#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৮।
সারাজ নিচে এসে দেখল পুতুল বেশ আয়েশ করে সোফার উপর দুই পা ভাঁজ করে বসে আছে। কোলের উপর একটা বড়ো থালা। এক হাতে টিভির রিমোট। অন্যহাতে একটু করে পরোটা ছিঁড়ছে আর মুখে পুরছে। সারাজ দুদিকে মাথা নাড়ায়। বিড়বিড় করে বলে,
‘একে দেখলে কেউ বলবে, এ এই বাড়ির নতুন বউ?’
সে গিয়ে দাঁড়াল পুতুলের সম্মুখে। এমনভাবে দাঁড়াল যে, পুতুলের টিভি দেখায় বিঘ্নিত হলো। ভ্রু কুঁচকে সারাজের মুখের দিকে চাইল পুতুল। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘দেখছ না টিভি দেখছি, সরো সামনে থেকে।’
নড়ল না সারাজ। পুতুল চেঁচিয়ে উঠল ততক্ষণাৎ,
‘মামনি, তোমার ছেলে দেখো না কী করছে।’
রান্নাঘর থেকে ছুটে এল রিতা। কপাল কুঁচকে চাইল ছেলে আর ছেলের বউয়ের দিকে। অতঃপর প্রশ্ন করল,
‘কী হয়েছে, পুতুল?’
পুতুল কিঞ্চিৎ ক্রোধ নিয়ে বলল,
‘মামনি, তোমার ছেলে আমাকে টিভি দেখতে দিচ্ছেন না। উনাকে সামনে থেকে সরতে বলো।’
রিতা সারাজের দিকে তাকাতেই সারাজ উল্টো আরো ক্ষোভ দেখিয়ে বলল,
‘জানো আম্মু, তোমার এই আদরের মেয়ে কী করেছে?’
‘কী করেছে?’
রিতা প্রশ্ন করে। সারাজ পুতুলের দিকে এক পলক চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘সে এখনও আমাকে ভাই বলেই ডাকছে। তুমিই বলো নিজের হাজবেন্ডকে কে ভাই ডাকে?’
রিতা বড়ো বড়ো অক্ষি মেলে পুতুলের দিকে চাইল। জিজ্ঞেস করল,
‘তুই এখনও ওকে ভাই ডাকিস, পুতুল? এটা কেমন কথা হলো?’
উঠে দাঁড়াল পুতুল। বসে বসে তর্কে জেতা সম্ভব না। রিতার নিকটে দন্ডায়মান হয়ে বলল,
‘ভাই কি আর সাধে ডেকেছি? তোমার ছেলে কী করেছে দেখো; ক্লিন শেভ করে একদম ছিলা মুরগী সেজে এসেছে। ওহ! তুমি তো মুরগী হবা না, মোরগ হবা। স্যরি।’
পুতুলের কথা শুনে রিতা শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে হাসে। অন্যদিকে ক্রোধে ফেটে পড়ে সারাজ। এইটুকু একটা মেয়ে তাকে এত বড়ো একটা অপমান করল। রাগে নিশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। তেড়ে আসে পুতুলের দিকে। পুতুল চট করে রিতার পেছনে লুকিয়ে বলে,
‘মামনি, তোমার ছেলেকে সাবধান করো। আগে বোন ছিলাম বলে যখন তখন এসে ঠাস ঠুস মেরে দিয়েছে। এখন মারতে আসলে কিন্তু একদম মামলা ঠুকে দিব।’
সারাজ তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘আম্মু, তুমি কিছু বলছো না কেন?’
কোনোরকমে হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখে চাইল রিতা। অতঃপর বলল,
‘খারাপ কী বলেছে পুতুল? তোকে ক্লিন শেভে কেমন লাগছে!’
‘তাই বলে ও আমাকে ছিলা মুরগী বলবে?’
বাজখাঁই শোনাল সারাজের গলার স্বর। পুতুল আঙ্গুল নাড়িয়ে বলল,
‘না না, ওটা মোরগ হতো; ভুলে মুরগী বলে ফেলেছি।’
‘পুতুল!’
ধমকে উঠল সারাজ। পুতুল পাত্তা দিল না সেসবে। সে রিতার পেছনে দাঁড়িয়ে দিব্যি তার শাড়ির আঁচল দিয়ে আঙ্গুল পেঁচিয়ে যাচ্ছে। সারাজ ফোঁস ফোঁস করতে করতে নিজে থেকেই বলল,
‘আম্মু, ওকে বলে দিও, ওর মুখে যেন আমি আর একবারও ভাই ডাক না শুনি।’
পুতুল মাথাটা একটু এগিয়ে বলল,
‘আচ্ছা সারাজ ভাই, মনে থাকবে।’
সারাজ ফের জ্বলে উঠে বলল,
‘এবার তুই সত্যিই আমার হাতে মার খাবি, পুতুল।’
রিতা গর্জে উঠে বলল,
‘ওকি সারাজ, তুই পুতুলকে “তুই” বলে সম্বোধন করছিস কেন? বউকে কেউ তুই বলে?’
