#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৬।
সারাজ গলার স্বর একটু বাড়াল। পুতুলকে শোনাতে হবে। এতক্ষণ ভীষণ বিরক্ত হওয়া মেয়েটির দিকে চেয়ে সে দারুণ চমৎকার এক হাসি দিল। বলল,
‘অবশ্যই। এমন মিষ্টি একটা মেয়ে আমার কাছে একটা জিনিস চাইল, আর আমি তাকে ফিরিয়ে দিব; অসম্ভব। লেখো, নাম্বার বলছি।’
মেয়েটা খুশিতে অস্থির। তাড়াহুড়ো করে ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে বলল,
‘জি, বলুন।’
‘01715…’
‘লিখেছো?’
‘জি।’
‘এটাই আমার নাম্বার। রাতে আমি ফ্রি আছি, কল দিও।’
এ তো পুরো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। মেয়েটা খুশিতে পারছে না এক্ষুণি সারাজকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরতে। এই প্রথম সে তার কোনো ক্রাশ থেকে পাত্তা পেয়েছে। আহ, আজ তো তার জন্য ঈদ।
সারাজ মৃদু হেসে বলল,
‘এবার আমি যাই। আমার একটু কাজ আছে।’
‘জি, অবশ্যই।’
মেয়েটা নাচতে নাচতে প্রস্থান ঘটাল। সারাজ ফুঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে পেছনে তাকাতেই দেখল এক জোড়া রক্তিম চোখ তাকে যেন গিলে খাচ্ছে। মনে মনে ভীষণ খুশি হলো সে। যাক, প্ল্যান সাকসেসফুল হয়েছে তাহলে। পুতুল তার দিকে তেড়ে আসে। নাক মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি ওকে চেনো?’
‘না তো।’
সারাজ স্বাভাবিক ভীষণ। পুতুল গর্জে উঠে বলল,
‘তাহলে ওকে তোমার ফোন নাম্বার দিলে কেন?’
সারাজ দায়সাড়া ভাবে বলল,
‘চেয়েছিল, তাই দিয়েছি।’
তেতে উঠল পুতুল। কোমরে হাত দিয়ে কর্কশ গলায় বলে উঠল,
‘কেউ চাইলেই তাকে নাম্বার দিয়ে দিবে? আশ্চর্য! এত বড়ো হয়েছো অথচ এই সামান্য কমনসেন্সটুকু তোমার নেই? এই জন্যই মামনি তোমাকে বোকা বলে।’
‘এক থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিব, ফাজিল মেয়ে। আমি কাকে নাম্বার দিব না দিব সেটা আমার ইচ্ছে। তোকে আমি সেই কৈফিয়ত দিব নাকি? সর সামনে থেকে।’
পুতুলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সারাজ গটগট করে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায়। বাইরে বেরিয়েই শব্দ করে হেসে ফেলে সে। কী এক্টিং’টাই না করছিল। তার তো সিনেমায় নাম লেখানো উচিত।
_____
রাগে শরীর রি রি করছে পুতুলের। ইচ্ছে করছে এখানের সব টেবিল চেয়ার ভেঙে একদম গুড়িয়ে দিতে। কী অ সভ্য লোকটা। একটা অপরিচিত মেয়ে এসে নাম্বার চেয়েছে, আর তিনিও নাচতে নাচতে নাম্বার দিয়ে দিয়েছেন। আরো বলে কি-না, মিষ্টি মেয়ে। কই তাকে তো জীবনেও মিষ্টি মেয়ে বলেনি? বরং সবসময় এমন ভাবে আচরণ করেছে যেন সে করলার চেয়েও তেঁতো। রাগে দাঁতে দাঁত পিষছে পুতুল। ঐ মেয়ে যদি তার সিনিয়র না হতো, তবে এক্ষুণি গিয়ে সে তাকে চিবিয়ে খেত। ছেলেদের কাছ থেকে নাম্বার নেওয়ার শখ তার জন্মের মতো গুজিয়ে দিত সে।
লীনা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে পুতুলের দিকে। আজ সকাল থেকেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। একদিনেই এত সব অদ্ভুত ঘটনা কেন ঘটছে কে জানে? সে বোঝে না, সারাজ ভাই যদি কাউকে নাম্বার দেয়ও তাতে পুতুলের এত রাগ করার কী আছে? নাম্বার কাকে দিবে না দিবে সেটা তো সারাজ ভাইয়েরই ব্যাপার। তাহলে পুতুল এমন করছে কেন?
