#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩২।
মেহেদী প্রোগ্রামের জন্য পুতুল বাড়ির দুতালার বড়ো বেলকনিটা ঠিক করেছে। সেখানেই বর্তমানে সাজ-সজ্জা চালাচ্ছে ইভেন্টের লোকেরা। সবুজ, হলুদ রঙের রঙিন কাপড় আর রঙিন ফুলে সাজানো হচ্ছে জায়গাটা। সাথে পুরো জায়গা দীপ্তমান হচ্ছে ছোট ছোট ফেইরি লাইটের আলোতে।
পুতুল সেজেছে সবুজ রঙের জামদানীতে। এই শাড়িতে মোহনীয় লাগছে তাকে। নিচ থেকে হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। বাড়ি ভর্তি কাজের মানুষ। কাল থেকে মেহমানরাও আসা শুরু করবেন। মেহুলের একটু বসার জো নেই। সে সকাল থেকে ছুটে বেড়াচ্ছে। রাবীর অফিসে গিয়েছিল, কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে। যদিও এই মেহেদী উৎসবে বাড়ির বড়োদের তেমন কোনো কাজ নেই, তাও পুতুলের কথা মতো উপস্থিত থাকতে হচ্ছে সবাইকেই । লীনা আর সাদরাজও এসেছে নিচে। তবে সারাজ এখনও আসেনি। আসবে কি-না তাও পুতুলের জানা নেই। সে তো সেদিনই বলেছিল, এই সবুজ রঙের শাড়িতে সে পুতুলকে দেখতে চায় না। হয়তো সেইজন্যই আসেনি। মন খারাপ হলেও ঠিক পাত্তা দিল না পুতুল। এই সময়গুলো জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো আর আসবে না। তাই অযথা মন খারাপ করে সময়গুলো নষ্ট করার কোনো মানে হয়না।
একেবারে তৈরি হয়ে লীনাকে নিয়ে নিচে নামল পুতুল। বসার ঘরে গিয়ে দেখল তার বিয়ের কার্ড চলে এসেছে। পুতুল খুশি মনে রিতার পাশে গিয়ে বসল। একটা কার্ড হাতে নিয়ে বলল,
‘দেখেছো মামনি, আমাদের কার্ডটা কত সুন্দর হয়েছে। তোমার ছেলের থেকে আমার পছন্দ হাজার গুণ ভালো।’
‘দেখতো, আমাদের কার্ডটা পছন্দ হয় কি-না?’
পাশের বক্স থেকে আরেকটা কার্ড বের করে রিতা পুতুলের হাতে দিল। অবাক হলো পুতুল। বলল,
‘দুইটা তো একই। এটাও তো আমাদের, তাই না?’
রিতা হাসল। বলল,
‘না, এটা ছেলে পক্ষের কার্ড। সারাজ তোর পছন্দের কার্ড’ই নিয়ছে।’
বিস্মিত হয়ে বড়ো বড়ো চোখে চাইল পুতুল। হ্যাঁ, দুই বক্স আলাদা ভাবে রাখা। উপরে নাম লেখা, একটা ছেলেপক্ষ আর অন্যটা মেয়েপক্ষ। তার মানে সারাজ সেদিন তার অগোচরে তার পছন্দের কার্ড’ই নিয়েছিল? আত্মতৃপ্ত হয় পুতুলের। এই ছোট্ট ছোট্ট প্রয়াসগুলো দিয়েই যেন সারাজ তার ভালোবাসা ব্যক্ত করছে। আর এই ভাবনা আসতেই ততক্ষণাৎ পুতুলের অন্তঃস্থল শীতল হয়।
______
মেহেদী প্রোগ্রাম শুরু। ছোট ছোট গদি দিয়ে সবার বসার জায়গা করা হয়েছে। হরেক রকমের ফুল আর রঙিন কাগজ দিয়ে চারদিক সাজানো। কক্ষ জুড়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে রঙিন আলোকছটা। এতকিছুর মাঝেও একগাল অভিমান নিয়ে চুপচাপ বসে আছে পুতুল। মেহেদী প্রোগ্রাম নিয়ে এত আয়োজন অথচ এখনও মেহেদীই আনা হলো না। মেহুল এসে বলে গিয়েছে, কাকে নাকি পাঠিয়েছে আনতে। অথচ সেই লোকের কোনো খবরই নেই। এইদিকে বিকেল পেরিয়ে এখন দিবাবসান ঘটেছে। কিন্তু, মেহেদীর কোনো চিহ্ন’ই চোখে পড়ছে না তার। পুতুল তেতে উঠল। লীনাকে বলল,
‘আর দশ মিনিট অপেক্ষা করব, এর মাঝে যদি বাসায় মেহেদী না এসেছে তবে মেহেদী প্রোগ্রাম ক্যান্সেল।’
লীনা তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
‘কুল কুল, এত হাইপার হচ্ছিস কেন? চলে আসবে মেহেদী। আন্টি বলে গিয়েছেন তো। আরেকটু অপেক্ষা কর।’
কিছু প্রহর ক্ষান্ত হতেই নিচ থেকে একটা মেয়ে ছুটে এসে বলল,
‘মেহেদী চলে এসেছে।’
উচ্ছ্বল হয়ে উঠে পুতুলের মুখাবয়ব। যাক, অন্তত মেহেদী প্রোগ্রামটা তো আর ক্যান্সেল হচ্ছে না। পুতুল আগ্রহ সমেত দরজার পানে চেয়ে আছে। ফের আবার লীনার দিকে চেয়ে বলে,
‘এই, মেহেদী আনলে আগে এই ডালাতে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে ছবি তুলবি, কেমন?’
