#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৮।(অন্তিম পর্ব)
গ্রীষ্মের এক উত্তপ্ত সকাল। চারদিক খা খা করছে রোদে। বাইরে তাকানোই যেন মুশকিল। আর যারা বাইরে প্রতিদিনকার কাজে ব্যস্ত, তাদের তো মনে হচ্ছে তাপদাহ বুঝি তাদের খরখরে পিঠের উপর ঠাটিয়ে চাপড় বসিয়ে যাচ্ছে। এই আর যেন সহ্য করা যাচ্ছে না।
ঘেমে গেয়ে এসে পাঞ্জাবীটা খুলে রাখল রাবীর। উফ, মাথা ধরেছে তার। রীতিমত চোখে অন্ধকার নেমেছে যেন। সে গলা উচিয়ে মেহুলকে ডাকল,
‘মেহুল, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিতে পারবেন?’
নিচ থেকে আওয়াজ এল,
‘আসছি।’
রাবীর চুপচাপ বিছানায় শরীর মেলল। মেহুল গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে বলল,
‘আপনার শরবত।’
রাবীর উঠে বসে। শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে অমায়িক হেসে বলল,
‘এটা কখনো ভুলবেন না, তাই না?’
মেহুল মৃদুমন্দ হেসে বলে,
‘না।’
‘বসুন।’
ইশারায় রাবীরের পাশে বসতে বলল। মেহুল বসে না। বলে,
‘এখন বসা যাবে না। রান্নার কাজ বাকি। একটু পরেই রিতারা চলে আসবে।’
মেহুল ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে যেতে নিলেই রাবীর তার ওড়না টেনে ধরে। ভ্রু কুঁচকে ফিরে মেহুল। অধৈর্য গলায় বলে,
‘আর কী চাই?’
রাবীর তার নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসতেই, মেহুল বুঝে। এক ঝটকায় ওড়ানাটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘আমার অনেক কাজ। একদম জ্বালাতে আসবেন না।’
বলেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় সে। তার যাওয়ার পানে চেয়ে পুনরায় হেসে, বিছানায় গা এলিয়ে দেয় রাবীর।
______
দুপুরে রোদের ঝাঁঝ আরো বাড়ে। রান্নাঘরে মেহুল যেন আর টিকতে বাড়ছে না। তাও সে সটান দাঁড়িয়ে সব রেঁধে যাচ্ছে। কাউকে হাত লাগাতে দিচ্ছে না। এই একটা দিন, সে সবকিছু উপেক্ষা করে রান্নায় মনোযোগ দেয়। যদিও যার জন্য এত আয়োজন, সে আদৌ এত সব খেতে পারে না। এখন অল্প স্বল্প খাওয়া শিখলেও, ঐ ডাল ভাত চটকিয়েই খাওয়াতে হয় তাকে। নাহলে গলা দিয়ে নামে না যে। তাও, প্রতিবছর মেহুল বেশ আয়োজন করে সবকিছু করে। নিজের হাতে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়টা সে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। বাড়ি সুদ্ধ সবার জন্য একা রাঁধে। আর এই সবকিছুতেই মেহুল ভীষণ তৃপ্তি পায়।
______
ওড়ানা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে মেহুল রুমে প্রবেশ করে। রাবীর তখন আধশোয়া বসে লেপটপে কিছু করছিল। মেহুল এসে তাগদা দিয়ে বলল,
‘একবার সাদরাজ ভাইয়াকে কল দিয়ে দেখুন না, উনারা কোথায় আছেন।’
রাবীর লেপটপের উপরেই দৃষ্টি বরাদ্দ রেখে বলে,
‘মাত্র কথা হয়েছে। বলেছে, রওনা দিয়েছে।’
মেহুল বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে বলে,
‘সেকি! আমার তো এখনও কিছুই করা হয়নি। আর এক ঘন্টার মধ্যে কীভাবে সব করব?’
