শেষটা সুন্দর ২ পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
793

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৩।

সকালে কোনোরকমে নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ে পুতুল। মায়ের সাথে একটাও কথা বলেনি। বাবার সাথেও না। সবার উপর রাগ তার। কেউ তাকে বুঝল না। সে মিছে মিছি বলল, আর অমনিই সবাই বিয়ে নিয়ে একেবারে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিয়েছে। কেউ বুঝল না, তার মনে কী চলছে। সারাজ ভাইও না।

ভার্সিটির গেইটের সামনে গাড়ি থামতেই নেমে দাঁড়াল পুতুল। ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আপনি চলে যান। আমি আজ রিক্সা করে বাড়ি ফিরব।’

‘কিন্তু ম্যাডাম, স্যার শুনলে তো রাগ করবেন।’

‘স্যারকে শোনানোর কী দরকার? কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আর কোনো সমস্যা হলে আমি আপনাকে বাঁচিয়ে নিব। চিন্তা নেই, যান।’

এই বলে পুতুল ভার্সিটির ভেতরে চলে যায়। ক্লাসে গিয়ে দেখে লীনাও এসে পড়েছে। পুতুল আলগোছে তার পাশে গিয়ে বসে। তাকায় লীনার দিকে। অথচ লীনা এখনও পুতুলের উপস্থিতি টের’ই পায়নি। মুখের ভেতর কলম ঢুকিয়ে সামনের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবছে। তাকে এভাবে দেখে ভ্রূকুটি হলো পুতুলের। হালকা করে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,

‘কী-রে, কী ভাবছিস এত?’

লীনা সম্বিত হয়। ভড়কে যাওয়ার দৃষ্টিতে পুতুলের দিকে চেয়ে বলে,

‘জানিস, কাল কী হয়েছে?’

পুতুল নিঃস্পৃহ সুরে বলে,

‘না বললে কী করে জানব? আমি তো আর অন্তর্যামী না।’

লীনা প্রথমে ভ্রু কুঁচকায়। তারপর আবার রয়ে সয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ক্লাসে শিক্ষক চলে আসে। ফুঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে লীনা বলল,

‘আচ্ছা, পরে বলব।’

টানা দুইটা ক্লাস হয়। ক্লাসের মধ্যে কথা বলার জো নেই। এখন আবার ক্লাস শেষে যেতে হবে অডিটরিয়ামে। হাতে আর মাত্র দু’দিন আছে। তাই সবাই বেশ মনোযোগী তাদের অনুশীলনে। পুতুল আর লীনা অডিটরিয়ামে প্রবেশ করে। আজ একটু বেশিই মানুষ এখানে। এতদিন যারা অনুশীলন করেনি, তারাও আজ এসেছে অনুশীলন করতে। পুতুল আর লীনা এক কোণে গিয়ে বসে। তারপর পুতুল লীনার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘তুই না তখন কী যেন বলতে চেয়েছিলি?’

লীনা ঠোঁট গুঁজ করে মাথায় নাড়ায়। তারপর বলে,

‘কাল একটা আননোন নাম্বার থেকে আমার কাছে প্রেম পত্র এসেছে। না, ঠিক প্রেমপত্র না, প্রেমকাব্য।’

‘প্রেমকাব্য?’

অবাক হয়ে প্রশ্ন করে পুতুল। লীনা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,

‘হ্যাঁ। দাঁড়া, দেখাচ্ছি তোকে।’

এই বলেই লীনা তার ফোন করে পুতুলকে সেই কবিতার মেসেজটা দেখায়। কবিতা পড়ে পুতুল মিটিমিটি হেসে বলে,

‘বাহ, ছেলে তো পুরো কবি। তা, এই কবিকে কই পেলি?’

‘আরেহ, আমি তো চিনি’ই না। প্রথমে কল করে কতক্ষণ জ্বালিয়ে তারপর এই কবিতা পাঠিয়েছে। কে এই মহান কবি কে জানে?’

‘এখনই একটা কল দে এই নাম্বারে। কথা বললেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

লীনা সাথে সাথেই কল লাগায়। হ্যাঁ, কল হচ্ছে। হঠাৎ একটা রিংটোনের শব্দ কানে আসে তাদের। ঠিক তাদের পেছন থেকে। লীনা আর পুতুল দুজনেই ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকায়। দেখে, মাহাতের কল বাজছে। লীনা আর পুতুল তখন একজন অন্যজনের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করে। ব্যাপারটা তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। মাহাত ফোন হাতে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। লীনার এবার কিঞ্চিৎ সন্দেহও হয়। পরক্ষণেই আবার ভাবে, এত ছেলে থাকতে এই রষকষহীন অগাধ ছেলে কেন তাকে অযথা প্রেমকাব্য পাঠাতে যাবে? উনাকে হয়তো অন্যকেউ কল দিয়েছে। পুতুল বলে উঠে,

‘এই, কলটা তো কেটে গেল।’

লীনা চেয়ে বলে,

‘ওমা, তাই তো! ছেলেটা কলটা রিসিভ করল না?’

