#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭।
একটা ক্লাস শেষ হয়েছে মাত্রই। সবাই ক্লাস থেকে ধীর পায়ে বেরুচ্ছে। পুতুল আর লীনাও আছে তাদের সাথে। কী নিয়ে যেন গভীর আলোচনা চলছে তাদের। হঠাৎ তখন পেছন থেকে ডাক এল,
‘পুতুল, কাল রাতে তুমি আমাকে ওভাবে বললে কেন?’
পুতুল ঘুরে তাকাল। সাহেলকে দেখে কপাল কুঁচকে এল তার। অপ্রসন্ন গলায় বলল,
‘কীভাবে?’
‘কাল রাতে বললে না, আমি নাকি মেয়েদের ডিস্টার্ব করি? তোমার কি আমাকে দেখলে তাই মনে হয়?’
পুতুল ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। চোখে মুখে সেই ছাপ স্পষ্ট। এই ছেলে কেন যেচে পড়ে কথা বলতে আসছে কে জানে।পুতুল বিরক্ত ভাব দমিয়ে রেখে বলল,
‘রাতে বিরেতে মেয়েদের মেসেজ দিলে তো এমন বলবই। এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে?’
‘মেয়েদের না, শুধু তোমাকেই কাল মেসেজ দিয়েছিলাম।’
‘তো, আমি মেয়ে না? আশ্চর্য!’
সাহেল তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। বলল,
‘আমি কি বলেছি, তুমি মেয়ে না? তুমি তো আমাকে ভুল বুঝছো। তুমি যেমন ভাবছ, আমি ওমন ছেলে না। আমি ভালো ছেলে। আমি একদমই মেয়েদের ডিস্টার্ব করিনা।’
পুতুল দু কদম এগিয়ে গেল। বুকের উপর হাত ভাঁজ করে টানটান হয়ে দাঁড়াল। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘এখন তবে কী করছো তুমি? একটা মেয়েকে অযথা প্রশ্ন করে বিরক্ত করা কোনো ভালো ছেলের কাজ না। তাই এসব আজগুবি চিন্তা মাথা থেকে বের করে ফেলো। কালকেই আমাদের প্রথম কথা হয়েছে। আর যে কারণে কথা হয়েছিল, সেই কারণের সমাধান ও কালকে হয়ে গেছে। তাই আজ আর কোনো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বুঝেছো?’
সাহেল অপ্রতিভ। যেন সে ভীষণ নারাজ পুতুলের উপর। মেয়েটা এভাবে কেন কথা বলে তার সাথে। ক্লাসের ভালো ছাত্র হিসেবে কম বেশি সব মেয়েই তাকে পছন্দ করে। তবে পুতুল কেন তাকে পাত্তা দেয় না? সে কি হ্যান্ডসাম না? ভাবনার মাঝেই ফোঁড়ন কাটল পুতুল। উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘বুঝতে পেরেছ তুমি?’
সাহেল বিব্রত বোধ করে। মাথা ঝাঁকিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। পুতুল তার যাওয়ার দিকে চেয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘আহাম্মক কোথাকার। এসেছিল আমার সাথে লাইন মারতে।’
লীনা ঘটনার আগা মাথা তখনও ধরতে পারেনি। তাই প্রশ্ন করে,
‘ব্যাপার কী বলতো?’
পুতুল তার হাত ধরে বলে,
‘চল, ক্যান্টিনে গিয়ে বলছি।’
_______
‘রমনা পার্কে যাবি, লীনা?’
‘হঠাৎ সেখানে?’
‘এমনি, ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে।’
‘কবে যাবি?’
‘আজই।’
‘আজ?’
লীনা চমকাল। পুতুল উৎসাহ দেখিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, চল না। অনেক দিন যাই না।’
‘কিন্তু, কী করে যাবি? তোর ড্রাইভার নিয়ে যাবে?’
‘জীবনেও না।’
‘তবে?’
‘লুকিয়ে যাব। ড্রাইভারকে বলা যাবে না।’
লীনা বাঁধা দিয়ে বলল,
‘সম্ভব না। ড্রাইভার ভার্সিটির বাইরেই থাকেন। উনার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা কোনোভাবেই যেতে পারব না।’
‘আরে, পারব পারব। সব ব্যবস্থা আমি করব। তুই শুধু আমার পাশে থাকিস।’
‘উফফ দোস্ত, তোর জন্য সবসময় আমাকে বাঁশ খেতে হয়।’
পুতুল হেসে বলল,
‘আচ্ছা যা, আজকের প্ল্যানে সাকসেসফুল হতে পারলে তোকে বিরিয়ানি খাওয়াব।’
বিরিয়ানি খাওয়ার লোভে লীনার মন সায় দেয়। এমন একটা অফারের বিনিময়ে, একটু আধটু রিস্ক নেওয়াই যায়। এটা আর এমন কী ব্যাপার।
সব ক্লাস আর করা হলো না। হাত ঘড়িতে পুতুল চোখ বুলিয়ে দেখল, কাটায় কাটায় বারোটা বাজে। ভার্সিটির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে তারা। সতর্ক দৃষ্টি বাইরের দিকে। ঐ যে পুতুলের কালো গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। ভেতরে ড্রাইভার আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। একটু উঁকি ঝুঁকি দিল। তাও বোধগম্য হলো না কিছুই। পুতুল বলল,
‘দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চল রিক্সা ডেকে রওনা দেই।’
‘আর তোর ড্রাইভার দেখে যদি আংকেলকে কল করে সব বলে দেয়?’
‘আরে, এত ভাবিস না তো। জীবন তো একটাই। এই এক জীবনে সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকবে আমাদের আনন্দ। এত ভয় পেতে হবে না, চল।’
লীনাকে একপ্রকার টেনে গেইটের বাইরে এনে দাঁড় করাল পুতুল। তারপর দ্রুত একটা রিক্সা ডেকে, উঠে পড়ল দুজন।
রিক্সা গিয়ে থামল, রমনা পার্কের গেইটের সামনে।
ভাঁড়া মিটিয়ে পার্কের ভেতরে পা রাখল দুই বান্ধবী। দুজনেই ভীষণ খুশি। এমন লুকিয়ে চুরিয়ে ঘুরার মজাই যেন আলাদা।
দুজনেই গিয়ে বসল শিশু প্রাঙ্গনে। এই দুপুর বেলাও গুটি কয়েক শিশুর আনাগোনা সেখানে। একটা বাদামওয়ালাকে দেখে পুতুল হাত উঠিয়ে ডাকল তাকে। বাদামওয়ালা ছুটে এল সঙ্গে সঙ্গে। তারপর ষাট টাকার বাদাম কিনল দুজন।
‘দোস্ত, তোর সারাজ ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ডের ছবি আছে তোর কাছে?’
পুতুল ভ্রু কুঁচকাল। হাতের বাদামগুলোতে ফুঁ দিয়ে মুখে পুরে বলল,
‘কেন, উনার গার্লফ্রেন্ডের ছবি দিয়ে তুই কী করবি?’
‘দেখব আরকি। উনার মতো একটা বয়ফ্রেন্ড যে পেয়েছে, সে নির্ঘাত ভীষণ ভাগ্যবতী। তাই সেই ভাগ্যবতীকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’
‘আর ভাগ্যবতী।’
হা হুতাশের স্বরে বলল পুতুল। লীনা অবাক চোখে তাকাল। পুতুল নিজ থেকেই বলল,
‘কালও আপু আমাদের বাড়িতে এসে কেঁদে গিয়েছেন। এখন উনি আফসোস করেন, কেন এমন একটা মানুষ উনার জীবনে এল। সারাজ ভাই উনার জীবনটা শেষ করে দিচ্ছেন। উঠতে বসতে ধমকের উপর রাখেন। চুন থেকে পান ঘষতেই গায়ে হাত তুলেন। তাও ব্রেকআপ করেন না। আপু কতভাবে নিজেকে সারাজ ভাইয়ের কাছ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি। ভাই তা হতে দেননি। উনি নাকি আপুকেই বিয়ে করবেন। আর আপু মরে গেলেও উনাকে বিয়ে করবেন না। এই নিয়েই দুই পরিবারে অশান্তি চলছে। তারপরও কি তোর মনে হয়, আপুটা ভাগ্যবতী? আমার তো মনে হয়, উনার মতো দুর্ভাগ্য বোধহয় আর কারো নেই। সারাজ ভাইয়ের মতো বয়ফ্রেন্ড থাকা মানে, যেচে পড়ে নিজের জীবন ধ্বংস করা। ভাগ্যিস, তুই ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড না। নাহলে আমার একমাত্র বান্ধবীর জীবনটাও শেষ হয়ে যেত।’
সবশুনে অবাকে চরম সীমায় পৌঁছে যায় লীনা। হা করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,
‘ভাইয়া এমন?’
‘হু, সেইজন্যই তো তোকে সাবধান করলাম। এমন খারাপ ছেলের কথা চিন্তায়ও আনিস না।’
লীনা কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে রইল। পুতুল হাতের বাদামখানা মুখে পুরে মনে মনে ভাবল, মেয়েটা তার কথা বিশ্বাস করেছে তো?
তাদের সুখকর সময় বেশিক্ষণ টিকে না। এর মাঝেই বা হাত ঢুকিয়ে দেয় সারাজের ফোনকল। পুতুলের ফোন ভোঁ ভোঁ শব্দ করে বাজছে। সারাজের নাম্বার দেখে রীতিমত ভয়ে হাত কাঁপছে তার। অন্যসময় হলে এত ভয় পেত না, তবে আজ এত লুকিয়ে চুরিয়ে পার্কে এসেছে বলেই, তার যত ভয়। সারাজ ভাইয়ের হাতে ধরা পড়লে আজ আর তার রক্ষে নেই। লীনা বলল,
‘কলটা ধর।’
‘হঠাৎ উনি কেন কল করছেন? এই টাইমে তো সচরাচর কল করেন না।’
‘হয়তো, জরুরি কিছু। কল না ধরলে বুঝবি কী করে?’
পুতুল শুকনো ঢোক গিলে একবার আশেপাশে চোখ বুলাল। না, কেউ নেই। এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত মনে কল রিসিভ করল সে। সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে এলো সেই পরিচিত গম্ভীর সুর,
‘কোথায় তুই?’
পুতুল পরপর দুবার ঢোক গিলল। সারাজ জানে পুতুল এই সময় ভার্সিটিতে থাকে। তবে, আজ এত ঘটা করে জিজ্ঞেস করছে কেন? পুতুলের মনের ভয় বাড়ে। কম্পিত সুরে বলে,
‘আ-আমি ত-তো ক্লাসে।’
‘ক্লাসে তো কথা বলছিস কী করে?’
‘এখনও ক্লাসে কোনো স্যার আসেননি। তুমি হঠাৎ কল করলে যে?’
‘তোর কথা মনে পড়ছিল।’
কথাটা সুবিধার ঠেকল না পুতুলের। নির্ঘাত এতে কোনো ঘাপলা আছে। পুতুল আরো একবার তাকাল আশেপাশে। কাউকেই তো দেখছে না সে। বাবার পরিচিতও কেউ নেই। তাহলে এত ভয় পাওয়ার কী আছে। পুতুল নিজেকে ধাতস্ত করে জবাবে বলল,
‘তোমার আবার আমার কথাও মনে পড়ে?’
‘হ্যাঁ, খুব মনে পড়ছে। একটা ভিডিও কল দে তো।’
আঁতকে উঠল পুতুল। ভিডিও কল দিবে? অসম্ভব। তাহলেই সারাজ ধরে ফেলবে সবটা। তার বুঝতে দু মিনিটও লাগবে না, যে এটা ক্লাস না। ধরা পড়লে আজ জান প্রাণ নিয়ে টান পড়বে তার। পুতুল তাই কথা কাটাতে বলল,
‘ক্লাসে স্যার এসেছেন। আমি তোমাকে পরে কল করব।’
‘আরে, তুই স্যারকে বলে বাইরে যা না। তোকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে, পুতুল। বুঝতে পারছিস না কেন?’
পুতুল বুঝতে পারছে না, এই লোকের হঠাৎ কী হলো? এমন ব্যবহার তো তিনি আগে কখনও করেননি। তবে, আজ কেন?
পুতুল ভয়ে ভয়ে লীনার দিকে চাইল। ফোনটা লাউডস্পিকারে ছিল বিধায়, লীনাও শুনল সব। সে পুতুলের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ভিডিও কল দে। জিজ্ঞেস করলে বলবি, এটা ভার্সিটির মাঠ। তুই মাঠে বসে উনার সাথে কথা বলছিস।’
পুতুল মোবাইল দূরে সরিয়ে বলল,
‘উনাকে কি তোর এতই বোকা মনে হয়?’
‘আরে, বোকা না হলে; বোকা বানাবি তুই। এত ভয় পাচ্ছিস কেন? কল দে। কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো।’
চলবে….