পুতুল তাল মিলিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, তাই তো। নিজে তুই বললে সমস্যা নেই, আর আমি ভাই বললেই যত সমস্যা।’
সারাজ উঁচু আওয়াজ তুলে বলল,
‘অবশ্যই সমস্যা। বউকে “তুই” বলে সম্বোধন করলে সম্পর্ক পাল্টে যায় না। কিন্তু জামাইকে “ভাইয়া” বলে সম্বোধন করলে সম্পর্কে গোলমাল লাগে। তাই আজকের পর থেকে “ভাই” শব্দটা মুখেও আনবি না।’
‘আর তুইও পুতুলকে “তুমি” করেই বলবি। “তুই” শুনতে খারাপ দেখায়।’
সারাজ হাত ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে বলল,
‘ঠিক আছে, বলব। এখন খেতে দাও; খেয়ে আবার একটু অফিসেও যেতে হবে।’
রিতা বলল,
‘ঠিক আছে। তুই ডাইনিং এ গিয়ে বস, আমি খাবার আনছি।’
রিতা চলে যেতেই পুতুল ধীর পায়ে এগুতে নিলেই সারাজ তার ওড়না টেনে ধরে। তা দেখে লাজুক স্বরে পুতুল বলে উঠে,
‘ইশ! কী করছ, সারাজ ভাই? কেউ দেখবে তো।’
সারাজ চোয়াল শক্ত করে চাইল। ক্রূর হাসল পুতুল। সারাজের অত্যন্ত নিকটস্থ হয়ে দাঁড়াল। তারপর স্মিত সুরে বলল,
‘আগামী এক সপ্তাহ তোমাকে ভাই’ই ডাকব। এক সপ্তাহে দাঁড়ি উঠে যাবে না?’
সারাজ ক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠল,
‘আজকাল খুব সাহস হয়েছে, না? ফাজিল মেয়ে, বেশি বাড়াবাড়ি করিস না।’
আরো একটু এগিয়ে এল পুতুল। সারাজ সতর্ক দৃষ্টিতে একবার আশেপাশে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘এখন কেউ দেখছে না?’
‘দেখুক, আমি কাউকে ভয় পায় না-কি?’
নির্লিপ্ত শোনাল তাকে। সারাজের ভ্রু যুগলের ভাঁজ আরো দৃঢ় হলো। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘কী চলছে মনে?’
পুতুল গন্ঠের স্বর আরো মিইয়ে বলল,
‘প্রেম।’
ফিচেল হাসল সারাজ। বলল,
‘রুমে চল। আমিও তোর মনের প্রেমকে একটু দেখি।’
সারাজ পুতুলের হাত ধরার জন্য উদ্যত হতেই পিছিয়ে যায় সে। অতঃপর জোরে শ্বাস টেনে গম্ভীর স্বরে বলে,
‘শুনো, তোমাকে আমি “ভাই” ডাকা বন্ধ করতে পারি, তবে একটা শর্ত আছে।’
ফের ভ্রু কুঁচকাল সারাজ। নিঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘থাপড়িয়ে সব দাঁত ফেলে দিলে, শর্ত ব্যতিত’ই “ভাই” ডাকা বন্ধ হয়ে যাবে। দিব?’
কোমরে হাত রেখে কড়া চোখের দৃষ্টি সারাজের উপর বর্তিয়ে পুতুল বলল,
‘ঐসব হুমকি দুমকি তে কিছুই হবে না, সারাজ ভাই। আমার শর্ত না মানলে আমি অবশ্যই “ভাই” ডাকব। একশো বার বলব; হাজার বার বলব। এখন তুমি’ই ভেবে নাও, কী করবে।’
সারাজ স্বীয় সুপ্ত ক্রোধ দমিয়ে বলল,
‘ঠিক আছে। বল, কী শর্ত?’
খুশিতে চকচক করে উঠল পুতুলের ফরসা মুখ। ঝরঝরে আওয়াজে বলল,
‘রিসিপশনের পর আমাকে হানিমুনে নিয়ে যেতে হবে।’
সারাজ ফিচেল হাসল। বলল,
‘তোর তো দেখছি আর তর সইছে না।’
পুতুল সরু চোখে চেয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, তো কী হয়েছে? তোমাকে দিয়ে তো ভরসা নেই। দেখা যাবে, রিসিপশনের পর অফিসের কাজ নিয়ে এত বিজি হয়ে যাবে যে তখন আর এসব মনেই থাকবে না।’
সারাজ জিজ্ঞেস করল,
‘তো, কোথায় যেতে চাচ্ছিস?’
পুতুল ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,
‘যেখানে যেতে চাইব, সেখানেই নিয়ে যাবে?’
‘চেষ্টা করব, বল।’
‘ভারতের আগ্রায়। তাজমহল দেখতে যাব।’
সারাজ পুতুলকে পাশ কাটিয়ে ডাইনিং এ গিয়ে বসল। পুতুলও এল তার পেছন পেছন। সারাজ জিজ্ঞেস করল,
‘ভিসা আছে তোর?’