রাবীর লেপটপ চাপিয়ে তার দিকে ঘুরে তাকায়। বলে,
‘কী করতে হবে? আমাকে বলুন, আমি করে দিচ্ছি।’
মেহুল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মনে মনে হিসাব কষল, কোন কোন কাজ বাকি তার। পরে রাবীরের দিকে চেয়ে বলল,
‘আপাতত আপনি ড্রয়িং রুমটার ডেকোরেশনের ব্যবস্থা করুন। আমি বাকি কাজ করে নিতে পারব।’
__________
লাল রঙের জামদানি’টা গায়ে জড়াতেই, নিজেকে যেন নতুন বউ রূপে আবিষ্কার করল মেহুল। মনে পড়ল বিয়ের কথা। একটা লাল টুকটকে বউ সেজেছিল। কী নিদারুণ লজ্জা আর ভয় ছিল চোখে মুখে। তবে জেদ আর বিষন্নতাও ছিল বরাবর। কিন্ত, সময়ের পরিবর্তনে রাবীরের একচ্ছত্র ভালোবাসায় সমস্ত জেদ, রাগ, ক্ষোভ মিলিয়ে যায়। তৈরি হয়, নতুন সম্পর্ক। তারপর জীবন চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। অন্তরালে হাতিয়ে দেখে, একি ভিতরে তো শূন্যতা ছেয়ে আছে। আজও সেই শূন্যতা পূরণ হয়নি। মেহুল ভ্রু কুঁচকে ফেলল। নিজেকে নিজে ধমকে বলল,
‘কে বলেছে পূরণ হয়নি?’ এই যে তার ছোট্ট সারাজ, সব শূন্যতা পূর্ণ করে দিয়েছে। আর কোনো কিছুর আক্ষেপ নেই তার।
শাড়ির আঁচল’টা পেছনে ঠেলতেই পিঠে কারোর উষ্ণ স্পর্শ পায়। আয়নার দিকে ফিরে তাকায়। রাবীর খুব যত্ন করে একটা পিন দিয়ে আঁচলটা আটকে দেয়।
চোখ সরিয়ে আয়নায় তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নেয় সে। কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
‘এখনও কেন আপনাকে দেখলে আপনার হৃদস্পন্দন থমকে যায়, মেহুল? এই একটা মানুষের উপর আমি আর কতবার প্রেমে পড়ব বলুন তো?’
লজ্জায় গালে লাল আভা ফুটে মেহুলের। ছয় বছরের বৈবাহিক জীবন তাদের। অথচ, মেহুলের লজ্জা পাওয়া দেখলে মনে হয়, সে যেন সদ্য বিবাহিতা একটা ছোট্ট কিশোরী। যার প্রতিটা শিরায় শিরায় প্রেমের পীড়া টগবগ করছে।
লজ্জায় রাঙা মেহুলকে দেখে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে রাবীর। পুনরায় একই স্বরে বলে,
‘এখনও এত লজ্জা! লজ্জা ভাঙার আর কোনো উপায় তো বাকি রাখিনি। তাও এত লজ্জা কোথ থেকে আসে?’
বেশ আফসোসের সুরে বলে রাবীর। মেহুলের তো তাতে আরো লজ্জা বেড়ে যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে লোকটার লজ্জা শরম সব লোপ পাচ্ছে। হুটহাট কেমন সব বেশরম কথা বলে বসেন। মেহুল কিছু বোঝাতে আসলেই, উল্টো সেই কথার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। তাই মেহুল ও এখন ধৈর্য্য হারিয়ে পিছ ছেড়ে দিয়েছে।
মেহুলের ধ্যান ভাঙে রাবীরের অধর স্পর্শে। তার ঘাড়ে গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে রাবীর সরে আসে। চোখে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
‘ঐ যে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওরা চলে এসেছে বোধ হয়।’
রাবীর রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মেহুল কোনো রকমে চুল বেঁধে তার পেছনে হাঁটা ধরে।
গাড়ির দরজাটা খুলেই একটা পাঁচ বছরের ছেলে ছুটে এসে মেহুলের কোমড় জড়িয়ে ধরে। খিলখলিয়ে বলে উঠে,
‘কেমন আছো, মা?’
তার উচ্ছ্বসিত বাচ্চা গলার স্বরে মনটা আনন্দে ভরে যায় মেহুলের। বাচ্চাটাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। বলে,
‘আমি ভালো আছি, সোনা। তুমি কেমন আছো?’
ছেলেটা মাথা তুলে তাকায়। দু হাত দু দিকে মেলে দিয়ে বলে,
‘আমি এতগুলো ভালো আছি।’
মেহুল তার গাল টেনে দেয়। হেসে বলে,
‘তাই!’
ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
‘দাদু কোথায়?’
‘উপরে, তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।’
ছেলেটা এক দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। সে যাওয়ার পর রিতা এসে তার পাশে দাঁড়ায়। হেসে বলে,
‘কাল থেকে পাগল হয়ে যাচ্ছিল, আম্মু, কবে মা’র কাছে যাব, কবে মা’র কাছে যাব, এই বলে বলে। আর এখন এসেই দেখ, কেমন চোটপাট শুরু করেছে।’
মেহুল হেসে বলে,
‘থাক। ও এমন করে বলেই তো, আমরা আনন্দে থাকতে পারছি।’
________
দুপুরের খাওয়া শেষ করে, মেহুল বসল সারাজকে খাওয়াতে। নিজ হাতে ভাত মেখে খুব ছোট একটা লোকমা তুলে সে সারাজের মুখের সামনে ধরে। সারাজ ততক্ষণাৎ মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে অভিমানের সুরে বলে,
‘আমি আগে কেক কাটব, মা।’
রিতা পাশে বসেই দই খেতে খেতে বলল,
‘ঐ হয়েছে। কেকের কথা শোনার পর থেকেই খাওয়া দাওয়া সব উঠে গিয়েছে তার।’
মেহুল এক হাতে সারাজকে আগলে নেয়। আদুরে গলায় বলে,
‘কেক কাটব তো আমরা। সবাই মিলে কেক কাটব। তবে এখন না, সন্ধ্যায়।’
ছেলেটা তার দিক চেয়ে মন খারাপ করে বলল,
‘কেন? এখন কাটলে কি হবে?’
‘দুপুর বেলায় তো কেউ কেক কাটেনা, বাবা। সন্ধ্যার পর সবাই বার্থডে পালন করে। তোমার জন্য কিন্তু আমরা অনেকগুলো গিফ্টও এনেছি। তোমার কি গিফ্টগুলো চাই?’
ছেলেটার চোখ মুখ খুশিতে চকচক করে উঠে। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চাই।’
মেহুল হেসে বলে,
‘তাহলে আগে তোমাকে এই ভাত গুলো শেষ করতে হবে। তারপর তুমি তোমার সমস্ত গিফ্ট পেয়ে যাবে।’
ছেলেটা মাথা হেলিয়ে বলল,
‘আচ্ছা।’
.
সন্ধ্যায় কেক কাটা শেষ করে, সারাজ তার গিফ্টগুলোতে মনোযোগ দিল। অনেক গিফ্ট পেয়েছে সে। তার আম্মু আব্বু তাকে অনেক রকমের খেলনা কিনে দিয়েছে। আর তার মা বাবা তাকে একটা ছোট্ট সাইকেল গিফ্ট করেছে। এই গিফ্ট পেয়ে তো বেচারা খুশিতে আত্মহারা। তাছাড়া তার দাদুও তাকে বেশ সুন্দর সুন্দর কিছু কাপড় কিনে দিয়েছেন।
.
সাদরাজ বড়ো কেকের পিস’টা রেখে দেয়। পেছন থেকে রিতা দেখে বলে,
‘কী ব্যাপার, খাবেন না?’
সাদরাজ চেয়ে বলল,
‘না, ইচ্ছে করছে না।’
রিতা মুচকি হেসে এগিয়ে আসে। কেক’টা তুলে নিজের ঠোঁটের অংশে ঘষে দেয়। সাদরাজ তার কাজ দেখে ভ্রু কুঁচকায়। ব্যাপার’টা ঠাহর করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কেক’টা ঠোঁটে মুখে লাগিয়ে লাজুক হাসে সে। পিটপিট করে এদিক ওদিক চেয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এবার খাবেন?’
সাদরাজ বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। মেয়েটা লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছে নাকি? ছেলেটা যে বড়ো হচ্ছে, অথচ এই মেয়ে বাচ্চা বাচ্চাই রয়ে গিয়েছে। সাদরাজ দু’দিক মাথা নাড়িয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে। রিতার দিকে দু’কদম এগিয়ে তার ঠোঁটের পাশটা আঙ্গুল দিয়ে ঘষে লঘু সুরে বলে,
‘আমার ছেলে বাচ্চাটা বড়ো হলেও, বউ বাচ্চাটা আর বড়ো হলো না।’
রিতা তখন অতশত না ভেবে চট করে তার মুখ এগিয়ে কেকের অংশটা সাদরাজের গাল ঘষে লাগিয়ে দিল। সাদরাজ পিছিয়ে যায়। গালে হাত দিয়ে হতাশ গলায় বলল,
‘অসভ্য মেয়ে।’
_________
সারাজ এবার কিছুদিন মেহুলদের সাথে থাকবে। তারপর আবার যাবে তার আব্বু আম্মুর বাড়িতে। এভাবেই সে থাকে। কিছুদিন মা বাবার কাছে, কিছুদিন আম্মু আব্বুর কাছে। আর এই নিয়ে তার কোনো অসুবিধা নেই। আবার রিতা বা সাদরাজেরও কোনো অভিযোগ নেই। মেহুল এই নিয়েই ভালো আছে, সুখে আছে। জীবন নিয়ে আর কোনো আক্ষেপ বা আফসোস নেই তার। তাদের ছোট্ট সারাজ তাদের জীবনে পূর্ণতা এনে দিয়েছে। আর এখন জীবন এটাতেই খুশি। সব পাওয়া না পাওয়ার মাঝেও গল্পের শেষটা ভীষণ সুন্দর। অন্তত মেহুল এখন তাই ভাবে।
সমাপ্ত।
#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
#অন্তিম (সারপ্রাইজ পর্ব)
হুট করেই গরমের ঠান্ডা লেগেছে সারাজের। বাচ্চা ছেলেটার বেহাল দশা। তাকে নিয়ে চিন্তায় অস্থির তার প্রিয়জনেরা। দু’দিন অপেক্ষা করেও ঠান্ডার কোনো অবসান না দেখে হসপিটালে ছুটল সবাই। রিতা, সাদরাজের সাথে মেহুল আর রাবীরও আছে। মেহুল আর রিতা সারাজকে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনে প্রবেশ করে। ছোট্ট সারাজের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে বাচ্চাটা। এই নিয়ে দুই মায়ের চিন্তার শেষ নেই।
ডাক্তার ভালোভাবে সারাজকে দেখে বললেন, গরমের ঠান্ডা। গায়ের ঘাম শুকিয়ে এই ঠান্ডার উৎপত্তি। ছেলেটাকে কিছুদিন রেস্টে রাখতে হবে। আর তার সাথে নিয়ম মাফিক ঔষধগুলো খাওয়াতে হবে।
ডাক্তার দেখিয়ে তারা কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। সাদরাজ আর রাবীর তখন বাইরেই ছিল, তাদের অপেক্ষায়। রিতা আর মেহুল তাদের কাছে গিয়ে সারাজের ব্যাপারেই কথা বলছিল। সারাজ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে। এই জায়গাটা নতুন তার কাছে। এই পরিবেশটা বেশ অন্যরকম ঠেকল তার। সবার মাঝেই সে দাঁড়িয়ে ছিল। হুট করেই কী ভেবে গুটি গুটি পায়ে সামনে এগিয়ে যায়। কথার মাঝে ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করে না। অনেকটা এগিয়ে বাচ্চা ছেলেটা থমকে দাঁড়ায়। পর্দা সরিয়ে ছোট্ট মুখটা এগিয়ে উঁকি দেয়। কী দেখে যেন সে সেদিকেই চেয়ে থাকে। মেহুল আচমকা তার পাশে সারাজকে না দেখে অস্থির হয়ে উঠে। পরে ভালো মতো সামনে তাকাতেই দেখে, বাচ্চাটা কার কেবিনে যেন উঁকি দিচ্ছে। ওকে পেছন দিয়ে দেখে মেহুল হেসে ফেলে। রিতার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
‘দেখ রিতা, তোর ছেলের কান্ড দেখ।’
সবাই মেহুলের ইশারা দেওয়া হাতের দিকে চাইল। তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসল সবাই। বাচ্চাটা কেবিনের ভেতর কী এত দেখছে?
মেহুল তার দিকে এগিয়ে যায়। পেছনে দাঁড়িয়ে সেও সারাজের মতো ভেতরে উঁকি দেয়। বিশেষ কিছু দেখতে পারে না সে। সারাজের পাশে আস্তে করে বসে, প্রশ্ন করে,
‘ঐদিকে কী দেখছো, সোনা?’
ছেলেটা হকচকিয়ে ফিরে। পরে নিজেকে স্বাভাবিক করে, দুঃখি দুঃখি গলায় বলে,
‘মা, দেখো ঐ বাবুটা কত কাঁদছে। ওকে কেউ আদর করছে না কেন? ওর মা বাবা কোথায়, মা?’
মেহুল এতক্ষণে ব্যাপারটা খেয়াল করে। হ্যাঁ, কেবিনের একটা খালি বেডে তোয়ালে মোড়ানো একটা বাচ্চা গলা ছেড়ে কেঁদে যাচ্ছে। অথচ আশেপাশে তার কেউ নেই। কারোর কানেই কি বাচ্চাটার কান্না যাচ্ছে না? বাচ্চাটার মা বাবা কোথায়?
মেহুল কেবিনটা ভালো ভাবে খেয়াল করে দেখল। কিন্তু, কোথায় কেউ নেই। অদ্ভুত তো! মেহুল কেবিনের ভেতরে এগিয়ে যায়। তার পেছন পেছন সারাজও যায়। তাদের ভেতরে ঢুকতে দেখে বাকি সবাই ও কেবিনের দিকে আসে।
মেহুল বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দুগ্ধশিশুটা কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ভয়ংকর লাল করে ফেলেছে। তাও তার কান্না থামছে না। মেহুলের তাকে দেখে বড্ড মায়া হয়। সে সযত্নে কোলে তুলে দেয় বাচ্চাটাকে। তখন পেছন থেকে সারাজ তার ওড়নায় টান দেয়। মেহুল ঘুরে চাইতেই সে ফোকলা দাঁতে হেসে বলে,
‘নিচে নামাও, আমিও একটু দেখি।’
মেহুল মুচকি হেসে হাঁটু ভেঙে সারাজের সামনে বসে। সারাজ আপ্লুত চোখে বাচ্চাটাকে দেখে। এত ছোট শিশু সে আগে দেখেনি। এ যেন এক ছোট্ট পুতুল। সারাজ তার ছোট ছোট হাত এগিয়ে বাচ্চাটার চোখ মুখ মুছিয়ে দেয়। আদুরে গলায় বলে,
‘থাক পুতুল, আর কেঁদো না।’
মেহুল চমকে তাকায়। হেসে বলে,
‘ও পুতুল?’
সারাজ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
‘হ্যাঁ তো। দেখো, পুরো পুতুলের মতো ছোট্ট একটা শরীর। কেমন তুলতুলে নরম ওর হাত পা। আমার বাসায়ও ওর মতো একটা পুতুল আছে।’
ওর কথা শুনে মেহুল সহ বাকি সবাই হেসে ফেলে।
মেহুল হাসতে হাসতে আবার বাচ্চাটার দিকে তাকায়। সে এতক্ষণে খেয়াল করে বাচ্চাটা আর কাঁদছে না। ভেজা চোখে পিটপিট করে চেয়ে আছে। ঐ মিষ্টি, মায়াভরা ছোট্ট মুখটা দেখে মেহুলের হৃদয় যেন বড্ড ব্যথিত হয়। সে দু হাত তুলে বাচ্চাটাকে নিজের গালের সাথে মিশিয়ে নেয়। বাচ্চাটাও কেমন যেন আদর পেয়ে মেহুলের কোলে একদম মিশে গিয়েছে। রাবীর নিষ্পলক চেয়ে মেহুলকে দেখে। একটা ছোট্ট বাচ্চা পেলেই মেয়েটার হৃদয় যেন হুহু করে উঠে। পুরনো ঘা থেকে রক্ত ঝরে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
সেই সময়ই একজন নার্স ত্রস্ত পায়ে কেবিনে প্রবেশ করে। উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে,
‘আপনারা কি বাচ্চাটার পরিবারের কেউ?’
সবাই চমকে তাকায়। মেহুল কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে বলে,
‘না। কিন্তু, বাচ্চাটার বাড়ির লোক কোথায়? ওর মা বাবা কোথায়?’
নার্সটি বিকৃত মুখে বিতৃষ্ণার সুরে বলল,
‘আর বলবেন না, জন্ম দিয়েই মা উধাও। এমন একটা দুধের শিশুকে রেখে কেউ কি পালিয়ে যায়, বলুন। আজকাল মানুষের দয়া মায়া বলতে কিছু নেই। কালই শিশুটার জন্ম। জন্মের দু ঘন্টা পর কেবিনে এসে দেখি, বাচ্চা আছে অথচ মা উধাও। হুলোস্থুল লাগে হসপিটালে। মা’কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর না পাওয়া গিয়েছে বাচ্চাটার পরিবারের কাউকে। তাই এই ফুটফুটে বাচ্চাটা এভাবে অনাহারে অবহেলায় এখানে পড়ে আছে। পুলিশকে জানানো হয়েছে, এখন উনারা এসেই একটা সিদ্ধান্ত নিবেন। না জানি, বাচ্চাটার ভবিষ্যত কেমন হবে! বড়ো মায়া হচ্ছে বাচ্চাটাকে দেখে।’
মেহুলের বুকটা কেমন যেন করে উঠল। এমন একটা বাচ্চাকে কেউ ফেলে রেখে কী করে চলে যেতে পারে? এত নিষ্ঠুর মানুষ কী করে হতে পারে? সে বাচ্চাটাকে আরো বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। রাবীরের দিকে চেয়ে বিনা দ্বিধায় বলে উঠে,
‘আমি এই বাচ্চাটাকে দত্তক নিতে চাই, রাবীর।’
রাবীর বিহ্বল, নির্বাক। এতদিন মেয়েটা নিজে থেকেই দত্তক নিতে চাইছিল না। রাবীর অনেকবার বললেও, সে রাজি হয়নি। তার কাছে তো সারাজ ছিল। কিন্তু, আজ হঠাৎ করেই মেয়েটার অভিব্যক্তি এভাবে বদলে গেল?
মেহুল পুনরায় অধৈর্য গলায় বলল,
‘কী হলো, আপনি কিছু বলছেন না কেন?’
রাবীর এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটার মুখ পানে চাইল। বাচ্চাটার চোখ বুজা। মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘আপনি কি নিশ্চিত, মেহুল?’
মেহুল ঢোক গিলে পরপর মাথা ঝাঁকাল। রাবীর তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। নার্সের দিকে চেয়ে বলল,
‘বাচ্চাটাকে আমরা এডপ্ট নিব। আপনি ডক্টরের সাথে কথা বলুন।’
নার্স খুশি হয়ে মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেল।
.
রিতা এসে মেহুলের কাঁধে হাত রাখে। মেহুল ভেজা স্বরে বলল,
‘আমি কি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি, রিতা?’
রিতা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। তাকে আশ্বস্ত দিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’
.
দুই দিনের মধ্যেই সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাচ্চাকে নিয়ে বাড়িতে আসে মেহুল আর রাবীর। আজ থেকে তারাই এই বাচ্চার আইনানুগ বাবা মা।
তারা বাড়িতে প্রবেশ করতেই, রাবীরের মা এগিয়ে এলেন। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বললেন,
‘সেই তো বাচ্চা দত্তক নিলে। তাহলে এই ছয় বছর এত অপেক্ষা করার কী দরকার ছিল?’
তার প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি কেউ। তবে ভদ্রমহিলা দারুণ সুন্দর ভাবে বাচ্চাটাকে মেনে নিল। কোলে নিয়ে অনেক আদর করল। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিল ছোট্ট শরীরটাকে। তারপর হেসে প্রশ্ন করলেন,
‘তা, বাবুর নাম কী রাখবে?’
‘পুতুল, ওর নাম পুতুল। আমার পুতুল।’
পেছন থেকে ছুটে এল সারাজ। খুশিতে হাত তালি দিতে দিতে বলল,
‘মা, ও আমার পুতুল।’
তার কর্মকান্ড দেখে সবাই হেসে ফেলল। রিতা এসে মেহুলের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘মনে হচ্ছে, আমার ছেলের বউ চলে এসেছে।’
মেহুল চমকে তাকায় তার দিকে। পরে আবার সারাজ আর ছোট্ট পুতুলকে দেখে। হঠাৎই কী ভেবে যেন চকচক করে উঠে তার চোখ। সত্যিই কি, বাচ্চাটা তার সারাজের পুতুল?
সমাপ্ত।