শেষটা সুন্দর পর্ব-৬৫+৬৬

0
1017

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৫।

এক তিক্ত গম্ভীরতা ছেয়ে আছে পুরো কক্ষ জুড়ে। ক্ষণে ক্ষণে শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ কেবল কর্ণগোচর হচ্ছে। মেহুল ভয়ে যবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত পা মৃদু কাঁপছে তার। শাশুড়ি মায়ের প্রতিক্রিয়া ধরতে পারছে না। চোখ পিটপিট করে সে রাবীরের দিকে মনোযোগ দেয়। রাবীর আগের মতোই শান্ত, নিরব। মেহুলকে চোখ দিয়ে ইশারা করে আশ্বস্ত করে। কিন্তু, বললেই কি আর নিশ্চিন্ত হওয়া যায়?তাও আবার এত বড়ো একটা ঘটনার পর।

বয়স বাড়লেও, চোখে মুখে বার্ধক্যের ছাপ নেই। চোখ মুখ এখনো টানটান তার। এই বয়সে এসেও মুখের এমন সুশ্রী ভাব’ই প্রমাণ দেয়, যৌবনে তিনি হৃদয়হরনী ছিলেন। শাড়ির আঁচল’টা টেনে কপালের ঘাম মুছলেন রাবীরের মা। অনেকক্ষণ ধরে কিছু ভাবলেন, গভীর চিন্তা করলেন। তার এই এত বছরের জীবনে এমন বিদঘুটে ধাক্কা কখনও খাননি তিনি। তাই আজ একটু নিজেকে ধাতস্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছে। তাও নিজেকে সামলালেন। গুমোট মুখে একবার ছেলেকে আরেকবার ছেলের বউকে পরখ করলেন। মেহুল ভয়ে ঠকঠক করছে। পাতলা ঠোঁট যুগল তিরতির করে কাঁপছে তার। কপালের ছোট চুল ঘামে লেপ্টে আছে। কী হবে এখন?

শাশুড়ি মা চাইলেন মেহুলের দিকে। কর্কশ গলায় শুধালেন,

‘বিয়ের আগে এই কথা তুমি জানতে না?’

মেহুল পরপর চোখের পল্লব ফেলে। একবার রাবীরের পানে চায়। পরে ভয়ে ভয়ে তাকায় শাশুড়ির দিকে। কী উত্তর দিবে? কথা সব গুলিয়ে ফেলেছে। কন্ঠস্বর বসে গিয়েছে। তাও চেষ্টা চালাল। খুব কষ্টে কম্পিত স্বরে বলল,

‘না, মা। আমি কিছুদিন আগে টেস্ট করিয়ে জেনেছি।’

শাশুড়ি মা নাকের পাটা ফুলিয়ে ফোস ফোস নিশ্বাস ফেলছেন। রাগ তার তরতরিয়ে ব্রহ্মতালুতে উঠে নাচছে। তাও, ছেলে সামনে উঁচু গলায় কিছু বলতে পারছেন না। তাই দাঁত চেপে রাগ নিবারণের পৃথা চেষ্টা চালিয়ে বলেন,

‘ডাক্তার কী বলেছেন? কী সমস্যা তোমার?’

মেহুল আই-ঢাই করছে। ফরফরিয়ে সব বলে দিতে পারলে মন হালকা হত তার। কিন্তু, আপাতত সেই উপায়ও নেই। তাই সে ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে বলল,

‘আমার জরায়ুতে সমস্যা। ডাক্তার বলেছেন, এটা জন্মগত। চিকিৎসা করলেও ভালো হবে না।’

খুব সাহস করে কথাটা বলে জোরে শ্বাস ফেলল মেহুল। জানে, শাশুড়ি মা এখন রেগে বাড়ি থেকে বেরও করে দিতে পারেন। কিন্তু, তাও সত্যটা তো অন্তত বলতে পেরেছে, সেই ঢের।