লীনা মাথা কাঁত করে সম্মতি জানাল।
দরজা পেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করল সেই কাঙ্খিত ব্যক্তি। হাতে দুই খানা মেহেদীর বক্স। তবে সেই ব্যক্তিকে দেখা মাত্রই পুতুলের মনে হলো, না না, এই মুহুর্তে এই ব্যক্তি তো অনাকাঙ্খিত। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল সে। ঈষৎ সবুজ পাঞ্জাবীতে বুঝি কাউকে এতটা অনবদ্য লাগে! পুতুল নির্নিমেষ চেয়ে থাকে। সারাজ যে ইতিমধ্যেই তার পাশে এসে বসেছে সেই খেয়াল তার নেই। ইশারা করতেই পুতুলকে রেখে একে একে সকলে বেরিয়ে যায়। অকস্মাত পুরো রুম স্তব্ধ দেখে ভ্রু কুঁচকায় পুতুল। সারাজের দিকে চেয়ে বলে,
‘সবাই কোথায় গিয়েছে?’
সারাজ কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
‘আমি কী জানি?’
ভ্রু যুগলের মাঝের ভাঁজ কিঞ্চিৎ দৃঢ় হলো। পুতুলের জিজ্ঞেস করল,
‘মেহেদীর কথা তুমি কী করে জানলে?’
‘মা ফোন করে বলেছেন।’
সারাজ তারপর প্যাকেট খুলে সবগুলো মেহেদী পুতুলের কোলের উপর রাখে। বলে,
‘দেখতো, এতে হবে কিনা; নাকি আরো লাগবে।’
‘না না, চলবে।’
পুতুল মেহেদীগুলো সুন্দর মতো ডালা জুড়ে সাজিয়ে রাখল। এর মাঝেই হঠাৎ প্রশ্ন করল,
‘আমাকে দেখে তোমার বমি পাচ্ছে না?’
ফিচেল হাসে সারাজ। বলে,
‘পাচ্ছে তো। কী বিচ্ছিরি এই শাড়িটা! তোকে তো আরো বিচ্ছিরি লাগছে। দেখলেই কেমন বমি বমি একটা ভাব আসছে মনে।’
পুতুল হেসে তার দিকে তাকায়। আমোদ গলায় বলে,
‘তাই না? তাহলে আমার সাথে ম্যাচিং করে তুমি কেন সবুজ পাঞ্জাবী পরে এলে? তোমাকে তো কলা গাছের মতো লাগছে। কলা গাছের গায়ের রংটাও এমন ঈষৎ সবুজ।’
সারাজ ভাব নিয়ে বলল,
‘আমি অবশ্যই পরতাম না। আম্মু জোর করেছে বলে পরেছি।’
পুতুল ঠোঁট কামড়ে হাসে। বলে,
‘তুমি না একদম মিথ্যে বলতে পারো না, সারাজ ভাই।’
সারাজ কপাল কুঁচকে বলল,
‘আমার কথা তোর মিথ্যে মনে হয়?’
‘অবশ্যই।’
বলে পুরনায় হাসল পুতুল। সারাজ তেতে উঠে বলল,
‘একদম হাসবি না। তোর হাসিও জঘন্য।’
পুতুল এবার সারাজের মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘আমার সবকিছু যদি এতই জঘন্য হয়, তবে বিয়ে করছো কেন? এই জঘন্য মেয়েটাকে সারাজীবন কী করে সহ্য করবে, বলোতো?’
এত নিকট হতে পুতুলের স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখে বক্ষঃস্থল খানিক কম্পিত হলো সারাজের। এই মেয়েটার হরিণাক্ষীর ন্যায় অক্ষিযুগলের ঐ মসীবর্ণ কাজল তাকে সবসময়ই ঘায়েল করে। আজও করেছে। মারাত্মক ভাবে করেছে। পুতুল নিচের ঠোঁট’টা এখনও দাঁত দিয়ে চেপে ধরে আছে। তা দেখে ভ্রু কুঁচকায় সারাজ। ক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠে,
‘আমার সম্পদে এভাবে দাঁত বসানোর অধিকার তোকে কে দিয়েছে, পুতুল? সেই অপরাধে এখন থাপ্পড় দিয়ে এই দাঁতগুলো ফেলে দিলে ভালো লাগবে?’
পুতুল থতমত খেয়ে যায়। কী বলছে লোকটা? ঠোঁট ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। পরক্ষণেই লজ্জায় মিইয়ে যায় যেন। সারাজ সেসবে আর পাত্তা দেয় না। ডালা থেকে একটা মেহেদী হাতে তুলে পুতুলকে বলে,
‘হাত দে।’
ফের অবাক হয় পুতুল। সংশয় নিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। পুতুলকে আরো চমকে দিয়ে সারাজ সেই হাতের পিঠেই মেহেদী স্পর্শ করায়। পুতুল যেন এত বিস্ময় কাটাতেই পারছে না। সারাজ মাথা নুইয়ে খুব মনোযোগের সহিত পুতুলের হাতে মেহেদী দিয়ে কিছু একটা করছে। পুতুলের সেদিকে খেয়াল নেই। সে কেবল নিমিষ চেয়ে আছে সারাজের দিকে। বিয়ের কথা উঠার পর থেকে এই লোকটা মারাত্মক রকম বদলে গিয়েছে। আগের সেই রাগী, গম্ভীর, রগচটা সারাজ ভাই এখন যেন পাল্টে এক দুর্ধর্ষ প্রেমিক হয়ে উঠেছে। হঠাৎ উনার মাঝে এই আকস্মিক বদল’টা কী করে ঘটল?
মেহেদীটা রেখে দিয়ে সারাজ বলল,
‘নে, এই পিঠটা নষ্ট করে দিলাম। বাকি হাতে সুন্দর করে মেহেদী পরে ফেল।’
বলেই উঠে দাঁড়াল সে। যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েও আবার একবার ফিরে তাকাল। তারপর কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
‘এই ক্যাটেক্যাটে সবুজ রংটাও আজ আমার কাছে মারাত্মক সুন্দর লাগছে, পুতুল। ভাবছি, বিয়ের পর তোকে আমি এই রঙের আরো আটটা শাড়ি কিনে দিব।’
পুতুল বিস্ফোরিত চোখে তাকাতেই সারাজ প্রসন্ন হেসে প্রস্থান ঘটায়। সারাজের একের পর এক অকস্মাত কর্মকান্ডে পুতুলের এখন মাথা ঘুরাচ্ছে। চোখ মেলে হাতের দিকে চেয়ে দেখে সেখানে লেখা,
“সারাজের ছোট্ট পুতুল।”
চক্ষু নিমীলিত করে পুতুল। আচ্ছা, আজ এত সুখ লাগছে কেন? আজ কী চারদিকে সুখের বাতাস বইছে?
চলবে….
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৩।
একটি রৌদ্রদগ্ধ নিরুপম সকাল। চারদিক ঝলমল করছে সেই দিবাকরের আলোতে। একছটা আলোক রশ্মি মুখের উপর আপতিত হতেই ঘুম ছুটে যায় পুতুলের। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। মন্থর গতিতে উঠে বসে। তারপর আনমনে মেহেদী রাঙা হাতগুলো ধরে চোখের সম্মুখে। মুচকি হাসি ফোটে অধর কোণে। হাতের পিঠে সারাজের লেখা, “সারাজের ছোট্ট পুতুল” বাক্যখানা জ্বলজ্বল করছে। পুরো হাতে রংচটা মেহেদী। বাহ, চমৎকার রং হয়েছে। হাত দুখানা বক্ষঃস্থলে চেপে ধরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পুতুল। অবশেষে এই হাত সারাজের মেহেদীর রঙে মজেছে। অবশেষে, দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সারাজ ভাই তার হতে যাচ্ছে। নিজেকে যেন আজ পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে তার।
ফ্রেশ হয়ে এসে দরজার বাইরে উঁকি দিল পুতুল। নিচ থেকে হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। মেহুলের গলাও স্পষ্ট। কাকে যেন খুব জোরে বকছে সে। পুতুল পা টিপে টিপে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়ায়। একবার নিচে চোখ বুলায়। মেহুলকে দেখতে পায়, তার সম্মুখেই নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাড়ির এক ভৃত্য। নির্ঘাত কিছু একটা করেছে ঐ ভদ্রমহিলা। নয়তো মা এত রাগতেন না। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল পুতুল। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে, মা?’
মেহুল ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
‘আর বলিস না, খালাকে বললাম আমি উপরে যাচ্ছি তুমি পায়েসটা একটু দেখো। ওমা, উনি নাচতে নাচতে বাইরে চলে গেলেন। এইদিকে আমার এক পাতিল পায়েস পু ড়ে ছাই। এতগুলো দুধ বাদাম দিয়ে পায়েসটা বানিয়ে ছিলাম। সবটা পু ড়ে ছাই। বলতো, কেমন লাগে?’
ভৃত্য ভয়ে ভয়ে মাথা তুলে বলল,
‘আমাকে ক্ষমা করে দেন, খালা।’
পুতুল বলল,
‘থাক না, মা। উনি হয়তো বুঝেননি। থাক আর রাগ করো না। খালা, যান আপনি। চিন্তা করবেন না, বিয়ের সবকিছু মা একা হাতে সামলাচ্ছেন তো, তাই মাথাটা একটু গরম। আপনি মন খারাপ করবেন না। যান আপনি, অন্য কাজে যান।’
খালা ভীত চোখে তাকিয়ে সেই জায়গা থেকে বিদায় হলো। মেহুল গরম চোখে পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘আমার মাথা গরম হয়ে আছে?’
পুতুল হেসে বলে,
‘হ্যাঁ মা, তোমার মাথা বর্তমানে মারাত্মক গরম হয়ে আছে। খুব চাপ পড়ে গিয়েছে তাই না? আমার নানা-নানু, দাদা-দাদু কেউ’ই নেই। আজ নানু বা দাদু থাকলেও তোমার একটু হলেও চাপ কমতো।’
মেহুল মলিন হেসে পুতুলের মাথায় হাত রেখে বলল,
‘থাক, এসব নিয়ে আর ভাবিস না। মেয়ের বিয়েতে মা একটু ব্যস্ত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তুই এসব না ভেবে নাস্তা করতে বস। তারপর আবার অনেক কাজ বাকি। এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে ডাইনিং-এ বস, আমি নাস্তা আনছি।’
_______
পুতুল নাস্তা খেতে খেতে বলল,
‘মা, সবাইকে কার্ড পাঠানো শেষ?’