‘তুই চা’টা খাবি না? ঠান্ডা হচ্ছে তো। আমি খেয়ে নিব?’
‘খেয়ে নে।’
‘তুই তোর চা আমাকে খেয়ে নিতে বলছিস? তুই না চা শেয়ার করিস না?’
পুতুল দুঃখী দুঃখী মুখ করে চেয়ে বলল,
‘যেখানে আমার জীনটাই আরেকজনের সাথে শেয়ার হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এই সামান্য চা…. তুই’ই খেয়ে নে।’
‘কী হয়েছে, দোস্ত? কিছু ঘটেছে? বলবিনা আমায়?’
পুতুল ঠোঁট উল্টে বসে বসে টেবিল খুঁটছে। মনটা মারাত্মক খারাপ তার। লীনা তার দিকে এগিয়ে বলল,
‘বল না, কী হয়েছে?’
‘মা আমার বিয়ের জন্য পাত্র দেখছেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, এ তো ভালো খবর।’
লীনা খুশি হলো। পুতুল নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘এটা কোন দিক দিয়ে তোর কাছে ভালো খবর বলে মনে হলো? আমি বিয়ে করব না। কিন্তু, মা মানতে নারাজ। সকালে আসার সময়ও কতক্ষণ ঝগড়া করে এসেছি। মন মেজাজ একদম ঠিক নেই আমার। তার উপর ঐ সারাজের বাচ্চা সারাজ আমার মেজাজ আরো বিগড়ে দিয়েছে।’
লীনা এক সেকেন্ড ভেবে বলল,
‘ওহ, সেইজন্যই সারাজ ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, তুই কাউকে পছন্দ করিস কি-না?’
চমকে তাকাল পুতুল। লীনার দিকে ঝুঁকে এসে বলল,
‘সারাজ ভাই তোকে এই কথা কখন জিজ্ঞেস করেছেন?’
‘আজকে সকালেই। তুই আসার আগে।’
‘তুই কী বলেছিস?’
‘বলেছি, না, পছন্দ করিস না।’
পুতুল বিরক্তির সাথে বলে উঠল,
‘ধুর, বলতি কাউকে পছন্দ করি। না বলার কী দরকার ছিল?’
‘ওমা! মিথ্যে বলতে যাব কেন?’
‘আরে আহাম্মক, এটা শুনলে উনি হয়তো আমার বিয়েটা হতে দিতেন না। আমার শেষ আশাটাও তুই নষ্ট করে দিলি।’
পুতুল মন খারাপ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। তার বোধ হয় কপালটাই খারাপ। নয়তো একটার পর একটা কেবল খারাপই কেন হচ্ছে? সারাজ ভাই নির্ঘাত শিওর হওয়ার জন্য লীনাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। এখন তো উনি বুঝে গিয়েছেন, সে যে মিথ্যে বলেছে। তাহলে, আর কী বলে এখন বিয়ে আটকাবে? সত্যিটা বলে দিবে? বলে দিলে, সারাজ ভাই কি মেনে নিবেন সবটা? মেনে নিবেন পুতুলকে বউ হিসেবে?
পুতুল জানে, মানবেন না। পুতুলের প্রতি টান থাকলে তিনি নিজ থেকেই বিয়েটা আটকাতেন। কিন্তু, তিনি কাল থেকে এতটা নির্লিপ্ত, যেন কিছুই হয়নি। তার পুতুলের বিয়েতে তার কিছুই যায় আসে না। উল্টো ভার্সিটিতে এসে অন্য মেয়ের সাথে লাইন মারার চেষ্টায় আছেন। অ সভ্য লোক।
_____
‘হ্যালো ম্যাডাম, আকাশ বাতাস দেখে আবৃত্তি করলে চলবে না। অডিয়েন্সের সাথে আই কন্ট্যাক্ট করতে হবে, বুঝেছেন?’
লীনা ক্ষিপ্ত হলো। সে এখানে প্র্যাকটিস করতে আসার পর থেকেই লোকটা তার ভুল ধরছে। এই প্রথমবারের মতো সে স্টেজে দাঁড়িয়ে কোনো পারফরমেন্স করতে যাচ্ছে, এমনিতেই মারাত্মক নার্ভাস; তার উপর এই ছেলের একটু পর পর ধমক দিয়ে বলে উঠা কথাগুলো আরো বেশি ভয় পাইয়ে দিচ্ছে তাকে।
মাহাত চশমাটা ঠেলে ভালোমতো চোখে লাগাল। লীনার দিকে চেয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
‘ম্যাডাম, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?’
‘জি, পাচ্ছি।’
‘তবে যেভাবে বলেছি সেভাবেই করুন। আই কন্ট্যাক্ট রাখার চেষ্টা করুন।’
লীনা নাক ফুলিয়ে বলল,
‘এখানে কে আছে, যার সাথে আমার আই কন্ট্যাক্ট করতে হবে?’
মাহাত বুকের উপর হাত ভাঁজ করে টানটান হয়ে চেয়ারে বসল। শান্ত গলায় বলল,
‘আমি আছি না? আমার দিকে চেয়ে বলুন। এদিক ওদিক তাকানো যাবে না। জাস্ট, লুকিং এট মি। নাও, স্টার্ট।’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল লীনা। অনুষ্ঠানের আগ অবধি যে এই লোক তাকে মারাত্মক প্যারা দিবে সেটা আর বলার বাকি রইল না।
লীনা হালকা করে গলা ঝারল। অতঃপর শুরু করল আবৃত্তি,
” অচির বসন্ত হায় এল, গেল চলে–
এবার কিছু কি, কবি করেছ সঞ্চয়।
ভরেছ কি কল্পনার কনক-অঞ্চলে
চঞ্চলপবনক্লিষ্ট শ্যাম কিশলয়,
ক্লান্ত করবীর গুচ্ছ। তপ্ত রৌদ্র হতে
নিয়েছ কি গলাইয়া যৌবনের সুরা–
ঢেলেছ কি উচ্ছলিত তব ছন্দঃস্রোতে,
রেখেছ কি করি তারে অনন্তমধুরা।
এ বসন্তে প্রিয়া তব পূর্ণিমানিশীথে
নবমল্লিকার মালা জড়াইয়া কেশে
তোমার আকাঙক্ষাদীপ্ত অতৃপ্ত আঁখিতে
যে দৃষ্টি হানিয়াছিল একটি নিমেষে
সে কি রাখ নাই গেঁথে অক্ষয় সংগীতে।
সে কি গেছে পুষ্পচ্যুত সৌরভের দেশে।”
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
লীনা পুরো আবেগ ঢেলে কবিতাটা আবৃত্তি করল। তার মাঝে এক পলকও সে এদিক ওদিক চাইল না। সম্পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল মাহাতের দিকে। মাহাতও চোখ সরাতে পারেনি। কী যেন খুব মনোযোগের সহিত শুনছিল সে। এই যে এখনও চোখ সরাতে পারছে না। কী এত দেখছে কে জানে? লীনা হালকা গলা ঝেরে বলল,
‘কোনো ভুল হয়েছে কি?’
সম্বিত ফেরে মাহাতের। এদিক ওদিক চেয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে। তারপর মৃদু সুরে বলে,
‘না, সব ঠিক আছে। এভাবেই প্র্যাক্টিস করতে থাকুন।’
লীনার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। বলল,
‘ঠিক আছে।’
মাহাত সেই জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ে। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে আসা দরকার।
চলবে…
#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৭।
রোদ কমেছে। বাইরে মৃদুমন্দ বাতাস। ভার্সিটি থেকে সবেই বেরিয়েছে পুতুল। বাইরে বেরিয়েই ক্লান্তশ্বাস ছাড়ল। সবকিছু বড্ভ বিরক্ত লাগছে। এই যে আজকের বিকেলটা এত তকতকে ঝকঝকে, তাও তার মন ভালো হচ্ছে না। মনের অসুখ হয়েছে বোধ হয়। কঠিন অসুখ। আর এই অসুখ কেবল তার সারাজ ভাই’ই সারাতে পারবেন।
পুতুলের মুখটা আরো মিইয়ে যায়। আজকাল সারাজ ভাই তো তাকে আগের তুলনায় একটু বেশিই অবজ্ঞা করছেন। কী সুন্দর অপরিচিত এক মেয়েকে নাম্বার দিয়ে দিলেন। নাম্বারের কথা মনে পড়তেই ভ্রু কুঁচকাল পুতুল। সারাজ ভাই ঐ মেয়েকে যে নাম্বার দিয়েছেন, সে তো জীবনেও এই নাম্বার সম্পর্কে জানত না। সারাজ ভাইয়ের একটা যে নাম্বার আছে সেটা তার টুটস্থ মুখস্থ। তবে ঐ নাম্বারটা কার? সারাজ ভাইয়ের কি আরেকটা সিম আছে? সেটা দিয়ে তিনি হয়তো খুব ব্যক্তিগত মানুষদের সাথে কথা বলেন।
বুকটা হুহু করে উঠল পুতুলের। মারাত্মক কান্না পাচ্ছে তার। ঐ পিচঢালা রাস্তার ঠিক মাঝে বসে হাত পা ছড়িয়ে এক ঘন্টা কাঁদতে পারলে হয়তো মনটা শান্ত হতো। তার সারাজ ভাই জীবনে যেই নাম্বার তাকে দেয়নি, আজ তিনি সেই নাম্বার একটা অপরিচিত মেয়েকে দিয়ে দিলেন? এত নিষ্ঠুর উনি?
পুতুল তৎক্ষণাৎ ঠিক করল, সে মায়ের পছন্দ করা ঐ ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকেই বিয়ে করবে। হ্যাঁ, অবশ্যই করবে। সারাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সে ঐ ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করে নাচতে নাচতে হানিমুনে যাবে। আর ঐ অসভ্য অভদ্র সারাজ এসব দেখবে আর লুচির মতো ফুলবে…হু।
বাসায় এসেই সোফার উপর ব্যাগটা ছুড়ে মারল পুতুল। চিৎকার করে ডাকতে আরম্ভ করল,
‘মা, মা। কোথায় তুমি? এক্ষুনি এখানে এসো।’
সিঁড়ির কাছে এসে মেহুল বাজখাঁই গলায় বলে উঠল,
‘কী হয়েছে, এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?’
‘নিচে নামো। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।’
মেহুল বিরক্ত হয়ে নিচে নেমে দাঁড়াল।
‘বল, কী বলবি।’
‘আমি ঐ ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করব।’
‘কোন ইঞ্জিনিয়ার?’