রাগে কটকট করছেন তিনি। এত বড়ো একটা খবর, আর তিনি বিয়ের আগে কিছুই জানলেন না? ঐ বাড়ির লোক কথাটা চেপে গেলেন কী করে? এটা তো অন্যায়, রীতিমতো ঠকানো। তিনি ঠকেছেন, তার ছেলেও ভীষণ ভাবে ঠকেছে। তার ছেলেটাকে আজীবন বাবা না হওয়ার আফসোস নিয়েই থাকতে হবে। উনার অন্তরটা তখন ছেলের দুঃখে হু হু করে উঠল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, না না; এমনটা তিনি হতে দিবেন না। তিনি তাই মাথা তুলে শক্ত গলায় বলেন,

‘তুমি না জানলেও, তোমার মা নিশ্চয়ই সব জানতেন। আর উনি ইচ্ছে করে আমাদের কিছু বলেননি, যাতে এই বিয়েটা না ভাঙে। তোমার মা তো একপ্রকার ঠকিয়েছেন আমাদের। আমাদেরকে ভালো পেয়ে নিজের অসুস্থ মেয়েকে ধরিয়ে দিয়েছেন। এখন তোমার জন্য আমার ছেলেটাকে সারাজীবন আফসোস নিয়ে বাঁচতে হবে। বলো, এখন কী করব?’

মেহুলের কোটর ভরে উঠে উষ্ণ জলে। গাল বেয়ে গড়িয়েও পড়ে সেটা। ত্রস্ত হাতে সেই জল মুছে, কোনোরকমে সোজা হয়। রাবীর তাকিয়ে দেখে তাকে। মায়ের দিকে চেয়ে দেখে, মা এখনো রাগে হাঁসফাঁস করছেন। রাবীর এবার তটস্থ হয়। নড়চড়ে বসে। গম্ভীর গলায় বলে,

‘মা, তুমি না জানলেও আমি সবকিছুই জানতাম।’

তার মা চোখ মুখ কুঁচকে তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘জানতে মানে? কী জানতে তুমি?’

রাবীর স্বাভাবিক স্বরে বলে,

‘এই যে মেহুল কোনোদিন মা হতে পারবে না, সেটা। বিয়ের আগেই মেহুলের মা আমাকে এই কথাটা জানিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন,আমি যেন সবকিছু ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিই। তবে, মেহুলকে আমার প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়েছিল। আর আমার কাছে এই বাচ্চা না হওয়ার ব্যাপারটা কোনো বিগ ইস্যু বলে মনে হয়নি। কেউ ইচ্ছে করে এই সমস্যা নিয়ে জন্মায় না। সবকিছুই আল্লাহর দান। তাই ব্যাপারগুলো সহজ ভাবে মেনে নিতে পারলেই, জীবন সুন্দর। এখানে কারোরই কোনো দোষ নেই। আর মেহুলের তো একদমই না।’

ছেলের কথায় যেন মা আকাশ থেকে পড়লেন। ছেলে তো তার পুরো বউয়ের আঁচলের নিচে একেবারে ঢুকে পড়েছে। কী সুন্দর, এত বড়ো একটা খবর সে মেনে নিল। তার ছেলেটাকে এত ভালো হতে কে বলেছে? ভালো মানুষের যে এই দুনিয়াতে কোনো দাম নেই, তা কি সে জানে না? তার মুখমন্ডলে নেমে এল ইষৎ কালো ছায়া। এত সহজে, এসব কিছু তিনি কী করে মেনে নিবেন? তার মনটা যে হতাশাগ্রস্ত। কত আশা করেছিলেন, একটা নাতি নাতনির মুখ দেখবেন। সব কি তবে শূন্য, শূন্যই রয়ে গেল?

তিনি চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কোনোপ্রকার সাড়া শব্দ না করেই, হনহন করে পা বাড়ালেন নিজের রুমের দিকে। শাশুড়ি মায়ের ব্যস্ত পদতলের দিকে অমোঘ চেয়ে রইল মেহুল। ধ্যান ভাঙল রাবীরের স্পর্শে। সে মেহুলের উজ্জ্বল ফর্সা গালে হাত রেখে নরম সুরে বলল,

‘চিন্তা করবেন না, মা’কে আমি বোঝাব।’

___________

বাইরের গরম কমেনি। তপ্ত বিকেল। সূর্য মামা এখন পশ্চিমে হেলে পড়াতে ব্যস্ত। এভাবে পড়তে পড়তেই ধীরে ধীরে তার তেজ কমবে। একসময় তার বিশাল আকাশ বন্ধুর বিশালতায় হারিয়ে যাবে। তারপর বুক ধর্পিয়ে মাথা চারা দিয়ে উঠবে নিকষ কালো অন্ধকার। হানা দিবে, এই ভৌগলিক অঞ্চলে।

লুকিয়ে লুকিয়ে একটা বেনসনের প্যাকেট নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায় রিতা। আজকাল যে তার কী হয়েছে কে জানে। একসময় যে জিনিস সে দু চোখেও সহ্য করতে পারত না, এখন তার সেটাই খেতে ইচ্ছে করছে। এই যেমন, এই সিগারেট। যেটার ঘ্রাণেই গা গুলিয়ে উঠত তার, বমি বমি পেত; আজ সেটা খাওয়ার জন্যই মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে সাদরাজের বেনসনের প্যাকেটটা লুকিয়ে লুকিয়ে খুঁজে বের করে।

সাদরাজ এখন বাসায় থেকেই অফিস করছে। সাথে ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ করছে বিধায়, তাকে আর কষ্ট করে অফিসেও যেতে হচ্ছে না। মাস শেষে হাতে এমনিই টাকা চলে আসে। সাদরাজ বাড়িতে আছে বলেই রিতার যত অসুবিধা। খাবার নিয়ে একটুও অনিয়ম সাদরাজ মেনে নিতে চায়না। জোর করে খাওয়াবে সে, বমি করলে করুক, তাও খাওয়াবে। এসবের জ্বালায় যে বেচারার শরীর কতবার বমিতে ভরেছে, তার আর হিসাব নেই। তবুও, এই ছেলে ক্লান্ত হয়না, এইটুকুও বিরক্ত হয় না। উল্টো বরং আরো সুখ পায় যেন।

সাদরাজ দেখলে কেলেঙ্কারি হবে। তাই চুপি চুপি বসার ঘরের বড়ো বারান্দায় এসেছে। এখানে খেলে, গন্ধ আর সারা ঘরে ছড়াতে পারবে না। বাইরের খোলা প্রান্তরে মিশে যাবে। রিতা সেই ভেবে, ভয়ে ভয়ে একটা সিগারেটে দু আঙ্গুল দিয়ে চিপকে আরেক হাতে আগুন জ্বালায়। পরে সেই জ্বলন্ত সিগারেট’টা দু ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরে। একটা টান দিয়েই, নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে কাশতে আরম্ভ করে সে। সেই কাশি ভয়ানক হাসি, থামার নামই নেই। বেচারির চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে মুহুর্তেই। তার কাশির শব্দ দ্রুত গিয়ে ঠেকল সাদরাজের কর্ণগুহরে। ঘুম থেকেই চট করে উঠৈ বসল সে। আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে রিতাকে খুঁজল। না পেয়ে খোলা দরজার দিকে চাইল। বাইরে থেকেই খুকখুক শব্দ আসছে। সাদরাজ দ্রুত উঠে পা বাড়ায় সেদিকে। সাদরাজের ভয়ে রিতা ততক্ষণে মুখে ওড়না চেপেছে। শব্দ না হলেও, শরীর কাঁপছে তার। জলদি সিগারেট’টা বাইরে ছুড়ে মারে। হাত নাড়িয়ে ধোঁয়া আর গন্ধ সরানোর বৃথা চেষ্টা চালায়। সাদরাজ সেই মুহুর্তেই পেছনে এসে প্রশ্ন ছুড়ে,

‘কী করছো, রিতা?’

রিতা আঁতকে উঠে। ভয়ে ভয়ে সাদরাজের দিকে তাকায়। সাদরাজের ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। হঠাৎই তার কুঁচকানো ভ্রু আরো দৃঢ় হয়। দু’বার নাক টেনে জিজ্ঞেস করে,

‘সিগারেটের ঘ্রাণ আসছে কোথ থেকে?’

রিতা ঢোক গিলে। সে যে সিগারেট খেয়েছে, সেটা জানলে সাদরাজ কী করবে কে জানে?

চলবে….

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৬।

রেলিং এর উপর বেনসনের প্যাকেট’টা দেখে সাদরাজের চক্ষু চড়কগাছ। এই প্যাকেট এখানে কেন? সে প্যাকেট’টা হাতে নিয়ে বিচলিত হয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

‘এটা এখানে কেন, রিতা?’

রিতা ভয় আর অস্বস্তিতে আড়ষ্ট। এখন কী বলবে সে? সত্য বললে আজ এই বাড়িতে কেয়ামত হবে, সে জানে। এদিকে মিথ্যে বলার জন্যও উপযুক্ত কথা সাজাতে পারছে না। বাক্য বিন্যাসে মস্তিষ্ক দূর্বল হয়ে পড়ছে বারবার। পরপর কয়েকবার ঢোক গিলে সাদরাজের মুখপানে চায় সে। তার মুখ দেখে অবস্থা ঠাহর করা কঠিন। সাদরাজ এখনো ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। রিতার নিরবতা মনে তীব্র সন্দেহ জাগাচ্ছে। সে গম্ভীর কন্ঠে তখন রিতাকে বলে,

‘কাছে এসো তো।’

রিতা ভড়কে যায়। মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ায়। ভাবতে থাকে, হঠাৎ কাছে ডাকছে কেন? চড় টড় মেরে বসবে নাকি? না না, এত খারাপ কিছুও তো সে করেনি যে চড় খাবে। রিতাকে নড়তে না দেখে সাদরাজ নিজেই তাকে হেঁচকা টান দেয়। তাল সামলাতে না পেরে রিতা হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার বক্ষস্থলে। সাদরাজ তখন রিতার মুখের কাছে মুখ নেয়। চট করেই আবার সরে যায় সে। বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে অবিশ্বাস্য কন্ঠে শুধায়,

‘তুমি সিগারেট খেয়েছ, রিতা?’

রিতার মুখ চুপসে যায় ততক্ষণাৎ। কালো ছায়া নেমে আসে চোখে মুখে। এত সাবধান থেকে লাভ কী হলো? সেই তো, বাঘের মুখে পড়তে হলো তাকে। ভয় আর অস্বস্তিতে মাথা নুইয়ে ফেলে। সাদরাজ তাকে নিয়ে কী ভাববে এখন? খুব খারাপ মেয়ে ভাববে? সে তো আর জানেনা, প্রেগন্যান্সিতে এমন উল্টা পাল্টা জিনিস খেতে ইচ্ছা করেই, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু, এই ছোট্ট কথাটাই বোঝানোর সাহস এখন রিতার নেই।

রিতার ভীত সন্ত্রস্ত মুখশ্রী দেখে সাদরাজ তার দৃষ্টি শীতল করল। রিতার মুখের সামনে পড়ে থাকা অবাধ্য এলোমেলো চুলগুলোকে কানের পিছে গুঁজে দিয়ে নরম সুরে বলল,

‘আমি জানি, এই সময় এমন অনেক কিছুই খেতে ইচ্ছে করে, যেগুলো সুস্থ শরীরে কেউ ছুঁয়েও দেখতে চাই না। তোমার বেলাতেও তাই হয়েছে। তবে, এটা তো তোমার আর আমাদের ছোট্ট বাবুটার জন্য ক্ষতিকর, তাই না। কষ্ট হলেও এসব জিনিসের থেকে দূরে থাকতে হবে। খাওয়া তো দূরে থাক আর ছোঁয়াও যাবে না। মনে থাকবে তো?’

ফটাফট মাথা দুলায় রিতা। হ্যাঁ, তার মনে থাকবে। একদম টুটস্থ মুখস্থ থাকবে সব। এত ভালোবেসে বললে কি আর কিছু ভুলা যায়?

সাদরাজ রিতাকে ছেড়ে বলল,

‘এই প্যাকেট’টা আমি ফেলে আসছি। তুমি তার মধ্যে রুমে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ো।’

সাদরাজের কথা মতো রিতা ভদ্র মেয়ের মতো রুমের দিকে পা বাড়ায়। মনটা আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠে তার। পেটে হাত দিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,

‘তুই একজন ভালো বাবা পাবি, সোনা। ভীষণ ভালো বাবা।’

__________

‘মা, আসব?’

ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ এলো না। রাবীর তাই আবার জিজ্ঞেস করল,

‘আসব, মা?’

