#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২০।
চোখ খোলার প্রারম্ভিক মুহুর্তেই সবকিছু খানিকটা ঝাপসা ঠেকল পুতুলের। বার কয়েকবার চোখ পিটপিট করল তাই। এক পল অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। এই তো সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
আশেপাশে চোখ বুলাল। এটা তো তার রুম। চট করে উঠে বসল পুতুল। হ্যাঁ, এটা তো তারই রুম। সে এই রুমেই এতক্ষণ শুয়ে ছিল? তবে কাজী অফিসে কখন গিয়েছে? কীভাবে গিয়েছে? আশ্চর্য, তবে কি সে যা দেখেছিল সব স্বপ্ন?
পুতুল ব্যাকুল হয়ে পা বাড়াল রুমের বাইরে। বাইরেও কেউ নেই কেন? মা কোথায়?
‘মা, ও মা। কোথায় তুমি?’
পুতুল গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছে। মেহুল রুম থেকে বেরিয়ে এসে বিরূপ সুরে বলল,
‘কী সমস্যা তোর? সবসময় এভাবে চেঁচাস কেন?’
ভ্রু কুঁচকাল পুতুল। জিজ্ঞেস করল,
‘আমি এখানে কেন, মা? আমি তো সারাজ ভাইয়ের সাথে বাইরে ছিলাম।’
মেহুল ভীষণ রকম বিদ্বিষ্ট। সে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
‘জি, ছিলেন। তারপর হুদাই বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলেন। তাই সারাজ এনে বাসায় রেখে গিয়েছে। আর বলে গিয়েছে, শাক সবজি, ফলমূল ভালো ভাবে গেলাতে। সামান্য মাথা ব্যথায় কেউ বেহুঁশ হয়ে যায়? আর তোর তো এমন মাথা ব্যথার ব্যারাম ছিল না। তাহলে, এই ব্যারাম আবার কবে আমদানি করলি?’
এতক্ষণে পুতুলের বোধদয় হয়। ব্যাপারটা এবার পানির মতো সোজা তার কাছে। কী চতুর লোক উনি। এমন ভাবে গেইম খেললেন, যেন সাপও মরে, আর লাঠিও না ভাঙে। আচ্ছা, তাতে কী? পুতুল ও কোনো ছোটখাটো খেলোয়াড় না।
পুতুল দাঁত বের করে হাসল। তার এই হাসির কোনো যৌক্তিক কারণ মেহুল উদঘাটন করতে পারল না। তাই কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
‘কী সমস্যা, হাসছিস কেন?’
চোখে মুখে মেকি লজ্জা ভাব উন্মীলিত করে সে শুধাল,
‘মা, বাবা কী বলেছেন? বিয়েটা হচ্ছে তো?’
মেহুল নির্বাক। নিমিষ চেয়ে রইল মেয়ের দিকে। তার মুখের অবিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে, যেন এর থেকে আশ্চর্যজনক প্রশ্ন সে এর আগে জীবনেও শুনেনি। মা’কে অনুসক্ত দেখে পুতুল ফের প্রশ্ন করল,
‘কী হলো, মা? কিছু বলছো না কেন?’
‘তুই কি সত্যিই বিয়েটা করতে চাস?’
সংশয় নিয়ে শুধাল মেহুল। পুতুল ফের লজ্জিতাবস্থার ন্যায় মৃদু সুরে বলল,
‘হ্যাঁ, অবশ্যই। ঐ ছেলেকে আমার পছন্দ হয়েছে?’
‘ঐ রকম হাবা টাইপ একটা ছেলেকে তোর পছন্দ হয়েছে?’
বিস্মিত মেহুল। পুতুল হেসে বলল,
‘হ্যাঁ, পছন্দ। আর খবরদার উনাকে হাবা টাবা কিছু বলবে না। উনি হলেন সহজ সরল মানুষ। আর আমার জীবনে এমন একজন সহজ সরল মানুষের খুব প্রয়োজন। এখন তুমি আর বাবা জলদি জলদি বিয়ের আয়োজনটা করে ফেল। শুভ কাজ ফেলে রেখে লাভ কী, বলো?’
মেহুলকে অথৈয় ভাবনায় ডুবিয়ে পুতুল নেচে নেচে নিজের রুমে প্রবেশ করে। আজ মনে হচ্ছে চিত্ত তার অন্যরকম রঙে রঞ্জিত হয়েছে। আহা, এত সুখ এত আনন্দ কোথায় রাখবে সে? সারাজ ভাই তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন? তার মানে তার ধারণা, তার ভাবনা মিথ্যে নয়। সারাজ ভাইও তাকে পছন্দ করেন?
