শেষটা সুন্দর ২ পর্ব-০৬

0
905

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬।

দুই বান্ধবী মিলে আজ শপিং এ বেরিয়েছে। জীবন সংসার সামলিয়ে আজকাল এসবের সময়ই হয়ে উঠে না তাদের। তাও সময় বের করে। খুটিয়ে খুটিয়ে নিজেদের জন্য ঠিক সময় বের করে নেয়। নাহলে জীবন বিরক্ত হয়ে উঠবে। বয়স বেড়েছে তো কী হয়েছে, শরীরের তেজ এখনও কমেনি। সেই ভরা যৌবনের মতোই ছুটে বেড়ায় দুই বান্ধবী। শপিং এ যায়, ফুচকা খায়, রিক্সা দিয়ে ঘুরে। এইসব কিছুই তো বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের। চারদিকের এত ব্যস্ততা, এত চাপের মাঝেও নিজেদের সময় দিতে তারা কখনও ভুলে না।

আজ রবিবার। রবিবার বিকেলে এই বাগানের পাশে একটা ফুচকাওয়ালা আসে। তার বানানো ফুচকা রিতা আর মেহুলের ভীষণ পছন্দ। আজ তাই তারা সেই ফুচকার লোভে এখানে চলে এসেছে। মেহুল ফুচকাওয়ালাকে বলল, ঝাল দিয়ে দুই প্লেট ফুচকা দিতে। বলেই রিতার পাশের চেয়ারটাতে গিয়ে বসল সে। রিতার দিকে চেয়ে বলল,

‘কী করছিস?’

‘ফোনটা এরোপ্লেন মুডে করলাম। নয়তো ঐ বাপ বেটা আমাকে কল করে জ্বালিয়ে মারত। তোর তো আর সেই টেনশন নেই। রাবীর ভাই বেশ ভালো আছেন, একটুও জ্বালান না তোকে।’

‘তো কী হয়েছে? উনার একটা বিচ্ছু মেয়ে আছে না? সে যদি জানতে পারে, আমরা ফুচকা খেতে এসেছি তাহলে দেখবি এরপর থেকে আর আমাদের একা ছাড়বে না। ফুচকা খাওয়ার লোভে সেও পেছন পেছন ঘুরবে।’

‘তাতে সমস্যা কোথায়। আমার ছেলের বউ, আমার আশেপাশে থাকলে ভালোই লাগে।’

‘আর ছেলের বউ।’

বেশ হতাশ শুনালো মেহুলের গলার স্বর। রিতা তার হাতের উপর হাত রেখে বলল,

‘কেন, কী হয়েছে?’

মেহুল রাশভারী গলায় বলল,

‘ছেলে মেয়ে দুইটা সারাদিন যে হারে লেগে থাকে, তোর মনে হয় ওদের দুইটাকে বিয়ে দিয়ে আমরা ঠিক থাকতে পারব। শেষে না, বাড়ি মাথার উপর তুলে রাখে। যা ফাজিল হয়েছে এই পুতুলটা। কারোর কথা শুনে না।’

‘আরে, ওর জন্য আমার সারাজই বেস্ট। একদম টাইটে রাখতে পারবে। যেমন তোকে রাবীর ভাইয়া টাইট করে ফেলেছিল।’

বলেই হু হা করে হাসল রিতা। মেহুল প্রচন্ড বিরক্ত হলো। কপাল কুঁচকে বলল,

‘উনি মোটেও আমাকে টাইট করেননি। আমি এমনিতেই খুব ভালো মেয়ে ছিলাম।’

‘এএ আসছে। বিয়ের পরপর কী করেছিলি, আমার মনে নেই ভেবেছিস? সব মনে আছে। বয়স হয়েছে তো কী হয়েছ? স্মৃতিশক্তি এখনও আগের মতোই প্রখর।’

‘আচ্ছা, সেসব বাদ দে। এখন ঐ বিচ্ছু দুইটাকে এক করবি কী করে সেটা ভাব।’

রিতা তখন দাঁত বের করে হেসে বলল,

‘পৃথিবীতে বোধ হয় আমরাই একমাত্র মা বাবা, যে কী-না নিজেদের ছেলে মেয়েদের প্রেম করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছি। তোকে বলেছিলাম না, বুড়ি বয়সেও আমরা সব সাংঘাতিক সাংঘাতিক কাজ করব। কি, মিলল তো আমার কথা?’

মেহুলও হেসে বলল,

‘হ্যাঁ, আসলেই তো। আমরা তো জিনিয়াস মাদার।’

ফুচকা খেতে খেতে দুই মা বিশদ আলোচনা জুড়ল। কীভাবে পুতুল সারাজকে এক করবে, সেটাই তাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। অনেক ভাবল। ভাবতে ভাবতে, এক প্লেটের জায়গায় তিন প্লেট ফুচকা খেল। তাও ভাবনার সুতো কাটল না।

‘তোর কি মনে হয়, এই প্ল্যান’টা কাজে দিবে?’

রিতা বেশ আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল,

‘আলবাত, দিবে। তুই খালি মনোযোগ দিয়ে অভিনয়টা করিস তাহলেই হবে।’

‘আমি পারব। তোর তো আবার হাসির ব্যারাম আছে। ভুলেও সিরিয়াস মুহুর্তে হাসবি না কিন্তু।’

রিতা সঙ্গে সঙ্গেই হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে বলল,

‘না, একদমই না। মরে গেলেও হাসব না।’

‘ঠিক আছে তাহলে। আজ থেকে যুদ্ধে নামব আমরা।’

‘ওকে, বেস্ট অফ লাক।’

‘বেস্ট অফ লাক টু ইউ টু।’

______

‘মা, তোমরা দুই বান্ধবী মিলে কোথায় ঘুরতে যাও বলোতো?’

মেহুল কাঁধ থেকে ব্যাগ রেখে ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে। বড়ো করে হাই তুলে বলে,

‘তোকে কেন বলব? তুই তোর বান্ধবীর সাথে কোথায় ঘুরিস, সেটা বলিস আমাকে?’

‘সেটা তো না বললেও তোমরা জেনে যাও। বাবার চেলা পেলা চারদিকে ছড়ানো। কোথাও একটু লুকিয়ে ঘুরতে যাব, সেই উপায় আছে? ঠিক কারো না কারো চোখে পড়ে যাই।’

‘এই হলো, বাপ মন্ত্রী হওয়ার বারো নাম্বার অসুবিধা। বাকি এগারোটা মনে আছে তোর? নাকি মনে করিয়ে দিতে হবে?’

‘ওসব আছে, মা। কিন্তু, তুমি যেচে পড়ে কেন মন্ত্রীকে বিয়ে করতে গেলে বলোতো? তুমি আজ বিয়ে না করলেই তো আমার এই দশা হতো না। সব দোষ তো তোমারই। হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে লোভ সামলাতে পারোনি।’

মেয়ের কথা শুনে রীতিমতো স্তব্ধ মেহুল। মেয়ে কেমন লাগামছাড়া কথা বলছে দেখো! পুরো বাপের মতো হয়েছে। সে ধমক দিয়ে বলল,

‘এসব কী কথা, পুতুল? মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?’

‘না, বলে না। যারা মা’কে কেবল মা ভাবে, তারা বলে না। তবে, আমি তো আমার মা’কে আমার বন্ধুও ভাবি। তাই মা’র সাথে এভাবে কথা বলা নিষেধ হলেও, বন্ধুর সাথে নিষেধ নেই। তাই না, বন্ধু?’

বলেই মা’কে জড়িয়ে ধরল সে। মেহুলের রাগ পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। সেও একহাতে আগলে ধরল তাকে। ভাগ্যিস, সেদিন সারাজ তাকে দেখেছিল। নয়তো, এই মিষ্টি মেয়েকে কোথায় পেত সে?

_______

রাতে খাবার শেষ করে রুমে আসতেই, একটা আননোন নাম্বার থেকে পুতুলের ফোনে মেসেজ আসে। মেসেজটা দেখে কপাল কুঁচকে যায় তার। মেসেজে তার নাম সম্বোধন করা আছে। তার মানে অজ্ঞাত ব্যক্তি তাকে চিনে। মেসেজে লেখা, “কী করছো, পুতুল?” ভীষণ আবেগভরা ঠেকল কথাটা। যেন কোনো বয়ফ্রেন্ড একগাদা আহ্লাদ নিয়ে তার গার্লফ্রেন্ডকে মেসেজ দিয়েছে। পুতুল উত্তর দিল না। ফোনটা পাশে রেখে দিয়ে বিছানায় গা ভাসাল। এক পল পরে আবারও একটা টুং শব্দ। জেগে ছিল পুতুল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল, সেই আগের নাম্বার। ভীষণ বিরক্ত হলো যেন। এবার তাতে লেখা, “ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?”
এবারও পুতুল উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। ফোনটা পাশে রেখে ঘুমানোর চেষ্টা চালাল। কিন্তু তাতে আবারও ব্যাঘাত ঘটাল আরেকটা টুং শব্দ। এবার বিরক্তির সাথে রেগেও গেল সে। তবে মেসেজটা দেখতেই কিছুটা স্বস্থি পেল। মেসেজে লেখা, “কলম আর কলমের ঢাকনা সামলে রেখেছ তো, আবার যেন কাল আমার গায়ে না পড়ে।” এই মেসেজটা দেখে অজ্ঞাত ব্যক্তিকে চিনতে খুব একটা কঠিন হলো না পুতুলের। সে এবার উঠে বসে উত্তরে লিখল, “রাত বিরাতে মেয়েদের ডিস্টার্ব না করে ঘুমাও।”

কিছু সময় ব্যয় হলো, তবে ওপাশ থেকে আর কোনো উত্তর এল না। বোধ হয় কথাটা ঐ ছেলের গায়ে লেগেছে। সে তো আর ডিস্টার্ব করছিল না। একটু মেসেজ’ই তো করেছে। তাই বলে কেউ এভাবে বলে নাকি?
পুতুল অতসব ধরল না। ঐ ছেলে রাগ করল না, নাকি খারাপ লাগল তাতে ওর কিছু যায় আসেনা। অযথা কোনো ছেলের সাথে সখিত্ব তার একদম পছন্দ না। নেহাতই ছেলেটা কলমের ঢাকনাটা খুঁজে দিয়েছিল, তাই সৌজন্যতার খাতিরে চায়ের অফার করেছিল। নয়তো, ঐটুকুও করতো না।

______________

‘আব্বু, আমি তো আগেই বলেছি, ঐসব ব্যবসা বাণিজ্য আমাকে দিয়ে হবে না।’

সাদরাজ মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজটা সরিয়ে বিরক্ত চোখে ছেলের দিকে চাইল। সকাল সকাল মেজাজটা ভীষণ চটে গেল যেন। একবার গলা উঁচু করে ডাকল,

‘রিতা, এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।’

বলেই সে খবরের কাগজটা ভাঁজ করে সোজা হয়ে বসে। সারাজ ফোন দেখছে। সাদরাজ তার দিকে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,

‘তো, কী চাও তুমি?’

সারাজ প্রশ্ন শুনে মোবাইল থেকে মনোযোগ সরিয়ে বাবার দিকে চাইল। গলা ঝেরে বলল,

‘রাজনীতি। রাজনীতি করতে চাই, আব্বু।’

মেজাজ আরো তিক্ত হলো। কপালের ভাঁজ চওড়া হলো সঙ্গে সঙ্গে। সাদরাজ কঠিন গলায় বলল,

‘তোমার মাথায় এসব রাজনীতির ভূত কবে থেকে ঢুকেছে? রাজনীতি আমার পছন্দ না, সারাজ। এসবের মধ্যে নিজেকে জড়িও না।’

‘আব্বু, আমি তো শুনেছি তুমিও এককালে রাজনীতি করতে। তুমি তো সাবেক সংসদ সদস্য ও ছিলে। তাহলে তোমার রাজনীতির প্রতি এত অভিযোগ কেন?’

‘সেসব তোমার না জানলেও চলবে। তোমার বাবা যখন চাইছেন না, তখন দরকার কী এসবের মধ্যে জড়ানোর?’

চায়ের কাপ রাখতে রাখতে রিতা বলল। সারাজ মায়ের দিকে চেয়ে বলল,

‘মা, সবসময় তো তোমাদের চাওয়া মতোই সব করে এসেছি। এবার একটু আমার চাওয়াটাকেও প্রাধান্য দাও। আমার রাজনীতি পছন্দ। আর তার থেকেও অধিক পছন্দ রাবীর খানকে, আমার বাবাকে। আমিও বাবার মতো হতে চাই, মা। তাই প্লিজ, তোমরা আমাকে কেউ বাধা দিও না।’

বলেই সারাজ বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে রিতা চেঁচিয়ে বলে,

‘আরে, নাস্তা তো করে যা।’

‘বাইরে করে নিব, মা।’

সারাজ আর দাঁড়াল না। সে চলে যেতেই রিতা চিন্তিত ভঙিতে সাদরাজের পাশে বসে পড়ল। সাদরাজের মেজাজ তখন তুঙ্গে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,

‘তোমার ছেলে কিন্তু এবার বেশি বাড়াবাড়ি করছে, রিতা। ওকে বুঝাও। এসব রাজনীতির চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে বলো আমার ব্যবসায় যুক্ত হতে। আমি আর একহাতে কতদিক সামলাব, আমারও তো বয়স হয়েছে নাকি।’

রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘ঠিক আছে, আমি বুঝিয়ে বলব ওকে।’

‘আর আমাকে একবার রাবীরের সাথেও কথা বলতে হবে। রাবীর হয়তো ওকে এসবে প্রশ্রয় দিচ্ছে। তাই ওকেও বারণ করতে হবে, যাতে এসবের মাঝে সারাজকে ঢুকতে না দেয়।’

রিতা তখন বিচলিত সুরে বলল,

‘দেখবেন, ছেলেকে নিয়ে আবার দুই বন্ধুর মাঝে যেন কোনো ঝামেলা না হয়।’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে