মহান কাজের জন্য আপনাকে পুরস্কৃত করবো?
হিমি চুপ করে বসে রইলো। দিবা এবার চেয়ার টা আরেকটু সামনে এগিয়ে বলতে লাগলো,
_আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না ঐ ছেলেটার জন্য কিনা তুই এত বড় একটা কাজ করলি! যেই ছেলে কিনা তোকে বাড়িতে নিয়ে অপমান করলো,তার জন্য? সিরিয়াসলি!
হিমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
_অপমান তো অপু করেনি,ওর মা করেছে।
দিবা এবার হাততালি দিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
_বাহ,খুব ভালো। তুই এখনো ওকে সাপোর্ট করছিস।
হিমি আর কিছু বললো না, দিবা যে এখন প্রচণ্ড রেগে আছে তা সে ভালোই বুঝতে পারছে। তবে এতকিছুর মাঝে যে একজোড়া চোখ তার দিকে নজর রাখছে তা হয়তো বুঝতেও পারলো না হিমি।
____
পনেরো দিন হলো বাড়িতে ফিরেছে হিমি,তবে এর মাঝে অপূর্ব একবার ও তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। হিমি কয়েকবার কল দিলেও তা রিসিভ হয়নি।
জানালার পাশে বসে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সম্পর্কে ভাবতে লাগলো হিমি। এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় হুর, হাতে একটি ব্যাগ। হিমির পিছনে এসে হাপাতে হাপাতে বললো,
_আপু,মা বলেছে তোকে তৈরি করে দিতে।
হিমি হুইল চেয়ারটা ঘুরিয়ে হুর এর তাকালো।কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
_আমাকে! কিন্তু আমি আবার এখন তৈরি হয়ে কোথায় যাবো?
_না না আমরা কোথাও যাবো না।
_তাহলে?
_আমাদের বাড়িতে লোকজন আসবে।
হিমি কিছুটা বিরক্তি মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
_তুই একটু ঠিকভাবে বলবি প্লিজ। কে আসবে বাড়িতে? আর তার জন্য আমি তৈরি হবো কেনো?
হুর কিছু বলার আগেই হিমির মা রিপা দরজার কাছ থেকে বললেন,
_তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে।
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো হিমির। মাকে কিছু বলার আগেই সে কিছু গহনা বিছানার উপর রেখে হুরের উদ্দেশ্যে বললেন,
_হুর, আপুকে জলদি এগুলো পরিয়ে দে। তারা কিছুক্ষন এর মধ্যেই চলে আসবে।
#চলবে