‘আরে, তুমি আর মামনি মিলে যাকে ঠিক করলে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি।’
‘ওহ, আচ্ছা।’
বলার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ গতিতে ভয়ানক এক ঝটকা খেল মেহুল। কোটর ছেড়ে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে আদৌ ঠিক শুনছে তো? পুতুল বিয়ের জন্য রাজি? মেহুলের মাথা ঘুরাচ্ছে। পুতুল এত সহজে রাজি হয়ে গেল কী করে? এবার তো মনে হচ্ছে নিজের পায়ে নিজেই কুঁড়াল মারা হয়ে গিয়েছে তাদের। মেহুল ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছে। দুই ভ্রু এর মাঝে দৃঢ় তিন খানা দাগ পড়েছে। পুতুল চেয়ে আছে বিরক্তভরা দৃষ্টিতে। তার মা খুশি হয়নি? তাঁর তো এতক্ষণে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ, চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি বরং কষ্ট পেয়েছেন।
‘মা, তুমি কি খুশি হওনি?’
মেহুল থতমত খায়। কী বলবে এবার? কী করে বলবে, সে একটুও খুশি হয়নি যে। পুতুলের সন্দিহান দৃষ্টি দেখে মেহুল হাসল। বলল,
‘খুশি হয়েছি। তবে, আমার মনে হচ্ছে আমি বোধ হয় তোর উপর এসব চাপিয়ে দিচ্ছি। তুই আমাকে খুশি করতে নিজেকে বিসর্জন দিচ্ছিস। আমি মা হয়ে সেটা এখন মেনে নিতে পারছি না। থাক, আপাতত বিয়ে নিয়ে আমি আর কোনো কথা বলব না। তুই আগে অনার্সটা শেষ কর তারপরই সব হবে।’
‘ওমা, বললেই হলো। দুদিন যাবত বিয়ে নিয়ে এত কাহিনী করে, এখন বলছ সব বাদ দিতে? শোনো, আমি মন থেকেই রাজি। তুমি পাত্র পক্ষকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলো। আর আমার তো বিয়ের বয়স হয়েই গিয়েছে, তাই না? বিয়ের পর বাকি পড়াশোনাও কমপ্লিট করে নিব, নো টেনশন।’
পুতুল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। মেহুলকে রেখে যায় কঠিন গোলক ধাঁধায়। মেহুলের ঘোর তো এখনও কাটছেই না। সকালে যে মেয়ে বিয়ে করবে না বলে তার সাথে এত ঝগড়া করে গেল, বিকেলে এসে সেই মেয়েই এভাবে পল্টি মারল? আশ্চর্য! এই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কী এমন হয়েছে? রিতাকে তো এক্ষুনি খবরটা দিতে হচ্ছে।
_______
‘কী বলিস, পুতুল বিয়েতে রাজি?’
‘হ্যাঁ, ও তো তাই বলল। আমার তো মাথা’ই কাজ করছে না। তবে কি আমাদের প্ল্যানে আমরা নিজেরাই ফেঁসে গেলাম?’
রিতা কিছুক্ষণ ভাবল। পুরো ব্যাপারটা বেশ চিন্তার। সে খানিক সময় পর বলল,
‘আমার মনে হচ্ছে, ঘটনা অন্যকিছু। দেখ, সারাজ আর পুতুল দুজনেই কিন্তু প্রথমে বিয়ে নিয়ে বেশ হম্বিতম্বি দেখিয়েছে। আমার মনে হয় কি, পুতুল আর সারাজের মধ্যে হয়তো রাগ অভিমান চলছে। হয়তো সারাজের সাথে রাগ দেখিয়েই পুতুল এখন বিয়েতে রাজি হয়েছে।’
‘সম্পর্কই যদি না থাকে, তবে সেই সম্পর্কে রাগ অভিমান আসবে কোথ থেকে?’
‘আহা, তুই বুঝছিস না। শোন, তুই তোর অভিনয় চালিয়ে যা। আর আমিও কালকে পাত্র পক্ষ নিয়ে আসব। ব্যাপারটাকে আরো ঘাটাতে হবে। ছেলে মেয়ে দুইটা মারাত্মক ফাজিল। এত সহজে ওদের ধরা যাবে না।’
মেহুল কপাল কুঁচকে বলল,
‘তুই পাত্রপক্ষ কই পাবি?’