‘আবার দে।’

পুতুল আর লীনা লাগাতার সেই নাম্বারে কল দিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই সেখানে এসে দন্ডায়মান হয় মাহাত। তাদের দুই বান্ধবীর দিকে কপাল কুঁচকে তাকায় সে। বিমুখ সুরে বলল,

‘কী ব্যাপার, অনুশীলন না করে আপনারা দুজন এখানে কী করছেন?’

হঠাৎ মাহাতকে দেখে দুজনেই চমকে তাকায়। লীনা আমতা আমতা করে বলে,

‘না, মানে… এখনই প্র্যাকটিসে যাচ্ছিলাম।’

‘জি, তাড়াতাড়ি করুন। আর আপনি পুতুল, আপনার গানের গ্রুপ ঐ দিকে। ওদের সবার সাথে গিয়ে প্র্যাকটিস করুন।’

পুতুল মাথা কাঁত করে সম্মতি জানিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। লীনা তার ফোনের দিকে চেয়ে আছে, ফোন তো এখনও যাচ্ছে ঐ নাম্বারে। আর তার ঠিক সামনেই তো মাহাত দাঁড়ানো। উনি হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই উনার ফোন বেজে উঠতো। না, তাহলে উনি নন। লীনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কলটা কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সামনের দিকে অগ্রসর হতেই মাহাত আবার ডাকে তাকে। লীনা ফিরতেই সে বলে,

‘আজ প্র্যাকটিস শেষ হলে আমাকে শোনাবেন।’

লীনা মাথা ঝাঁকিয়ে ফের অগ্রসর হলো সম্মুখে।

______

মাহাতকে আজ কবিতা আবৃত্তি করে শোনানোর সময় লীনা বেশ অস্বস্তিতে পতিত হয়েছিল। ছেলেটা কেমন করে যেন চেয়ে ছিল তার দিকে। একবারের জন্যও অন্যদিকে তাকায়নি। এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল কেবল তার মুখের দিকে। যেন চোখ সরালেই কোনো মহা মূল্যবান জিনিস সে হারিয়ে ফেলবে। কই, আরও তো কত ছেলে মেয়ে আজ আবৃত্তি করল, তাকে শোনাল; তাদের কারোর দিকে তো উনি এভাবে চেয়ে ছিলেন না। তবে তার বেলাতেই কেন? লীনা সেই প্রশ্নের জবাব পায় না। শিরঃস্থিত মজ্জার নিউরন কি তাদের কর্ম আজ গ্রথন করেছে? তবে কেন সে এই সহজ প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছে না?

লীনার ভাবুক মুখখানা দেখে পুতুল প্রশ্ন করে,

‘কী-রে আবার কী ভাবছিস?’

লীনা অপ্রস্তুত হেসে বলে,

‘না, কিছু না। কিন্তু, তোর আজ কী হয়েছে বলতো? সকাল থেকে এমন মনমরা হয়ে আছিস?’

পুতুল ভারি নিশ্বাস ছাড়ে। বিষন্ন সুরে বলে,

‘আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।’

লীনা চমকে বলে,

‘কী বলিস? কবে, কোথায়? আমাকে তো কিছুই জানালি না।’

‘আর জানানো। কী হবে জানিয়ে? আমার তো এই বিয়েতে কোনো মত’ই নেই।’

লীনা অবাক কন্ঠে বলে,

‘তবে কি আন্টি আংকেল জোর করে তোর বিয়ে দিচ্ছেন?’

‘না, ঠিক জোরও না। আসলে, ওরা কেউ আমাকে বুঝতে চাইছে না। আর আমিও আমার মনের কথাটা ওদের বলতে পারছি না। আমি চাই না, এই বিয়ে হোক।’

‘তুই কি অন্যকাউকে পছন্দ করিস, পুতুল?’

পুতুল গোল গোল চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে লীনার দিকে। এখন তাকে “হ্যাঁ” বললেই, মেয়েটা সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির পরিচয় জানার জন্য উতলা হয়ে উঠবে। কিন্তু, পুতুল এখনই লীনাকে সারাজ ভাইয়ের প্রতি তার অনুভূতির কথা জানাতে চাইছে না। তাই সে কথা ঘুরাতে বলল,

‘চল, আজকে একটু টং এর চা খেয়ে আসি।’

লীনা সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘তুই কিন্তু আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিস-নি।’

‘দিব, সময় হলেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি।’

লীনা বিদ্বিষ্ট হয়ে চেয়ে থাকে পুতুলের দিকে। পুতুল সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে তার হাত টেনে নিয়ে যায় চা খেতে।

_______

টং এর দোকানের চায়ের টাকা দিয়ে ফিরতেই পুতুল চমকে ওঠে। তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে চিত্ত জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। ছাই রঙের গাড়িটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারাজ। স্যূট বুট গায়ে একেবারে ফর্মাল গেট আপ তার। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রংটা মিহির অংশুতে চকচক করছে যেন। পুতুল তো তার দৃষ্টি সংযত করতে পারছে না। ছি, কী বেহায়া তার অক্ষিযুগল। সারাজের শঅনিত চোখের দৃষ্টি এবার কোমল হয়। অধর জুড়ে ফুটিয়ে তুলে নিরুপম সুন্দর হাসি। এগিয়ে আসে পুতুলের দিকে। হালকা মাথা নুইয়ে বলে,

‘আরেক কাপ চা খাবি?’

পুতুল বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। সারাজ ভাই তাকে টং এর চা খেতে বলছেন? হৃষ্টতা সহিত সে বলে উঠে,

‘অবশ্যই।’

তারপর সারাজ লীনার দিকে চেয়ে বলে,

‘তুমি খাবে আরেক কাপ?’

লীনা ইতস্তত সুরে বলে,

‘না না, ভাইয়া। আমি এক কাপের বেশি খেতে পারি না।’

সারাজ হেসে টং এর মামাকে বলে, আরও দুই কাপ চা দিতে। চিনি কম দিয়ে কড়া লিকারের দুধ চা।

সারাজের এহেন আচরণে পুতুল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তার দিকে। সারাজ ভাইয়ের আজ অকস্মাৎ কী হলো, সেটাই ভাবছে সে।

লীনা আর দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে। তাই সে পুতুলের কাছে গিয়ে বলে,

‘তোরা চা খা। আমি বরং যাই।’

‘কেন, থাক না আরো কিছুক্ষণ। এত তাড়া কীসের?’

‘না, আমার এখানে থেকে কোনো কাজ নেই। তুই বরং তোর ভাইয়ের সাথে চা খা। আসছি।’

‘আচ্ছা, সাবধানে যাস।’

লীনা হেসে রিক্সা ডেকে সেখান থেকে চলে যায়।

.

এই অপরাহ্নে উদম অম্বরতলে দাঁড়িয়ে প্রিয় মানুষের সাথে এক কাপ চা খাওয়ার মতো সুখকর ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। এই চায়ের স্বাদ অমৃতের চেয়েও কম কিছু না। চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই তৃপ্তিতে নেত্র রহিত করে পুতুল। আহ, কী শান্তি।

সারাজ মৃদু হেসে পুতুলের সামনের ছোট চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দেয়। চট করে তাকায় পুতুল। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে। সারাজের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেশটা এখনও প্রতীয়মান। পুতুল বিভোর সুরে বলে,

‘তোমার আজ কী হয়েছে, সারাজ ভাই?’

সারাজ মোহগ্রস্ত কন্ঠে বলে উঠে,

‘আমার না খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে, পুতুল।’

চলবে….

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৪।

পুতুল তার সিটে হেলান দিয়ে এক খেয়ালে সারাজকে অবলোকন করে যাচ্ছে। এই লোকটাকে মাঝে মাঝে অত্যন্ত অপরিজ্ঞাত লাগে তার। এই যে এখন যেমন লাগছে। সারাজ ভাইয়ের প্রেম প্রেম পাচ্ছে? আশ্চর্য, তার মতো এমন রগচটা গম্ভীর মানুষেরও বুঝি প্রেম প্রেম পায়?

সারাজ হঠাৎ কন্ঠ খাদে নামিয়ে ঔৎসুক্য সুরে বলে উঠে,

‘এভাবে যে দেখছিস, পরে যদি আমার নজর লেগে আমি কুৎসিত হয়ে যায়; সেই দায়ভার কি তুই নিবি?’

সারাজের প্রশ্ন শুনে ভড়কে যায় পুতুল। ভ্রুকুটি করে চেয়ে বলে,

‘আমি তোমাকে দেখছিলাম না। আমি ভাবছিলাম কেবল।’

সারাজ তার দিকে একপলক চেয়ে বলে,

‘কী ভাবছিলি?’

‘তোমার হঠাৎ প্রেম প্রেম পাচ্ছে কেন, বলতো? এটা তো মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। ব্যাপার কী, হু?’

পুতুল ভ্রু নাচায়। সারাজ সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিকদের ন্যায় সলজ্জ হেসে বলে,

‘মনে হয় প্রেমে পড়েছি।’

বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় পুতুল। কোটর ছেড়ে এই বুঝি অক্ষি যুগল বেরিয়ে আসবে তার। তার সারাজ ভাই প্রেমে পড়েছে? বক্ষঃস্থলে মোচড় দেয় তার। ত্রসন গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘কার প্রেমে পড়েছ?’

