#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৬।
লীনা বাকরুদ্ধ। এই বাইশ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে এত বড়ো ঝটকা এর আগে খায়নি সে। দুই ওষ্ঠের মাঝে কিঞ্চিৎ ফাঁক। চোখের পলক ফেলতেও বেমালুম ভুলে গিয়েছে। আজকে কি এই লোকটা একটার পর একটা ঝটকা দিয়ে তাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছে না-কি?
মাহাত ভ্রুকুটি করে। জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার? এমন হা করে চেয়ে কী দেখছ? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, বিয়ে করবে আমায়?’
পুতুলেরও একই দশা। সেও হতভম্ব। প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই; ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব? এই মাহাত তো সাংঘাতিক ছেলে।
মাহাত এবার বীতঃস্পৃহ। পুতুলের দিকে চেয়ে বলে উঠল,
‘আপনার ফ্রেন্ডকে বলুন তো, এমন হা করে চেয়ে না থেকে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে।’
পুতুল নির্বোধের মতো মাথা নাড়িয়ে লীনাক বলল,
‘এই লীনা, জবাব দে।’
লীনা ভ্রু কুঁচকে চাইল পুতুলের দিকে। পুতুলও বোকার মতো চেয়ে আছে। এই অতর্কিত প্রস্তাবে দুজনেরই মারাত্মক মাথা ঘুরাচ্ছে। লীনা তো যেকোনো সময় পড়ে টড়েও যেতে পারে।
লীনার এহেন নিস্তব্ধতা দেখে মাহাত এবার ক্ষুব্ধ হলো ভীষণ। ঠোঁট কামড়ে এক পল চেয়ে থেকে বলল,
‘বুঝেছি, আজ জবাব দিবে না। সময় লাগবে তোমার? ঠিক আছে, দিলাম সময়। তবে ঠিক চব্বিশ ঘন্টা। আগামীকাল ঠিক এই সময় এসে তুমি আমার জবাব দিবে। আর অবশ্যই জবাব যেন আশাব্যঞ্জক হয়। অন্যথায়, তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব।’
লীনা এবার সত্যিই মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নেয়। সে এক পা পেছাতেই মাহাত তার হাত টেনে ধরে। তারপর মৃদু হেসে বলে,
‘আহা, এত দূর্বল হলে চলে? ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবে। আর এই কৃষ্ণচূড়া ফুলটা রাখ। যদিও এতক্ষণে মজে গিয়েছে। তাও, আমার প্রথম দেওয়া ফুল। যত্ন করে রেখে দিও, আমাদের ছেলে মেয়েদের দেখাতে হবে না?’
আল্লাহ! লীনার মনে হচ্ছে এই জমিন কেন দুদিকে চিরে যাচ্ছে না; সে কেন এই জমিনের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে না? এই লোকটা এমন বেশরম হবে, সে এটা দুঃস্বপ্নেও কখনো ভাবেনি। এক লাফে বাচ্চা পর্যন্ত চলে গিয়েছে? বুকে ব্যথা করছে লীনার। এখনই নির্ঘাত একটা অ্যাটাচ ফ্যাটাক হয়ে যাবে।
মাহাত হাতের ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
‘এখন আমাকে যেতে হবে। কাল আবার দেখা হচ্ছে। আশা করছি, কোনো টাল বাহানা না করে সুন্দর মতো আমার উত্তর দিয়ে দিবে।’
বলেই সে এক হাতে লীনার ডানপাশের গালটা টেনে দিয়ে প্রস্থান ঘটাল। এত জোরে গালে টান লাগল যে লীনা গালটা হাত দিয়ে ঘষতে লাগে। বলে উঠে,
‘কী অসভ্য লোক রে বাবা!’
পুতুল এক লাফে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
‘এই দোস্ত, কী হয়ে গেল এসব?’
লীনা দু হাতে মাথা চেপে বলল,
‘আমায় ধর, আমায় ধর। মাথাটা এখনও ঘুরছে।’
পুতুল দু হাতে তাকে আগলে ধরে বলল,
‘চল, ঐখানে গিয়ে বসি।’
____
‘তো, এবার কী উত্তর দিবি?’
লীনা ড্যাবড্যাব করে পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘দেখেছিস, ছেলেটা কী সাংঘাতিক! মানে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব? আমার তো এখনও কিছু মাথায় ঢুকছে না।’
‘রাজি হয়ে যা। ভালো ছেলে, তোকে সুখে রাখবে।’
লীনা তেতে উঠে বলল,
‘তুই কী করে জানলি, সুখে রাখবে? তুই প্রেম করেছিলি আগে?’
‘আসতাগফিরুল্লাহ, কী বলিস এসব? আমার হবু দুলাভাই লাগেন উনি, দুঃস্বপ্নেও উনাকে নিয়ে এসব ভাবতে পারি না।’
‘তাহলে চুপ থাক। বললেই রাজি হওয়া যায় না-কি? আগে আমাকে দেখতে হবে না, উনি আদৌ সিরিয়াস কি-না। পরে যদি আমি ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে যাই?’
‘আরে না, তেমন কিছু হবে না। ভার্সিটিতে উনার বেশ প্রশংসা। উনাকে স্যার থেকে ছাত্র সবাই পছন্দ করে। আমার মনে হচ্ছে, উনি সিরিয়াস। নাহলে কি আর ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব দিতেন? তুই একটু ভেবে দেখ। চব্বিশ ঘন্টা সময় তো আছেই।’
‘আর যদি রাজি না হই, তবে কি উনি সত্যি সত্যিই আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলবেন?’
ভীত শোনায় লীনার কন্ঠস্বর। পুতুল ঠোঁট চেপে আসে। মারাত্মক মজা লাগছে এসব তার। তারপর চোখ মুখ সিরিয়াস করে বলে,
‘হতেও পারে। ছেলেদের বিশ্বাস নেই রে। আমার মনে হয়, রাজি হয়ে যাওয়াটাই বেটার অপশন। তারপর বাকিটা তোর ইচ্ছে।’
_____
প্রোগ্রাম শেষে ভার্সিটির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পুতুল। লীনা বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে কিয়ৎক্ষণ আগেই। পুতুলের গাড়িটা প্রত্যহের মতো এক পার্শ্বে অবস্থান করছে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে আবার একবার ফেসবুকে ঢুকল সে। স্টোরিতে তার শাড়ি পরা ছবিতে লাভ রিয়েক্টের বন্যা বইছে। সারাজও সিন করেছে সেই স্টোরি। অথচ একটা রিয়েক্টও দেয়নি। পুতুলের ভীষণ অন্তর্বেদনা হলো তাতে। আজকের দিনে কী সুন্দর মাহাত লীনার প্রতি তার ভালোবাসা জাহির করল। এত এত প্রেম দেখাল। অথচ এই ব্যক্তি, যার সাথে কয়দিন পর তার বিয়ে; সে কেন এত নির্লিপ্ত থাকে সবসময়? এই যে সে শাড়ি পরা ছবি দিল, একবারও কি এটা দেখে তার মনে প্রেম জাগল না? একবারও মনে হলো না, এই শাড়ি পরিহিত প্রেয়সীকে একবার বাস্তবে নিজ চোখে গিয়ে দেখে আসি? একবার তাকে গিয়ে বলি, “এই পুতুল, শাড়িতে তো তোকে মারাত্মক লাগছেরে।” তা না, সে এখানে সামান্য একটা রিয়েক্ট দিতেও কৃপণতা করছে।
পুতুল নাক মুখ কুঁচকে সামনে পা বাড়াতেই কোথ থেকে যেন সাহেল এসে হাজির হয়। পুতুলের দিকে চেয়ে বলে উঠে,
‘তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছিল, পুতুল। আর তোমার গানও অসাধারণ হয়েছিল।’
এই মুহুর্তে এই ছেলেকে দেখে ভীষণ বিদ্বিষ্ট হলেও পুতুল সেটা প্রকাশ করল না। বরং হেসে বলল,
‘ধন্যবাদ।’
বলেই আবার সামনে পা বাড়াল। সাহেল তাকে ফের ডেকে বলল,
‘তুমি কি এখন বাসায় চলে যাবে?’
পুতুল ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
‘তো কি এখানে দাঁড়িয়ে ভার্সিটি পাহারা দিতে বলছ?’
সাহেদ বোকার মতো হেসে বলল,
‘না, তা কেন বলব? আসলে বলতে চাইছিলাম যে, তুমি যদি এখন ফ্রি থাক, তবে কি আমরা একটু ঐ সামনের কফি শপটাতে যেতে পারি?’
পুতুল ফুঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘দুঃখিত। আমার এখন তোমার সাথে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তুমি অন্য কাউকে নিয়ে যাও।’
সাহেল বিরক্ত ভঙিতে সেই জায়গা ছাড়ল। পুতুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আসছে কফি খেতে। ভেবেছে, এদের চালাকি আমি বুঝি না। যত্তসব আজাইরা পাবলিক।’
.
পুতুল তার গাড়ির দরজাটা খুলতেই শো করে একটা বাইক এসে থামল তার সামনে। অকস্মাৎ এই আগমনে প্রথমে সে কিছুটা ঘাবড়ে গেল, পরে পরিচিত বাইক আর বাইকের মালিককে দেখে ধাতস্ত হলো সে। মাথা থেকে হেলমেট’টা সরিয়ে জোরে শ্বাস টানল সারাজ। পুতুল ভ্রু কুঁচকাল তা দেখে। আচমকাই সারাজ হেঁচকা টানে পুতুলকে তার কাছে এনে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘এই মামা, তুমি গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে যাও। আমি পুতুলকে নিয়ে আসব।’
অমনি গাড়ি ছেড়ে দিল। পুতুল সারাজের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল,
‘আমি তোমার সাথে যাব না।’
সারাজ কপাল কুঁচকে চাইল। বলল,
‘কেন?’
‘এমনি।’
নাক ফুলিয়ে বলল পুতুল। সারাজ কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। হঠাৎ সে তার ডানহাতের বৃদ্বাঙ্গুল দিয়ে পুতুলের অধর ছোঁয়ে বলল,
‘এসব রং চং কেন মেখেছিস? কেমন লাগছে তোকে!’
অধরের পৃষ্ঠে সারাজের এমন অতর্কিত স্পর্শে প্রথমে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে পুতুল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সারাজের কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে যায় তার। এসব রং চং? আর কেমন লাগছে মানে কী? তাকে কি সুন্দর লাগছে না?
পুতুল নাক মুখ ফুলিয়ে শুধাল,
‘আমাকে সুন্দর লাগছে না, সারাজ ভাই?’
পুতুলের গাল ফুলানো দেখে হাসি পেল সারাজের। কিন্তু সেই হাসি চেপে রেখে সে গম্ভীর গলায় বলল,
‘না, একদমই না।’
পুতুল দাঁতে দাঁত চেপে চেয়ে থাকে সারাজের দিকে। যদি আজ সারাজের চোখে তার এই সৌন্দর্য ধরা না পড়ে, তবে নিশ্চয়ই এই লোক অন্ধ।
সারাজ বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল,
‘চল তাড়াতাড়ি, লেইট হচ্ছে।’
পুতুল ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বাইকে উঠে বসল। রাগে শরীর রিঁ রিঁ করছে তার। এত সুন্দর করে সেজে কী লাভ, যদি এই সৌন্দর্য ভালোবাসার মানুষের চোখেই না পড়ে?
রাগে পুতুল প্রথমে খেয়াল করেনি যে, তারা উল্টো রাস্তায় যাচ্ছে। পরে ব্যাপারটা বুঝতেই সে প্রশ্ন করে,
‘আমরা এইদিকে কোথায় যাচ্ছি? এটা তো উল্টো রাস্তা।’
সারাজ সামনের আয়নায় পুতুলের চিন্তিত মুখটা একবার পরখ করে বলল,
‘কাজী অফিস যাচ্ছি।’
পুতুল আঁতকে উঠে বলে,
‘কেন?’
‘বিয়ে করতে।’
‘কী?’
চেঁচিয়ে উঠে পুতুল। সারাজ ক্ষিপ্ত সুরে জবাব দেয়,
‘এবার বেহুঁশ হলে, আছাড় মেরে জ্ঞান ফেরাব। তাও বিয়ে না করে ফিরব না।’
চলবে …
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৭।
‘এটা তো কাজী অফিস না, সারাজ ভাই। আমরা এখানে কেন এসেছি?’
সারাজ বাইক থেকে নামতে নামতে জবাবে বলল,
‘তোর তো দেখছি কাজী অফিসে যাওয়ার খুব তাড়া।’
পুতুল কপাল কুঁচকে বলল,
‘আমার মোটেও কোনো তাড়া নেই। ইনফেক্ট, আমি এরকম বিয়ে চাইও না। তুমি বলেছিলে, তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
সারাজ বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। পুতুলের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধায়,
‘তাহলে কেমন বিয়ে চাস?’
পুতুল এগিয়ে সারাজের পাশেই হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। তারপর তাকায় সামনের খোলা প্রান্তরে। সেদিকেই বিভোর থেকে বলে,
‘আমি চাই একটা চমৎকার বিয়ে। যেখানে আমার কাছের মানুষগুলোর উপস্থিতি থাকবে; থাকবে তাদের একরাশ আনন্দের ছটা। চারদিক সেদিন রঞ্জিত হবে নিয়নের আলোতে। আমি সেদিন মন ভরে সাজব। হাত রাঙাব নিঁখুত মেহেদিতে। এই, তুমি না আমাকে একটা সিঁদুর লাল শাড়ি কিনে দিবে। আমি জানি, তোমার লাল পছন্দ না। তবে লাল ছাড়া কি বউ হয় না-কি? শোনো, বিয়েতে যা হবে সব আমার পছন্দের। তুমি তো হলে নিরামিষ মানুষ, তাই তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। সব আমাকেই দেখতে হবে।’
এতক্ষণ অনিমেষ চেয়ে পুতুলের বিয়ে বর্ণনা শুনছিল সারাজ। তাতেই অধর কোণে স্মিত হাসির রেশ ফুটে ওঠে। তবে পুতুলের দৃষ্টিগোচর হওয়ার আগেই সেই হাসি বিলিন করে সারাজ ক্ষিপ্ত সুরে বলে ওঠে,
‘আমাকে তোর নিরামিষ মনে হয়?’
‘অবশ্যই। একেবারে রষকষহীন তেতো একটা মানুষ।’
পুতুলকে নির্লিপ্ত শোনায়। সারাজ তখন ফিচেল হেসে বলে,
‘এই তেতো মানুষকেই আজীবন বহন করে চলতে হবে কিন্তু। এখনও সময় আছে, ভেবে নে।’
পুতুল সারাজের মুখের দিকে চাইল। হেসে বলল,
‘সমস্যা নেই। আমি তেতো’কে মিষ্টি বানাতে পারব।’
সারাজ দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
‘বাহ, খুব কনফিডেন্ট দেখছি।’
পুতুল জবাবে আর কিছু বলে না। কিছুক্ষণ দুজনেই ঈষৎ নিরবতা পালন করে। এই উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে হয়তো দুজনেই নিরবে তাদের চিত্তে চিত্তে সন্ধি ঘটাচ্ছে। স্বীকার না করুক। তবুও, তাদের হিয়ার প্রতিটি স্পন্দন তাদের এই প্রণয়ের সাক্ষী হয়ে যাচ্ছে।
অনেক সময় পর পুতুলের দীর্ঘশ্বাসের শব্দে প্রকৃতির এই নিরবতা কাটে। পুতুল চোখ তুলে সারাজের দিকে তাকায়। তবে সারাজের ঐকান্তিক দৃষ্টি এখনও পূর্বের মতোই স্থির। পুতুল মোলায়েম সুরে বলে উঠে,
‘জানো, আজ লীনাকে আমাদের ভার্সিটির একটা ছেলে প্রপোজ করেছে। প্রেম ভালোবাসার প্রস্তাব না কিন্তু; ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব। কী সুন্দর করে বলছিল, “আমাকে বিয়ে করবে লীনা”। আমি হতভম্ব হয়ে দেখছিলাম সেই মানুষটাকে। আচ্ছা, প্রেম বুঝি চোখেও ভাসে? আমি ঐ ভাইয়ার মাঝে নিদারুণ প্রেম দেখেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, ভাইয়ার এই চাওয়া ঠুনকো না। উনি সত্যিই লীনাকে ভালোবাসেন। আর বোকা লীনা, বোকার মতো চেয়েই ছিল কেবল। ভাইয়া কম যায় না। জানো, লীনাকে রীতিমতো হুমকি দিয়েছে। সে নাকি বিয়ে করতে না চাইলে, উনি তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবেন। কী সাহস দেখেছো? আমার বেলাতে কেন এমন হলো না কে জানে?’
শেষের কথাটুকু আস্তে বলে পুতুল। তাও সেটা সারাজের শ্রবণেন্দ্রীয় এড়ায় না। কপালের ভাঁজ ফেলে সে পুতুলের দিকে তাকায়। বিদ্বিষ্ট সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘তোর বেলাতে এমন হলো না মানে?’
পুতুল সরে আসে। সারাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ সুরে বলে উঠে,
‘মানে আমাকে কেউ এভাবে প্রপোজ করেনি। আমিও তো এমন একটা প্রপোজ ডিজার্ভ করি, তাই না?’
সারাজ নিমিষ চেয়ে তাকে পুতুলের বিষন্ন মুখাবয়বের পানে। পুতুলের মনঃক্ষুণ্ণ হলো যেন। সে পেছন ফিরে দু কদম এগুতেই হঠাৎ শাড়ির আঁচলে টান পড়ে। অবাক হয়ে পেছন ফেরে। চেয়ে দেখে সারাজ শক্ত মুঠে তার আঁচল ধরে আছে। পুতুল তখন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
‘কী হয়েছে?’
মুঠোয় রাখা আঁচলের অংশটা আরেকটু হাতের মাঝে পেঁচায় সারাজ। পুনরায় টান পড়াতে পুতুল আরেকটু এগুয়। ভ্রু যুগলের মাঝের ভাঁজ তাতে আরো দৃঢ় হয়। সারাজের ঠোঁটের কোণে তখন উচ্ছ্বল হয় ঈষৎ হাস্য রেশ। আচমকাই টানের গতি বাড়ে। এবার খানিক জোড়েই টান পড়ে। পুতুল হুমড়ি খেয়ে পড়ে সারাজের প্রশ্বস্থ বুকে। বুকের কম্পন বাড়ে ততক্ষণাৎ। ভাগ্যিস, বেশি করে পিন মেরেছিল। নয়তো এতক্ষণে শাড়ির আঁচল খুলে সারাজের হাতে থাকত। পুতুল বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে সারাজের দিকে তাকায়। হঠাৎ থমকে যায় সে। সারাজ ভাই এভাবে কেন চেয়ে আছেন? এই দৃষ্টির সাথে তো পূর্ব পরিচিত নয় সে। সারাজ তাকে কখনো এভাবে দেখেনি। ঢোক গিলে পুতুল। কোমরে শক্ত পোক্ত হাতের স্পর্শ পেতেই আরো বেশি কুন্ঠিত হয়ে পড়ে যেন। সারাজ দুই হাতে শক্ত করে পুতুলের কোমর আঁকড়ে ধরেছে। পুতুলের নিশ্বাস আটকে আসার উপক্রম। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। পুতুলের এমন ভীত সন্ত্রস্ত মুখশ্রী দেখে সারাজের অধর কোণের হাসি দীর্ঘ হয়। সে পুতুলের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠে,
‘খুব না তখন বলছিলি, আমাকে তেতো থেকে মিষ্টি বানাবি। এই তার নমুনা? শিক্ষক যদি এত অপরিপক্ক হয়, তবে ছাত্রকে কীভাবে শেখাবে? হু?’
আরেকটু চেপে ধরে সারাজ। পুতুল এবার নাক মুখ কুঁচকে বলে,
‘সমস্যা কী তোমার? ছাড়ো। আশেপাশের কারোর চোখে পড়লে কালকেই হেডলাইন বেরুবে।’
‘ভয় পাচ্ছিস, নাকি লজ্জা?’
পুতুল মাথা নুইয়ে ধীর গলায় বলে,
‘দুটোই।’
সারাজ ঠোঁট কামড়ে হেসে পুতুলের লাজ মাখা মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে থাকে। ততক্ষণে তার হাত পুতুলের কোমর ছেড়ে এসে গালে ঠেকেছে। অন্যহাতে খুব যত্ন করে পুতুলের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে কোমল স্বরে বলে উঠে,
‘বউ হবি আমার?’
পুতুল চোখের পল্লব নাড়িয়ে পিটপিট করে তাকায়। সারাজের অমন নির্লিপ্ত চাহনি তার লজ্জাকে আরো প্রশমিত করছে যেন। সে পুনরায় মাথা নুইয়ে ফেলে।
‘কিরে, উত্তর দিচ্ছিস না যে? বউ হবি না?’
মাথা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় সে। সারাজ ক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠে,
‘বোবা হয়ে গিয়েছিস? মুখে বল।’
পুতুল জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘হ্যাঁ, হব।’
কাঙ্খিত জবাবে অন্তস্থল শীতল হয় সারাজের। টুপ করে পুতুলের ললাটে অধর ছোঁয়ে দেয়। পুনরায় এমন অতর্কিত ছোঁয়াতে আরো বেশি ঘাবড়ে যায় পুতুল। একদিনে এত ঝটকা আর নিতে পারছে না। তড়িৎ গতিতে দুকদম পিছিয়ে যায়। তারপর বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘আজকেই তোমার এত প্রেম উতলে পড়ছে কেন বলতো? একদিনে এত চাপ আমি কী করে সহ্য করব?’
পুতুলের এমন নির্বোধ উক্তিতে না হেসে সারাজ পারল না। বলল,
‘তুই আসলেই একটা আহাম্মক, পুতুল। একেবারে উচ্চ পর্যায়ের আহাম্মক। তোকে নিয়ে আমি কী করে সারাজীবন কাটাব, বলতো? আমার তো এখনই চিন্তা হচ্ছে।’
পুতুলের সুন্দর অনুভূতিগুলো নিমিষেই উবে যায়। কোমরে হাত দিয়ে সে উঁচু স্বরে বলে উঠে,
‘এত চিন্তা হলে, আমাকে বিয়ে করার কী দরকার? যাও, বিয়ে করতে হবে না। আর এমনিতেও আমার পছন্দের মানুষ অন্যকেউ। তাই তুমি আমাকে বিয়ে না করলেও আমার তেমন কিছু যায় আসেনা।’
পুতুলের কথা শেষ হতেই সারাজ বাইক ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বুকের উপর হাত দুখানা ভাঁজ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘আচ্ছা, তোর পছন্দের মানুষ অন্য কেউ? আগে বলবি না, তাহলে আর তোকে এত কষ্ট দিতাম না। তুই এক কাজ কর, এখানে দাঁড়িয়ে থাক। আমি তোর পছন্দের মানুষকে এখানে পাঠাচ্ছি। তারপর দুজন গিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে করে ফেলবি। চিন্তা নেই, মা বাবাকে আমি সামলে নিব।’
বলেই সারাজ বাইকে বসে বাইক স্টার্ট দেয়। পুতুল আঁতকে উঠে বলে,
‘আরে, তুমি আমাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছ?’
