#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৭।
সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা পেরিয়ে মুহুর্তেই কেটে যায় নয়টা মাস। এখন দেশে কনকনে শীত চলছে। গ্রামের এই সময়টা নিতান্তই মনোমুগ্ধকর। কুয়াশা বেষ্টিত পরিবেশে মন প্রাণ যেন হুহু করে উঠে। শীতে টনটন করে উঠে গায়ের চামড়া। কিন্তু, শহরে এই দৃশ্য অনেকটাই ভিন্ন। এখানে শীতের দাপট খুব একটা চলে না। ভোর সকালে শীত বাবাজি খুব আয়োজন করে এলেও দুপুর ঘনিয়ে আসতেই তার হাওয়া ফুস হয়ে যায়। তবে রাত বাড়ার সাথে সাথে তার তীব্রতা কিন্তু আবার বেশ বোঝা যায়।
ছেলেটাকে মোটা কাপড়ের এক সোয়েটার পরিয়ে কাঁথা দিয়ে ভালোভাবে মুড়িয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে রিতা। গরম গরম দু কাপ কফি বানাতে হবে। কয়েক পল যেতে না যেতেই শোনা গেল, কান্নার শব্দ। রিতা সতর্ক হয়। গা খাড়া করে শব্দটা শোনে। পরপরই চেঁচিয়ে ডাকে,
‘সাদরাজ, বাবু কাঁদছে কেন?’
উপর থেকে সাদরাজও বড়ো গলায় বলে,
‘কাঁদবে না, এমন করে কাপড় মুড়িয়ে ছেলেটাকে শ্বাস নেওয়ার উপক্রম রেখেছ? বেচারা গরমে হাঁসফাঁস করছে।’
পরের কথাটা আর রিতার কানে যায়নি। তবে যতটুকু শুনেছে সেইটুকুতেই আশ্বস্ত হয়ে আবার কফি বানানোতে মনোযোগ দেয়।
কফির কাপ দুটো ট্রে’তে রেখে রুমে ঢুকেই আরেক দফা চেঁচিয়ে উঠে রিতা,
‘একি! আপনি বাবুকে এভাবে শুইয়ে রেখেছেন কেন? ঠান্ডা লাগবে তো।’
কথাটা সম্পূর্ণ করেই, হাতের ট্রে’টা অযত্নে টি টেবিলের উপর রাখে। ছুটে আসে বিছানার কাছে। একটা কাঁথা দিয়ে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে নেয়। সাদরাজ ওর কর্মকান্ড দেখে ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে দুই দিকে মাথা নাড়ায়। মানে এসবে ভীষণ বিরক্ত সে। লেপটপ’টা চাপিয়ে সোজা হয়ে বসে। নরম গলায় বলে,
‘সারাজ তখন গরমে কাঁদছিল, রিতা। এত কাপড় পরালে বাচ্চাদের অস্বস্তি হয়। আর আমাদের এখানে খুব একটা ঠান্ডা নেই। দেখছো না, কাঁথাটা সরিয়ে দেওয়ায় কত সুন্দর করে খেলছে।’
মায়ের মন, অত শত মানতে নারাজ। শীত পড়ুক বা না পড়ুক, শীতের ঋতুতে বাচ্চাদের ভারী কাপড় পরাতেই হবে। রিতার নিশ্চল অভিব্যক্তি দেখে সাদরাজ বোঝে, রিতার কোনোকিছুই মাথায় ঢুকেনি। তাই সেও আর কথা না বাড়িয়ে কফির কাপটায় চুমুক বসায়।
সারাজকে দু পায়ের উপর বালিশ দিয়ে শুইয়ে দিয়ে রিতা কফির কাপ হাতে নেয়। পরক্ষণেই আবার সাদরাজের দিকে চেয়ে বলে,
‘চলুন না, আজ একটু রাবীর ভাইয়াদের বাসায় যাই।’
সাদরাজ একপলক চেয়ে বলে,
‘সারাজকে নিয়ে বেরুবে?’
‘হ্যাঁ, ওকে দেখলেই তো মেহুল খুশি হয়ে যায়। এখন তো আমার থেকে ওর ওকেই বেশি প্রয়োজন।’
বলেই বিষন্নতায় ঠোঁট টেনে হাসে। একটা বাচ্চার জন্য মেয়েটার দুঃখের শেষ নেই। যতই রাবীর ভাইয়া ওকে বোঝাক না কেন, কোনো নারীর মন কি আর মাতৃত্বের স্বাদবিহীন জীবন মানতে পারে? এই যে তার বাচ্চাটাকে যখন প্রথম মেহুলের কোলে দেওয়া হয়েছিল, সেদিন ও খুব কেঁদে ছিল। সারাজকে বুকে নিয়ে সুখে, দুঃখে হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হয়ে উঠেছিল তার। সেদিন তার সেই কান্না দেখে রিতাও কেঁদেছিল খুব। খুব করে দোয়া করেছিল, তার এই কান্নার অবসান ঘটুক। তার কোল জুড়েও একটা ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা আসুক। কিন্তু, হলো না। বরাবরের মতোই রিতার কোল খালি। মেয়েটা এখন আর আগের মতো কাঁদে না। হাসে যে, তেমনও না। ঐ চলছে জীবন, জীবনের মতো। তবে সবকিছুর মাঝেও একটু ভালো আছে, শুধুমাত্র রাবীর ভাইয়ের জন্য। বড্ড ভাগ্য করে এই মানুষটাকে সে পেয়েছে।
ভাবনার পর্ব শেষ করে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় রিতা। সাদরাজকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘চলুন, এখনই যাই। বিকেলে তো ভাইয়াও বাসায় থাকে।’
‘ঠিক আছে, তৈরি হয়ে নাও।’
_________
সন্ধ্যার আযান হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। বাইরে আবছা আলো। কুয়াশায় যেন বেশি ঘোলাটে লাগছে চারদিক। ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে, এক জোড়া স্বচ্ছ চোখের নিরেট দৃষ্টি বাইরের নিস্তব্ধ রাস্তাটার উপর। এই সময় এইদিকে একদমই মানুষ থাকে না। কেমন যেন চারদিক নিরব নিস্তব্ধ হয়ে উঠে। এই নিরবতা দেখেও মেহুল শান্তি পায়। আজকাল কোলাহল বেশ সমীচীন ভাবে এড়িয়ে চলে সে। মানুষের হাক-ডাক খুব একটা পছন্দ না। তাই তো প্রতিদিন ছাদে একান্তে সময় কাটায়। নিজেকে বোঝায়। এটাই তার জীবন, এইভাবেই চলবে সবকিছু। মাঝে মাঝে মন বোঝে, আবার মাঝে মাঝে মন বড্ড বেশি অশান্ত হয়ে পড়ে; জিজ্ঞেস করে, কেন? কেন, তার সাথেই এমন হলো?
গেইটের সামনে সাদা ফকফকা গাড়িটাকে থামতে দেখেই চকমকিয়ে উঠে মেহুলের উজ্জ্বল ফর্সা মুখশ্রী। নিমিষেই মিশে গেল সব হতাশা। এক ছুটে নিচে নামল সে। দৌড়ে গেল গেইটের সামনে। ততক্ষণে সাদরাজ আর রিতা গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। মেহুল ছুটে গিয়ে আগে ছোট্ট সারাজকে কোলে তুলে নিল। তারপর সাদরাজের দিকে চেয়ে হেসে জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন আছেন, ভাইয়া?’
‘ভালো, আপনি কেমন আছেন?’
‘এই যে, আমার খুশি আমার কোলে। এখন আর ভালো না থেকে উপায় আছে। আসুন, ভেতরে আসুন।’
বলেই সারাজকে বুকে জড়িয়ে হাঁটা ধরল মেহুল। পেছন থেকে রিতা ঠোঁট উল্টে বলল,
‘আজকাল কেউ তো ভুলেই গেছে, তার যে একজন বেস্টফ্রেন্ড আছে। তাকে তো সে পাত্তাই দিচ্ছে না।’
রিতার কথা শুনে মেহুল ঘুরে তাকায়। ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বলে,
‘পাত্তা পাওয়ার মানুষ এসে পড়েছে, তাই এখন থেকে তোকে আর আমি চিনি না। হু’
ঠোঁট বাকিয়ে আমার সামনে তাকায় মেহুল। পেছন থেকে রিতা হেসে ফেলে। বলে,
‘দেখা যাবে, প্রয়োজন পড়লে কাকে ডাকিস।’
_______
সাদরাজ আর রাবীরকে নাস্তা দিয়ে, মেহুল বাবু আর রিতাকে নিয়ে উপরে তার রুমে যায়। মেহুল আসার পর থেকে সারাজকে আর কোল থেকে নামায়নি। আর বাচ্চাটাও মেহুলের কোলে খুব আরাম করে ঘুমাচ্ছে। এমনিতে তার ঘুম পাতলা। অথচ, আজ তার চোখই খুলছে না যেন।
রিতা বলল,
‘ঘুমাচ্ছে যখন বিছানায় শুইয়ে দে।’
মেহুল নরম সুরে বাচ্চাটার মুখের দিকে চেয়ে বলল,
‘থাক না আমার কোলে।’
রিতা আর কিছু বলল না জবাবে। সে মেহুলের মন বোঝে।
তারা কথা তুলতেই মেহুলের শাশুড়ি মা রুমে এলেন। রিতার দিকে চেয়ে হেসে হেসে বললেন,
‘বাচ্চার মা দেখি শুকিয়ে গিয়েছে। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো না?’
‘করি, আন্টি। ঐ যে রাত জাগতে হয়, সকালেও বাবুর জন্য ঠিক মতো ঘুমাতে পারি না, তাই শরীরের উপর দিয়ে একটু বেশি ধকল যাচ্ছে।’
শাশুড়ি মা এগিয়ে গিয়ে মেহুলের কাছে দাঁড়ালেন। সারাজকে মনোযোগ দিয়ে দেখে বললেন,
‘মাশাল্লাহ, বেটা তো বড়ো হয়ে গিয়েছে। পুরো বাপের মতো হয়েছে কিন্তু দেখতে।’
তাঁর কথার জবাবে রিতা প্রসন্ন হাসে। পরে তিনি এক পলক মেহুলের দিকে তাকান। মেহুল বাচ্চাটাকে এমন যত্নে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে , যেন বাচ্চাটা তার। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। শুধু রিতাকে বলে গেলেন,
‘রাতের খাবার খেয়ে যেও।’
____
কথার প্রসঙ্গে মেহুল বলল,
‘আমার মেয়ে নেই তো কী হয়েছে, তোর ছেলের জন্য মেয়ে কিন্তু আমিই খুঁজে বের করব।’
কথাটা বলেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হাসে সে। রিতাও তখন হেসে বলে,
‘অবশ্যই, আফটার অল তুই তো ওর মা।’
মেহুল বিস্ময়ে চেয়ে বলে,
‘মা? আমি?’
রিতা হেসে মাথা নাড়ায়। বলে,
‘হ্যাঁ। আমি সারাজের আম্মু আর তুই সারাজের মা। সারাজ তোকে মা বলেই ডাকবে।’
মেহুলের চোখ চকচক করে। খুশি নাকি আক্ষেপ বোঝা যায় না। ঠোঁট চেপে সারাজের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আলতো চুমু খায় তার কপালে। রিতার দিকে চেয়ে বলে,
‘তুই এত ভালো কেন, দোস্ত? এত ভালোবাসিস কেন আমায়? আমার যে এখন বেশি ভাশোবাসা পেতেও ভয় করে, যদি হারিয়ে যায়।’
রিতা নাক মুখ কুঁচকাল। রাশভারী গলায় বলল,
‘এসব আজগুবি কথা বন্ধ কর। আসল কথায় আয়। শোন, আমাদের এই ছোট্ট সারাজের দুটো মা। একটা আমি, আরেকটা তুই। এই বাচ্চাটা আমাদের দুজনের। ওর উপর আমাদের দুজনের সমান অধিকার থাকবে। তাই তুই কখনো ওকে বান্ধবীর বাচ্চা ভাববি না। ভাববি, ও তোর নিজের বাচ্চা। বুঝেছিস?’
মেহুল আর জবাব দিবে কী। তার আগেই কোটর উপচে জল বেরিয়ে আসে। কেঁপে উঠে শরীর। বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে হুহু করে কেঁদে উঠে হৃদয়। এই ছোট্ট জীবনে, না পাওয়ার হিসেব খুব বেশি না হলেও পাওয়ার হিসেব অফুরন্ত। এই যে এত ভালোবাসা, এত সুখ, এসব কিছু তার পাওনার খাতায় থাকবে, সে ভাবেওনি। অথচ, একটা ছোট্ট দুঃখেই এতদিন হতাশায় অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল যেন। ভাগ্যিস, এই মুহূর্তেটা এসেছে। নয়তো এই গল্পের শেষটা সুন্দর কী করে হতো।
চলবে….