‘হ্যাঁ, কালকেই সব হয়ে গিয়েছে। আমার আর তোর বাবার পরিবারের তো তেমন কেউ নেই। যারা আছে সব গ্রামে, সবাই নাকি কালকে আসবেন। আর শহরে যারা আছেন সব সাদরাজ ভাই আর তোর বাবার পরিচিত লোকেরা। উনারাও সবাই কালকেই আসবেন।’
পুতুল হঠাৎ মন খারাপ করে বলল,
‘তো, আজকে আমার হলুদে কেউ আসবে না?’
‘কে বলেছে আসবে না? এই যে আমরা এসেছি।’
গলার স্বর পেয়ে দরজার দিকে চেয়ে দেখে লীনা সহ তার ক্লাসের আরো অনেকেই। তাদের দেখেই খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল পুতুল। মেহুল হেসে বলল,
‘এবার খুশি তো?’
পুতুল মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বোঝাল। কোনোরকমে খেয়ে উঠে গেল বন্ধুদের কাছে। এই ছেলে মেয়েগুলোর সাথে ক্লাসে সে সবথেকে বেশি মিশে। ওরা যে আজ আসবে পুতুল সেটা চিন্তাও করেনি। ভেবেছিল হয়তো কেবল বিয়েতেই আসবে। যদিও সে লীনাকে বারবার বলেছিল, কার্ডের সাথে ওদের সবাইকে বিশেষ ভাবে হলুদের দাওয়াতটাও দেওয়ার জন্য। অন্তত, ওরা সবাই থাকলে তো হলুদটা আর একঘেয়ে হবে না।
মেয়েরা সব পুতুলকে নিয়ে ছাদে গেল। পুতুলের গায়ে জড়ানো কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি। মুখে কোনো প্রসাধনীর ছিটে ফোঁটাও নেই। তাও এই রোদ ঝলমলে আলোতে স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। ছাদে পুতুলের গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হলুদ মাখিয়ে গোসল করানো হবে তাকে। মেহুল হলুদের ডালা নিয়ে উপরে আসতেই সব যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল হলুদ নিতে। মেহুল ডালা পেছন দিকে নিয়ে বলল,
‘দাঁড়াও দাঁড়াও, আগে আমরা একটু হলুদ ছোঁয়ায়। তারপর তোমরা যা খুশি করো।’
মেহুলের পেছন পেছন রাবীরও ছাদে এসে হাজির হয়। দুজনে গিয়ে খুব যত্ন করে মেহুলের গাল, কপাল আর হাতে হলুদ মাখাল। মেয়েকে হলুদ মাখিয়ে উঠে দাঁড়াল রাবীর। বাটি থেকে আরেকটু হলুদ নিয়ে এক সাইডে সরে পড়ল। মেহুল উঠে আসতেই মেহুলের সব বন্ধুরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল যেন। একজন অন্যজনকে হলুদ দিয়ে একেবারে হুলোস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে। পুতুলকে তো ইতিমধ্যেই হদুল দিয়ে ভূত বানানো শেষ। মেহুল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য তৃপ্তি ভরে দেখছে আর হাসছে। আচমকা সেই মুহূর্তে আঁচলে টান পেতেই ফিরে তাকায় সে। রাবীরের হাতের মুঠোয় তার শাড়ির আঁচল দেখে চোখ পাকায়। ইশারায় বলে, বাচ্চারা দেখবে। রাবীর সেসব তোয়াক্কা না করে মৃদু আওয়াজে বলে,
‘ওপাশে চলুন।’
মেহুল ভ্রু কুঁচকে একই সুরে বলে উঠে,
‘মাথা খারাপ হয়েছে আপনার? এতগুলো বাচ্চার সামনে কী শুরু করে দিয়েছেন?’
‘ওদের সামনে কিছু শুরু করতে চাইছি না বলেই তো, ওপাশে যেতে বলছি। চলুন।’
বলে রাবীর আগে পা বাড়াল। নিঃস্পৃহ ভঙিতে মেহুলকেও যেতে হলো সেদিকে।
______
‘কী হয়েছে আপনার?’
রাবীর মুচকি হেসে মেহুলের কাছে এসে দাঁড়ায়। মেহুল তখন সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশটা একটু পরখ করে দেখে নেয় কেউ আছে কি-না। অতঃপর রাবীরের দিকে চেয়ে বলে,
‘এই বয়সে এসেও শুধরালেন না আপনি? এতগুলোর বাচ্চার সামনে কী শুরু করেছেন, বলুনতো?’
জবাবে রাবীর কিছুই বলল না। একরাশ মৌনতা নিয়ে দুহাতের হলুদ সমস্তটা ঘষে লাগিয়ে দিল মেহুলের গালে। মেহুল হতভম্ব। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে রাবীরের দিকে। রাবীরের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাস্যরেখা। কপাল কুঁচকে ফেলে মেহুল। কিছুটা এগিয়ে এসে পা দুটো অল্প উঁচু করে রাবীরের গালে নিজের হলুদ ভর্তি গালটা ঘষে দেয়। রাবীর হেসে ফেলে। রগড় সুরে বলে উঠে,
‘আপনিও তো আগের মতোই দুষ্টু’ই রয়ে গেছেন, মেহুল।’
মেহুল কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
‘তা অবশ্য ঠিক। বয়স বাড়লেও আমাদের ভালোবাসা তো আর কমে যায়নি। মনে হয়, এই তো সেদিন আপনার আমার বিয়ে, আমার অভিমান আর আপনার একচ্ছত্র ভালোবাসা। তারপর আমার অপূর্ণতা পূর্ণ করে দেওয়ার জন্য ছোট্ট পুতুলের আগমন, সবকিছুই কত দ্রুত হয়ে গিয়েছে তাই না? এখনও চোখ নিমীলিত করলে সেসব দৃশ্য অক্ষিপটে ভেসে ওঠে। অথচ আমাদের সেই ছোট্ট পুতুল আজ কত বড়ো হয়ে গিয়েছে। তার আজ বিয়ে। আমাদের ছেড়ে অন্য ঘরে চলে যাবে। আমরা ওকে ছাড়া কীভাবে থাকব, বলুনতো?’
চোখ জোড়া ভিজে উঠে সঙ্গে সঙ্গে। রাবীর আলতো করে জড়িয়ে ধরে মেহুল। মাথায় অধর ছুঁইয়ে নরম গলায় বলে,
‘দূরে কোথাও যাচ্ছে না তো। এক মা ছেড়ে আরেক মায়ের কাছে যাচ্ছে। আর আমি জানি, সেখানে পুতুল ভালো থাকবে। আমার ছেলের উপর আমার ভরসা আছে, ও আমাদের পুতুলকে ভালো রাখবে মেহুল। চিন্তা করবেন না।’
মেহুল চোখ বোজে নিশ্বাস ফেলল। পুতুলকে ছাড়া আগামী দিনগুলো যে বড্ড পো ড়াবে তাকে।
_______
সন্ধ্যা পড়তেই মন্ত্রী বাড়ি ঝলমলিয়ে উঠে হরেক রকম রঙিন আলোতে। পুরো গেইট থেকে বাগান অবধি চারদিকে নিদারুণ আলোকসজ্জা আর ফুলের সমারোহ। ইভেন্টের লোকেরা চমৎকার সাজিয়েছে, এই নিয়ে কারোর সন্দেহ নেই। এর মধ্যেই আস্তে ধীরে মানুষের আগমন শুরু হলো। মন্ত্রীর মেয়ের বিয়ে বলে কথা, বাড়ির আশেপাশের কোনো প্রতিবেশী দাওয়াত পাওয়া থেকে বাদ যায়নি।
পুতুলের হলুদের স্টেজ ছাদে করা হয়েছে। হলুদ রঙের ঝমকালো লেহেঙ্গায় অপ্সরী লাগছে তাকে। কানে গলায় স্থান পেয়েছে শুভ্র ফুল। ওষ্ঠ রাঙিয়েছে লাল রঞ্জকে। বরাবরের মতোই আজও পুতুলকে লীনাই সাজিয়েছে। মেয়েকে এত বলেও কেউ পার্লারে পাঠাতে পারেনি। তার একমাত্র বিউটিশিয়ান লীনা। লীনা ব্যতিত আর কারোর কাছেই সাজবে না সে।
লীনা সহ বাকি সব বন্ধু বান্ধবরা হলুদ শাড়ি আর পাঞ্জাবীতে সেজেছে। সবাইকেই নিঁখুত সুন্দর লাগছে। পুতুলের সাজ শেষ হতেই মেহুল তার রুমে এল। তাদের সবাইকে তাড়া দিয়ে বলল,
‘এই, তোদের হয়েছে? জলদি পুতুলকে নিয়ে ছাদে আয়।’
পুতুল উঠে দাঁড়াল। লীনাকে বলল,
‘চল তাহলে।’
______
হলুদের মাঝপথেই শোনা গেল, নিচে নাকি বর এসেছে। এই নিয়ে হৈচৈ বেঁধেছে চারদিকে। সেই কথা পুতুলের কর্ণগোচর হতেই সে লজ্জা আর অস্বস্তিতে মজে যায়। ইশ, আজ তো সারাজের আসার কথা ছিল না। তবে কেন এল? তাকে হলুদ দিতে? নিদারুণ ব্রীড়ায় রক্তিম হয়ে উঠে পুতুলের নাক আর নরম গালযুগল।
পুতুলকে রেখেই নিচে ছুটল সবাই। একাই বসে আছে পুতুল। আশেপাশে যারা আছে তারা সবাই প্রতিবেশী। তাদের সে খুব একটা চেনে না। তাই উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের একপাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। একটু আঁড়ালে দাঁড়িয়ে নিচে তাকায়। ঐ তো সারাজের গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। আরো একবার সে লজ্জায় লাল হয়। ফিরে আসতে নিয়েও হঠাৎ থামল কী ভেবে। তার ঠিক অল্প কিছু দূরত্বেই দুজন মহিলা দাঁড়ান। দুজনেই পুতুলের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছেন। কিছু একটা নিয়ে কথা বলছেন তারা। সেই কথার সুর’ই অকস্মাৎ পুতুলের কানে আটকেছে। সেখানের একজন মহিলা অন্যজনকে বলছিলেন,
‘শুনেছি, এই মেয়ে নাকি মন্ত্রী সাহেবের আসল মেয়ে না। হসপিটাল থেকে পেয়েছিল নাকি। অথচ দেখ, আজ সেই মেয়েরই কী ধুমধাম করে বিয়ে দিচ্ছেন। না জানি কোন মায়ের সন্তান, কপাল করে জন্মেছে বটে। নয়তো এমন পালিত মেয়ে কি আর এত ভালোবাসা পায়?’