সারাজ চোয়াল শক্ত করে বলে,
‘তোর পছন্দের মানুষকে আনতে।’
পুতুল দৌড়ে সারাজের কাছে এসে বলে,
‘উফ, তুমি মজাও বুঝো না? আমি তো কেবল মজা করছিলাম। আমার কোনো পছন্দের মানুষ টানুষ নেই। সব মিথ্যা।’
সারাজ তার কথায় পাত্তা দেয় না। বাইক স্টার্ট দিয়ে বসে। পুতুল চট করে বাইকের পেছনে উঠে বলে,
‘তুমি কী চিন্তা করছ? তোমার মতো রগচটা মানুষকে নিয়ে আমি কীভাবে সংসার করব, সেই চিন্তাতে তো আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে বসেছি।’
‘আর একটাও বাজে কথা বললে কিন্তু এখানে ফেলে রেখেই চলে যাব।’
সারাজের হুমকিতে বিন্দুমাত্র ভয় পেল না পুতুল। তাও গম্ভীর মুখে বলল,
‘ঠিক আছে, চুপ আছি।’
_________
পুতুলের বাসার সামনে বাইক থামতেই নেমে দাঁড়াল সে। সারাজ তার সাথে কোনোপ্রকার কথা না বলে পুনরায় বাইক স্টার্ট দিতেই সে ডেকে উঠে,
‘সারাজ ভাই।’
সারাজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পুতুল মুচকি হাসে। সারাজের কাছে তার এই ভাবমূর্তি বোধগম্য হলো না। হঠাৎ এমন হাসছে কেন?
সে পুনরায় পুতুলের দিকে তাকানোর আগে ঝড়ের গতিতে পুতুল তার কাজ সেরে সেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেল। সারাজ হতভম্ব। গালে হাত দিয়ে মনে মনে বলে উঠল,
‘আশ্চর্য! মেয়েটা আবার পাগল টাগল হয়ে যায়নি তো?’
চলবে…..
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৮।
ক্লাস শেষ করে সবেই ভার্সিটির গেইটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে লীনা। বাইরের দিকে দৃষ্টি যেতেই চোখ মুখ কুঁচকে আসে তার। কী মারাত্মক রোদ আজ! চোখে এসে লাগছে যেন। পুতুলও আজ ভার্সিটিতে আসেনি। উল্টো তাকে তার বাড়িতে ডেকেছে। মেয়েটার যে আজকাল কী হয়েছে কে জানে?
লীনা হাত উঠিয়ে একটা রিক্সাকে ইশারা দেয়। তবে রিক্সা আসার আগেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় মাহাত। মাহাতের এমন আকস্মিক আগমনে ভড়কে যায় লীনা। ভ্রূ কুঁচকে বলে,
‘আপনি এখানে?’
মাহাত ব্যস্ত চোখে একবার হাতের ঘড়িতে সময় পরখ করে পুনরায় লীনার দিকে চেয়ে বলে,
‘আরো দু ঘন্টা বাকি। তবে আমার আর ধৈর্যে কুলোচ্ছে না। উত্তরটা দিয়ে দাও তো, লীনা।’
লীনা বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এমন ভাবে বলছে, যেন এই উত্তর দেওয়াটা একেবারেই ঠুনকো ব্যাপার। অথচ, এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কাল থেকে তার মাথা ব্যথা হয়ে গিয়েছে। লীনাকে চুপ থাকতে দেখে মাহাত নিঃস্পৃহ সুরে বলে উঠে,
‘এই, তুমি কি আজকেও চুপ থাকার ব্রত করছো? তবে, আমি কিন্তু আজ উত্তর না পাওয়া অবধি তোমাকে ছাড়ছি না। সো, বি ফাস্ট। আমার আবার ল্যাবে যেতে হবে।’
লীনা শান্ত চোখে চাইল। বলল,
‘আপনি আমায় ভালোবাসেন, মাহাত?’
মাহাত অকপটে বলে উঠে,
‘ভালোবাসা না থাকলে কি বিয়ে করতে চাইতাম?’
‘তাও, আপনি তো একবারও সেটা মুখে বলেননি। আর আমাদের তো কেবল এই কয়দিন’ই কথা হয়েছে। এর মাঝেই আপনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন? পরে যদি আপনার আফসোস হয়?’
সশব্দে হাসে মাহাত। বলে,
‘আমার নিজের উপর আস্থা আছে। আমার পছন্দ কখনো খারাপ হতেই পারে না। এখন এত কথা না বাড়িয়ে উত্তর দাও তো। এমনিই মাথার উপর বিশাল চাপ। সামনে ফাইনাল, অ্যাসাইনমেন্টের প্যারায় যা তা অবস্থা একেবারে। এখন আপাতত তোমার উত্তর শুনে নিজের অশান্ত মনটাকে একটু শান্ত করতে চাই।’
লীনা ইতস্তত সুরে বলে,
‘কী উত্তর দিব?’
মাহাত ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল,
‘বিয়ে করবে কি-না?’
‘যদি উত্তর না হয়?’
‘তবে তুলে নিয়ে যাব।’
লীনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘তাহলে আর উত্তর শুনে কী করবেন? আমার হ্যাঁ বা না তে তো আপনার কিছুই যায় আসে না। সেই তো আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েই বিয়ে করবেন।’
‘তাও, মনের শান্তি বলে একটা ব্যাপার আছে না?’
লীনা যে রিক্সাকে ডেকেছিল সেই রিক্সা অনেকক্ষণ যাবত তার সম্মুখেই দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা বোধ হয় এই যুগলের কথাই মনোযোগের সহিত শুনছিলেন এতক্ষণ। তাই ড্যাবড্যাব করে চেয়েছিলেন এইদিকেই। লীনা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই উনি দাঁত বের করে হেসে বললেন,
‘আপনি না ডাকছিলেন, মামা। কই যাইবেন?’
‘বনানী এগারো নাম্বার রোডে যাবেন?’
‘হ মামা, উডেন।’
লীনা চট করে রিক্সায় চড়ে বসে। তাকে রিক্সায় বসতে দেখে আরও বেশি বিদ্বিষ্ট হয় মাহাত। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি কি চাও, এখন আমি অন্যসব প্রেমিকদের মতো উত্তরের জন্য তোমার পেছন পেছন ঘুরি?’
লীনা ঠোঁট চেপে মিটমিটিয়ে হাসে। রিক্সার মামাকে তাড়া দিয়ে বলে,
‘মামা, যান তো।’
মাহাত এবার খানিকটা ক্রোধ নিয়ে বলে উঠে,
‘আরে, আশ্চর্য তো! তুমি চলে যাচ্ছো কেন? আমার সময়ের কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?’
রিক্সা চলতে শুরু করে ততক্ষণে। মাহাত চোখ মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে থাকে। রিক্সাটা তাকে পাড় হয়ে একটু সামনে যেতেই পেছন ফিরে তাকায় লীনা। মাহাতের বিক্ষিপ্ত চোখ মুখের দিকে চেয়ে বলে,
‘শুনেছি, কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। তাহলে আপনি কেন এত সহজে সবকিছু পেয়ে যাবেন, হু?’
ভ্রু নাচিয়ে হেসে আবার সামনে ফেরে সে। অধর জুড়ে তার শোভিত নিরুপম হাসি। উত্তর না পাক, মাহাতের মন লীনার ঐ নিঁখুত হাসিতেই শীতল হয়ে গিয়েছে। সে এবার নিশ্চিন্তে ল্যাবে যেতে পারবে।
_______
‘তোর কী হয়েছে বলতো? আজকাল খুব ক্লাস মিস দিচ্ছিস? আবার জরুরি তলপে ডাকাডাকিও করছিস? ব্যাপার কী, হু?’
পুতুল চিপসের প্লেটটা নিয়ে পা তুলে আরাম করে সোফায় বসল। তারপর একটা চিপস মুখে পুরে বলল,
‘ব্যাপার তো তুই বলবি। উত্তর দিয়েছিস?’
‘উঁহু।’
ভ্রু কুঁচকায় পুতুল। জিজ্ঞেস করে,
‘কেন? আরও সময় লাগবে তোর?’
‘সময়ের ব্যাপার না ঠিক। তবে এত সহজেই কি আর এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়? একটু ঘুরাতে হবে না?’
‘আচ্ছা, তোমার মনে এই চলছে তাহলে?’
‘হুম। এবার তুই তোর সমস্যার কথা বল। ভার্সিটি না গিয়ে আমাকে তোর বাসায় ডাকলি কেন?’
‘একটা জরুরি কথা বলার আছে।’
‘কী?’
‘বলছি, চিপস খা তুই।’
লীনা চিপস একটা নিয়ে মুখে পুরল। পুতুল খালাকে ডেকে বলল,
‘খালা, দুই কাপ কফি দিয়ে যেও তো।’
‘আন্টি বাসায় নেই?’
‘না। মামনির সাথে একটু বাইরে গিয়েছেন।’
‘আচ্ছা। এবার তুই তোর জরুরি কথাটা বল।’
‘বলছি। তবে তুই আবার অ্যাটাক ফ্যাটাক করবি না তো?’
লীনা চিপস খাওয়া রেখে কপাল কুঁচকে তাকায়। তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘কোনো আকাম কুকাম করেছিস না-কি? শোন, আমি কিন্তু কোনোকিছুর দায়ভার নিতে পারব না।’
বলেই দুহাত ঝেরে সোজা হয়ে বসল লীনা। পুতুল বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘আরে না, তেমন কিছু না।’
‘তাহলে কী?’
পুতুল এক পল থেমে সময় নিয়ে বলল,
‘আমার বিয়ে তো ফাইনাল।’
লীনা চমকে বলল,
‘ঐ কামাল মিয়ার সাথেই?’
‘না।’
আরেক দফা চমকাল লীনা। বলল,
‘তাহলে কার সাথে?’
পুতুল চোখ তুলে লীনার তীক্ষ্ণ চোখ মুখের দিকে চাইল। চোখের দৃষ্টি তখন আরো সরু হলো লীনার। পুতুল ক্ষীণ আওয়াজে বলল,
‘সারাজ ভাইয়ের সাথে।’
সঙ্গে সঙ্গেই “কী” বলে চেঁচিয়ে উঠল লীনা। তার গলার আওয়াজ গিয়ে বারি খেল এই বসার ঘরের প্রতিটি দেয়ালে। বিস্ময়ে হতভম্ব সে। মুখ দিয়ে কোনো রা বের হচ্ছে না। পুতুল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
‘মা বাবা বিয়ে ঠিক করেছেন। আমি তো কিছু জানতাম’ই না।’
ঠাস করে পুতুলের বাহুতে একটা চ ড় বসায় লীনা।।বিক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠে,
‘আমাকে কি বোকা পেয়েছিস? তুই কি ভেবেছিস, তোর হাবভাব আমি বুঝি না? তারমানে এতদিন আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম। তোদের দুজনের পেটে পেটেই এসব চলছিল, কেবল মুখে স্বীকার করিসনি। কী মারাত্মক অভিনয় করেছিস আমার সামনে। সারাজ ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ডের নাটকটা কিন্তু দূর্দান্ত ছিল। সব করে এখন আবার আমাকে বোকা বানাতে এসেছিস? এক থা প্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিব, ফাজিল মেয়ে।’
পুতুল মাথা নুইয়ে লজ্জিত কন্ঠে বলে,
‘তুই না সারাজ ভাইকে পছন্দ করতি, তাই তোকে কিছু বলার সাহস পাইনি।’
‘আশ্চর্য! আমি উনাকে পছন্দ করতাম, প্রেম ভালোবাসা তো আর ছিল না। তাই বলে এত বড়ো একটা কথা আমার কাছ থেকে চেপে গেলি?’
‘স্যরি।’
‘সর, ঐসব স্যরি ট্যরি দিয়ে আমি কী করব? আমার লেহেঙ্গা লাগবে।’
মাথা তুলে তাকায় পুতুল। অবাক গলায় প্রশ্ন করে,
‘লেহেঙ্গা দিয়ে তুই কী করবি?’
‘তোর বিয়েতে পরব। আর সেই লেহেঙ্গা আমাকে তুই কিনে দিবি। নাহলে তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই।’
পুতুল হেসে জড়িয়ে ধরে লীনাকে। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠে,
‘অবশ্যই অবশ্যই, কিনে দিব।’
‘হয়েছে, এবার প্রথম থেকে সব খুলে বল আমায়। সব না শোনা পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না।’
__________
‘তোর কোন কার্ডটা পছন্দ হয়েছে, পুতুল?’
পুতুল সবগুলো কার্ড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। হঠাৎ একটা হালকা বেগুনী রঙের কার্ডের দিকে নজর স্থির হয় তার। কার্ডের চারদিকে চিকন গোল্ডেন রঙের ফুলের কাজ। ফুলের এই কাজটা নিঁখুত। এই হালকা বেগুনী রঙের উপর এই কাজটা দারুন মানিয়েছে। সে কার্ডটা হাতে নিয়ে বলল,
‘মা, মামনি, আমার এটা পছন্দ হয়েছে।’
রিতা আর মেহুল কার্ডটা হাতে নিয়ে বলল,
‘বাহ, সুন্দর তো।’
‘আমার এটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে, মা। এটাই ফিক্সড করো।’
মেহুল তখন বলল,
‘একবার সারাজকেও এই কার্ডের ছবিটা পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেনে, ওর পছন্দ কি-না।’
‘আচ্ছা, দাঁড়াও পাঠাচ্ছি।’
পুতুল কার্ডের ছবি তুলে সারাজের হুয়াট’স অ্যাপে পাঠিয়ে দিল। লিখে দিল, ‘দেখোতো, এই কার্ডটা পছন্দ হয়েছে কি-না?’
সারাজ এই সময় অফিসে। তাই মেসেজ সিন করছে না। পুতুল বিরক্ত হয়ে কল করে। দুবার রিং বাজতেই রিসিভ হয়। পুতুল ব্যস্ত গলায় বলে উঠে,
‘শোনো, তোমার ফোনে না একটা কার্ডের ছবি পাঠিয়েছি। দেখোতো কার্ডটা কেমন লাগে।’
সারাজ বলে,
‘হোল্ড অন, দেখছি।’
ছবি দেখে সারাজ বলে,
‘একদম ভালো লাগেনি, এটা একটা কার্ড হলো?’
পুতুল বলল,
‘ছবিতে হয়তো ভালো লাগছে না। তবে বাস্তবে ভীষণ সুন্দর। আমার পছন্দ হয়েছে।’
‘তোর পছন্দের উপর আমার ভরসা নেই। তোরা থাক, আমি আসছি। আমি এসে পছন্দ করব।’
বলেই কল কাটে সারাজ। পুতুল ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
‘মা, তোমাদের ছেলের নাকি আমার পছন্দের উপর ভরসা নেই। সে নাকি নিজে এসে পছন্দ করবে। আমিও বলে দিচ্ছি, আমি এটা ছাড়া অন্য কার্ড নিব না। মেয়ে ছেলে উভয় পক্ষের কার্ড এটাই হবে। আর তোমরাও আমার সাপোর্ট করবে, বুঝেছো?’
জবাবে মেহুল আর রিতা হতাশ ভঙিতে মাথা নাড়ায় কেবল।
চলবে….