‘ভিসা লাগবে না। ট্রেনে যাব।’
‘বাহ, সব ভেবে রেখেছিস দেখছি।’
‘হ্যাঁ, যাতে তুমি কোনো টাল বাহানা করতে না পারো।’
ক্ষুব্ধ চোখে চাইল সারাজ। বলল,
‘তুই না বললে এমনিতেও আমরা হানিমুনে যেতাম।’
পুতুল ফের গিয়ে তার পূর্বের স্থানে বসল। ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং হওয়ায় ওখান থেকে বসেই সে বলল,
‘আচ্ছা, মেনে নিলাম তোমার কথা। এবার বলো, আমার বাসর রাতের গিফ্ট’টা আমার হাতে পুরোপুরি অর্পণ কখন করবে?’
সারাজের মনে পড়ল সেটা। বলল,
‘ও হ্যাঁ, তোর স্কুটি গ্যারেজে আছে। খাওয়ার পর বের করে দিব।’
_______
খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল পুতুল আর সারাজ। পুতুল গেরেজের বাইরেই অবস্থান করছে। ভেতরে সারাজ। স্কুটিতে বসে নিজেই চালিয়ে বাইরে নিয়ে আসল সেটা। স্কুটি দেখে খুশিতে চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে পুতুলের। হালকা গোলাপী রঙের ভীষণ চমৎকার এই জিনিসটা। পুতুলের মারাত্মক পছন্দ হয়েছে। সে এগিয়ে এসে আপ্লুত সুরে বলল,
‘কী সুন্দর এটা!’
‘পছন্দ হয়েছে?’
পুতুল সারাজের পানে চেয়ে বলল,
‘এত সুন্দর জিনিস; পছন্দ না হয়ে উপায় আছে? আচ্ছা, আজ থেকে তবে এটা শেখানোর দায়িত্ব তোমার।’
ছোট্ট শ্বাস ফেলে সারাজ। বলে,
‘তা তো আমাকে নিতেই হবে।’
আরেকদফা খুশিতে মজে যায় পুতুল। সেই খুশির বহিঃপ্রকাশ করতে সে তার কোমল ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দেয় সারাজের কপোলে।
চলবে….
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৯।
সারাজকে পুতুল কোনোভাবেই ছাড়ল না। তার একটাই কথা, “বিয়ের পরদিন কেউ অফিস যায় না; তাই সেও যেতে পারবে না। তার এখন একমাত্র প্রধান কাজ হচ্ছে নিজ বউকে স্কুটি চালানো শেখানো।” বেচারা সারাজ! সে জানে, বউয়ের সাথে তর্কে জড়ানো আপাতত কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তার চেয়ে বরং স্ত্রীর অন্তর তুষ্ট যেটাতে, সে তাই করবে।
পুতুলকে সামনে বসিয়ে সারাজ তাকে নিয়ে পুরো বাগান একবার চক্কর দিল। এর মাঝেই চেঁচিয়ে উঠল পুতুল। বলল,
‘এই, তুমি নামো নামো; আমি একাই এখন চালাতে পারব।’
সারাজ তাকে বাঁধা দিয়ে বলে,
‘একবার মাত্র দেখিয়েছি, এর মাঝেই পেরে যাবি? এত ভালো স্টুডেন্ট কবে হয়েছিস তুই?’
ঈষৎ ঘাড় কাত করে চাইল পুতুল। সরু চোখে চেয়ে বলল,
‘আমাকে অপমানের কোনো সুযোগই ছাড় না দেখছি। এমন করলে একদম বাপের বাড়ি চলে যাব কিন্তু।’
সারাজ ফিচেল হাসল। রাশভারী স্বরে বলল,
‘তাই! আমি তোকে অপমান করি? আর তুই যে আমাকে ছিলা মুরগী বলেছিস, সেটা কিছু না?’
পুতুল রগড় সুরে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠল,
‘ছিলা মোরগ, মুরগী না তো।’
চটল সারাজ। ক্ষুব্ধ হয়ে পুতুলের কোমরের পাশটা চেপে ধরল। অতঃপর তার শ্রবণেন্দ্রিয়ের নিকট মুখ এগিয়ে নিয়ে বলল,
‘খুব কথা ফুটেছে মুখে, তাই না? একদম এমন অবস্থা করব যে এক সপ্তাহ আর ঘর থেকেই বের হতে পারবি না।’
পুতুল মেকি রাগ নিয়ে স্বীয় কোমর থেকে সারাজের হস্ত যুগল আলগা করে বলল,
‘অবস্থার কি আর কিছু বাকি রেখেছ, অ সভ্য লোক।’
অনবদ্য হাসে সারাজ। বলে,
‘তাই? রাতে কি একটু বেশিই অসভ্যতামো করে ফেলেছি?’
লজ্জায় ততক্ষণাৎ লাল আভা প্রস্ফুটিত হলো পুতুলের গন্ডস্থলে। ইশ, রাতের কথা মস্তিস্কে বিচরণ চালাতেই আকাশচুম্বী ব্রীড়ায় কুন্ঠিত হয়ে পড়ল যেন। স্কুটির আয়নায় তার এই লাজমাখা মুখশ্রী’টা স্পষ্ট। তাকে দেখে হাসল সারাজ। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলতে নিল,
‘পুতুল, তোর শ…’
বাকিটা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই পুতুল দুহাতে মুখ চেপে ধরল তার। কড়া চোখে চেয়ে শাসিয়ে বলল,
‘খবরদার, আর একটাও বাজে কথা বলবে না। তুমি আসলেই একটা অ সভ্য; মারাত্মক পর্যায়ের অ সভ্য।’
__________
পরদিন প্রাতঃকালের প্রারম্ভিক ক্ষণেই শুরু হয়ে যায় সকল ব্যস্ততা। সারাজ আর পুতুলের আজ রিসিপশন। যদিও তার আয়োজন করা হয়েছে সেন্টারে। তাও বাড়িতে মানুষের হৈ চৈ এর কমতি নেই। তাই আজ খুব ভোরেই পুতুলের ঘুম ভেঙেছে। তন্দ্রা থেকে জেগে সে সারাজকে তার পাশে পায়নি। পরবর্তিতে ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখে, রিসিপশনের সব কাজের তদারকিতে ব্যস্ত সে। সারাজের সঙ্গে তখন তার খুব একটা কথা বলার সুযোগ হয় না। কোনোরকমে নাস্তা সেরেই রুমে যেতে হয়। পার্লারের মেয়েরা এসেছে তাকে সাজাতে।
___________
অসিত রঙের ভারি কাজের এক শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে পুতুল। পার্লারের মেয়েদের অনেক বলে বলে হালকা সেজেছে। অত ভারি মেকআপ তার কোনো কালেই পছন্দের ছিল না। কান আর গলায় স্থান পেয়েছে ছোট্ট কালো রঙের পাথর খচিত নেকলেসের সেট। মাথার মাঝ সিঁথি বরাবর একখানা ছোট্ট টিকলি। আর ওষ্ঠ জোড়ার ঐ রক্তিম রঞ্জক পদার্থ’টা যেন আজ একটু বেশিই জ্বলজ্বল করছে। নিজেকে আয়নায় দেখে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করে পুতুল। ঠিক যেমন চেয়েছিল, তেমনই লাগছে তাকে।
____________
পার্লারের মেয়েগুলো বেরিয়ে যেতেই হন্তদন্ত দেখিয়ে কক্ষে এসে উপস্থিত হয় সারাজ। তাড়া দিয়ে পুতুলকে বলে,
‘কিরে, হলো তোর? এবার সেন্টারে যেতে না পারলে কিন্তু সত্যিই লেইট হয়ে যাবে।’
পুতুল ঘুরে তাকায়। মুচকি হেসে বলে,
‘হ্যাঁ শেষ, চলো।’
চোখের সম্মুখে মসীবর্ণ বসনে এক নারীকে দেখে কিঞ্চিৎ বুকে ব্যথা হয় সারাজের। বুকের বা পার্শ্বে হস্ত স্থাপন করে মোহনীয় সুরে বলে উঠে,
‘আমাকে মারতে চাস, পুতুল?’
পুতুল বোকার মতো তাকায়। সারাজ মন্থর গতিতে এগিয়ে এসে তার অতি নিকটে দন্ডায়মান হয়। এক হাত পুতুলের কপোলে ঠেকিয়ে স্মিত সুরে বলে,
‘সবকিছুতে তোকে এত মারাত্মক কেন লাগে, পুতুল? আমার যে দমবন্ধ হয়ে আসে তোকে দেখলে। মরে টরে গেলে তার দায়ভার কি তুই নিবি?’
লজ্জায় মাত্রাধিক সংকুচিত হয়ে চক্ষু নিমীলিত করে পুতুল। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,
‘এখন এসব বলতে সময় যাচ্ছে না তোমার?’
সারাজের আরেকটু এগিয়ে পুতুলের ললাটে স্বীয় ললাট ঠেকিয়ে ঘোর লাগা আওয়াজে বলে,
‘না, যাচ্ছে না। আজ যদি সময় এখানেই থমকে যায়, আর আমি যদি তোকে অনন্তকাল এভাবেই দেখে যাই, তাহলে ব্যাপারটা খুব চমৎকার হবে না?’
পুতুল মাথা তুলে বলে,
‘না, একদমই চমৎকার হবে না। কারণ এখন আমাদের রিসিপশনে অ্যাটেন্ড করাটা বেশি জরুরি।’
‘তার থেকেও বেশি জরুরি এখন একটা চুমু খাওয়া।’
বিস্ফোরিত হয় পুতুলের অক্ষিযুগল। দু কদম পিছিয়ে গিয়ে বল উঠে,
‘খবরদার, আমার লিপস্টিক যদি নষ্ট করেছ।’
কুটিল হাসে সারাজ। বলে,
‘তা তো অবশ্যই করব।’
বলেই সে পুতুলকে হেঁচকা টানে নিজের অতিশয় নিকটে এনে দাঁড় করায়। অতঃপর …….
_______
রিসিপশনের প্রোগ্রামে মা বাবাকে দেখে অতিমাত্রায় আনন্দিত হয় পুতুল। বিয়ের দিনের মতোই অনেক ব্যস্ততার সহিত নিষ্পন্ন হয় এই দিনটাও। মেহমান সব চলে যাওয়ার পর পুতুল নেচে নেচে গিয়ে গাড়িতে তার স্থান দখল করে। এর এক পল পরেই তার পাশেই এসে সারাজ বসে। সে বসতেই পুতুল ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছো, অনুভূতি কেমন?’
পুতুলের ভ্রু নাচানো দেখে কপাল কুঁচকায় সারাজ। এমন ভাবে বলছে যেন, সারাজ ঐ বাড়িতে প্রথমবারের মতো যাচ্ছে। সিটে গা এলিয়ে দেয় সে। বলে,
‘আমাদের বাড়িতে আসার সময় তোর অনুভূতি যেমন ছিল, এখন আমার অনুভূতিও তেমন।’
পুতুলও হেলান দিয়ে বসে। বলে,
‘জানো তো, আমিই বোধ হয় একমাত্র মেয়ে যে তার বিদায়ের বেলায় একটুও কাঁদেনি। যার কিঞ্চিৎ পরিমাণও কষ্ট লাগেনি, বরং খুশি লেগেছে। দেখেছো, আমি কত ইউনিক।’
সারাজ উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ভীষণ ইউনিক। তোর মতো এমন ইউনিক এক পিসকে পেয়ে আমি ধন্য।’
সারাজের কথা শুনে শব্দ করে হাসল পুতুল। অতঃপর বলল,
‘তোমাকে পেয়েও আমি ধন্য।’
সারাজ তখন স্নাত চোখে তাকাতেই পুতুল তারদিকে উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে।
________
অশ্ব গতিতে কেটে যায় বিয়ের এক সপ্তাহ। আগামীকাল পুতুল আর সারাজ যাবে ভারতে। সেই প্রস্তুতিই চলছে তাদের। পুতুলের জন্য সারাজের ঠিকঠাক মতো অফিসেও যাওয়া হয় না। পুতুলের এক কথা, একেবারে হানিমুন সেরে এসে তবেই সারাজ অফিসে জয়েন করবে; এর আগে না।
পুতুলের এক ট্রলি ভর্তি কাপড় দেখে চক্ষু চড়কগাছ সারাজের। ক্ষিপ্ত কন্ঠে সে বলে উঠে,
‘এই মেয়ে, এত কাপড় নিচ্ছিস কেন? যাচ্ছি তো কেবল তিন দিনের জন্য। এর জন্য কি এত কাপড় লাগে?’
পুতুল ব্যাগে আরো এক সেট কাপড় রাখল। বলল,
‘মেয়েদের তিনদের জন্য তিন তিরিকা নয় সেট কাপড় লাগে। আমি আরও এক সেট বেশি নিয়েছি। এতে কী এমন অন্যায় হয়েছে, বলো?’
সারাজ বিস্মিত কন্ঠে বলে,
‘দশ সেট কাপড়? এত কাপড় কখন পরবি তুই?’
পুতুল ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘তিনবেলা তিন সেট করে পরলেই হয়ে যাবে। সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।’
পর পর আবার মনে মনে বলে উঠে,
‘তুমি যা মারাত্মক লেভেলের অ সভ্য; সেখানে গেলে যে তোমার অসভ্যতামো আরো বাড়বে সেটা আমি ঢের বুঝতে পারছি। তাই তো এত প্রস্তুতি।’
__________
প্রত্যুষকালের প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করেই বাড়ি ছেড়ে প্রস্থান ঘটায় পুতুল আর সারাজ। গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যায় ঢাকা কমলাপুর স্টেশনে। সেখান থেকেই মৈত্রী এক্সপ্রেসে যাত্রা শুরু হবে তাদের। পুতুল মারাত্মক উদ্দীপিত। এই প্রথম নতুন কোনো দেশে যাচ্ছে সে। তাও যাচ্ছে পছন্দের এক জায়গায় ঘুরতে। তার স্বপ্নের তাজমহল। শাহজাহানের তাজমহল। মমতাজের তাজমহল। ভালোবাসার তাজমহল।
চলবে….
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪০।
নতুন দেশে পা রাখতেই অদ্ভুত সুন্দর কিছু অনুভূতি ঠেসে বসল পুতুলের মনে। এই হাওয়া, এই প্রকৃতি, এই মাটি সবকিছু চমৎকার ঠেকল তার। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়ি দিয়ে হোটেলে যাওয়া আগ অবধি পুরোটা সময় পুতুল জানলায় মাথা ঠেকিয়ে নতুন শহরকে অবলোকন করেছে। এই শহরের ব্যস্ত রাস্তায় ছুটে চলা হলুদ রঙের ট্যাক্সিগুলোকে নিরুপম লেগেছে তার। রাস্তায় দুপাশের প্রাচীন আধ ভাঙা দালানগুলোও ছিল অনবদ্য।
আগে থেকেই হোটেলের রুম বুকিং ছিল পুতুলদের। তাই আর তাদের খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি। গাড়ি থেকে নেমেই সোজা রিসিপশনে চলে যায়। সেখান থেকে যায় নিজ কক্ষে। পুতুলের কথা মতো সারাজ আগ্রাতেই একটা হোটেল ভাড়া করেছে। হোটেলও পড়েছে তাজমহলের অতি নিকটে। হোটেলের পারিপার্শ্বিক অবস্থাও বেশ ভালো। সব মিলিয়ে পুতুলের দারুণ পছন্দ হয়েছে।
সারাজ স্টাফের সাথে কথা শেষ করে রুমে আসতেই দেখে, পুতুল হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখ জোড়াও নিমীলিত তার। মন্থর গতিতে তার শিউরে অবস্থান করল সারাজ। হাত নিয়ে ঠেকাল পুতুলের মাথার উপর। জিজ্ঞেস করল,
‘শরীর খারাপ লাগছে?’
চোখ মেলে চাইল পুতুল। কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,
‘না।’
‘তবে ফ্রেশ হয়ে নে। খেতে যেতে হবে।’
উঠে বসে পুতুল। বলে,
‘আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। তুমি মা বাবা আর মামনিকে কল দিয়ে জানিয়ে দাও, আমরা যে এসে পৌঁছেছি। নয়তো উনারা আবার টেনশন করবেন।’
সারাজ বলল,
‘আগে সিম’টা চেঞ্জ করতে হবে। তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি সব করছি।’
মাথা হেলিয়ে পুতুল চলে যায় ফ্রেশ হতে।
________
নিচে নেমে খেতে আসে সারাজ আর পুতুল। দুই দিনের টানা জার্নিতে মাত্রাধিক ক্লান্ত তারা। পুতুলের জন্য তো চোখের পাতা খুলে রাখা’ই দুষ্কর হয়ে ওঠেছে। তাও কোনোরকমে এই অসাধ্য কাজ সম্পন্ন করে খেতে এসেছে সে।
ভিন্ন দেশের ভিন্ন খাবারের এই স্বাদ অতুলনীয়। পুতুল আর সারাজ বেশ তৃপ্তি ভরে তাদের আহার সম্পন্ন করেছে। তারপর এক কাপ কফি নিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় তারা।
কফিটা কোনোরকমে শেষ করে বিছানায় আবারও গা এলিয়ে দেয় পুতুল। সারাজ পাশে বসে বলে,
‘কফি খেয়েও ঘুম পাচ্ছে তোর?’
পুতুল জড়ানো আওয়াজে বলে,
‘হ্যাঁ, ভীষণ।’
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সারাজ প্রত্যুত্তর করে,
‘ঠিক আছে, ঘুমা। জার্নি করে এসেছিস বলে আজ মাফ পেয়েছিস। ভেবে নিস না কালও মাফ করে দিব।’
পুতুল চিৎ হয়ে শু’লো। হাত উঁচিয়ে সারাজের গাল টিপে বাচ্চাদের মতো আদর করে বলল,
‘তুমি খুব দুষ্টু হয়েছ, সারাজ।’
সারাজ বোকার মতো তাকায়। ওষ্ঠযুগল আপনা আপনি ফাঁক হয়। পুতুল আরেকটু আলগা ভাবে শুয়ে বলে,
‘আমাকে আর দেখতে হবে না; এবার ঘুমিয়ে পড়ো, বাবু।’
সারাজ ততক্ষণাৎ কান মলে দেয় পুতুলের। ক্ষিপ্ত সুরে বলে,
‘খুশিতে কি মাথা গিয়েছে? কীসব উল্টা পাল্টা কথা বলছিস?’
মাথাটা উঁচু করে তাকায় পুতুল। ঈষৎ ক্রোধান্বিত হয়ে বলে,
‘তাহলে তুমি না ঘুমিয়ে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছো কেন? চুপচাপ ঘুমাও গিয়ে, যাও।’
সারাজ ভ্রু ভাঁজ করে অবাক কন্ঠে শুধায়,
‘তুই আমাকে ধমক দিচ্ছিস?’
‘অবশ্যই। বউ’ই তো বরকে শাসন করে। তাই আমিও করছি।’
‘আচ্ছা! তাই না?’
বলেই উঠে দাঁড়ায় সারাজ। অতঃপর হস্ত চালায় নিজের শার্টের বোতামের উপর। বিস্ফোরিত হয় পুতুলের অক্ষিযুগল। সাবাধান বাণী ছুঁড়ে বলে,
‘এই, তুমি কিন্তু নিজেই না করেছিলে।’
ফিচেল হাসে সারাজ। বলে,
‘হ্যাঁ, প্রথমে না করেছিলাম। তবে এখন সিদ্ধান্ত পাল্টে নিয়েছি। আর আমাকে ধমকানোর জন্যও একটা পানিশমেন্ট তোকে দেওয়া উচিত।’
পুতুল উঠে চট করে কাঁথা দিয়ে মুখ ডাকে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
‘না না, আমার ঘুম পাচ্ছে।’
কিন্তু তার এই আবেদন কঠিনভাবে অগ্রাহ্য করা হয়। এবং সূচনা ঘটানো হয় রোমাঞ্চকর এক শাস্তির। যার প্রতিটি স্পর্শে শরীরের লোমকূপ দন্ডায়মান হয়। বক্ষঃস্থলের ভেতরের হৃদপিন্ডের কম্পন তড়ান্নিত হয়। শরীর জুড়ে বয়ে যায় উষ্ণ স্রোত। মস্তিষ্ক হয়ে পড়ে অকেজো। এত এত যন্ত্রণা সহ্য করার পরও শাস্তি দাতা এবং শাস্তি গ্রহিতা উভয়ই তাতে চমৎকার মজে যায়। চিত্তের একচ্ছত্র অংশ তখন আওড়াতে থাকে, “আরেকটু শাস্তি বেশি পেলে ক্ষতি নেই।”