সারাজ চোখ ঘুরিয়ে পুতুলের আতঙ্কিত মুখের দিকে চেয়ে ম্লান হাসে। তারপর আবার সামনে চেয়ে বলে,

‘একটা ছোট্ট প্রতিমার। কী মিষ্টি দেখতে সে। হরিণনয়নার ন্যায় অক্ষিযুগল মেলে সে যখন আমাকে দেখে, চিত্ত জুড়ে তখন আমার শীতল স্রোত বয়ে যায়। কী অনবদ্য সেই নেত্র জোড়া। মনে হয়, এই হরিণাক্ষীর গভীরে তলিয়েই আমার একদিন প্রাণনাশ হবে। তবে, তার থেকেও আমাকে অধিক প্রলুব্ধ করে কি জানিস? ওর ওষ্ঠযুগল।’

থামে সারাজ। না, আর বলতে পারছে না। মনটা এবার বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। ঐদিকে আরেক মেয়ের যে জান ওষ্ঠাগত সেই খেয়াল তার নেই। পুতুলের গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। সারাজের দৃষ্টিগোচর হওয়ার আগেই সন্তর্পনে সেটা মুছে ফেলে সে। অন্যদিকে চেয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলে,

‘কে সে মেয়ে? আমি কি চিনি তাকে?’

সারাজ রগড় সুরে বলে উঠে,

‘অবশ্যই চিনিস।’

পুতুল চট করে উঠে বসে। মাথার ভেতর সব এলোমেলো লাগছে। সে ঐ মেয়েকে চেনে? তারমানে তার পরিচিত কেউ। কে হতে পারে? পুতুল চিন্তন মনে ফের বাইরে তাকায়। দুশ্চিন্তা আর বিষাদ অন্তরিন্দ্রিয় চিবিয়ে খাচ্ছে তার। একটু পরপর নাক টানছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। বেঁচে থেকে আর কী লাভ? সেই তো সারাজ ভাইকে তার হারাতে হলো। এবার ঐ কামাল মিয়া ছাড়া তার আর গতি নেই। পুতুলের গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। পাশে সারাজ বিধায় সেটাও এখন অসম্ভব। রাগে, ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে সে। এতদিনের এত প্রেম, এত আবেগ সব বৃথা তার।

_____

সারাজের গাড়ি এসে থামে তাদের গন্তব্যে। পুতুল হম্বি তম্বি দেখিয়ে গাড়ি থেকে নামার জন্য উদ্যত হতেই সারাজ মৃদু আওয়াজে বলে উঠে,

‘ঐ মেয়েটা কে, জানতে চাস না?’

পুতুল দাঁত খিঁচে চেয়ে বলল,

‘না, জানতে চাই না।’

বলেই গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে যায় সে। সারাজ পেছন থেকে আওয়াজ তুলে বলে,

‘সমস্যা নেই। আগামী সপ্তাহেই তার সাথে তোর পরিচয় করিয়ে দিব।’

বলেই গাড়ি নিয়ে ফের বেরিয়ে যায় সে।

.

পুতুল বাড়ি এসে ধুমুর ধুমুর শব্দ করতে করতে নিজের রুমে চলে যায়। এত জোরে জোরে শব্দ শুনে মেহুল তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে দেখে, পুতুল এসেছে। মেহুল প্রসন্ন হেসে তার রুমের কাছে যায়। তখনই পুতুল গর্জে উঠে বলে,

‘মা, আগামী তিন ঘন্টা আমার রুমে কেউ এলাউ না। কেউ না মানে কেউ না। তিন ঘন্টা পর আমি নিজে নিচে গিয়ে খেয়ে আসব। এর আগে কেউ যেন আমার রুমের ধারে কাছেও না আসে। বুঝেছো?’

মেহুল চোখ পাকিয়ে তাকায়। পুতুল সেসবে পাত্তা না দিয়ে বলে,

‘তোমার ঐসব চোখ পাকানোতে বাবা ভয় পেলেও, আমি পাই না। সো, এসব করে লাভ নেই। যাও, তুমি তোমার রুমে গিয়ে চুপচাপ টিভি দেখো। তিন ঘন্টা পর আবার দেখা হচ্ছে। টাটা।’

বলেই রুমের দরজা আটকে দেয় সে। মেহুল মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মেয়ে আর তাকে শান্তি দিল না।

____

‘আপনি তো দেখছি মারাত্মক ফাজিল মেয়ে। একটা মানুষকে কেউ এতবার কল দেয়?’

মেসেজটা দেখেই মেজাজ তুঙ্গে উঠে লীনার। মানে ফাজলামো পেয়েছে না-কি? কাল থেকে তাকে লাগাতার জ্বালিয়ে এসে, এখন আবার তাকেই ফাজিল মেয়ে বলছে। কী অভদ্র, ভাবা যায়। লীনা সঙ্গে সঙ্গে মেসেজের জবাবে লেখে,

‘এই যে মি. , আপনি কে বলুন তো? কাল থেকে জ্বালিয়ে এখন আবার আমাকেই ফাজিল বলছেন? আমি ফাজিল হলে আপনিও হলেন বিরাট বড়ো মাপের একজন অভদ্র লোক।’

তার মেসেজ পাঠানোর পরপরই উত্তর আসে,

‘কী করব বলুন? আজকাল ভালো ছেলেদের মেয়েরা খুব একটা দাম দেয়না। তাই একটু অভদ্র হওয়ার ট্রাই করছি। তবে আমি কিন্তু খুব বেশি অভদ্র না। একটুখানি অভদ্র। আপনি চাইলেই আমার সাথে মানিয়ে নিতে পারবেন।’

মেসেজ পড়েই ভ্রু কুঁচকায় লীনা। এখানে মানিয়ে নেওয়ার কথা আসছে কোথ থেকে? সে আবার মেসেজে লেখে,

‘আশ্চর্য, এখানে মানিয়ে নেওয়ার কথা আসছে কোথ থেকে? মনে হচ্ছে যেন, আমি আপনাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি।’

তার মেসেজেই বিপরীতে অপর পাশ থেকে উত্তর আসে,

‘বলা তো যায় না, কখন কী হয়।’

তার পরপরই একটা চোখ টিপের ইমুজি আসে। লীনা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মেসেজটার দিকে। অভদ্রের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছে লোকটা। লীনা তেতে উঠে সঙ্গে সঙ্গেই সেই নাম্বারটা ব্লক করে দেয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আর একবার তাকে বিরক্ত করতে আসলে একেবারে পুলিশ কেইস ঠুকে দিবে। অভদ্র কবি কোথাকার।

________

ঠিক তিন ঘন্টা পরেই পুতুল নিচে নামে। ডাইনিং এ বসে মেহুলকে চেঁচিয়ে ডেকে বলে,

‘মা, খাবার দাও।’

মেহুল রুম ছেড়ে বেরিয়ে ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়ায়। মেয়ের দিকে গভীর মনঃসংযোগ করে বলে,

‘কেঁদেছিস তুই?’

পুতুল নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,

‘হু।’

‘কেন?’

‘এমনি। অনেকদিন ধরে কাঁদছিলাম না বলে কীভাবে কাঁদতে হয় ভুলে গিয়েছিলাম; তাই কতক্ষণ প্র্যাকটিস করে আসলাম। বিয়েতে তো কাঁদতে হবে, তাই না?’

মেহুল ফিচেল হেসে ফলে,

‘আমার তো মনে হচ্ছে, তুই একদমই কাঁদবি না। বরং নাচতে নাচতে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবি।’

পুতুল ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলে,

‘হয়েছে। আমি এই ব্যাপারে আর কিছু শুনতে চাই না। খাবার দাও, খিদে পেয়েছে।’

মেহুল একজন গৃহকর্মীকে ডেকে বলল, রান্নাঘর থেকে সব খাবারগুলো বেড়ে নিয়ে আসতে। তারপর সেও একটা চেয়ার টেনে বসল ঠিক পুতুলের মুখোমুখি। পুতুল খালি প্লেটে আঙ্গুল দিয়ে খুটে যাচ্ছে। চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মারাত্মক ক্ষোভ ভেতরে তার। মেহুল ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ফেলে। কোমল গলায় বলে,

‘কামাল মিয়াকে তুই বিয়ে করতে চাস না, তাই না?’

পুতুল চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়। মায়ের চোখ মুখ দেখে চিত্তের খবর সে ঠাহর করতে পারছে না। তাই জিজ্ঞেস করে,

‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’

‘আমরা তোর উপর কোনদিনই কোনোকিছু চিপিয়ে দেইনি। সবকিছু হয়েছে তোর মর্জিতেই। আর তাই এই বিয়েটাও আমরা তোর উপর চাপিয়ে দিব না। তুই যা বলবি তাই হবে। বল, কী চাস তুই? বিয়েটা হোক?’

পুতুল হতাশ সুরে বলে,

‘না।’

মেহুল পরপরই বলে উঠে,

‘কেন? অন্য কাউকে পছন্দ করিস?’

মাথা নুইয়ে ফেলে পুতুল। মায়ের কাছে কোনদিনও কোনোকিছু লুকাইনি, কেবল সারাজের প্রতি তার অনুভূতি ছাড়া। কিন্তু, আজ ইচ্ছে হচ্ছে সেটাও বলে দিতে। পরক্ষণেই আবার ভাবছে, লাভ কী? সারাজ ভাই তো অন্যকাউকে ভালোবাসে। পুতুলের বুক চিরে বেরিয়ে আসে রুদ্ধশ্বাস। সে মায়ের দিকে চেয়ে বলে,

‘আমার পছন্দ অপছন্দে এখন আর কিছুই যায় আসে না, মা। আমি এমনিতেও তাকে হারিয়ে ফেলেছি।’

‘কাকে? কার কথা বলছিস তুই?’

মেহুল অধীর গলায় প্রশ্ন করে। পুতুলের নতজানু। মায়ের চোখের দিকে চেয়ে বলতে পারবে না। বিব্রত হচ্ছে ভীষণ। সে মৃদু আওয়াজে বলে,

‘সারাজ ভাই।’

কাঙ্খিত নাম শুনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে মেহুল। তারপর প্রসন্ন হেসে পুতুলকে জিজ্ঞেস করে,

‘সারাজকে পছন্দ করিস?’

‘হু।’

‘বিয়ে করবি ওকে?’

পুতুল টলমল চোখে চেয়ে বলে,

‘কিন্তু, উনি অন্য কাউকে পছন্দ করেন।’

সেই কথা শুনে মেহুল সশব্দে হাসে কতক্ষণ। পরে হাসি থামিয়ে রয়ে সয়ে বলে,

‘ভেবে নে, বিয়ে ফাইনাল। আজ থেকে ঠিক দশ দিন পর।’

হতভম্ব হয়ে তাকায় পুতুল। মা কী বলছে এসব? তার তো বোধগম্য’ই হচ্ছে না কিছু। আজ থেকে দশ দিন পর কি তার আর সারাজ ভাইয়ের বিয়ে? এটা কি আদৌ সত্যি হবে? না-কি মা তার সাথে মজা করছে?

চলবে…

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৫।

বাংলার বর্ষপঞ্জিতে ১৪৫৭ বঙ্গাব্দের ইতি টেনে আগমন ঘটল ১৪৫৮ বঙ্গাব্দের। পহেলা বৈশাখ আজ। চারদিকের নর-নারীরা আজ তাই সেজেছে শুভ্র আর লালিমাতে। ঐ বড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছটাও আজ তাদের সাথে তাল মিলিয়ে ভরে উঠেছে রক্তিম আলিঙ্গনে।

পুতুল আর লীনা দুজনেই আজ লাল পাড়ের শ্বেত শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে। হাত ভর্তি লাল সাদা চুরির বাহার। ললাটের ঠিক মাঝ বরাবর একটা ছোট্ট লাল রঙা টিপ। হরিণের ন্যায় অক্ষিযুগলে টানা নিকষ কাজল। পাতলা ফিনফনে ওষ্ঠ জোড়া সেজেছে তাদের টকটকে লাল ওষ্ঠরঞ্জনীতে।

______

পুতুল নিঃস্পৃহ সুরে বলে উঠল,

‘ইশ, এই শাড়ি সামলানো এত মুশকিল কেন?’

লীনা স্বাভাবিক স্বরে বলে,

‘কই, আমার তো কষ্ট হচ্ছে না।’

‘আর আমার মনে হচ্ছে, এই বুঝি শাড়ি খুলে যাবে।’

‘আচ্ছা চল, ওয়াশরুমে গিয়ে আবার ঠিক করে দিচ্ছি।’

_______

অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটল “এসো হে বৈশাখ” গানের সুরে। সেই দলীয় সঙ্গীতে পুতুল আর লীনাও ছিল। দলীয় সঙ্গীতের পর্ব চুকিয়ে উপস্থাপক একে একে উপস্থিত সকলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়। অতঃপর শুরু হয় অনুষ্ঠানের মূল পর্ব। ভার্সিটির ভি.সি সহ প্রধান অতিথির বক্তৃতা পাঠ শেষ হতেই সাংস্কৃতিক পর্বের আগমন ঘটে। এই পুরো সময়েই লীনা আর পুতুল চেয়ারে বসে উপভোগ করছিল। এবার তো তাদের পারফরম্যান্সের পালা। লীনার বুকে ব্যথা উঠে ততক্ষণাৎ। পুতুলের হাত টেনে ত্রসন গলায় বলে,

‘দোস্ত, আমার তো ভয় করছে। যদি স্টেজে গিয়ে সব ভুলে যাই?’

‘ধুর, তেমন কিছুই হবে না। স্টেজে দাঁড়িয়ে ভাববি তোর সামনে কেউ নেই। তুই তোর মতো বলে যাবি। একদম স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। ডানে বামে কিচ্ছু দেখবি না, বুঝেছিস?’

লীনা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। পুতুলের সাথে গিয়ে দাঁড়াল স্টেজের পেছন দিকটাই। সেখানেই সবাই উপস্থিত। সবাই যার যার মতো পারফরম্যান্সের চিন্তায় মত্ত। হঠাৎ সেই মূহুর্তে লীনার মাহাতের কথা স্মরণ এল। এই লোকটা কোথায়? সকাল থেকে তো চোখেই পড়ল না। তার ডিপার্টমেন্টের অনুশীলন নিয়ে এতদিন এত হম্বিতম্বি দেখিয়ে, এখন পারফরম্যান্সের বেলাতেই উধাও। আশ্চর্য! লীনার আকস্মিক মন খারাপ ঘটল। কেন যেন মন বলছে, লোকটা সামনে থাকলে সাহস পেত সে।

একে একে সবাই গিয়ে তাদের পারফরম্যান্স করে এসেছে। এবার লীনার পালা। তার পরেই পুতুল। লীনার হাত পা কাঁপছে। বক্ষঃস্থলের কম্পন বেড়েছে। পুতুল লীনাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘আল দ্য বেস্ট, দোস্ত।’

ত্রস্ত হাসে সে। হাতের ফোনটা পুতুলের দিকে বাড়াতেই টুং করে একটা শব্দ হয়। লীনা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখে একটা মেসেজ। চোখের দৃষ্টি গভীর হয়। মেসেজে লেখা, “অল দ্য বেস্ট।” আবারও আননোন নাম্বার। আশ্চর্য, সে না ঐ নাম্বারটা ব্লক করছিল, তবে এই নাম্বারটা কার। এতকিছু ভাবার আগেই, উপস্থাপক তার নাম ডেকে ওঠে। লীনা ব্যস্ত হয়ে তার ফোন আর পার্স পুতুলের হাতে দিয়েই স্টেজে দিকে পা বাড়ায়।

এই প্রথম এত মানুষের সামনে মাইক ধরে দাঁড়িয়েছে লীনা। চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। মানুষগুলো এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। লীনা চোখ পিটপিট করে হালকা ঢোক গিলে। হঠাৎই দৃষ্টি আটকায় স্টেজ থেকে কিছুটা সামনের এক পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকা এক সুদর্শন যুবকের উপর। লীনা আচমকা এই যুবককে দেখে চোখ সরাতে পারে না। শুভ্র পাঞ্জাবী গায়ে কী চমৎকার লাগছে তাকে। অধরে ছড়িয়ে থাকা নিঁখুত হাসিটা যেন কেবল তার’ই জন্য। হঠাৎ ছেলেটা চোখের ইশারায় তাকে কী যেন বোঝাল। লীনা বুঝল, ছেলেটা তাকে শুরু করতে বলছে। স্মিত হাসে লীনা। এই তো সে সাহস পেয়েছে। এবার সে নির্দ্বিধায় এই আবৃত্তি করে ফেলতে পারবে।

আবৃত্তি শেষ হতেই জনসমাগমের মাঝে করতালির রোল পড়ল যেন। সবার এত উদ্দীপনা দেখে ভীষণ খুশি হলো লীনা। যাক, সে তাহলে পেরেছে।

লীনা স্টেজ থেকে নামতেই পুতুলের ডাক পড়ল। লীনাও তাকে জড়িয়ে ধরে “অল দ্য বেস্ট” জানাল।

যতই আত্মবিশ্বাস থাকুক না কেন, এই স্টেজে দাঁড়ালে, হাত পা সবারই কাঁপে। পুতুলেরও এই মুহুর্তে একই অনুভূতি হচ্ছে। গলা কাঁপছে তার। তাও প্রচন্ড সাহস নিয়ে সুর তুলে সে,

“মায়াবন বিহারিণী হরিনী,
গহন-স্বপন-সঞ্চারিণী।
কেন তারে ধরিবারে করি পণ অকারণ
মায়াবন বিহারিণী….

থাক্ থাক্, নিজ-মনে দূরেতে
আমি শুধু বাঁশরির সুরেতে
থাক্ থাক্, নিজ-মনে দূরেতে
আমি শুধু বাঁশরির সুরেতে
পরশ করিব ওর প্রাণমন
অকারণ,
মায়াবন বিহারিণী…”

পুতুলের গান শেষ হতেই আবারও চারদিক করতালির শব্দে রমরমা হয়ে উঠে। স্টেজ থেকে নেমে আসে পুতুল। লীনা খুশিতে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘বাহ, কী গেয়েছিস? মনে হচ্ছিল প্রফেশনাল সিঙ্গার। তোকে না এই গান নিয়ে কিছু একটা করার দরকার।’

পুতুল হেসে বলে,

‘আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে, আর পাম দিস না। চল এখন ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খেয়ে আসি। সকাল থেকে এক্সাইটমেন্টের ঠেলায় কিছুই খেতে পারিনি।’

‘হ্যাঁ, আমিও। চল।’

_______

ক্যান্টিন থেকে অল্প স্বল্প কিছু খেয়ে পুতুল আর লীনা ভার্সিটির পাশের বাগানটার কাছে যায়, ছবি তুলতে। আধ ঘন্টার মধ্যে প্রায় শো খানেকের মতো ছবি তুলে ফেলেছে তারা। বেচারা ফোনও বোধ হয় এখন ভেতরে ভেতরে কষ্টে মরে যাচ্ছে। মনে মনে হয়তো ভাবছে, এই নারী জাতির কবলে পড়লে যে কারোর’ই রেহাই নেই।

পুতুল ছবিগুলো দেখে বলল,

‘আরে দোস্ত, আমাদের তো নায়িকার চেয়ে কিছু কম লাগছে না।’

লীনা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,

‘আসলেই-রে, আমরা কী সুন্দর দেখেছিস!’

পেছন থেকে তখনই কেউ গলা ঝেরে বলে উঠে,

‘বাহ, সেল্ফ সেটিসফেকশন। ব্যাপারটা দারুণ কিন্তু।’

দুজনেই ঘুরে তাকায়। মাহাতকে দেখে পুতুল প্রসন্ন হেসে বলে,

‘শুভ নববর্ষ, ভাইয়া। আপনি কোথায় ছিলেন, সকাল থেকে তো আপনাকে দেখলাম’ই না।’

‘ছিলাম আশেপাশেই। খেয়াল করেননি হয়তো। বাই দ্য ওয়ে, আপনাদের দুজনের পারফরম্যান্স’ই কিন্তু দারুণ হয়েছে।’

পুতুল আর লীনা দুজনেই এক সঙ্গে বলে,

‘ধন্যবাদ।’

মাহাত এবার লীনার দিকে দৃষ্টিপাত করে। লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে একেবারে খাঁটি বাঙালি বধূ লাগছে তাকে। এবার একটা ছোট্ট ঘোমটা টানলেই হতো। মাহাত তখন হুট করেই বলে উঠল,

‘এই পুতুল, আমাকে আর লীনাকে একটা ছবি তুলে দিন তো?’

অকস্মাৎ এমন কথা শুনে লীনা আর পুতুল মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। লীনা মাথা চুলকে বিভ্রান্ত সুরে বলে,

‘আমার সাথে কেন ছবি তুলবেন, ভাইয়া?’

‘ইচ্ছে হয়েছে তাই। এদিকে এসো দাঁড়াও।’

আশ্চর্য! প্রথমে ছবি তুলতে চাওয়া। এখন আবার আপনি থেকে ডিরেক্ট তুমিতে? এই লোকটার কী হলো আজ?

লীনার বোকার মতো চাউনি দেখে মাহাত বিদ্বিষ্ট সুরে বলল,

‘কী হলো? আমার পাশে এসে দাঁড়াও।’

লীনা পুতুলের দিকে তাকায়। পুতুলও হতবিহ্বল। লীনা ধীর পায়ে গিয়ে মাহাতের পাশে দাঁড়ায়। তবে মাঝে তাদের তিন ফুটের দূরত্ব।

মাহাত ফের বিক্ষিপ্ত সুরে বলল,

‘মা বাবার মুখে শুনেছিলাম, ২০২০ সালের দিকে নাকি পৃথিবীতে করোনা নামের এক ভাইরাসের আগমন ঘটেছিল। তাই সেই সময় মানুষ এই ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য এমন তিন ফুটের দূরত্ব মেনে চলতো। তবে এখন তো আর সেই ভাইরাসের নাম গন্ধও নেই। তাহলে তুমি এমন তিন ফুট দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমরা কাছে আসলে কি করোনা লাগবে গায়ে? কাছে এসো।’

শেষে কিঞ্চিৎ ধমক দিয়েই উঠে মাহাত। লীনার মাথা ঘুরাচ্ছে। এই লোকটা এমন করছে কেন? এমন একটা ভাব করছে, যেন সে তার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র প্রেমিক।

লীনা ত্রস্ত পায়ে আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তাও আরো এক ফুটের মতো দূরত্ব রয়ে গিয়েছে। মাহাত ফুঁস করে নিশ্বাস ফেলে সেই দূরত্বও ঘুচিয়ে দেয়। তারপর পুতুলের দিকে হেসে বলে,

‘নিন, এবার ক্লিক করুন।’

মাহাতের মুখে চমৎকার হাসি। আর লীনা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। ছবি তুলে পুতুল হেসে বলল,

‘তুলেছি, ভাইয়া।’

লীনা ততক্ষণাৎ সরে আসতে নিলেই মাহাত আবার বলে উঠে,

‘দাঁড়াও।’

লীনা থমকে দাঁড়াল। খানিকটা ক্ষুব্ধ সে মাহাতের আচরণে। মাহাত তখন তার পকেট থেকে এক গুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া ফুল বের করল। সেটা এক হাতে চেপে লীনার দিকে এগিয়ে দিয়ে, বিমোহিত সুরে বলে উঠল,

‘আমায় বিয়ে করবে, লীনা?’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে