#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৯।
‘একটা কার্ড নিয়েও তোদের দুজনের ঝগড়া করতে হয়?’
‘মামনি, তুমি তোমার ছেলেকে বলো এখান থেকে যেতে। আমি যা বলব তাই হবে। এটাই আমার বিয়ের কার্ড, দ্যাট’স ফাইনাল।’
‘বিয়েটা তোর একার না, আমারও। সো, আমি যেটা পছন্দ করব সেটাই ফাইনাল হবে।’
ওদের এমন তর্ক বিতর্ক দেখে দোকানদারও বেজায় ক্ষিপ্ত। সেই এক ঘন্টা যাবত এরা এভাবে ঝগড়াই করছে। দুই মা দাঁড়িয়ে দেখছে আর ভাবছে, এই দুই টম এন্ড জেরি কী করে সংসার করবে? এদের তো কোনো কিছুতেই বনিবনা হয় না।
দোকানদার এবার কিছুটা উঁচু সুরে বলে উঠেন,
‘আমি একটা বুদ্ধি দেই আপনাদের, দুই পক্ষ দুই ডিজাইনের কার্ড নেন। যার যার পছন্দ মতো। মেয়ে পক্ষ মেয়ের পছন্দের কার্ড নিবেন। আর ছেলে পক্ষ ছেলের পছন্দের। তাহলেই তো সব মিটমাট হয়ে যাচ্ছে।’
সারাজ নাকের পাটা ফুলিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল,
‘হ্যাঁ, এটাই হবে। এই পুতুল, তুই তোর পছন্দ মতো কার্ড নে। আমার বাড়িতে আমার পছন্দের কার্ড যাবে। আর যদি এখন একটাও তিড়িং বিড়িং করেছিস তবে কার্ড ছাড়াই বিয়ে হবে। আর এমনিতেও এখন অনলাইনেই ই-মেইল পাঠিয়ে ইনভাইট করা যায়। তোর কথা রাখতেই এসব। এখন আর কথা না বাড়িয়ে, চুপচাপ কার্ড পছন্দ করে বের হ এখান থেকে।’
পুতুল মুখ কালো করে মেহুলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মিনমিনিয়ে বলল,
‘আমার পছন্দের নিলে কী হয়?’
‘আহা, এমন করছিস কেন? দুইজনে দুইটা পছন্দ কর দুই বাড়ির জন্য, তাহলেই তো হচ্ছে।’
পুতুল তার হাতের বেগুনী কার্ডটা দোকানদারকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা মেয়ের বাড়ির কার্ড। বাকি সব ইনফরমেশন মায়ের কাছ থেকে নিয়ে নিন।’
বলে সে দোকানের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। মনে মনে মারাত্মক বীতঃস্পৃহ সে। সারাজের কাছে তার পছন্দ অপছন্দের কোনো দাম নেই? একটা কার্ড’ই তো নিজের পছন্দের নিতে চেয়েছিল, এটা আর এমন কী ব্যাপার। অথচ, লোকটা তার এই ক্ষুদ্র ইচ্ছাতেও সম্মতি জানায়নি। ভবিষ্যতে হয়তো এভাবে বড়ো কোনো ইচ্ছাও গ্রাহ্য করবে না।
_________
‘আম্মু, তোমরা কি এখন বাসায় যাবে?’
রিতা একবার মোবাইলে সময় দেখে বলল,
‘কেবল তো সাত’টা বাজে। আর এখনও তো সব শপিং বাকিই রয়ে গিয়েছে। ভাবছি আজকে মেহেদীর শপিংটা সেরে ফেলব। আর তো বেশিদিন নেই। কাল বাদে পরশু’ই তো মেহেদী, তারপর হলুদ, তারপর দিন বিয়ে আর তার একদিন পর রিসিপশন। এই মেহুল, আমরা তো বাগদান বা এনগেজমেন্টের কোনো আয়োজন’ই করলাম না।’
মেহুল চমকে বলল,
‘হ্যাঁ, তাই তো। ঘরের ছেলে মেয়ের বিয়ে বলে কি এনগেজমেন্টের আয়োজন হবে না?’
‘কেন হবে না? অবশ্যই হবে। কালই হবে।’
সারাজ ঠোঁট জোড়ো করে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলল,
‘কতকিছু করতে হয়, বলোতো? আমার তো এখনই ক্লান্ত লাগছে।’
‘তাহলে আর বিয়ে করার কী দরকার।’
নির্লিপ্ত সুরে বলল পুতুল। সারাজ শুনেই বুঝল, ইচ্ছে করে ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলছে। তাই তাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
‘আম্মু, আব্বু বলেছেন মিটিং শেষে নয়টার পর ফিরবেন। তাই এর আগে যা যা শপিং শেষ করো। আমি আছি।’
‘এই সারাজ, একটু তোর বাবাকেও কল দিয়ে দেখতো উনি কোথায় আছেন।’
‘কথা হয়েছে, মা। বাবা এলাকায় বেরিয়েছেন। উনারও ফিরতে লেইট হবে।’
‘যাক, আমরা তাহলে আজ স্বাধীন।’
সারাজ কপাল গুঁটিয়ে বলল,
‘উঁহু, একদমই না। তাড়াতাড়ি শপিং করবে। বেশি ঘুরে আমার মাথা খাবে না কিন্তু।’
‘এই, তুমি বাড়ি যাও তো। তোমাকে আমাদের আসতে হবে না।’
পুতুলের কথা শুনে ফিচেল হাসে সারাজ। তারপর ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
‘কেন রে, আমি গেলে কি তোর শপিং এ ব্যাঘাত ঘটবে?’
পুতুল তার দিকে কিছুটা তেড়ে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘খবরদার যদি শপিং গিয়ে আমার পছন্দে বাম হাত ঢুকিয়েছো। সাবধান করে দিচ্ছি কিন্তু।’
সারাজ হেসে বলল,
‘কেবল বাম হাত কেন, এই পুরো আস্ত আমিটাই ঢুকে যাব।’
পুতুল চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘সারাজ ভাই।’
সারাজ হেসে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এই মেয়ের এসব ঠুনকো রাগকে পাত্তা দেওয়ার সময় তার নেই।
মেহুল এসে পুতুলের হাত ধরে বলল,
‘এখন তো একটু থাম। আর দুদিন বাদে তোদের বিয়ে, অথচ এখনও তোরা একজন অন্যজনকে এক চুলও ছাড় দিচ্ছিস না। এরকম করলে কী করে হবে বলতো?’
‘আমাকে কেন বলছো? তোমাদের ঐ আদরের ছেলেকে বলতে পারো না কিছু?’
রিতা হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘আচ্ছা ঠিক আছে, ওকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে গুরুতর একটা শাস্তির ব্যবস্থা করব।’
পুতুল ততক্ষণাৎ হেসে বলে,
‘তা তো অবশ্যই। আর সেই শাস্তিটা আমিই দিব।’
‘আচ্ছা, দিস। এবার চল।’
_______
‘মা, এই গাঢ় সবুজ রঙের জামদানীটা কী সুন্দর না?’
মেহুল শাড়িটা দেখে বলে,
‘হ্যাঁ, সুন্দর তো। তোর পছন্দ হয়েছে?’
‘ভীষণ।’
‘কিন্তু, আমার পছন্দ হয়নি। এমন ক্যাটক্যাটে একটা সবুজ রং চোখে লাগে একদম। ঐ হালকা আকাশী রঙের শাড়িটা দেখতে পারিস।’
পুতুল তখন ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
‘মেহেদী প্রোগ্রামে সবাই এমন সবুজ রঙেরই শাড়ি পরে। ঐসব আকাশী ফাকাশী পরে না।’
‘এই কথা কোন বইয়ে লেখা আছে শুনি? সবুজ রং না পড়লে কি মেহেদী হবে না? অবশ্যই হবে। আরর ঐ আকাশী কালারটা তোর সাথে মানাবে। একবার গায়ে লাগিয়ে দেখ।’
সারাজের সাথে তাল মিলিয়ে তখন মেহুলও বলে উঠল,
‘সারাজ যখন এত করে বলছেই, তখন একবার গায়ের সাথে লাগিয়ে দেখ না।’
অনিচ্ছা শর্তেও শাড়িটা হাতে নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল পুতুল। তারপর শাড়ির ভাঁজ খুলে মেলে ধরল গায়ে। নিজেকে আয়নায় ভালো ভাবে পরখ করে দেখল। না, খারাপ লাগছে না। তাও, তার মন বলছে ঐ সবুজ রংটা তাকে বেশি মানাত।
‘ভালোই লেগেছে, মা। চাইলে নিতে পারো।’
পুতুলের সম্মতি পেয়ে সারাজ খুশি হয়। দোকানদারকে বলে এটা প্যাক করে দিতে। তারপর সবার দিকে চেয়ে বলে,
‘তোমরা অন্য দোকানে যাও। আমি পেমেন্ট করে ব্যাগ নিয়ে আসছি।’
পুতুল, মেহুল আর রিতা বেরিয়ে যায় এবার এনগেজমেন্টের জন্য আংটি দেখার উদ্দেশ্যে।
পুতুল এবার আগে বাগেই মায়ের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘আংটি আমার পছন্দের কিনবে। খবরদার এবার যদি আর সারাজ ভাইকে সাপোর্ট করেছো।’
মেহুল জবাবে কেবল দুই দিকে মাথা নাড়ায়।
_____
একটার পর একটা আংটি দেখিয়েই যাচ্ছে, তবে কোনোটাই পুতুল বা সারাজের পছন্দ হচ্ছে না। এত বড়ো বড়ো আংটি পুতুল কখনোই পরবে না। সে তো চাচ্ছে, সিম্পলের মধ্যে কিছু। হঠাৎ একটা আংটিতে চোখ পড়ে পুতুলের। বলে উঠে,
‘ঐটা দেখান তো।’
তার সাথে আরেকজন ও একই কথা বলে। পুতুল চেয়ে দেখে সারাজ ও দোকানদারকে ঐ আংটিটাই দেখাতে বলছে। মনে মনে স্বস্তি পায় সে। যাক, অন্তত আংটি’টা তো নিজের পছন্দের নিতে পারবে।
.
মোটামুটি এনগেজমেন্ট আর মেহেদী প্রোগ্রামের জন্য সব কেনাকাটা শেষ তাদের। সারাজের মাথা ব্যথা উঠেছে। এই মহিলা গুষ্ঠির সাথে শপিং এ আসা, আর যেচে পড়ে পাগল হওয়া একই কথা। এই কয়েক ঘন্টাতেই মাথা খারাপ করে দিয়েছে তার। এই সামান্য কয়টা জিনিস কিনতে না হলেও পুরো শপিং মল সাতবার চক্কর লাগিয়েছে তারা। সেই চক্করে চক্করে এখনও মাথা চক্কর খাচ্ছে তার।
সবগুলো শপিং ব্যাগ গাড়ির পেছনে রেখে সারাজ বলে উঠল,
‘চলো, আগে একটু কোথাও গিয়ে চা খেয়ে আসি। আমার খুব মাথা ধরেছে।’
সবাই সম্মতি দিল। পুতুল তো রীতিমত নেচে নেচে বলল,
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। চলো।’
______
বাসায় ফিরতে সকলের দশটার উপরে বেজে যায়। পুতুল আর মেহুলকে নামিয়ে দিয়ে সারাজও মা’কে নিয়ে তার বাসায় ফিরে গিয়েছে। তবে, বাসায় ফিরেই চমকে যায় পুতুল আর মেহুল। বসার ঘর পুরো ভরে গিয়েছে জিনিসপত্রে। পুতুল তার হাতের ব্যাগ গুলো রাখতে রাখতে বলল,
‘এগুলো কে করল, মা?’
মেহুল কোমরে হাত দিয়ে বলল,
‘নির্ঘাত তোর বাবার কাছ। উনাকে বলেছিলাম, আমাকে না জানিয়ে কিছু কিনবেন না। অথচ দেখ, আমাকে না বলে পুরো শপিং মলটাই তুলে নিয়ে এসেছেন। এই লোকটাকে নিয়ে যে আমি কী করি। তুই এক কাজ কর, এখন যা কেনা হয়েছে এগুলো তোর রুমে নিয়ে রাখ। আর এখানের জিনিসগুলো আমি গুছিয়ে নিচ্ছি।’
মায়ের কথা মতো পুতুল ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে ক্লান্ত ভঙিতে নিজের রুমে ছুটল। আজ বেশি হেঁটে ফেলেছে হয়তো, পাগুলো কেমন যেন ঝিমঝিম করছে।
ব্যাগগুলো বিছানায় রাখতে নিলে অসাবধানতায় শাড়ির ব্যাগটা নিচে পড়ে যায়। সেটা তুলতে গিয়ে আরেকদফা চমকাল পুতুল। ভুল শাড়ি চলে এসেছে না-কি? এটা তো সেই সবুজ জামদানীটা। কিন্তু সে তো পরে আকাশীটাই দিতে বলেছিল। তবে এটা এখানে এল কী করে? তখনই একটা ছোট্ট কাগজে নজর পড়ল তার। শাড়ির প্যাকেটেই রাখা। খুলে দেখল সেখানে লেখা,
‘আমি ব্যতিত তোর পছন্দের সবকিছু মাত্রাধিক জঘন্য। তাও শাড়িটা কিনে দিলাম, যেন গাল ফুলিয়ে না থাকিস। খবরদার, এই শাড়ি পরে আমার সামনে আসবি না। বলা যায় না, বমি টমিও হয়ে যেতে পারে আমার।’
লেখা পড়ে পুতুল আনন্দ পাবে না-কি কষ্ট, সেটা নিয়েই সে এখন বিরাট কনফিউজড।
চলবে…
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩০।
সমস্ত বাড়িতে আজ আনন্দের রোল পড়েছে। সকাল থেকেই চলছে তার তোড়জোড়। মন্ত্রীর একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। রাবীর তাই কোনোকিছুতেই কোনো কমতি রাখতে চায় না। পুরো বাড়ির সাজানোর জন্য ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোক চলে এসেছে। পুতুলের কথা মতো তার বিয়ে এই বাড়িতেই হবে। তাই পুরো বাড়ি এমন ভাবে সাজানো হচ্ছে, যেন সেটা কোনো সেন্টারের চেয়ে কম কিছু না লাগে।
______
এনগেজমেন্টের জন্য পুতুল অযথা মেহমান ডাকতে বারণ করেছে। যারা আসবে তারা কেবল তার খুব কাছের মানুষ। আর বর্তমানে সবার ঊর্ধ্বে তার সবথেকে কাছের মানুষ হলো, একমাত্র বান্ধবী লীনা। লীনা সেই সকালেই তার বাড়িতে এসে হাজির। লীনাকে নিয়েই পুতুল সব তদারকি করছে। সবকিছু হচ্ছে তার পছন্দের। মেহুল ব্যস্ত রান্নাবান্নার কাজে। রাবীর সকাল থেকে বাড়িতে থেকে এখন তার অফিসে বেরিয়েছে।
পুতুল গোসল সেরে এসে বলল,
‘এই শাড়িটাতে আমাকে মানাবে?’
‘অবশ্যই।’
পুতুল আকাশী রঙের সিল্কের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বলল,
‘আসলেই মানাচ্ছে। বাবার পছন্দ আছে বলতে হবে।’
লীনা কপাল কুঁচকে বলল,
‘এই পুতুল, আমার লেহেঙ্গা কই?’
পুতুল চমকে বলে,
‘আরে, খেয়ালই তো ছিল না। নো টেনশন, আমরা আজকে আবার বের হব। আমারও বিয়ে আর হলুদের শপিং বাকি। সেগুলোর সাথে তোর লেহেঙ্গাটাও কিনে ফেলব। কী রঙের কিনতে চাস বল?’
লীনা এক পল ভেবে বলল,
‘তোর শাড়ি যে কালার নিবি আমার লেহেঙ্গাও তেমন কালারের’ই নিস।’
‘ওকে ডান।’
‘এবার জলদি এইদিকে আয়। তাড়াতাড়ি তৈরি হতে হবে। তোর শ্বশুরবাড়ির লোক চলে আসল বলে।’
____
আকাশী রঙের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে মাথায় একটা আকাশী রঙের ওড়না জড়াল। গলায় কানে শোভিত হলো ছোট্ট একটা নেকলেসের সেট। পাতলা ফিনফিনে ওষ্ঠযুগল রাঙানো হলো গোলাপী রঞ্জকে। হরিণাক্ষী জোড়া রাজিত হলো মসীবর্ণ কাজলে। বরাবরের ন্যায় ললাটে ঠায় পেল ছোট্ট এক কালো টিপ।
লীনা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলে,
‘কী মারাত্মক লাগছে তোকে, দোস্ত। ভাইয়া আজ নির্ঘাত মারা পড়বে।’
পুতুল ভেংচি কেটে বলল,
‘মোটেও তেমন কিছু হবে না। উনাকে মুগ্ধ করা এত সহজ না। সেদিন নববর্ষের দিনও তো কত সুন্দর সেজেছিলাম। সাহেল ছুটে এসে আমার প্রশংসাও করে গিয়েছিল। অথচ ঐ লোকটা আমার সাজকে পাত্তাই দিল না।’
‘আহারে, থাক মন খারাপ করিস না। আজকে ঠিক পাত্তা দিবে। দেখবি, লুকিয়ে এসে টুপ করে একটা চুমুও খেয়ে বসবে।’
চোখ পাকিয়ে তাকায় পুতুল। গরম গলায় বলে উঠে,
‘খুব অসভ্য হয়েছিস কিন্তু।’
‘তোর থেকে কম আছি। তুই তো আরও ডিটেইলসে সবকিছু বলিস।’
পুতুল মাথার ওড়নাটা ঠিক করতে করতে বলল,
‘মোটেও না। আমি খুব ইনোসেন্ট। এসব দুষ্টু দুষ্টু কথা তোর মুখেই মানায়।’
‘থাক, হয়েছে। আমাকে আর কিছু বোঝাতে আসিস না। আমার থেকে বেশি তোকে কেউ চেনে না, বুঝলি।’
পরবর্তী জবাবের জন্য পুতুল মুখ খোলার আগেই লীনা বলে উঠল,
‘এই গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ভাইয়ারা বোধ হয় চলে এসেছেন।’
শোনা মাত্রই পুতুল বারান্দায় ছুটে যায়। ঐ তো সারাজের গাড়িটা গেইট পেরিয়ে ভেতরে আসছে। নিশ্চয়ই ড্রাইভিং সিটে সারাজ বসা। পুতুল একটু উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু অত দূর থেকে কিছু দেখা মুশকিল। গাড়ি মেইন গেইট অবধি এসে থেমে যায়। এবার নিশ্চয়ই সারাজ নামবে। পুতুল খানিকটা আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে সাদরাজ আর রিতা নামে। তারা নামতেই গাড়ি সেখান থেকে সরে গ্যারাজের দিকে চলে যায়। মনক্ষুন্ন হলো পুতুলের। সারাজ তো নামলই না। মন খারাপ করে রুমে এসে বসল সে। একটু উপর থেকে ভালো মতো দেখতে পারত। নিচে গেলে কি আর ঠিকমতো চাওয়া যাবে? যাবে না। এত মানুষ, তার উপর ঐ লোকটার চোখে চোখ পড়লেই তো সে লজ্জায় মরে যাবে।
‘পুতুল, তুই এখানে বস। আমি একটু নিচে গিয়ে দেখে আসি।’
‘না না, এখন যাবি না। একেবারে আমার সাথে নামবি। বস এখানে।’
লীনা পুতুলের পাশে বসল। ভ্রু নাচিয়ে সন্দিহান গলায় বলে উঠল,
‘তুই কি কোনো ভাবে সারাজ ভাইয়াকে নিয়ে ইনসিকিউরড?’
পুতুল নাক মুখ কুঁচকে তাকায়। বলে,
‘না, একদমই না। আমি জানি তুই মাহাতের প্রেমে অলেরডি হাবুডুবু খাচ্ছিস। সো, এসব ইনসিকিউরিটির প্রশ্নই আসে না।’
লীনা ক্ষিপ্ত হয়ে পুতুলের হাতে চাপড় বসিয়ে বলে,
‘তোকে কে বলেছে আমি ঐ মাহাতের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি? সবসময়ই বেশি বেশি বুঝিস।’
‘আচ্ছা তাই! তবে কাল রাত একটার সময় তোমার ফোন বিজি ছিল কেন? অত রাতে কার সাথে কথা বলছিলে শুনি?’
ধরা পড়া চোরের মতো মিইয়ে যায় লীনা। তারপর দাঁত বের করে বোকার মতো হেসে বলে,
‘না মানে, ঐ আরকি একটু কথা বলছিলাম। এই জানিস, ঐ রং নাম্বারের ব্যক্তিটা তো আর কেউ না; এই মাহাত’ই।’
পুতুল হেসে বলে,
‘সেটা তো আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। তা ভালোই হয়েছে। আমার বিয়ের পরপরই তোরাও বিয়েটা করে ফেলিস। তারপর একসাথে দুই বান্ধবী প্রেগন্যান্ট হব, আর তারপর দুইজনের ছেলে মেয়ের বিয়ে দিব; আমার মা আর মামনির মতো। ওরাও কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।’
লীনা আগে জানত না এই কথা। পুতুল তো সারাজকে সবসময় তার কাজিন বলে এসেছে। আজ হঠাৎ এই কথা শুনে একটু বেশিই অবাক হলো সে। বলল,
‘সারাজ ভাইয়া তোর মা’র বান্ধবীর ছেলে? তোরা কাজিন না?’
‘না। আর সারাজ ভাইয়ের বাবা সাদরাজ চাচুও বাবার বেস্টফ্রেন্ড ছিলেন। মানে বুঝতে পারছিস দুই বেস্টফ্রেন্ড জোড়ার বিয়ে হয়েছে। ঐ মাহাত যদি না আসত, তবে আমিও সারাজ ভাইয়ের কোনো এক বেস্টফ্রেন্ডের সাথে তোর লাইন লাগিয়ে দিতাম।’
লীনা হেসে বলল,
‘বাহ, তোদের ব্যাপারটা দারুণ তো।’
তাদের কথার মাঝেই একজন গৃহপরিচালিকা সেখানে উপস্থিত হলেন। বললেন,
‘খালা, আপনাদের নিচে যাইতে বলছে।’
পুতুল বলল,
‘আচ্ছা আপনি যান, আমরা আসছি।’
লীনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘চল চল, এবার যেতে হবে। সারাজ ভাই হয়তো অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।’
পুতুল লীনাকে হালকা চিমটি কেটে বলল,
‘ফাজিল।’
_____
সিঁড়ির মাঝ বরাবর আসার পরপরই সবার দৃষ্টি নিক্ষেপিত হয় পুতুলের উপর। পুতুলের যদিও খুব একটা লজ্জা বা অস্বস্তি হচ্ছে না, তাও সে নতুন বউয়ের মতো মাথা নুইয়ে রেখেছে। হয়তো মাথাটা তুললেই দেখতে পেত, এক জোড়া অক্ষি কেমন বেহায়া ভাবে দেখছে তাকে।
সারাজের পাশেই লীনা পুতুলকে বসাল। সারাজ এতে মনে মনে বিরক্ত। পাশে না বসিয়ে সামনেও তো বসাতে পারত। এখন কি সে এত মানুষের মাঝে ঘাড় কাত করে পুতুলকে দেখবে? ধুর! সারাজও মাথা নুইয়ে বসল।
রিতা এগিয়ে এসে পুতুলের চিবুক নাড়িয়ে বলল,
‘মাশাল্লাহ, আমার ছোট্ট পুতুলকে কী সুন্দর লাগছে।’
পুতুল মৃদু হাসে। পাশ ফিরে একবার সারাজকে অবলোকন করার মারাত্মক ইচ্ছে জাগছে মনে। কিন্তু, এভাবে কি তাকানো যায়? সবাই যদি তাকে নির্লজ্জ ভাবে? সারাজকে না দেখুক সারাজের হাত যুগল সে আড় চোখে দেখতে পাচ্ছে। শুভ্র পাঞ্জাবী গায়ে জড়িয়েছে নিশ্চয়ই। গোটানো হাতা জোড়া দেখেই তা স্পষ্ট। এক হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে আরেক হাত রেখে ক্রমাগত সেগুলো নাড়িয়ে চলছেন। উনি কি চিন্তিত? চিন্তিত হলেই তো মানুষ এমন করে।
সারাজের পাশে রিতা আর পুতুলের পাশে বসল মেহুল। দুজনের হাতেই দুটো ছোট্ট লাল বক্স। সেই বক্সগুলোতেই জ্বলজ্বল করছে দুখানা চমৎকার আংটি। দুই মা দুইজনকে আংটি দুখানা তুলে দিল। এবার আংটি বদলের পালা। সারাজ প্রথমে হাত বাড়িয়ে দিল পুতুলের দিকে। পুতুল বুঝল, সারাজ তার হাত চাইছে। এতক্ষণে চোখ তুলে তাকাল সে। শ্বেত শুভ্র সারাজকে দেখে অন্তর শীতল হলো তার। হাতটা সযত্নে রাখল সারাজের হাতের উপর। অনামিকা আঙ্গুলটা ততক্ষণাৎ ঝলমলিয়ে উঠল ছোট্ট হীরক খচিত অঙ্গরীয়কে। লজ্জা মিশ্রিত হাসি উজ্জীবিত হলো পুতুলের অধর কোণে। সেই মুহুর্তেই তাকে আরো ব্রীড়ায় ফেলতে হাতের পিঠে চুম্বন করে বসে সারাজ। পুতুল আঁতকে উঠে। লজ্জায় সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে ফেলে। হায় হায়, এতগুলো গুরুজনের সামনে এই অসভ্য লোকটা কী করে বসল!
চলবে….
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩১।
বাগদানের পর্ব চুকতেই মিষ্টি খাওয়ার রোল পড়ল। এ ওকে তো সে তাকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। লীনাও এসে সারাজের মুখের সামনে মিষ্টি ধরল। সারাজ প্রসন্ন হেসে গ্রহণ করল সেই মিষ্টি। আরেকটা মিষ্টি তখন লীনা তুলল পুতুলের মুখের সামনে। পুতুল অল্প একটু খেল। বাকিটা খাইয়ে দিল লীনাকে।
মিষ্টি খাওয়া পর সবাই টেবিলে এসে বসেছে, দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। সবাই একসাথেই খাওয়ায় বসেছে। পুতুলকে এবারও বসানো হয়েছে সারাজের পার্শ্ব আসনে। তখনের পর থেকেই মারাত্মক রকমের লজ্জায় মুখিয়ে আছে পুতুল। অথচ, যে অভদ্র লোক কাজটা ঘটিয়েছে সে অদ্ভুতভাবে নির্লিপ্ত। এমন একটা ব্যবহার, যেন এটা কোনো ব্যাপারই না। অথচ পুতুল এই ব্যাপার নিয়েই এত ব্রীড়ায় সংকুচিত হয়ে মরছে।
_________
নিচে সবাই বিয়ে নিয়ে বিশদ আলোচনায় বসেছে। দাওয়াত, আপ্যায়ন, মেহমান, খাবার দাবার সবকিছু নিয়েই তাদের এই আলোচনা। লীনা কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়েছে। পুতুল তাকে এত করে বলেছিল, “থাক, তোকে নিয়ে শপিং-এ যাব”। কিন্তু, সেই মেয়ে জানাল তার বাসা থেকে ক্রমাগত কল আসছে; এখন না গেলেই নয়।
রুমে বর্তমানে একাই বসে আছে পুতুল। গায়ে জড়ানো এখনও আকাশী শাড়ি। তার মনোযোগী দৃষ্টি এখন ঐ অনামিকা আঙ্গুলের অঙ্গরীয়কের উপর। আংটি’টা কী অবলীলায় চকমকিয়ে যাচ্ছে। কী দারুণ, এর সৌন্দর্য। পুতুল দেখছে আর মুগ্ধ হচ্ছে।
এই সময় সারাজ এর আগমন ঘটল তার কক্ষে। হালকা গলা ঝেরে সারাজ বলল,
‘আসব?’
পুতুল ঘুরে তাকাল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘আমার রুমে আসার আগে তুমি অনুমতি নিচ্ছো, স্ট্রেঞ্জ!’
ভেতরে প্রবেশ করে সারাজ। সোজা গিয়ে বসে পুতুলের পাশে। একদম ঘা ঘেঁষে। ভ্রু কুঁচকাল পুতুল। জিজ্ঞেস করল,
‘কী হলো?’
সারাজ ঘাড় ঘুরিয়ে তার পানে চায়। রগড় সুরে বলে,
‘আপাতত কিছু হয়নি। তবে বিয়ের পর হবে।’
পুতুল সরু চোখে তাকায়। মৃদু আওয়াজে বলে,
‘আজকাল তুমি ভীষণ অভদ্র হয়ে যাচ্ছো, সারাজ ভাই।’
সারাজের কপালে ভাঁজ পড়ল। গম্ভীর গলায় শুধাল,
‘আমি তোর সাথে কোনোপ্রকার অভদ্রতা করেছি?’
‘অবশ্যই করেছো।’
বিস্ফোরিত চোখে তাকায় সারাজ। অবিশ্বাস্য সুরে বলে,
‘আমি তোর সাথে অভদ্রতা করেছি? সিরিয়াসলি, পুতুল?’
সারাজের বিচলিত চোখ মুখ দেখে ঠোঁট গুঁজে হাসে পুতুল। তারপর বলে,
‘আজকে সবার সামনে আমার হাতে চুমু খেলে কেন? এটা কি অভদ্রতার কাতারে পড়ে না?’
সারাজ নিশ্বাস ছাড়ে। তারপর বাঁকা হেসে বলে,
‘আচ্ছা, এই ব্যাপার? সবার সামনে চুমু খেয়েছি বলে সমস্যা? আগে বলবি-না, তোর লুকিয়ে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।’
পুতুলের চোয়াল ঝুলে। অবাক কন্ঠে বলে,
‘আমি আবার এই কথা কখন বললাম?’
‘এই যে, মাত্র বললি।’
‘আমি…’
“আমি’টা” আমিতেই আটকে রইল। বাকিটা শেষ করার আগেই সারাজের ভয়ানক কাজে স্তব্ধ হয়ে গেল সে। গাল হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে চাইল সারাজের মুখপানে। সারাজের ঠোঁট কোণে চমৎকার হাসি, যেন বিশ্বজয় করেছে সে। পুতুলকে সে মুখ খোলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠল,
‘শাড়ি পরিস না, পুতুল। শাড়িতে তোকে বিদঘুটে লাগে।’
বলেই সে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। পুতুল হতবম্ব, হতবাক। গালে হাত দিয়ে এখনও এক ভাবে চেয়ে আছে। কী অদ্ভুত লোক! প্রথমে চুমু খেয়ে পরে বলে আবার শাড়িতে বিদঘুটে লাগে। শাড়িতে বিদঘুটে লাগলে চুমু খাবে কেন, আশ্চর্য?
______
সারাজ পাঞ্জাবী গায়েই বেরিয়েছে। তবে পুতুল শাড়ি ছেড়ে গায়ে জড়িয়েছে একটা সুতি কামিজ। গাড়ির পেছনে মেহুল আর রিতা। সামনে ড্রাইভিং সিটে সারাজ, পাশে পুতুল। রাবীর আর সাদরাজ আজও এই সেই বাহানা দিয়ে উধাও। মেয়ে মানুষের সাথে শপিং এ বেরিয়ে মাথা খারাপ করতে চায় না তারা। তাই তো নিঁখুত অভিনয় চালিয়ে কেটে পড়েছে।
লাল রং’টা সারাজের বরাবরই অপছন্দ। অথচ আজ নিজেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই রং দেখছে। পুতুল ভেবেছিল, বিয়ের শাড়ি কিনতে আসলে সারাজের সাথে আরেক দফা ঝগড়া হবে। কারণ হিসেবে শাড়ির লাল রংটাই ভেবেছিল সে। কিন্তু এখানে আসার পর তো সব উল্টো হচ্ছে। সারাজ নিজে থেকেই লাল রং এর শাড়ি দেখছে।
একটা লাল টকটকে বেনারসী হাতে তুলল সারাজ। হুট করেই এই শাড়িটা যেন চোখে আটকেছে। সে পাশে পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘দেখতো এটা কেমন লাগে?’
শাড়িটা দেখে খুশি হলো পুতুল। চমৎকার লেগেছে তার। সাথে সাথেই বলল,
‘খুব সুন্দর।’
‘নিব এটা?’
সারাজ ফের প্রশ্ন করে। পুতুল মাথা কাঁত করে সম্মতি জানাল। সারাজ এবার দুই মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
‘তোমাদের পছন্দ হয়েছে?’
মেহুল হেসে বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তোদের পছন্দই আমাদের পছন্দ।’
সবার সম্মতি পেয়ে সারাজ প্রসন্ন চিত্তে শাড়িটা দোকানদারকে দিয়ে বলল,
‘এটা প্যাক করে দিন।’
শাড়ি কিনে পুতুল বেজায় খুশি। শাড়ি একেবারে মনের মতো হয়েছে তার। তাই সে সারাজের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ধন্যবাদ।’
সারাজ তখন কাউন্টারে টাকা পে করছিল। পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘কীসের জন্য?’
পুতুল প্রাণবন্ত হেসে বলল,
‘এই যে এত সুন্দর একটা শাড়ি কিনে দেওয়ার জন্য।’
সারাজ মৃদু হেসে বলল,
‘কী করব বল, পছন্দ মতো না কিনে দিলে তো বিয়ের দিনও মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবি। তখন তো আবার আমার বিয়ের ছবিগুলো খারাপ আসবে, সেই চিন্তা করেই দিলাম আরকি।’
পুতুল দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
‘সে তুমি মুখে যা-ই বলো না কেন, আমি কিন্তু ঠিকই সব বুঝি।’
সারাজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী বুঝিস?’
‘তোমার সেসব না জানলেও চলবে। এখন শাড়ি নিয়ে চলো তাড়াতাড়ি। একটা শাড়ি কিনলেই তো আর হবে না। তোমাকে পুরো ফকির বানিয়ে তবে আমি যাব। ওহ মনে পড়েছে, একটা লেহেঙ্গাও নিতে হবে লীনার জন্য। সেটা অবশ্য তোমার টাকায় নিব না। আমার টাকাতেই নিব, আর বাকি লাগলে মা তো আছেই।’
‘লীনার জন্য তুই কেন লেহেঙ্গা নিবি?’
‘আমার বান্ধবী চেয়েছে, তাই।’
সারাজ শাড়ির ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল,
‘ঠিক আছে, চল। এইদিকে বেশি লেইট করলে আবার দোকান সব বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’
________
চার জন মানুষের হাত হয়তো এক্ষুনি ছিড়ে পড়বে। না, আঙ্গুলের আর এইটুকু অংশও বাকি নেই যে যেখানে আরেকটা ব্যাগের একটুখানি জায়গা হবে। সবাই ক্লান্ত। পা চলছে না কারোর’ই। পুতুল এক দোকানের টুলে বসে মন্দীভূত সুরে বলল,
‘আমি আর হাঁটতে পারব না, মা। আমার পা কোমর সব ব্যথা করছে।’
তার কথা শুনে নাক মুখ কুঁচকায় সারাজ। ক্ষিপ্ত সুরে বলে,
‘আমাদের যেন খুব মজা লাগছে। নিজে হাঁটতে না পারলে আমাদের এত হাঁটাচ্ছিস কেন? এক দোকান থেকে সব কেনা যায় না। পুরো শপিং মল ঘুরতে ঘুরতে আমার এখন মাথা ঘুরাচ্ছে। উফ, বিয়ের শপিং এত ঝামেলার জানলে বিয়েই করতাম না।’
সারাজের কথা শুনে মেহুর রিতা একজন অন্যজনের দিকে চেয়ে হাসে। পুতুল তেতে উঠে বলে,
‘করো না। এখনও তো সময় আছে, না করে দাও।’
সারাজ ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠে,
‘হ্যাঁ, আমি এখন বিয়েতে না করি আর আমার এতগুলো টাকার কেনাকাটা সব জলে যাক; এটাই তো চাস তুই?’
‘আহা, তোরা ঝগড়া বন্ধ করবি? সব তো কেনাকাটা শেষ, চল তবে এখন বাড়ি ফিরে যাই।’
মেহুলের কথা শুনে পুতুল কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,
‘কী করে শেষ হলো, মা? কাল আমার মেহেদী, অথচ তোমরা কেউ মেহেদীই কিনলে না। এখন তো মেহেদীর কোনো দোকানও খোলা নেই।’
‘ঠিক আছে, কাল সকালে কেনা যাবে তো। চল, উঠ এবার।’
পুতুল ঝিমিয়ে উঠে দাঁড়াল। সারাজের কাছে গিয়ে বলল,
‘এই ব্যাগগুলো ধরো না, আমি আর পারছি না।’
সারাজ ভ্রু কুটি করে চাইল। বলল,
‘আমার কি দুই তিনটা হাত এক্সট্রা আছে? দেখছিস, আমার হাতের গুলোই জায়গা হচ্ছে না, আবার উনি আসছে উনার গুলোও ধরিয়ে দিতে। পারব না আমি।’
পুতুল গাল ফুলিয়ে ভেংচি কাটল। বলল,
‘এখন ধরছ না তো কী হয়েছে। সারাজীবন তোমাকে দিয়েই সব বোঝা টানাব। দেখে নিও, হু।’
বলে পুতুল সামনে এগুতেই সারাজ তার হাতের ব্যাগগুলো টেনে ধরে। পুতুল ফিরতেই বলে,
‘দে আমার কাছে। এগুলোর ভারে আবার পড়ে গিয়ে আহত টাহত হলে অযথা আমার বিয়েটা ক্যান্সেল হবে। তার থেকে বরং আমিই কষ্ট করি।’
পুতুল খুশি হয়ে নিজের হাতে একটা ব্যাগ রেখে বাকি সবগুলো ব্যাগ সারাজের হাতে দিয়ে দেয়। সারাজ অসহায় সুরে বলল,
‘ঐ একটা করে আর রাখলি কেন? এটাও দিয়ে দে।’
পুতুল হেসে বলে,
‘না না, কী বলো। সব তোমাকে দিয়ে দিলে আমার হাত একদম খালি হয়ে যাবে না? তোমাদের সবার হাতে ব্যাগ আর আমার হাত খালি, এটা কেমন দেখায় না; থাক এটা আমার হাতে।’
বলেই সে হেলে দুলে সামনের দিকে এগুলো। আর পেছন পেছন সারাজ এগিয়ে ভাবতে লাগল,
‘বিয়ের পর এই মেয়ে নির্ঘাত তাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে।’
চলবে….