_________
পরদিন প্রাতঃকালের প্রথম প্রহর সমাপ্তির পূর্বেই হোটেল রুম ছাড়ে পুতুল আর সারাজ। উদ্দেশ্য তাদের, আশেপাশের এলাকা ঘুরে পরবর্তীতে একটু বেলা হলেই তাজমহলে পদার্পণ ঘটাবে। চিন্তা মোতাবেক’ই হলো সব। প্রভাতের প্রাতঃরাশ একটা লোকাল হোটেলে সম্পন্ন করেই তাজমহলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল তারা। গাড়ি দিয়ে সেখানে যেতে সময় নিল পনেরো মিনিট। সারাজ গিয়ে টিকিট কাটল। অতঃপর ভেতরে তাদের চরণস্থাপন করল। গেইট পেরিয়ে ঠিক সম্মুখে দাঁড়াতেই স্তব্ধ হলো পুতুল। ঐ সাদা রঙের মারবেল খচিত প্রাসাদ’টা সে আগে টিভি আর মোবাইলে অনেক দেখেছে। অথচ আজ সেটা ঠিক তার চোখের সম্মুখে। চোখের পল্লব জোড়া সংকুচিত করে প্রগাঢ় শ্বাস টানল পুতুল। ততক্ষণাৎ নাকে এসে ঠেকল তার এক অন্যরকম ভেজা মাটির ঘ্রাণ। অনুভূতিতে নাড়া পড়ল। চাইল আবার। সারাজকে তাড়া দিয়ে বলল,
‘চলো চলো, তাড়াতাড়ি ভেতরে যেতে হবে। আমার আর তর সইছে না।’
পুরো তাজমহলের আনাচে কানাচে ঘুরে ফেলেছে পুতুল। শ’খানেক ছবিও তুলেছে। এতদিন ছবিতে দেখে আসা এই জিনিসটা চোখের এত সামনে দেখে অভিভূত সে। হাতের স্পর্শ মেখেছে তার প্রতিটি দেয়ালে।
মাথার উপর রোদ বাবাজি চড়াও হতেই পুতুলকে নিয়ে একটু সাইডে এসে দাঁড়ায় সারাজ। পানির বোতলের ঢাকনা’টা খুলে এগিয়ে দেয় পুতুলের দিকে। বলে,
‘নে, পানি খা। খুব গরম এইদিকে।’
ঢকঢক করে দুই ঢোক পানি গিলল পুতুল। সারাজের দিকে এগিয়ে দিল বোতলটা। অতঃপর আহ্লাদী সুরে বলল,
‘শুনো, আমি মারা গেলে তুমি আমার জন্যও এইরকম একটা তাজমহল বানাবে। তারপর মানুষ সেই তাজমহল দেখবে আর ভাববে, আহ! সারাজ আর পুতুলের ভালোবাসার প্রতীক; কী নিদারুণ চমৎকার!’
সারাজ পুতুলের মাথায় গাট্টি মেরে বসে। ক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠে,
‘বাজে কথা বললে এক্ষুনি মেরে এখানেই কবর দিয়ে দিব। তাজমহল বানানোর শখ তখন একেবারে মিটে যাবে।’
পুতুল হাত দিয়ে মাথা ঘষে নাক ফুলিয়ে বলে,
‘তুমি আমাকে এতগুলো মানুষের সামনে মারলে?’
‘মারলাম কোথায়? তবে বাজে বকা বন্ধ না করলে মারও খেতে পারিস।’
গাল নাক উভয়ই ফুলাল পুতুল। ফোঁস ফোঁস করতে করতে পা বাড়াল সামনের দিকে। ভ্রু কুঁচকাল সারাজ। পেছন থেকে ডেকে উঠে বলল,
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘জাহান্নামে যাচ্ছি।’
সারাজ ব্যস্ত গলায় উত্তর দিল,
‘দাঁড়া, আমিও আসছি।’
পুতুলের পদযুগলের গতি বাড়ে। সারাজ ডাকলেও সেই স্বর কানে তুলে না সে। হাঁটতে হাঁটতে ঠিক তাজমহলের সম্মুখের বিশাল গেইটের সামনে এসে স্থির হয়। সারাজও দ্রুত পা চালিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। তেতে উঠে বলে,
‘কী সমস্যা তোর?’
পুতুল ক্ষিপ্ত সুরে জবাবে বলল,
‘অনেক সমস্যা। আর সবথেকে বড়ো সমস্যা তুমি।’
সারাজ কপাল গুঁটিয়ে শুধাল,
‘আমি কী করেছি?’
‘কিছুই করোনি। তুমি তো নিত্যান্তই এক ভদ্র মানুষ।’
প্রসন্ন হাসল সারাজ। রগড় সুরে বলল,
‘তা অবশ্য ঠিক। আমার মতো এমন ভদ্র মানুষ আর দুটো হয় না। তুই কিন্তু খুব লাকি, পুতুল।’
তপ্ত শ্বাস ছাড়ল পুতুল। পুতুলের নিঃস্পৃহ মুখাবয়ব দেখে সারাজের অধর কোণের হাসি দীর্ঘ হলো। আচমকা এক হাঁটু ভাঁজ করে নিচু হয়ে বসে পড়ল সে। পুতুল বিস্মিত হয়ে এক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল,
‘কী হলো?’
ঠোঁটের সেই ঈষৎ হাস্যরেখা বজায় রেখেই সারাজ সহসা এক হাত এগিয়ে দিল পুতুলের পানে। পুতুল ফ্যালফ্যাল করে চাইল। মনে মনে আওড়াল, “কী করতে চাইছে লোকটা?” ইশারায় পুতুলকে তার হাতের উপর হাত রাখতে বলল সারাজ। পুতুলও তাই করল। সারাজের হাতের পিঠে পুতুলের নরম হাতের স্পর্শ পেতেই সেই হাতখানা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল সে। পুতুল নির্নিমেষ চেয়ে আছে কেবল। কোনোকিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। সারাজ আওয়াজ তুলল। কোমল সুরে বলল,
‘সেই ছোট্ট সাত বছরের বালক যখন প্রথমবার একটা ছোট্ট প্রাণকে দেখেছিল, তখন সে অভিভূত হয়েছিল। অবাক হয়ে, বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে কেবল সেই ছোট্ট প্রাণকেই দেখছিল সে। কী চমৎকার সুন্দর সেই প্রাণ! সঙ্গে সঙ্গেই সেই বালকের মনে হয়েছিল, এই প্রাণটা নির্ঘাত এক পুতুল; জ্যান্ত পুতুল। তাই সেই পুতুলকে ঘরে আনতে উতলা হয়ে পড়ল সে। পুতুলও এল ঘরে। তার অতি নিকটেই থাকতে আরম্ভ করল। সময়ে অসময়ে দেখা হতো দুজনের। বেশ ভাব জমে গিয়েছিল কিন্তু। তবে এর মাঝেই সেই বালক একবার এক অনাকাঙ্খিত কাজ করে বসল। কী করল জানিস? সে সেই ছোট্ট পুতুলকে দিয়ে বসল তার মন। আর তারপর থেকে আজ অবধি সেই মন আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি সে। হয়তো বেঁচে থাকা আগ অবধি আর পারবেও না। কী করে পারবে বল? কাউকে কিছু দিলে বুঝি সেটা ফিরিয়ে আনা যায়? যায় না তো। তাই আমি শিওর, সেও পারবে না। কিন্তু এতকিছুর মাঝেও আসল মজার ব্যাপার কি জানিস? সেই পুতুলের আজ বিয়ে হয়েছে। সে আজ একজনের স্ত্রী। কার স্ত্রী জিজ্ঞেস করবি না?’
পুতুল মৃদু ঢোক গিলে। অস্ফুট স্বরে বলে,
‘সেই বালকের।’
হাসল সারাজ। বলল,
‘বাহ, ধরে ফেলেছিস? হ্যাঁ, সে এখন ঐ বালকের’ই স্ত্রী। অথচ সেই বালক এখনও তাকে তার মনের কথা বলে উঠতে পারেনি। এত বোকা, এত আহাম্মক কেউ হয়?’
পুতুল তৃষ্ণার্ত চোখে চেয়ে আছে। কিছু একটা শোনার জন্য বক্ষঃস্থলে যুদ্ধ বেঁধেছে তার। অশান্ত মনকে শান্ত করা বড্ড দায় হয়ে ওঠেছে। সারাজ নিজ থেকে বলে,
‘জানিস পুতুল, আজ সেই বালক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সে তার মনের কথা তার পুতুলকে বলবে। অনেক সময় নিয়েছে আর না। এবার বলা উচিত। বল, উচিত না?’
অস্থির হয়ে মাথা নাড়ায় পুতুল। যেন মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করছে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই বলা উচিত। বলে তার অশান্ত মনটাকে শান্ত করা উচিত। আর অপেক্ষা করানোটা ঠিক হবে না। শেষে তার পুতুলের মনক্ষুন্ন হবে যে।”
সারাজ এবার পুতুলের দুহাত আঁকড়ে ধরে। আশেপাশের মানুষ সব হা করে তাদের দেখছে। ঢোক গিলে পুতুল। ক্ষণে ক্ষণে হৃদপিন্ডের কম্পন তীব্র হচ্ছে। সে কম্পনের শব্দ কানে এসে ঠেকছে তার। আমজনতা উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে তাদের দিকে। কেউ কেউ আবার ভিডিও ও করছে।
সারাজ এক পল সময় নিয়ে মৃদু আওয়াজে বলল,
‘ভালোবাসি, পুতুল। প্রচন্ড রকম ভাবে ভালোবাসি। আর জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি এইরকম ভাবেই ভালোবেসে যেতে চাই। আমায় সেই অধিকার দিবি তো, পুতুল?’
চোখ জোড়া সিক্ত পুতুলের। যেন একটু নড়লেই টুপ করে সবটা জল কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে। বক্ষঃস্থলের ঝড় এখন কমেছে। চিত্ত ফুরফুরে হয়ে উঠেছে যেন। ঠোঁট জোড়া মৃদু কাঁপছে। কিছু একটা বলতেও গিয়েও আটকে যাচ্ছে যেন। কেবল সারাজ না, বেশ কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ চেয়ে আছে তার পানে; তার উত্তরের অপেক্ষায়।
চলবে…….