‘আরে সেটা আমি ম্যানেজ করে নিব। তুই গিয়ে পুতুলকে জানিয়ে দে, আগামীকাল পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে আসবে। তারপর দেখ ও কী বলে।’
মেহুল বিরক্ত হয়ে বসল। সামনের কিছু চুলে পাকা ধরেছে তার। এবার তো মনে হচ্ছে এই ছেলে মেয়ে দুইটার চিন্তায় চিন্তায় এক মাসের মধ্যেই তার সব চুল পেকে যাবে।
_______
সন্ধ্যার পর বাপ বেটা অফিস থেকে ফেরে। সাদরাজ ছেলেকে অনেক কিছু বুঝিয়েছে। পারছে না কেবল একদিনেই সব দায়িত্ব তার ঘাড়ে তুলে দিতে। অফিসের সবাইও বস বস বলে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল তার। মাথা ধরেছে এখন।মৈ। ফ্রেশ হয়ে কড়া লিকারে এক কাপ চা খেতে হবে।
রিতা সারাজের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘প্রথম দিন অফিস কেমন গেল, বাবা?’
‘আর কেমন যাবে, বলো? তোমার হাজবেন্ডের জ্বালায় বাঁচা যায়? একদিনেই সব বুঝিয়ে আমার মাথা হ্যাং করে দিয়েছেন।’
রিতা হেসে বলে,
‘তাই? এক্ষুনি একটা দারুণ খবর দিব। দেখবি, এক সেকেন্ডেই মাথার হ্যাং ছেড়ে দিয়েছে।’
সারাজ চায়ের কাপে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘কী খবর?’
রিতা তার পাশে বসল। মুখে চওড়া হাসি। আমোদ গলায় বলল,
‘পুতুল বিয়েতে রাজি। কালই পাত্রপক্ষ ওকে দেখতে যাবে।’
নাকেমুখে চা উঠে গেল সারাজের। কাশতে আরম্ভ করল। রিতা অস্থির ভঙিতে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘আস্তে খা। এমন নাকে মুখে উঠল কেন?’
সারাজ ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করল। মাথার হ্যাং ছাড়ার বদলে উল্টো আরো জমে গিয়েছে। সে চায়ের কাপ রেখে সটান উঠে দাঁড়াল। বিরক্ত গলায় বলল,
‘ভালো তো, খুব তাড়াতাড়ি একটা বিয়ে খেতে পারব।’
‘তুই যাবি না কালকে?’
‘আমি কেন যাব? ওর মতো আহাম্মককে আরেক আহাম্মক দেখতে আসছে, সেখানে আমি গিয়ে কী করব? দুই আহাম্মকের আহাম্মকগিরি দেখব?’
রিতা মুখ থেকে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে বলল,
‘এভাবে বলছিস কেন? তুই থাকলে পাত্রের সাথে একটু ভালোভাবে কথা বলে খোঁজ খবর নিতে পারবি। আফটার অল, তোর দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বোন; ভাই হিসেবে তো এইটুকু দায়িত্ব পালন করতেই পারিস, তাই না?’
সারাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘মা, যাবে এখান থেকে?’
‘আরে বাবা, রেগে যাচ্ছিস কেন? এখানে রাগার মতো আমি কী বললাম?’
সারাজ চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। কপালের রগ ফুলে উঠেছে। রিতা তার চোখ মুখ দেখে ঠোঁট চেপে হাসছে। আহা, ছেলেটার এই রাগ তার মনে ভীষণ শান্তি দিচ্ছে। এই রাগই বলে দিচ্ছে, সে অবশ্যই পুতুলকে চায়। আর চিন্তা নেই, এবার যা করবার তার ছেলেই করবে। রিতা নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ছাড়ল।
চলবে….