খুশিতে প্রাণ যায় যায় পুতুলের। হর্ষাবিষ্ট চিত্তে রুম জুড়ে নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে সে। আজ তার ঈদের দিন। সে তাই গলা ছেড়ে গান ধরল,
“মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ…..”
______
‘বাবা, তুমি কি উনাদের সাথে কথা বলেছো?’
রাবীর চোখ তুলে জিজ্ঞেস করে,
‘কাদের সাথে?’
‘আরে, পাত্রপক্ষের সাথে।’
‘না, কেন?’
‘ওমা, উনারা তো অপেক্ষা করছেন। তুমি তোমার মত জানাবে না? আমি তো রাজি, বাবা। তুমিও রাজি হয়ে উনাদের জানিও দাও।’
রাবীর চমকে খেতে ভুলে যায়। বিহ্বল কন্ঠে বলে উঠে,
‘তুমি রাজি? তুমি এখনই বিয়ে করতে চাও? অনার্স শেষ করবে না?’
‘করব তো। বিয়ের পর করব।’
পুতুল যেন প্রকৃতিবিরুদ্ব আচরণ করছে। এত সহজেই সে বিয়েতে কী করে রাজি হয়ে গেল? সেদিনও তো এত ক্রুদ্ধ ছিল সে। আর আজ হঠাৎই বিয়ের জন্য এমন উতলা হয়ে উঠল? ব্যাপারটা তাদের মাত্রাধিক চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
পুতুল খেয়ে নিজের রুমে ফিরে যায়। রাবীর খাওয়া ফেলে বলে,
‘সবকিছু হয়েছে আপনার জন্য? কী দরকার ছিল, মেয়েটার মাথায় এমন বিয়ের ভূত ঢোকানোর?’
মেহুল এমন ভাবে চাইল যেন সে নিঃসহায়। তারই বা দোষ কীসের? সে কি জানতো, সবকিছু এমন হিতে বিপরীত হবে। যা চেয়েছিল তা তো হলোই না, উল্টো এখানে সবকিছু উল্টে তারাই কেইস খেয়ে গেল।
______
সারাজকে পুতুল ক্রমাগত কল দিয়ে যাচ্ছে। অন্তরিন্দ্রিয়তে কেমন একটা তীক্ষ্ণ ব্যথার উৎপত্তি হয়েছে যেন। এই ব্যথা তাকে বর্তমানে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। সারাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলা ভীষণ জরুরি। কিন্তু, ঐ মূর্খ ব্যক্তিটা বুঝলেই না সেসব।
প্রায় ছাব্বিসটার মতো কল দিয়েছে সে। আর চারবার দিবে। বরাবর ত্রিশটা হওয়ার পর আর দিবে না। তারপরও ফোন রিসিভ না হলে, অতঃপর সে নাকে মুখে কাঁথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।
তাকে আর কষ্ট করে ঘুমাতে হলো না। আটাশ নাম্বার কলের মাথায় সেটা রিসিভ হলো। পুতুল তখন বিক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠল,
‘কল রিসিভ করছিলে না কেন?’
‘সেই কৈফিয়ত তোকে দিব না-কি?’
সারাজের স্বর ভাবাবেগ শূন্য। এমন একটা ভাব যেন কিছুই হয়নি। অথচ, ছয় ঘন্টা আগেও যদি সে কবুল বলে দিত, তবে বর্তামানে হতো সে সারাজের বউ। কথাটা ভাবতেই শরীর জুড়ে অন্যরকম শিহরণ খেলে গেল তার। সে হতো তার সারাজ ভাইয়ের বউ? সারাজ আহমেদের বউ পুতুল আহমেদ? লজ্জায় এবার মরেই যাবে সে। ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল।
সারাজ বাজখাঁই গলায় বলল,
‘আছিস? নাকি আবারও বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিস? তোকে দিয়ে তো আর ভরসা নেই।’
পুতুল সশব্দে শ্বাস ত্যাগ করল। কেন যে তখন সে বেহুঁশ হলো? বড্ড আফসোস হচ্ছে। এমন মারাত্মক একটা মুহুর্তে কী করে সে বেহুঁশ হতে পারল, কী করে? মাথা চাপড়ে বসল পুতুল। মিনমিনিয়ে বলল,
‘সারাজ ভাই।’
সারাজ চোখ মুদে নিল। এই যে এই ছোট্ট ডাক তার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলে সেটা কি এই নির্বোধ বালিকা বোঝে না? কেন বার বার এমন কোমল স্বরে তাকে ডেকে এভাবে আঘাত করে? সে যে এই আঘাতের তোপ আর সইতে পারছে না।
‘সারাজ ভাই, তখন তুমি কী করতে যাচ্ছিলে? তুমি কি সত্যিই আমাকে বিয়ে করতে?’
‘তোর কী মনে হয়?’
‘তুমি বলো না। আমার মনে হওয়া, না হওয়াতে কী আসে যায়।’
ফোনের ওপাশে মৃদু হাসে সারাজ। সেই হাসি পুতুলের দৃষ্টিগোচর হয় না। এক সেকেন্ড থেকে সেই হাসি আমার মিইয়ে যায়। সারাজ শ্রান্ত সুরে বলে,
‘সবসময় কেন সব উত্তর মুখে বলেই দিতে হবে? তুই না আসলেই বড্ড নির্বোধ, পুতুল। হয় কিছু বুঝিস না, নয়তো ইচ্ছে করেই বুঝতে চাস না। শোন, তুই বুঝতে না চাইলে আমি নিজ থেকে তোকে কখনোই বোঝাব না। তোকেই বুঝে নিতে হবে সবকিছু। আর এই ব্যাপারে তুই আমার পক্ষ হতে কখনোই কোনো সাহায্য পাবি না।’
পুতুল জড়ীভূত হয়ে বসে আছে। মাথার ভেতরে চক্কর খাচ্ছে। বুকে শব্দ হচ্ছে খুব। নিউরন নিউরন মিলে যুদ্ধে নেমেছে হয়তো। এই কথাগুলোকে ভেঙে ভেঙে বুঝতে হবে। তাই সময় প্রয়োজন। সারাজ ভাই বলেছেন, তাকে সাহায্য করবে না। ঠিক আছে, সেও চাইবে না কোনো সাহায্য। এবার থেকে নিজে নিজেই সব বুঝে নিবে।
সারাজ দ্বিতীয় আর কোনো কথা না বলে কলটা কেটে দেয়। তার নিজের অস্তিরতাই তো কমছে না এখনও। আজ কী করতে যাচ্ছিল সে? এভাবে সে তার পুতুলকে বিয়ে করবে? না, এমনটা তো সে ভাবেনি। তার আর তার পুতুলের বিয়ে হবে মহাসমারোহে, এমন ঠুনকো ভাবে না।
_________
সারারাত নির্ঘুম কাটাল পুতুল। মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ চলছিল কেবল সারাজের কথাগুলোই। সারাজ ভাই কী বোঝাতে চাইছেন, হয়তো সে বুঝেছে। আবার, একটু পর মনে হচ্ছে, না, বুঝেনি। কী যে এক বিপদ। লোকটা সহজ ভাবে বললেই তো পারেন, সে পুতুলকে পছন্দ করেন। তাকেই বিয়ে করতে চান। সেসব না করে, এখানে কাব্যিক কথাবার্তা শুরু করেছেন। পুতুল ঠিক করল, যা বুঝেছে, বুঝেছে; আর কিছু বুঝবে না। বাকিটা সারাজ ভাই নিজে এসে তাকে বোঝাবেন, তারপর সে বুঝবে; এর আগে না।
সকালে অফিসের জন্য বের হওয়ার সময় সারাজ মায়ের গলা শুনতে পায়। মা যেন কার সাথে খুব উচ্চ সুরে ফোনে কথা বলছে। পুতুলের নাম শুনেই খান খাড়া করে সারাজ। শুনতে পায় রিতা বলছে,
‘তাহলে রাবীর ভাইও বিয়েতে রাজি? যাক, আলহামদুলিল্লাহ। এবার সুষ্ঠুভাবে বিয়েটা হলেই হয়।’
কথাটা গানে বারি খেয়ে সোজা মস্তিষ্কে গিয়ে হরতাল বাঁধিয়ে দেয়। মারাত্মক মেজাজ চটে সারাজের। তারমানে, কাল রাতের কোনো কথাই পুতুলের বোধগম্য হয়নি? সে তার সিদ্ধান্তেই অটুট? সে বিয়ে করবেই। রাগে সারাজ কাঁধের ব্যাগটা সোফায় ছুড়ে মারে। অতঃপর ভীষণ ক্রোধ নিয়ে পা বাড়ায় মায়ের রুমের দিকে।
চলবে…
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২১।
‘মা, তোমার সাথে আমার কথা আছে।’
রিতা ফোন কেটে ছেলের দিকে চাইল। বলল,
‘হ্যাঁ, বল কী বলবি।’
নিশ্বাসের গতি প্রখর হলো সারাজের। অন্তরিন্দ্রিয়তে প্রশ্ন জাগল, আদৌ কথাটা বলা উচিত হবে তো? তার চিত্ত জুড়ে উত্তোলিত প্রেম বলল, অবশ্যই বলা উচিত। নয়তো সব হারিয়ে নিঃস্ব হতে হবে তোকে। চিত্তের এহেন প্রবচন সারাজ অগ্রাহ্য করতে পারল না। সত্যিই যদি এই বিলম্বতায় সব হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয় তাকে, তখন?
সারাজ নিজেকে ধাতস্ত করে মৃদু সুরে বলল,
‘মা, আমি বিয়ে করব।’
রিতা আঁতকে উঠল। চোখ জোড়া এমন আকৃতি করল, যেন এই মুহুর্তেই সেগুলো তাদের স্থান ত্যাগ করে বেরিয়ে আসবে। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে অপ্রত্যয় সুরে শুধাল,
‘আমি কি আদৌ সব ঠিকঠাক শুনছি, বাবা? আমার কানে আবার কোনো সমস্যা হয়নি তো?’
সারাজ ভ্রু বাঁকায়।
‘আহ মা, মজা করো না তো। আ’ম সিরিয়াস। আমি সত্যিই বিয়ে করতে চাই।’
রিতা ঠোঁট গোল করে ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। মুখ দেখে চিত্তহরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। সারাজ অপ্রসন্ন সুরে বলল,
‘মা, কিছু বলবে?’
‘হু? হ্যাঁ হ্যাঁ, বলছি। ইয়ে মানে বলছিলাম যে, হঠাৎ বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলি যে?’
‘না নিয়ে আর উপায় কই? আমার আশেপাশের সবাই তো বড্ড নির্বোধ। তাদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে কিছুই দেখে না। তাই আমি একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।’
‘বেশ বেশ। তা বাবা, কাকে বিয়ে করবি? না মানে, পাত্রী ঠিক করা আছে? না-কি আমরা দেখব?’
সারাজ অকপটে বলল,
‘পাত্রী ঠিক করা আছে।’
রিতা একটু নড়ে চড়ে বসল। খুব সিরিয়াস তার ভাব ভঙ্গি। চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘মেয়েটা কে?’
সারাজ দৃষ্টি রাখল মায়ের উপর। বাক্য বিবরণ করতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে। একটু ইতস্তত। তবে সে ভীত নয়। হালকা গলা ঝেরে বলল,
‘পুতুল।’
রিতা বড়ো করে নিশ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে বিশাল পাথর সরে গিয়েছে। আহ, কী শান্তি! শ্বাস প্রশ্বাসও নিচ গতিতে বহমান। এতদিনে গিয়ে একটু স্বস্তি পেল সে।
‘মা, কিছু বলছো না কেন?’
‘হ্যাঁ? আমাকে কি কিছু বলতে হবে?’
‘মা, আমি বলেছি, আমি পুতুলকে বিয়ে করতে চাই।’
রিতা মাথা নুইয়ে কিছু একটা ভাবল। পরে বিষন্ন চোখে ছেলের দিকে চেয়ে বলল,
‘কিন্তু, পুতুলের তো বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।’
সারাজ টুঁটিস্বর কাঠিন্য করে বলল,
‘ঐ বিয়ে ভেঙে দিতে বলো। পুতুলের বিয়ে আমার সাথেই হবে। আর এটাই ফাইনাল।’
বলেই মায়ের কক্ষ হতে প্রস্থান ঘটাল সে। রিতা খুশিতে পারছে না একটু নেচে উঠতে। কিন্তু, বয়সের সাথে এসব ঠিক মানায় না বলে, বসেই রইল সে। সঙ্গে সঙ্গেই মেহুলকে কল লাগাল। এই সুসংবাদটা যে এক্ষুনি মেহুলকে দিতে হবে।
_____
‘আরে, আপনি আমার কথা কেন শুনছেন না?’
লীনা চেয়ার ছাড়ল। বলল,
‘দেখুন, আমার প্র্যাকটিস করা হয়ে গিয়েছে। এখন আমাকে যেতে হবে।’
‘এই তো এখন এলেন। একবার কেবল কবিতাটা পড়লেন। আর তাতেই প্র্যাকটিস করা শেষ? এর আগে আপনি কখনও স্টেজ পারফরম্যান্স করেননি। এটাই প্রথমবার। তাই বারবার প্র্যাকটিস করতে হবে। আমি চাই, আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকটা পারফরম্যান্স যেন নিখুঁত হয়, বুঝেছেন?’
লীনা ফোঁস ফোঁস করছে। এই লোকটাকে একদম তার সহ্য হচ্ছে না। এইদিকে তার খুব জোরে ওয়াশরুম চেপেছে। এখন একবার না গেলেই নয়। অথচ এই তার ছেঁড়া লোক তার কথা মানতেই নারাজ। সে বিদ্বিষ্ট ভঙিতে আবার তার জায়গায় বসল। তার থেকে কিছুটা দূরেই পুতুল তার গানের প্র্যাকটিস করছে। চোখ বুজেই পরপর সুর তুলে যাচ্ছে সে। লীনা খুব করে চাইছে, পুতুল একটিবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করুক। কিন্তু, এই মেয়ে তো তার গান নিয়েই মজে আছে।
আধ ঘন্টা খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রাখল। না, আর সম্ভব না। এবার ওয়াশরুমে না গেলে এখানেই উল্টা পাল্টা কিছু একটা হয়ে যাবে। লীনা চেয়ার ছেড়ে উঠতেই মাহাত তার সম্মুখে এসে দন্ডায়মান হয়। তাকে দেখা মাত্রই লীনার মুখ ভঙিমা পাল্টে যায়। মাহাত জিজ্ঞেস করে,
‘প্র্যাকটিস শেষ?’
‘হু।’
‘ঠিক আছে, একবার আমাকে শোনান।’
লীনা ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
‘এখন শোনানো সম্ভব না।’
‘কেন?’
ভ্রুকুটি হলো মাহাতের। লীনা ঠোঁট কামড়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কী করে বোঝাবে, ভেতরে কী যুদ্ধ চলছে তার। মাহাত সরু চোখে চেয়ে বলে,
‘কী হলো, চুপ কেন?’
‘ইশ, আপনি বুঝতে পারছেন না। আমাকে এক্ষুনি এখান থেকে বেরুতে হবে।’
‘আশ্চর্য! আপনি এমন করছেন কেন? কেন বের হতে হবে? কোনো প্রবলেমে পড়েছেন?’
‘জি, হ্যাঁ। বিশাল প্রবলেমে পড়েছি। এখনই যদি এখান থেকে যেতে না পারি, তবে প্রবলেম সব এখানেই হয়ে যাবে।’
মাহাত হা করে চেয়ে থাকে। মেয়েটা কী বলছে কিছুই তার বোধগম্য না। কিন্তু, তার ঘর্মাক্ত মুখ দেখে এইটুকু বুঝতে পারছে, জটিল কোনো সমস্যা। সে মুখ খুলে কিছু বলতে নিবে, তার আগেই লীনা বলে উঠে,
‘দয়া করে আর কিছু বলবেন না। আমি একটু পর এসে আপনার সব কথা শুনব। এখন আসছি।’
বলেই এক প্রকার ছুটে সে অডিটরিয়াম থেকে বেরিয়ে গেল। আর মাহাত বোকার মতো চেয়ে রইল কেবল।
_______
অডিটরিয়ামের কোথাও লীনাকে না দেখে পুতুল মাহাতের কাছে আসে। জিজ্ঞেস করে,
‘ভাইয়া, লীনা কোথায়? ওকে দেখছি না যে?’
‘আপনার বান্ধবী কিছুক্ষণ আগেই ছুটি বেরিয়ে গেছে। কী একটা প্রবলেম যেন বলছিল। আমি কিছু বলার আগেই উনি লাপাত্তা।’
পুতুল চিন্তায় পড়ে।
‘বলেন কী? আমাকে না বলেই উধাও? কী এমন প্রবলেম ওর? খুব গুরুতর কিছু?’
‘হবে হয়তো। কিছু তো বলেওনি ভালো করে।’
‘আচ্ছা ভাইয়া, আমি ওকে দেখে আসছি।’
পুতুল ফোনে লীনার নাম্বার ডায়েল করতে করতে বাইরে ছুটল। কল রিসিভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উৎকন্ঠিত সুরে সে বলে উঠল,
‘দোস্ত, কই তুই? কী প্রবলেমে পড়েছিস? আমাকে না বলেই চলে এলি কেন? খুব সিরিয়াস কিছু হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, খুব সিরিয়াস। আগামী তিন ধরে আটকে যাওয়া কাজ আজ সম্পন্ন হলো। এখন খুব শান্তি লাগছে।’
পুতুলের মস্তিষ্ক এই কথার মানে বুঝল না। তাই জিজ্ঞেস করল,
‘কী বলছিস? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’
‘দুতালার ওয়াশরুমে চলে আয়। তোকে বুঝিয়ে বলছি।’
বলেই লীনা কল কাটল। পুতুল ভড়কে গিয়ে ভাবল, ওয়াশরুমে গিয়ে বোঝার মতো কী এমন কাজ করল ও?
____
‘এই মেয়ে, তুই আমাকে পরিষ্কার করে বলতো কী হয়েছে?’
‘উফ! বললাম না, তিন দিনের আটকে যাওয়া কাজ আজ সম্পন্ন হয়েছে।’
‘মানে?’
‘মানে, আজ আমার স্টেশন ক্লিয়ার। তিন ধরে অনেক চেষ্টা করেও ক্লিয়ার করতে পারছিলাম না। আজ সেটা পরিপূর্ণ ভাবে ক্লিয়ার হয়েছে। তাই এখন হালকা লাগছে খুব।’
লীনার চোখ মুখ দেখে পুতুলের আর বুঝতে বাকি রইল না, সে কীসের কথা বলছে। চেতে গিয়ে লীনার হাতে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে বলল,
‘ফাজিল মেয়ে, আমি আরও ভাবলাম কী না কী হয়েছে? চিন্তায় ঘাম ছুটে গিয়েছে আমার।’
লীনা উত্তরে দাঁত কেলিয়ে হাসে। পুতুল বলে,
‘চল, মাহাত ভাইয়াও তোর জন্য চিন্তা করছেন।’
‘উনার কেন আমাকে নিয়ে এত মাথাব্যথা বলতো? একটা তো কবিতা আবৃত্তি করতে চেয়েছিলাম, তাও আবার ভার্সিটির প্রোগ্রামে। অথচ এই ভদ্রলোক এমন একটা ভাব করছেন, যেন আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে গিয়ে কবিতাটা আবৃত্তি করব। আশ্চর্য!’
লীনা লোকটার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ। তা দেখে পুতুলের অবশ্য ভারী আনন্দ জাগছে।
তাদের কথার মাঝেই ওয়াশরুমে আরো দুজন মেয়ের আগমন ঘটল। তার মধ্যে একটা মেয়েকে পুতুল চেনে। খুব ভালো ভাবেই চেনে। এটাই সে মেয়ে, যে তার সারাজ ভাইয়ের থেকে নাম্বার নিয়েছিল। তাদের কথোপকথন শুনতে কান খাড়া করল পুতুল। শুনতেও পেল সে। মেয়েটা তার পাশের মেয়েটাকে খুব আফসোসের সুরে বলছে,
‘আমার শালা ভাগ্যটাই খারাপ। ভেবেছিলাম, অবশেষে একটা ক্রাশ পাত্তা দিল। এখন বোধ হয় চুটিয়ে একটা প্রেম করতে পারব। অথচ, সেই ক্রাশের নাম্বার এখনও বন্ধই বলে যাচ্ছে। বেটা বোধ হয় আমাকে ভুল নাম্বার দিয়েছে রে।’
ব্যাস, এইটুকু শুনেই পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল পুতুলের। তার মানে, সে অযথাই সারাজ ভাইকে এত সন্দেহ করছিল। পুনরায় পুরোনো সেই অনুরাগ মস্তিষ্কে চেপে বসল তার। এবার, সে নিশ্চিত; সারাজ ভাই তাকে ঈর্ষান্বিত করার জন্যই এসব করেছেন। খুশিতে চোখ মুখ পুলকিত হয়ে উঠে তার। সারাজ ভাইকে এখনই একটা কল দিতে হবে। বলতে হবে, সে তার সমস্ত চালাকি ধরে ফেলেছে।
চলবে…
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২২।
‘ফোন দিয়েছিলি?’
‘হু, তুমি কি খুব ব্যস্ত?’
‘না, বল।’
পুতুল ঠোঁট কামড়ে হাসে। রগড় সুরে বলে,
‘আমি তো সব ধরে ফেলেছি, সারাজ ভাই।’
সারাজের অক্ষিযুগল স্থির হয়। ভ্রু এর মাঝে পড়ে দৃঢ় ভাঁজ। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘কী ধরে ফেলেছিস?’
পুতুল মিটিমিটি হাসছে। হু, এসেছিল তাকে জ্বালাতে। এখন যে নিজেই জ্বলছেন। ঐ কামাল মিয়ার কথা শুনলেই তো কেমন ছ্যাৎ করে উঠেন। ভাবেন, কেউই বুঝি কিছু বুঝে না। উনিই একমাত্র চালাক, আর বাকি সবাই হাদারাম।
‘আছিস?’
‘হু।’
‘তাহলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছিস কেন? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তো?’
‘তোমাকে আমি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।’
অকপটে বলল পুতুল। আজ আর কোনো ভয় ডর নেই তার। সারাজ ক্রূর হাসে। বলে,
‘বাহ, খুব তো সাহস হয়েছে দেখছি। তোকে আমার বাধ্য বানানোর সমস্ত প্রক্রিয়া আমি সেরে ফেলেছি, পুতুল। বাড়ি যা, দারুণ এক সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য।’
পুতুল এক পল ভেবে বলে,
‘আমার জন্য সারপ্রাইজ? তোমার মাথায় কী চলছে বলতো?’
পুনরায় হাসে সারাজ। মেয়েটাকে বোকা বানাতে বেশ লাগে তার। প্রশ্নের বিপরীতে কোনোপ্রকার জবাব না দিয়েই কল কেটে দেয়। পুতুল তাতে ক্ষুব্ধ হয় ভীষণ। এটা কেমন ধরনের অভদ্রতা? তার কথার কোনো মূল্য নেই? এভাবে মুখের উপর কল কেটে দিল? এই লোকটাকে বিয়ের পর সে নাকানিচুবানি খাওয়াবে। ডিসিশান ফাইনাল।
_____
বাসায় ফিরে পুতুল আরেকদফা চকিত হয়। তার মা’কে আজ অন্যরকম লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে, দারুণ খুশি সে। তার স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে সেই আমোদের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। হঠাৎ কী নিয়ে এত খুশি? ঐ কামাল মিয়ার সাথে বিয়েটা আবার ফাইনাল হয়ে যায়নি তো? আঁতকে উঠে তীব্রভাবে। ছুটে যায় মায়ের কাছে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘মা, কী হয়েছে? তোমাকে আজ এত খুশি লাগছে কেন?’
মেহুল হেসে তার দিকে তাকায়। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
‘দারুণ খবর আছে, পুতুল।’
দারুণ খবর শুনে পুতুলের চিত্ত আরো চুপসে যায়। এই দারুণ খবর তার জন্য না আবার নিদারুণ কষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। সে ভীত সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘কী খবর, মা?’
‘তোর তো বিয়ে ফাইনাল।’
যা ভেবে অন্তঃকরণে এতক্ষণ তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল, অবশেষে তাই হলো। এবার তাকে ঐ কামাল মিয়াকেই বিয়ে করতে হবে। পুতুল অসাড় ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে প্রস্থান ঘটাল। মেহুল নির্বোধের মতো চেয়ে দেখল কেবল। মেয়েটা তার পুরো কথা না শুনেই চলে গেল? যাকগে, পরে না হয় সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে।
গোসল সেরে পুতুল না খেয়েই শুয়ে পড়েছে। মেহুল এসে অনেকবার ডেকে গিয়েছে তাকে। কিন্তু সে কোনো সাড়া দেয়নি। তার বক্ষুঃস্থলের ব্যথাও ততক্ষণে আরো প্রখর হয়েছে। এই যন্ত্রণা কুলোতে না পেরে কেঁদে ফেলে সে। সারাজ ভাইয়ের সাথে অভিমান করে সে এই বিয়েতে রাজি হওয়ার অভিনয় করেছিল; কিন্তু, সারাজ ভাই এসবে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালেন না। বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত ছিলেন। উনি কি তবে সত্যিই পুতুলকে চান না?
পুতুল ঠোঁট উল্টে উঠে বসে। তীব্র ক্রোধে গা কাঁপছে তার। এই এত এত আবেগ অনুভূতি কি ঠুনকো জিনিস নাকি? ঐ লোকটা তার সাথে এমন করতে পারে না। তাকে বুঝতে হবে। অবশ্যই বুঝতে হবে।
পুতুল উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। গোধূলি লগ্ন। অম্বরে তখন পীতবর্ণ অম্বুধর তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। সেই পীতবর্ণের এক ছটা বর্ণ এসে ঠিকরে পড়ছে পুতুলের কঠিন ললিত মুখশ্রীর উপর। মাত্রাধিক চটে আছে সে। সারাজের নাম্বারে কল লাগাল। কল রিসিভ হলে, ওপাশ থেকে শোনা যায় নিঃস্পৃহ গলার স্বর,
‘বারবার কল করে বিরক্ত করছিস কেন, বলতো?’
‘তুমি ভীষণ খারাপ, সারাজ ভাই। ভীষণ মানে ভীষণ। এই ভীষণের কোনো তুলনা নেই। ইনফিনিটি। তোমার মতো খারাপ লোক আমি আমার জীবনে আর একটাও দেখিনি।’
‘দেখবি কী করে? আমি এই এক পিস’ই আছি। তা, হঠাৎ আমাকে খারাপ বলার জন্য এত উতলা হয়ে উঠলি যে? কী এমন খারাপ কাজ করেছি আমি?’
‘তুমি কিছু করোনি; আর দুঃখটা তো আমার এখানেই। তুমি কিছুই করলে না। আমি বারবার বলেছি, মা’কে বোঝাও; বিয়েটা ভেঙে দাও। শুনলে না আমার কথা। এখন খুশি তো? এটাই তো চেয়েছ তুমি? এই সারপ্রাইজের কথাই তো বলছিলে নিশ্চয়ই?’
সারাজের কাছে খটকা লাগে। পুতুল এভাবে বলছে কেন? ও কি খুশি তবে হয়নি? ও কি চায় না, তার আর সারাজের বিয়ে হোক? তবে, এত বিদ্বিষ্ট কেন শোনাচ্ছে তাকে?
সারাজ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘এই, কী হয়েছে বলতো? তুই এভাবে কেন বলছিস? তুই কি এই বিয়েতে খুশি না?’
পুতুলের এবার দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সারাজ ভাই এখনও কিছু বুঝতে পারছেন না? অথচ তিনি নির্বোধ ডাকে পুতুলকে। কিন্তু উনার চেয়ে অধিক নির্বোধ কেউ আছে না-কি?
পুতুল ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায়। সিক্ত সুরে বলে,
‘তুমি বুঝবে না, সারাজ ভাই। তোমাকে আমার বলা’ই ভুল হয়েছে। আমি আর তোমাক কিচ্ছু বলবো না। রাখি।’
রাখি বলেই রেখে দিল। সারাজ হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে ফোনের দিকে। এই আহাম্মক মেয়ের হলো’টা কী? তার তো এতক্ষণে খুশিতে আধমরা হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ, তা না করে উল্টো সে ফোন করে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিল? ব্যাপার কী? সারাজ আর বিলম্ব না করে মেহুলকে কল দেয়। এক্ষুনি জানতে হচ্ছে সবটা।
সব শুনে কুটিল হাসল সারাজ। বলল,
‘আচ্ছা, এই ব্যাপার তাহলে? তোমার মেয়েকে কি আমি সাধে আহাম্মক বলি, মা? যাকগে, একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। ওকে একটু জ্বালানো যাবে। শোনো, ও যখন কিছু বুঝেইনি, তখন আপাতত আর বোঝানোর দরকার নেই। অনেক জ্বালিয়ে ছিল আমাকে। এবার তার শোধ নেওয়ার পালা।’
________
এই মাঝ রাতে মারাত্মক রকমের রোষ নিয়ে বসে আছে লীনা। ইচ্ছে করছে ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটাকে তার রোষানলে একেবারে ভস্ম করে দিতে। সে আবারও তীব্র স্বরে বলল,
‘কী হলো, ফোন করে চুপ করে আছেন কেন? কথা বলতে না চাইলে বারবার কল কেন দিচ্ছেন? কী সমস্যা আপনার? বুকের গ্যাস্ট্রিক কি মাথায় উঠেছে? তাই এমন পাগলের মতো ব্যবহার করছেন?’
এবারও নিশ্চুপ ওপাশ। ঘন্টাখানেক যাবত ধরে এসবই হয়ে যাচ্ছে। কোনো এক আননোন নাম্বার থেকে বার বার কল আসছে। অথচ কল রিসিভ করলেই আর কোনো রা নেই। লীনা তখন থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তির সাথে কথা বলার চেষ্টা করেই যাচ্ছে, অথচ সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি হয়তো পণ করেছে, যায় হয়ে যাক না কেন আজ সে কোনোভাবেই মুখ খুলবে না। এবার রাগে ব্রহ্মতালু লাফাচ্ছে তার। এই মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে এসব ফাজলামোর কোনো মানে হয়। রাগে কল কেটে নাম্বারটা ব্লক করে দিল সে। রাগ দমাতে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলল। তারপর শুয়ে পড়ল আগের জায়গায়। এর কিয়ৎক্ষণ পরই আবার তার ফোন বেজে উঠে। মাথার ভেতরটা ক্রোধে ফাটছে তার। ফোন হাতে নিয়ে দেখে আরেকটা আননোন নাম্বার। নির্ঘাত আগের ব্যক্তিই, এখন অন্য নাম্বারে কল করছে। লীনা কল রিসিভ করে না। কল আপনা আপনি কেটে তার দু মিনিট পরেই একটা মেসেজ আসে। মেসেজে দেখেই বিস্মিত হয় লীনা। বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে পড়তে থাকে সেটা। যেখানে লেখা,
‘আপনার রঙে হৃদয় রাঙিয়ে নারী,
করে কুন্ঠিত স্বরে শ্লোক দান।
অথচ নারী স্বীয় অজ্ঞ,
বোঝে না মোর প্রণয়বান।’
মেসেজ দেখে চক্ষু চড়কগাছ। এই যুগে এসে এমন কবিতার স্রোতে প্রেম নিবেদন কেউ করে নাকি? আশ্চর্য! কে এই ব্যক্তি?
চলবে….