মুহুর্তেই মাথা ঘুরে উঠল পুতুলের। হঠাৎ চোখে অন্ধকার দেখছে যেন। হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। অকস্মাৎ এসব হচ্ছে কেন তার সাথে? বক্ষঃস্থল এভাবে কাঁপছে কেন? মনে হচ্ছে নিশ্বাস ফেলতে পারছে না। এত কষ্ট কেন হচ্ছে? একটু আগেও তো সব ঠিক ছিল। এখন এখন…. এসব কিছু মিথ্যে। সে তার মা বাবার’ই সন্তান। মেহুলের সন্তান। উনারা মিথ্যে বলছেন মিথ্যে। দিক বেদিক না দেখে ছুটে নিচে নামতে লাগল পুতুল। মনে মনে এক কথাই আওড়াতে লাগল, “আমিই আমার মা বাবার আসল সন্তান। আমাকে হসপিটাল থেকে পেয়ে আনেনি। আমিই উনাদের আসল সন্তান, আমিই।”
চলবে….
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৪।
ভারি লেহেঙ্গা নিয়ে ছুটা মুশকিল। তাও দিক বেদিক সব ভুলে পুতুল ছুটে নিচে নামল। সিঁড়ি ভেঙে বসার ঘরের সামনে যেতেই প্রথমে প্রস্ফুটিত হলো সারাজের চমৎকার হাস্যজ্জ্বল মুখটা। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পুতুলের সকল বন্ধু বান্ধব। পুতুলকে দেখা মাত্রই সারাজের হাসি আরো চওড়া হয়। সে মন্থর গতিতে এগিয়ে এসে পুতুলের সম্মুখ পানে দাঁড়ায়। তবে নিকটে আসতেই অকস্মাৎ সারাজের হাসিটা মিইয়ে যায়। পুতুলের চোখ মুখ বিধ্বস্ত লাগছে। সারাজকে দেখে খুশি হওয়ার বদলে, সে যেন আরো বিষন্নতায় মূর্ছে গিয়েছে।
উদ্বিগ্ন হয়ে সারাজ বলে উঠল,
‘কী হয়েছে, পুতুল? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
সারাজের কথা হয়তো ঠিক পুতুলের কর্ণগোচর হয়নি। সে আশেপাশে তাকিয়ে বিচলিত ভঙিতে বলে উঠল,
‘মা কোথায়?’
গলার স্বরটাও কাঁপছে তার। সাথে কাঁপছে তার হস্ত যুগল। সারাজ চিন্তার মাত্রা বাড়ল এবার। ফের জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে বলবি তো? এভাবে কাঁপছিস কেন তুই?’
পুতুল সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো চেঁচিয়ে বলল,
‘মা কোথায়?’
তার চিৎকারে স্তব্ধ চারপাশ। সবাই ভড়কে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে মেহুল। মেহুলকে দেখা মাত্রই পুতুলের কম্পন আরো বেড়ে যায়। মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে নিউরনে একটাই প্রশ্ন ছুড়ে, “এটা তার আসল মা না?”
মেহুল এগিয়ে যায় পুতুলের কাছে। পুতুলের চোখ মুখ দেখে সেও চিন্তিত হয়ে পড়ে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, মা?’
পুতুলের ওষ্ঠযুগলে কম্পন ধরে। তার শ্বাস প্রশ্বাসের গতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। শ্বাস ফেলতে পারলেও নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাও একরাশ ক্লেশ উহ্য করে সে কম্পিত সুরে বলে উঠল,
‘আমি কি তোমার মেয়ে না, মা? আমি তোমার গর্ভের সন্তান না? আমাকে কি তোমরা হসপিটাল থেকে এনেছ? মা, ঐ আন্টিগুলো এসব কেন বলছিলেন? উনারা মিথ্যে বলছেন, তাই না? বলো না, মা; তাই তো?’
উক্তিগুলো কান পেরিয়ে মস্তিষ্ক পৌঁছাতেই শরীরের সমস্ত লোমকূপে ভয়ংকর শিহরণ দিয়ে ওঠে মেহুলের। এই এত বছর যাবত এত নিঁখুত ভাবে যে সত্যিটাকে তারা লুকিয়ে এসেছে, সেটা আজকেই জানতে হলো পুতুলকে? ভাগ্য এত নির্মম কেন?
মায়ের নিরবতা পুতুলের যন্ত্রণাকে আরো ত্বরান্বিত করছে যেন। তার কান্না পাচ্ছে, ভয়ংকর কান্না। সারাজ বাকরুদ্ধ। নিমিষ চেয়ে আছে পুতুলের মুখের দিকে। পুতুল এবার ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘মা, কিছু বলো। চুপ করে আছো কেন? বলো, আমি কি তোমাদের নিজের মেয়ে না? তোমাদের সাথে কি আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই? আমাকে তোমরা পেয়ে এনেছ? আমি তোমাদের পালিত মেয়ে?’
পুতুলের এত এত প্রশ্নে মাথা ঘুরে উঠে মেহুলের। সে মাথা ধরে ঢলে পড়তে নিলেই সারাজ সহস্তে আগলে ধরে। মেহুল টলমল চোখে সারাজের দিকে তাকায়। সারাজ জোরে দম নিয়ে বলে,
‘মিথ্যে বলে সাময়িক সুখের চেয়ে সত্যি বলে আজীবন কষ্ট পাওয়াও শ্রেয়। তুমি আজ পুতুলকে সবটা সত্যি বলে দাও, মা। আর লুকিয়ে রেখো না।’
পুতুলের ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি সারাজের উপর নিবদ্ধ হলো। সারাজ মেহুলকে ধরে নিয়ে বসাল সোফার উপর। তারপর পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘এদিকে আয়।’
পুতুল ধীর পায়ে এগিয়ে মেহুলের ঠিক সামনে প্রতীয়মান হলো। চোখ মুখ কিয়ৎক্ষণের মাঝেই পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করেছে তার। মেহুল চাইল মেয়ের দিকে। অন্তঃস্থলে তীক্ষ্ণ এক ব্যথার আভাস পাচ্ছে সে। নিজেকে কিছুটা ধাতস্ত করে ভগ্ন সুরে বলল,
‘রক্তের সম্পর্ক’ই কি সব, পুতুল? আত্মার সম্পর্কের কি কোনো দাম নেই? তোকে আমি দশ মাস গর্ভে ঠাই দেইনি তো কী হয়েছে, বাইশ বছর যাবত এই বক্ষঃস্থলে ঠাই দিয়ে এসেছি। কেবল গর্ভে ধরলেই কি মা হয়ে যায়? আর নিজের জীবনের চেয়েও অধিক ভালোবাসা দিয়ে লালন পালন করলে কি মা হওয়া যায় না? আমি কি তোর মা নই, পুতুল? আমার তো একবারের জন্যও মনে হয়নি তোকে আমি পেয়ে এনেছি, বরং মনে হয়েছে তুই আমার নাড়ী ছেড়া ধনের চেয়েও অধিক কিছু। (একটু থেমে বলল) হ্যাঁ পুতুল, তোকে আমি হাসপাতাল থেকেই এনেছি। তখন তো কেবল একদিনের দুগ্ধশিশু ছিলি তুই। সারাজ’ই প্রথম দেখেছিল তোকে। সে কি গগনবিদারি চিৎকার তোর। প্রথমবারের মতো যখন তোর ছোট্ট শরীরটাকে দুই হাতের ভাঁজে নিয়েছিলাম, তখনই মনে হয়েছিল তুই আমার সন্তান। সারাজ তো প্রথম দেখাতেই বলেছিল, তুই তার ছোট্ট পুতুল। তারপর থেকে সেই ছোট্ট পুতুলকে আমি আমার বুকে আগলে বড়ো করেছি। কখনও একটাবারের জন্যও ভাবিনি, এই মেয়েটা আমার না। তোর সাথে হয়তো আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু, আত্মার যে সম্পর্ক রয়েছে সেই সম্পর্ক তুই কেমন করে অস্বীকার করবি, পুতুল?’
পুতুল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মেহুল উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। আদুরে গলায় বলে,
‘কাঁদছিস কেন, মা? তুই তো আমারই মেয়ে, আমার আর রাবীরের একমাত্র মেয়ে তুই। আমাদের ছোট্ট পুতুল। এছাড়া তোর আর কোনো পরিচয় নেই, কোনো না।’
পুতুল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল মা’কে। কান্নারত অবস্থায় বলল,
‘কেউ যদি না বলতো তবে তো আমি কখনোই বুঝতে পারতাম না, যে আমাকে তোমরা পেয়ে এনেছ। নিজের সন্তানকেও কেউ হয়তো এত ভালোবাসা দেয় না, যতটা দিয়েছ তোমরা আমাকে। তবে এত বছর পর এই বিদঘুটে সত্যিটা শুনে আমার বড্ড কষ্ট লাগছে, মা। তাও, আমি তোমাদেরই সন্তান, আর এই একটা কথা বিশ্বাস করেই আমি সারাজীবন বাঁচতে চাই। মা, আমি তোমাদের ভালোবাসি, প্রচন্ড ভালোবাসি।’
মেহুল পুতুলের কপালে গালে আদর দিয়ে বলে,
‘আমরাও আমাদের ছোট্ট পুতুলকে অনেক ভালোবাসি।’
‘এবার আর কোনো অভিযোগ নেই তো তোর?’
পুতুল সারাজের দিকে তাকায়। মাথা নাড়িয়ে “না” বোঝায়। সারাজ প্রসন্ন হাসে। এগিয়ে এসে পুতুলের চোখের পানি যত্ন সহিত মুছে দিল। তারপর খানিক উঁচু গলায় সবার উদ্দেশ্যে বলল,
‘আপনারা সবাই শুনুন, পুতুল এই বাড়ির মেয়ে। বাবা আরিয়ান খান রাবীর আর মা মেহুল খানের একমাত্র সন্তান পুতুল খান। ও এই বাড়ির মেয়ে, আর এটাই তার একমাত্র পরিচয়। এই নিয়ে যেন আর কোনোদিন কোনো কথা না ওঠে।’
অতঃপর পুতুলের দিকে চাইল সে। মৃদু হেসে বলল,
‘তবে কাল থেকে ওর আরো একটা পরিচয় হবে। আর সেটা হলো, সারাজ আহমেদের স্ত্রী পুতুল আহমেদ।’
পুতুল মাথা নুইয়ে রাঙা গালে লজ্জিত হাসে। মেহুল পুনরায় মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলে,
‘অনেক কান্নাকাটি হয়েছে, এবার যা উপরে গিয়ে হলুদ শুরু কর। সারাজ, যা তো বাবা পুতুলকে নিয়ে ছাদে যা।’
সারাজ এগিয়ে এসে পুতুলের দিকে এক হাত মেলে ধরল। মুচকি হেসে সেই হাতের উপর স্বীয় হস্ত অর্পণ করল পুতুল। অন্য হাতে লেহেঙ্গাটা একটু উঁচু করে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। পেছন থেকে তারা বন্ধু বান্ধবরাও পুনরায় মেতে উঠল হৈ চৈ এ। প্রতিবেশীদের সবার রা বন্ধ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, এমন স্বার্থপর ভূমিতলে আজকাল এমন স্বার্থহীন ভালোবাসা পাওয়া দুষ্কর।
_______
সারাজ বসেছে পুতুলের পাশেই। সবাই একে একে এসে হলুদ দিয়ে যাচ্ছে। মিউজিক সিস্টেমে গান চলছে ফুল জোশে। পুতুলের বন্ধু বান্ধবরা সব উরাধুরা নাচে ব্যস্ত। সারাজ এর মাঝেই হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘একটু দুতলার বেলকনিতে আসিস তো।’
পুতুল অবাকন্ঠিত সুরে বলল,
‘কেন?’
‘কাজ আছে।’
বলেই সারাজ ছাদ থেকে বেরিয়ে গেল। পুতুল আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়াল। সবাইকে ফেলে হুট করে চলে যাওয়াটা কেমন দেখায়? তাও, সে নেমে গেল। সারাজ ভাই যখন বলেছেন, কাজ আছে; তার মানে জরুরি কাজ। যেতেই হবে।
পুতুল বেলকনির কাছে এসে সারাজের পেছন বরাবর দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
‘কী কাজ?’
সারাজ ঘুরে চাইল। মোলায়েম সুরে বলল,
‘কাছে আয়, বলছি।’
পুতুল ইতস্তত পায়ে এগুল। সারাজের মুখ বরাবর দাঁড়ালেও উচ্চতা তার সারাজের গলা অবধি। তাই মাথা ঝুঁকাল সারাজ। এক হাতের সমস্ত হলুদটা বেশ যত্ন করে মাখাল পুতুলের দুই গালে। অকস্মাৎ এমন কাজে খানিকটা লজ্জা পেল পুতুল। তবে তার থেকেও অধিক ব্রীড়ায় ফেলল যখন সারাজের হস্ত তার গ্রীবা এবং গ্রীবার পশ্চাদ্ভাগ স্পর্শ করল। সেখানে লেপ্টে গেল হলুদের বাকি অংশ। সারাজের পুরু হাতের স্পর্শ তার গলা ঘাড় ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর তাতেই শরীরের প্রতিটি ঊর্ণা ততক্ষণাৎ দন্ডায়মান হয়ে জানান দিল, এই স্পর্শ ভয়ংকর পুতুল, এই স্পর্শ ভয়ংকর।
পুতুলের নিমীলিত চোখ জোড়ার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল সারাজ। রগড় সুরে বলে উঠল,
‘চোখ বোজে আছিস যে, আরো কিছু যাচ্ছিস নাকি?’
চট করে চোখ মেলে তাকায় পুতুল। সারাজের কথার মানে বুঝতেই লজ্জায় সংকুচিত হয়ে পড়ে। পরক্ষণেই আবার ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,
‘বাজে কথা বলবে না একদম। আর কোন সাহসে তুমি আমাকে এত হলুদ লাগালে? এমনিতে কি আমার গায়ে হলুদ কম ছিল, যে তোমাকেও লাগাতে হবে? ভূত বানিয়ে ফেলেছ একদম।’
বলেই হাত দিয়ে মুখ গলার হলুদ পরিষ্কার করতে শুরু করল। সারাজ ঠোঁট কামড়ে হাসল। বলল,
‘আমি হলুদ না ছোঁয়ালে এই হলুদ অসম্পূর্ণ’ই থেকে যেত। তুই তো বোকা তাই বুঝিস না।’
পুতুল মুখ কালো করে বলল,
‘কিন্তু, আমি তো তোমায় হলুদ লাগাতে পারলাম না।’
পুতুলের বিষন্ন সুর ক্ষান্ত হওয়ার পূর্বেই সারাজ ততক্ষণাৎ তার দুই গাল পুতুলের গালে ঘষে বলল,
‘নে, তোর এই ইচ্ছেটাও পূরণ দিলাম।’
পুতুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দুই গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারাজ ঠোঁট চেপে হেসে সরে আসতে নিলেই পুতুল অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
‘তোমার দাঁড়ি এত ধার কেন, সারাজ ভাই? আমার গালগুলো নির্ঘাত কেটে গিয়েছে।’
সারাজ ঘুরে তাকায়। ভ্রুকুটি করে এক পল পুতুলের দিকে চেয়ে বলে,
‘কাল তবে ক্লিন শেভ করে আসব।’
পুতুল ততক্ষণাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠে,
‘না না। ক্লিন শেভ করে আসলে আমি তোমাকে বিয়ে করব না, সারাজ ভাই। তোমাকে ক্লিন শেভে জঘন্য লাগে।’
অথচ সারাজ শুনলই না। সে ততক্ষণে সে জায়গা ছেড়ে উধাও। পুতুল মাথা চাপড়ে বলে উঠল,
‘হায় হায়, সত্যি সত্যিই কি সারাজ ভাই কাল ক্লিন শেভ করে চলে আসবেন? হে মাবুদ, প্লিজ উনার সেই ক্লিন শেভ করা চেহারা আমাকে দেখিও না, প্লিজ প্লিজ।’
চলবে…..