#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৫।
মায়ের ডাকে কোনোরকমে চোখ পিটপিট করে তাকায় পুতুল। চোখ জোড়া নিভু নিভু। তাও কোনোরকমে ঢুলতে ঢুলতে উঠে বসে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে শুধায়,
‘কী হয়েছে, মা? ডাকছ কেন?’
মেহুল ব্যস্ত হয়ে কিছু একটা করছিল। মেয়ের দিকে নিঃস্পৃহ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
‘ডাকছি কেন মানে? উঠবি না তুই? সাতটা বাজে, পার্লারে যাবি কখন?’
পুতুল ফের বিছানায় গা এলিয়ে দিল। জড়ানো আওয়াজে বলল,
‘মা, পার্লারে যাব না। লীনা আমাকে সাজাবে। এই লীনা, সাজাবি না?’
বলেই তার পার্শ্বে শায়িত লীনাকে ধাক্কা দিল। ঘুমন্ত লীনা খানিকটা নড়ে উঠে বলল,
‘হু।’
মেহুল কোমরে হাত দিয়ে বলল,
‘বিয়ের দিনও পার্লারে যাবি না?’
‘উঁহু।’
প্রগাঢ় শ্বাস নিঃসৃত করে মেহুল। অতঃপর বলে,
‘ঠিক আছে। উঠ এবার। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে রেডি হতে বস। নয়তো পরে মেহমানরা চলে আসলে অসুবিধা হবে।’
পুতুল হাত উঁচু করে বলল,
‘আচ্ছা, উঠছি।’
মেহুল পুতুলের শাড়ি গহনা সব বের করে রেখে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। আজ অনেক কাজ। যদিও ক্যাটারিং এর লোকেরাই সব আয়োজন করছে, তাও সে তো মা। তাকে তো আর বসে থাকা মানায় না।
_______
চোখ কচলে উঠে বসল লীনা। পুতুলকে দুবার ধাক্কা দিল। কিন্তু, সে বেঘোরে তন্দ্রায় ব্যস্ত। লীনা উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এল। আবার বসল পুতুলের পাশে। পুতুল এখনও গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন। লীনা ডাকল তাকে,
‘এই পুতুল, উঠ না। আর কত ঘুমাবি। আন্টি সেই কবে এসে ডেকে গিয়েছেন। উঠ, নয়তো বিয়ের দিনও কিন্তু বকা খেতে হবে।’
পুতুল নড়ে উঠল। অতঃপর পাশ ফিরে আবার শু’লো।
বীতঃস্পৃহ লীনা। ক্রমাগত ডেকেই যাচ্ছে তাকে। পুতুল ভ্রু কুঁচকে ফেলে। তেতে উঠে বলে,
‘কয়টা বাজে? এত তাড়াতাড়ি কেন উঠতে হবে, শুনি?’
‘কারণ আজ তোমার বিয়ে। বিয়ের দিন মানুষ তাড়াতাড়িই উঠে, এটাই নিয়ম।’
পুতুল উঠে বসল। গরম চোখে চাইল লীনার দিকে। লীনা হেসে বলল,
‘এবার লক্ষী মেয়ের মতো জলদি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।’
হাত পা ছুড়ে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল পুতুল। তারপর ঠোঁট নাড়িয়ে কী যেন বিড়বিড় করতে করতে ওয়াশরুমে ঢুকল।
____
সকালের নাস্তা সেরে পুতুল আর লীনা গেল বড়ো বাগানের দিকটায়। সেখানেই খাবার দাবারের আয়োজন করা হয়েছে। বুফে সিস্টেম খাবার হবে। চারদিকে আলো আর ফুলের চমৎকার সমারোহ। পুতুল আর সারাজের স্টেজটাও সেখানেই করা হয়েছে। সবকিছু অত্যন্ত অনবদ্য লেগেছে তার। যেন প্রকৃতির রঙে মিশে গিয়েছে এই আয়োজন। লীনা আপ্লুত সুরে বলল,
‘স্টেজ’টা কিন্তু চমৎকার হয়েছে।’
পুতুল হেসে বলল,
‘হ্যাঁ, আমারও খুব পছন্দ হয়েছে।’
‘এই, এবার চল তাড়াতাড়ি। তোকে সাজাতে বসাতে হবে। লেইট হলে আন্টি বকবেন কিন্তু।’
লীনা তাড়া দিতেই পুতুল ছুটল তার রুমের দিকে।
___________
নিচে থেকে হৈ চৈ এর শব্দ ভেসে আসছে। মেহমানদের আগমন ঘটছে হয়তো। পুতুল ছটফট করছে একবার নিচে যাওয়ার জন্য। কিন্তু, লীনাও তাকে এখন ছাড়বে না বলে পণ করেছে। পুতুলের সাজও প্রায় শেষের দিকে। এখন গয়নাগুলো পরিয়ে মাথায় দুপাট্টা দিয়ে দিলেই সমুদায় ব্যাপারটা পরিপূর্ণতা ভাবে।
গয়নাগুলো লীনা ভীষণ যত্ন সহিত পুতুলের গলা আর কানে আরোপণ করল। মাথায় দুপাট্টা দিয়ে পিন লাগাতেই চমৎকার হাসি প্রস্ফুটিত হলো অধর কোণে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল,
‘দোস্ত, তোকে কী লাগছে রে!’
পুতুল চুরি পরছিল। লীনার কথা শুনে আরশিতে বিদ্ধ হওয়া স্বীয় প্রতিবিম্বটি পরখ করে সে। অবাক হয়। আসলেই, নিরুপম লাগছে তাকে। আহামরি রংচটা প্রসাধনী মুখশ্রীতে ঠাই না পেলেও, এই ক্ষুদ্রতার মাঝেও নিঁখুত চমৎকার ঠেকছে তার এই রূপ। গায়ে জড়ানো রক্তিম লাল শাড়ি, ওষ্ঠ জুড়ে পুষ্পিত লাল রঞ্জক আর ললাট রাঙানো ছোট্ট লাল বিন্দু। না, কেবল এইটুকুই না। অসিত অলকের মাঝ বরাবর তুলা সিঁথিতে স্থান পেয়েছে ছোট্ট একখানা টিকলি। ছোট্ট সরু নাকটাও বাদ যায়নি। বৃত্তাকার একটা বড়ো নোলকে সেটা চকমক করছে যেন।
অদ্ভুত ভাবে পুতুল লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠে। গালে লাল রঞ্জক প্রসাধনী ব্যবহার না করলেও তাতে নিদারুণ ভাবে ফুটছে রক্তিম আভা। তা দেখে লীনাও হাসে। বলে,
‘থাক, আর লজ্জা পাস না। আর এমনিতেও আজ রাতের পর থেকে ভাইয়া আর তোকে এরকম লজ্জা পেতে দিবেনও না।’
বলেই চোখ টিপল সে। পুতুল তার কুনুই দিয়ে গুঁতা দিল ঠিক লীনার পেট বরাবর। লীনা কুঁজো হয়ে পেট চাপড়ে বলল,
‘আজও মারবি?’
‘হ্যাঁ, বাজে কথা বললে অবশ্যই মারব।’
‘হু, সত্যি বললে সবার গায়েই ফোসকা বলে। থাক, আমি আর কিছু বললাম না।’
‘সেটাই ভালো। চুপ থেকে এবার নিজে গিয়ে রেডি হ। নয়তো পরে মাহাত ভাই এসে বলবেন, বান্ধবীকে রেডি করতে করতে আমার গার্লফ্রেন্ডটা একটু রেডি হওয়ার সুযোগও পেল না। ঐ যে তোর লেহেঙ্গা। জলদি পরে, জলদি রেডি হ।’
লীনা অবাকন্ঠে বলল,
‘মাহাতকে কে বলেছে?’
‘কেন, আমি বলেছি। আমার বিয়ে আর আমার বান্ধবীর হবু বর আসবে না? এমনটা আমি কী করে হতেই দেই, বল? তাই মাহাত ভাইও আসবেন। এখন তুই গিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হ তো।’
লীনা এক পল ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থেকে, অতঃপর গেল তৈরি হতে।
__________
নিচে থেকে বেশ শোরগোল শোনা যাচ্ছে। সবাই বলছে, “বর এসেছে, বর এসেছে।” সেই সুর শুনেই নিচে নেমে গিয়েছে লীনা। এদিকে অস্থিরতায় পুতুলের অবস্থা কাহিল। এর মাঝে এক দুবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি মারাও হয়ে গিয়েছে। সারাজের গাড়ি আজ থেমেছে মেইন গেইটের বাইরেই। সেখানে মানুষের ভীড় জমে গিয়েছে যেন। এত মানুষের ভীড়ে কাঙ্খিত সেই ব্যক্তির মুখাবয়ব না দেখতে পেয়ে বিষন্ন মনে রুমে ফিরে আসল পুতুল। আরো যে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে?
লীনা দৌড়ে পুতুলের রুমে এসে হাঁপাতে লাগল। পুতুল চমকে তাকিয়ে বলল,
‘কী হলো, এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন?’
দাঁত কেলিয়ে হাসল লীনা। লেহেঙ্গা গায়ে অনুপম সাজে মেয়েটার এই হাসি চমৎকার ঠেকল পুতুলের কাছে। পুতুলও আলতো হাসল। বলল,
‘তোকে ভীষণ সুন্দর লাগছেরে।’
লীনা বড়ো বড়ো নিশ্বাস ছেড়ে পুতুলের পাশে গিয়ে বসল। বলল,
‘ওসব ছাড়। এটা দেখ।’
পুতুল চাইল লীনার হাতের দিকে। টাকার বান্ডেল দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘এত টাকা?’
লীনা ফের দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, তোর জামাইয়ের পকেট কেটেছি। গেইট ধরার টাকা এটা?’
পুতুল মাথায় হাত দিয়ে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলে,
‘বলিস কী? এত টাকা? তোরা তো দেখছি একদিনেই আমার জামাইকে ফকির বানিয়ে ছাড়বি।’
‘অবশ্যই। আমাদের দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র দুলাভাই। ফকির তো তাঁকে হতেই হবে।’
বলেই লীনা টাকা গুনতে মনোযোগ দিল। পুতুল ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আমাকেও একটু ভাগ দিস, প্লিজ।’
অতঃপর লীনা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই পুতুল বোকা বোকা হাসি দেয়।
______________
পুতুলকে নিয়ে যাওয়া হলো স্টেজের সামনে। মাথায় টানা বড়ো ঘোমটার কারণে তার মুখশ্রী সকলের দৃষ্টিগোচরের বাইরে। তাও তারদিকে সবাই চেয়ে আছে নিষ্পলক চোখে। স্টেজের ঠিক মাঝ বরাবর টানিয়ে রাখা বড়ো ফুলের চাদর পেরিয়ে পুতুলকে দেখা মুশকিল। তবুও একজনের অবাধ্য তৃষ্ণার্ত অক্ষিযুগল সব পেরিয়ে তার বধূরূপী প্রেয়সীকে দেখতে ব্যস্ত। তবে ঐটুকু দেখাতে কি হয়? হয় না, ঐ ক্ষুদ্র দেখা কেবল অন্তরের অন্তঃস্থলের আকাঙ্খাকে তীব্র করে, অন্তরকে শীতল করতে পারে না।
পুতুলকে বসানো হলো সারাজের উল্টো পাশে। তাকে ঘিরে আত্মীয়স্বজন সবাই দাঁড়িয়ে আছে। মেহুল আর রিতা অফুরন্ত খুশিতে উন্মাদ। তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রাবীর আর সাদরাজ। আপ্লুত চোখে ছেলে মেয়েগুলোকে দেখছে। যেন চোখের পলকেই বড়ো হয়ে গিয়েছে তারা।
কাজী সাহেব কাবিননামা পড়ে শোনালেন। অতঃপর সারাজের দিকে চেয়ে বললেন,
‘বলো বাবা, আলহামদুলিল্লাহ কবুল।’
সারাজের নির্নিমেষ দৃষ্টি ঘোমটার আড়ালে তার পুতুলের পানেই। ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।’
পরপর আরো দুবার বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল; আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।’
এবার কাজী সাহেব চাইলেন পুতুলের দিকে। কাবিননামা পড়লেন পুনরায়। একই ভাবে বললেন,
‘কবুল বলো, মা।’
কোনোপ্রকার ভনিতা ছাড়াই ঝরঝরে সুরে পুতুল বলে উঠল,
‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল, কবুল, কবুল।’
তাকে এত নির্লিপ্ত ভাবে কবুল বলতে দেখে অবাক চোখে চাইল সবাই। সারাজ নিজেও বিস্মিত। প্রথমবার কবুল বলার সময় যে মেয়ে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল, আজ সেই মেয়ে এক শ্বাসেই কবুল বলে ফেলল? আশ্চর্য!
সবার অমন দৃষ্টি দেখে ইতস্তত সুরে পুতুল বলল,
‘এভাবে দেখছ কেন? কবুল’ই তো বলেছি। খুশি হওনি তোমরা?’
একসঙ্গে হেসে উঠল সবাই। সমস্বরে বলে উঠল,
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
চলবে…
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৬।
বেশ আড়ম্বতার সাথে সমাপ্ত হলো সারাজ আর পুতুলের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। আত্মীয়স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীর অভাব ছিল না। তার সাথে বাবা মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে মিডিয়ার লোকেরা তো ছিলই। ছবি তোলা, খাওয়া দাওয়া, হৈ চৈ আর আনন্দ, সব মিলিয়ে চমৎকার এক দিনের মধ্যে দিয়েই প্রারম্ভ ঘটল তাদের আনকোরা জীবনের।
এবার বিদায়ের পালা। মেহমানদের উপস্থিতি ইতিমধ্যেই অবহুল হয়ে এসেছে। বসার ঘরে সবাই।
সারাজের সাথে কথা বলছে রাবীর। প্রচন্ড বিশ্বাস আর আশ্বাসের সহিত সে মেয়েকে তুলে দিচ্ছে সারাজের হাতে। সারাজও তাই তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
‘আমি তোমার বিশ্বাস ভাঙতে দিব না, বাবা। পুতুলকে আমি আমার সবটুকু দিয়ে ভালো রাখব।’
মেহুল থেকে থেকে আঁচলে চোখ মুছছে। রিতা বোঝাচ্ছে তাকে, মেয়ে তো আর পরের ঘরে যাচ্ছে না। এক মা ছেড়ে কেবল অন্য মায়ের কাছে যাচ্ছে। তাও, মায়ের মন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে তাদের কাছে সন্তানের অভাব। এই অভাব অন্যকিছুতে যে মিটে না।
সবার ভাবমূর্তি মনোযোগের সহিত পরখ করল পুতুল। সোফায় তার পাশেই বসে আছে লীনা। যদিও মন তার এখানে নেই। মাহাত ছেলেটা ক্রমাগত তাকে মেসেজ দিয়ে দিচ্ছে। তার মেসেজের রিপ্লাইটাও ঠিক মতো দিতে পারছে না সে। এত মানুষ, তাও আবার বিদায়ের বেলা। এইসময় মেসেজে প্রেমালাপ করা ঠিক মানায় না।
পুতুল হঠাৎ তাকে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘এই দোস্ত, আমি তো একটু পর চলে যাব।’
লীনা দুঃখি দুঃখি চোখে চাইল। বলল,
‘মন খারাপ করিস না, দোস্ত। তোর শ্বশুরবাড়ির মানুষরা তো তোকে অনেক ভালোবাসেন। তুই অনেক ভালো থাকবি।’
পুতুল বিষন্ন হয়ে চাইল। হতাশ সুরে বলল,
‘কিন্তু দোস্ত, সমস্যা তো অন্য জায়গায়।’
লীনা খানিক চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘কী সমস্যা?’
পুতুল ইতস্তত সুরে জবাবে বলল,
‘আমি না এখন চলে যাব? বিদায়ের বেলায় তো মেয়েরা অনেক কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে তো অনেকে আবার বেহুঁশও হয়ে যায়। অথচ দোস্ত, আমার না একটুও কান্না পাচ্ছে না। মানে, চেষ্টা করেও চোখে পানি আনতে পারছি না। এমন হলে কী করে হবে বলতো? না কাঁদলে সবাই কী বলবে, এই মেয়ের মা বাবার প্রতি একটুও মায়া নেই। দেখো, কেমন নাচতে নাচতে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। আমার এখন কী হবে, দোস্ত?’
পুতুলের চোখে মুখে মারাত্মক চিন্তার ছাপ। অন্যদিকে সব শুনে লীনা বাকরুদ্ধ। সে কী প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝতে পারছে না। এই মুহুর্তে এই মেয়ের কান্নাও উধাও হয়ে গিয়েছে? বাহ!
লীনা জোরে নিশ্বাস বর্জন করল। তাকাল পুতুলের দিকে। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘না কান্না আসলে কাঁদবি না। এটা নিয়ে এত চিন্তা করার কী আছে?’
‘কিন্তু, মানুষ কী বলবে?’
‘মানুষ তোর মাথা আর আমার মুন্ডু বলবে। আপাতত আমার মাথা না খেয়ে চুপ করে বসে থাক।’
পুতুল গাল ফুলিয়ে বসল। মনে মনে বিড়বিড় করে কতকগুলো গালিও দিল লীনাকে।
__________
পুতুলকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে মেহুল। বান্ধবীর কান্না দেখে রিতার চোখ জোড়াও সিক্ত হয়ে এসেছে। মেহুলের পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। মেহুলের কান্না থামছে না তাও। সারাজ মোলায়েম সুরে বলল,
‘মা, তুমি তো পুতুলকে তোমার ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছ; তাহলে এত কাঁদছ কেন? আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার? পুতুল ভালো থাকবে, মা। প্লিজ, কান্না থামাও।’
মেহুল নাক টেনে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ফর্সা নাক গাল সব রক্তিম হয়ে ওঠেছে। পুতুল আর সারাজের কপালে পরপর চুমু খেয়ে বলল,
‘আমি জানি, আমার মেয়ে ভালো থাকবে। কিন্তু মেয়েকে ছাড়া আমি কী করে ভালো থাকব, বল? আমার সব ভালো থাকা যে মেয়েটা সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে।’
‘তাহলে তুমিও চলো আমার সাথে।’
পুতুলের নির্লিপ্ত সুর শুনে হেসে ফেলল মেহুল। মেয়ের মাথায় চাটি দিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, এখন তোর জন্য মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বসে থাকব? যা তুই। এমনিতেও এতদিন অনেক জ্বালিয়েছিস আমাকে। এবার আবার বান্ধবীর পালা।’
বলেই রিতার দিকে চেয়ে হাসল সে। রিতাও হেসে বোঝাল, সে পুতুলের সব জ্বালানো মাথা পেতে সহ্য করে নিবে।
রাবীরও এগিয়ে এসে মেয়ের কপালে চুমু খেল। অক্ষিযুগল তারও ছলছল। সারাজকে আরো একবার বুকে জড়িয়ে বলল,
‘মেয়েটাকে ভালো রাখিস, বাবা।’
.
লীনার চোখে পানি দেখে পুতুল অসহায় সুরে বলল,
‘দেখেছিস সবাই কাঁদছে, কেবল আমার চোখেই পানি আসছে না। কী এক মসিবতে পড়েছি বলতো?’
লীনা টলমল চোখেই হেসে ফেলে। পুতুলকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘তুই না জীবনেও শুধরাবি না।’
গাড়িতে নিজের আসনে আরাম করে বসল পুতুল। তার পাশের স্থান দখল করেছে সারাজ। পেছনের আরেক গাড়িতে রিতা আর সাদরাজ। তারপর আরো তিন গাড়ি মেহমান। গাড়ি স্টার্ট হয়। পুতুল জানলা দিয়ে তাকায় তার অসহায় মা বাবার দিকে। যারা এক বুক বিষন্নতা নিয়ে চেয়ে আছে তার পানেই। এবার খানিকটা মনস্তাপ হয় তার। তাকিয়ে থাকে এক ধ্যানে। চলন্ত গাড়িতে যতক্ষণ তাদের দৃষ্টিগোচর হলো ততক্ষণই চেয়ে রইল। দৃষ্টির বাইরে মানুষ দুটো হারিয়ে যেতেই সিটে হেলান দিয়ে বসল সে। চাইল সারাজ দিকে। সারাজও এতক্ষণ অনিমেষ চেয়ে ছিল বিধায় চোখে চোখ পড়ল। হঠাৎ কী খেয়াল করে চট করে সোজা হয়ে বসে পুতুল। তারপর ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে উঠে,
‘এই সারাজ ভাই, তুমি দেখি ক্লিন শেভ করোনি। ভাগ্যিস, আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন। নয়তো আজ তো তোমাকে বিয়েই করতাম না।’
সারাজ প্রচন্ড রকম তেতে ওঠল। জোরে ধমক দিয়ে বলল,
‘আমি কি এখনও তোর ভাই?’
পুতুল ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘ওপস সরি, ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি তো এখন ভাইয়া থেকে সাইয়্যা হয়ে গিয়েছ।’
বলে শব্দ করেই হেসে ফেলল সে। সারাজ চোয়াল শক্ত করে বলে উঠল,
‘আজকে বাসায় গিয়েই আমি ক্লিন শেভ করব।’
ভ্রু কুঁচকে তাকাল পুতুল। তারপর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আজ ক্লিন শেভ করলে বাসর ক্যান্সেল।’
হাসল সারাজ। পুতুলের দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে একই সুরে বলল,
‘তোর কি মনে হয়, সবকিছু তোর কথায় হবে? আমার এতদিনের প্রতীক্ষার রজনী, অবশ্যই আজ তোর কোনো মর্জি চলছে না।’
ভ্রু যুগলের ভাঁজ দৃঢ় হলো পুতুলের। এক পল সারাজকে দেখে ফের গা এলিয়ে দিল তার আসনে। দায়সাড়া ভাবে বলল,
‘তোমাকে আমি ভয় পাই না।’
ফের ক্রূর হাসল সারাজ। বলল,
‘আচ্ছা, রাতেই দেখা যাবে।’
পুতুল সন্দিহান চোখে তাকাতেই চোখ টিপল সারাজ। অতঃপর মুখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরে চাইল। ভ্যাবাচ্যাকা খেল পুতুল। মনে মনে ভাবল, “এই অসভ্য লোকটার মাথায় কী চলছে কে জানে?”
_________
পুতুলকে বেশ তোড়জোড় করে বরণ করা হলো। বসার ঘরে গিয়ে বসল তারা। আশপাশ থেকে আরো মানুষ এসেছে নতুন বউ দেখতে। পুতুলকে ড্যাবড্যাব করে দেখছে সবাই। এতক্ষণ ভালো লাগলেও এবার ভীষণ ক্লিষ্ট আর অস্বস্তি হচ্ছে। কতক্ষণে এসব শাড়ি গহনা খুলবে আপাতত সেই চিন্তাতেই বিভোর সে। রিতা এসে নতুন বউকে পুনরায় পরিচয় করিয়ে দিল সকলের সাথে। অতঃপর একটা মেয়েকে ডেকে বলল, পুতুলকে আপাতত গেস্ট রুমে নিয়ে যেতে। বাসর ঘর সাজানো এখনও শেষ হয়নি। শেষ হলেই খেয়ে দেয়ে তারা রুমে যাবে।
ভারি শাড়ি গহনা থেকে নিজেকে উন্মুক্ত করতেই মাত্রাধিক শান্তি অনুভূত হলো পুতুলের। গায়ে পুনরায় জড়াল একটা সুতি লাল রঙা শাড়ি। সে শাড়ি পরতে জানে না বিধায়, সেই অজ্ঞাত মেয়েটাই তাকে সাহায্য করেছে।
ভেজা কুন্তল বেয়ে ঝরঝরিয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু অম্বু রাশি। আরশিতে নিজের প্রতিবিম্ব পরখ করতেই লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠল স্বীয় গন্ডস্থল। অক্ষিপটে সারাজের মুখাবয়ব প্রস্ফুটিত হতেই আরো বেশি লাজে কুন্ঠিত হয়ে পড়ল যেন। মনে পড়ল, আজ তো তাদের বাসর রাত। সারাজ তখন গাড়িতে যেভাবে বলল, তার কাছে এই রজনী দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রজনী। এই রজনীতে পুতুলের কোনো মর্জিই গ্রাহ্য করা হবে না। একেবারেই না। আবারও লজ্জায় নুয়ে পড়ল সে। ঠোঁট কামড়ে হাসল। বিড়বিড় করে বলল,
‘অসভ্য সারাজ।’
চলবে….
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৭।
পুষ্প নিহিত পালংকে হাত পা গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে পুতুল। নিদারুণ লজ্জা আষ্টেপৃষ্ঠে যেন জড়িয়ে ধরেছে তাকে। এই বাড়ি, এই ঘর, আর ঐ মানুষটা সবই তার পূর্ব পরিচিত। অথচ, আজ সবকিছু কেমন যেন নতুন মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে সে কোনো অজানা এক রাজ্যে চলে এসেছে। যার চারদিকে পুষ্পের সমারোহ। আর সে সেই পুষ্পের রাণী। আর তার একমাত্র সুদর্শন রাজা সারাজ।
কীসব বাচ্চাদের মতো উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথায় আসছে। পুতুল একবার নিঃস্পৃহ হচ্ছে তো একবার হাসছে। আবার একবার আকাশচুম্বী ব্রীড়ায় হচ্ছে কুন্ঠিত। ঠিক সেই মুহূর্তেই আগমন ঘটল সেই কাঙ্খিত ব্যক্তির। দরজাটা অতি সন্তর্পনে আটকে দিয়ে সারাজ এসে দন্ডায়মান হলো ঠিক পুতুলের সম্মুখে। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল পুতুল। উদ্যত হলো সালাম করতে। পুতুল উঁবু হয়ে বসে সারাজের পায়ে কোমল হস্তে স্পর্শ করতেই অধর কোণে চমৎকার হাসি ফুটে সারাজের। মনে মনে আওড়ায়,
‘আমার পুতুল বউ। একমাত্র আমার।’
সারাজের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে ভ্রু কুঁচকে উপর দিকে তাকায় পুতুল। বিরক্ত গলায় বলে উঠে,
‘কী হলো? দেখছ না, আমি পা ধরে বসে আছে। উঠাও আমাকে।’
ঈষৎ হাসল সারাজ। পুতুলের দুই বাহুতে হাত রেখে তাকে দাঁড় করাল। সঙ্গে সঙ্গেই তখন তার সামনে ডান হাত মেলে ধরল পুতুল। উৎফুল্ল সুরে বলল,
‘এবার আমার গিফ্ট দাও।’
সারাজ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘গিফ্ট? কীসের গিফ্ট?’
‘কীসের গিফ্ট মানে? এই যে তোমাকে সালাম করলাম, তার গিফ্ট। আর বাসর রাতে তো এমনিই বউকে গিফ্ট দিতে হয়।’
সারাজ বিছানার এক পার্শ্বে পা তুলে বসল। অতঃপর পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘আচ্ছা, কী গিফ্ট চাই বল।’
কোমরে হাত দিয়ে গরম চোখে চাইল পুতুল। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘মানে আমি বললে তুমি আনবে? এখন নিয়ে আসোনি?’
‘না। বিয়েতে খরচ করতে করতে বর্তমানে আমি ফকির। বল কী লাগবে, পরে নিয়ে আসব।’
নাক মুখ কুঁচকে বিদ্বেষে জ্বলে উঠল পুতুল। গটগট করে হেঁটে গিয়ে বিছানার আরেক পার্শ্বে বসল। তেতে উঠে বলল,
‘থাক, কিছু লাগবে না আমার।’
বিছানায় হেলান দিয়ে বসল সারাজ। তীক্ষ্ণ চোখে চাইল পুতুলের পানে। তবে পেছন থেকে কেবল তার পৃষ্ঠদেশ’ই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। আধভেজা খোলা কুন্তলে চোখ আটকাল তার। এগিয়ে এসে সেই মসীবর্ণ কেশে নাক ডুবিয়ে বলল,
‘এমন তীব্র ঘ্রাণওয়ালা শ্যাম্পু আর কখনো দিবি না। আমার বড্ড নাকে লাগছে।’
ঘুরে চাইল পুতুল। অকস্মাৎ সারাজকে এত নিকটে দেখে ভড়কে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তোমার জন্য আর কী কী করতে হবে, তার একটা লিস্ট করে দিও। মুখে বললে আমার মনে থাকবে না।’
হাসল সারাজ। পুতুলের কন্ঠের তেজ যথেষ্ট। আবারও হেলান দিল পূর্বের জায়গায়। বলল,
‘সামান্য একটা গিফ্টের জন্য এত রাগ?’
পুতুল রাগ দেখিয়ে বলল,
‘এটা সামান্য গিফ্ট না। বাসর রাতের গিফ্ট স্পেশাল হয়। অবশ্য তোমার মতো নিরামিষ মানুষ কি আর সেসব বোঝে!’
সারাজ নিমীলিত চক্ষে প্রগাঢ় শ্বাস নির্গত করে। পুতুল এসে শুয়ে পড়ে তার জায়গায়। গম্ভীর সুরে বলে,
‘লাইট’টা অফ করে দিও।’
চোখ মেলে চাইল সারাজ। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘আজ রাত কি ঘুমানোর জন্য?’
জবাব দিল না পুতুল। সারাজ উঠে দাঁড়াল। আলমারির কাছে গিয়ে কিছু একটা নিয়ে আবার ফিরে এল তার স্থানে। পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘ওঠ।’
পুতুল অগ্রাহ্য করল তার সেই হুকুম। সারাজ ফের বলল,
‘উঠতে বলেছি, পুতুল।’
অগত্যাই উঠে বসল পুতুল। বিমুখ হয়ে বসে রইল। সারাজ তার দিকে ছোট্ট একটা বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘তোর গিফ্ট।’
চমকে চাইল পুতুল। অবাক কন্ঠে বলল,
‘তার মানে এতক্ষণ তুমি মজা করছিলে?’
‘না, তোর গাল ফুলানো দেখে ম্যাজিক করে নিয়ে এসেছি।’
সরু চোখে এক পল সারাজকে দেখে হাসল পুতুল। অতঃপর হাতের ছোট্ট বক্সটার দিকে চাইল। কী আছে এতে? হয়তো আংটি। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বক্সটা উন্মুক্ত করল সে। তবে ভেতরের জিনিসটা দেখে মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময় ছেয়ে গেল পুরো চিত্ত জুড়ে। সারাজের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বলল,
‘চাবি? কীসের চাবি এটা?’
‘স্কুটির।’
পুতুলের চোয়াল ঝুলল। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল কেবল। সারাজ নিজ থেকেই বলল,
‘ছোট বেলায় একবার এক স্কুটি দেখে অনেক কেঁদেছিলি তুই। ছোট বলে বাবা তোকে আর স্কুটি কিনে না দিয়ে সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেদিনই তোর কান্না দেখে মনে মনে ঠিক করেছিলাম, একদিন নিজের আয়ে তোর এই ইচ্ছে পূরণ করব। অবশেষে পেরেছি। খুশি হয়েছিস?’
মুখে কিছু না বলে সারাজকে সহস্তে জড়িয়ে ধরল পুতুল। প্রতুল খুশিতে আত্মহারা সে। বাসর রাতে যে এমন একটা গিফ্ট পাবে সেটা তার কল্পনাতীত ছিল। সারাজও দু হাতে আগলে নিল তাকে। মাথায় গাঢ় এক চুম্বন করে বলল,
‘এবার আমার গিফ্ট।’
ঈষৎ লাজে গাল রাঙিয়ে পুতুল বলল,
‘এই যে পুরো আমিটাকেই আজ থেকে তোমায় দিয়ে দিলাম।’
অন্তঃস্থলে মৃদু কম্পনের সৃষ্টি হলো ততক্ষণাৎ। হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় করে সারাজ শুধাল,
‘সত্যি বলছিস?’
মাথা নাড়িয়ে পুতুল বলল,
‘হ্যাঁ, একদম।’
পুতুলকে সোজা করে বসাল সারাজ। তার নববধূকে সাধারণ এই লাল রঙা শাড়িতে অমায়িক লাগছে। তার অবাধ্য চোখের দৃষ্টি আর এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। পুতুলের সমস্ত মুখাবয়ব জুড়ে তার বিচরণ শুরু হয়। ঘোরে লাগে সারাজের। অন্য এক নেশায় বুঁদ হয় মস্তিষ্ক। লজ্জায় সংকুচিত পুতুল। কুন্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘এভাবে কী দেখছ?’
এগিয়ে এসে পুতুলের আরো নিকটস্থ হয় সারাজ। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে,
‘তোকে ভীষণ আবেদনময়ী লাগছে, পুতুল।’
লজ্জায় শিহরণ জাগে শরীরে। প্রতিটি লোপকূপ দাঁড়িয়ে যেন তারই ইশারা দিচ্ছে। বক্ষঃস্থলের কম্পন তীব্র হয়। সারাজের তপ্ত নিশ্বাস চোখে মুখে আছড়ে পড়তেই সে কম্পন আরো প্রগাঢ় হয়। শরীর শীতল হয়ে আসে। আচমকা ওষ্ঠযুগলের উপর সারাজের পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেতেই শরীর কেঁপে উঠে তার। তার কম্পিত ওষ্ঠে নজর বরাদ্দ রেখেই সারাজ বলে উঠল,
‘এভাবে কাঁপছিস কেন, পুতুল? আমি কি কিছু করেছি?’
অসহায় চোখে তাকায় পুতুল। ভগ্ন সুরে বলল,
‘কিছু করোনি বলেই তো কেবল কাঁপছি। আর কিছু করলে তো মরেই যাব।’
ঠোঁট কামড়ে হাসল সারাজ। মোহিত সুরে বলে উঠল,
‘তবে আজ তোকে মেরেই দেই, কী বলিস?’
বিস্ফোরিত চোখে চাইল পুতুল। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে কিন্তু, তার আগেই যা ঘটার ঘটে গেল। তাজ্জব বনে বসে রইল পুতুল। শরীর ইতিমধ্যেই অসাড় হয়ে এসেছে তার। খেয়াল করল সারাজ অল্পতেই উন্মাদ হয়ে ওঠেছে। এতেই শরীর আরো ছেড়ে দিল তার। সারাজের বুকে ঢলে পড়তেই হাসল সে। ফিচেল স্বরে বলল,
‘পুরোপুরি মরার আগে এমন এক দু বার বেহুঁশ হওয়া কোনো বড়ো ব্যাপার না, পুতুল। আই’ল হ্যান্ডেল ইট।’
__________
মার্তন্ডের তীক্ষ্ণ আলোকছটা চোখে মুখে আপতিত হতেই ঘুম ছুটে যায় পুতুলের। চোখ পিটপিট করে তাকায়। মস্তিষ্ক জাগ্রত হতেই টের পায় ভয়ানক লজ্জার কিছু। বড়ো বড়ো চোখের পল্লব ফেলে সারাজের দিকে তাকায়। সে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পুতুল এতক্ষণ তার সুঠাম বক্ষকেই বালিশ বানিয়ে শুয়েছিল। আশেপাশের এলোমেলো জিনিসপত্রগুলো দেখে তীব্র এক অস্বস্তি ঝেঁকে বসল অন্তঃস্থলে। কোনো রকমে নিচ থেকে অযত্নে পড়ে থাকা শাড়িখানা গায়ে জড়িয়ে উঠে দাঁড়াল সে। ব্যাগ হাতড়িয়ে যা পেল তা নিয়েই ছুট লাগাল ওয়াশরুমে।
গোসল শেষে ফিরে এসে জোরে জোরে দম নিল পুতুল। বিছানায় চেয়ে দেখল, ঐ অভদ্র অসভ্য লোকটা এখনও গভীর তন্দ্রায় নিমজ্জিত। তাকে এত আরামে ঘুমাতে দেখে চটে যায় পুতুল। আরো বেশি চটে যায় আয়নায় স্বীয় প্রতিবিম্ব দেখে। রাতে কি লোকটা নেশা টেশা করে এসেছিল নাকি? এমন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল কেন?
রাগে বিড়বিড় করতে করতে আয়নার সামনে দাঁড়াল পুতুল। নিজেকে দেখে রাগের চেয়ে লজ্জা পাচ্ছে বেশি। আবারও ফিরে চাইল সারাজের দিকে। বিদ্বিষ্ট সুরে বলল,
‘দেখে মনে হয়, এনার মতো ভদ্র ছেলে আর দুটি হয়না। অথচ ভেতরে ভেতরে একটা আস্ত রাক্ষস বৈ আর কিছু না।’
‘আমি কিন্তু সব শুনতে পাচ্ছি, পুতুল।’
আকস্মিক সারাজের কন্ঠস্বর শুনে আঁতকে উঠল পুতুল। সরু চোখে চেয়ে বলল,
‘এই, তুমি না ঘুমাচ্ছো?’
‘তো, ঘুমালে কি মানুষ কালা হয়ে যায়? আর তোর কত বড়ো সাহস তুই আমার রুমে দাঁড়িয়ে আবার আমাকেই রাক্ষস বলছিস? এর জন্য তোকে কঠিন একটা শাস্তি পেতে হবে, পুতুল।’
বলতে বলতেই উঠে বসল সারাজ। পুতুল ভেবেছিল এখনই বোধ হয় সে এসে ঝাপ্টে ধরবে তাকে। তাই আগে ভাগেই দৌড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু সারাজ তেমন কিছুই করল না। সে নির্লিপ্ত ভঙিতে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে। খানিকটা অবাক হয়ে পুতুল ভাবল, ‘শাস্তি না দিয়েই চলে গেল যে?’
____
সারাজের শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া কি এতই সহজ? পুতুলও পেল না। সারাজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই চেঁচিয়ে উঠল পুতুল। দুহাতে মাথা চাপড়ে বলল,
‘সারাজ ভাই, এটা কী করলে?’
ক্ষুব্ধ হলো সারাজ। তেতে উঠে বলল,
‘আমার ভাই বলছিস?’
দ্বিগুণ তেতে উঠল পুতুল। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
‘যতদিন পর্যন্ত না তোমার আগের মতো দাঁড়ি হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আমি তোমাকে ভাই’ই ডাকব। আর এটাই হলো তোমার ক্লিন শেভ করার শাস্তি।’
গটগট করে রুম ছাড়ল পুতুল। সারাজ বোকার মতো চেয়ে তার যাওয়া দেখে বলল,
‘এটা কেমন হলো? যাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমি ক্লিন শেভ করলাম, উল্টো সে’ই এখন আমাকে শাস্তি দিচ্ছে? আচ্ছা ধড়িবাজ মেয়ে তো!’
চলবে …..