এবারও নিশ্চুপ পরিবেশ। রাবীর ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তাই আর অনুমতি না নিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়ে। গিয়ে দেখে, মা বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে। মাগরিবের পর মায়ের শোয়ার অভ্যাস নেই। আজ শুয়েছে, মানে তার মেজাজ এখনও বিগড়ানো। রাবীর ধীরে সুস্থে পা বাড়িয়ে মায়ের পাশে বসে। চোখ বুজা মা’কে দেখে বুঝতে পারে, তিনি জেগে আছেন। সে মায়ের ডান হাতের উপর নিজের হাতটা রাখে। সতর্ক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায়। মা এখনও চোখ বুজা। রাবীর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। নরম স্বরে বলে,

‘মা, এখনও রেগে আছো? কার উপর এত রাগ তোমার, আমার না মেহুলের? তুমি কথা বলো, এমন চুপচাপ হয়ে থাকলে সবকিছুর সমাধান হবে কী করে? ঐদিকে মেহুলও তো কষ্ট পাচ্ছেন। উনার তো এখানে কোনো ভুল নেই, মা। উনি নিজেই তো কিছু জানতেন না। আর আমি…’

‘আমি তোমার বউয়ের সাফাই শুনতে চাই না, রাবীর। এখান থেকে যাও।’

মায়ের রাশভারি স্বরে থামল রাবীর। কিছুক্ষণ কুঁচকানো মুখে চেয়ে রইল মায়ের দিকে। পরক্ষণেই নিরস মুখে বলল,

‘মা, তুমি বোঝাদার মানুষ হয়ে এমন করলে কী করে হবে? আর এটা একটা সামান্য ব্যাপার। আজকাল বাচ্চা নেওয়ার অনেক পদ্ধতি আছে। আমরা নাহয় অন্য কোনো ব্যবস্থা করব। দরকার পড়লে দত্তক নিব। কিন্তু, সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে তুমি এভাবে রেগে থেকো না প্লিজ।’

রাবীরের মা তখন চট করে উঠে বসলেন। মনে মনে ভীষণ তেতিয়ে উঠলেন তিনি। এই এত বড়ো ব্যাপারটাকে তার ছেলে সামন্য একটা ব্যাপার বলছে কীসের ভিত্তিতে? সব করছে, বউকে খুশি করতে। তার এই কাঠিন্য মনা ছেলেটা এমন বউ পাগল হয়ে গেল, আশ্চর্য! তিনি নিজের কপাল’ই ইচ্ছে মতো চাপড়ালেন মনে মনে। ভাবলেন, কেন একবার বিয়ের আগে ভালো ভাবে খোঁজ খবর নিলেন না। আজ তবে আর এই অবস্থায় পড়তে হতো না তাদের। পরক্ষণেই আর কোনো উপায়ান্তর না দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। নিজেকে ঠান্ডা করে বললেন,

‘তুমি যত সহজে সবকিছু ভাবছো, সবকিছু আদৌ এত সহজ হবে না। দশ লোকে দশ কথা বলবে। এই সবকিছু তোমার বউকেই শুনতে হবে। আর তার জন্য এখন এসব আমাকে আর তোমাকেও মানতে হবে। কিছু তো আর করার নেই, না? আমার কপালটাই খারাপ। একটা মাত্র ছেলে, তার বংশপ্রদীপ দেখার আর ভাগ্যে হয়ে উঠল না।’

মায়ের কথায় কিঞ্চিত বিরক্ত হলেও রাবীর সেটা প্রকাশ করল না। সে ভীষণ সহজ সাবলীল ভাষায় বলল,

‘মা, দশ লোকের কথায় আমার কিছু যায় আসে না। আমার পৃথিবী তোমার আর মেহুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ঐ দশ লোক নিয়ে তো আর আমি বাঁচব না, বাঁচব তোমাদের নিয়ে। তাই আমার কাছে তোমাদের খুশিটাই বেশি ইম্পোরটেন্ট। আর রইল বংশপ্রদীপের কথা, সময় এলে প্রদীপ এমনিই জ্বলবে। সেসব নিয়ে তুমি আর দুশ্চিন্তা করো না। আর মেহুলকেও ভুল বুঝো না, প্লিজ। এসবের মাঝে উনার কোনো দোষ নেই। উনি নিজেও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। মা হতে না পারার কষ্ট একটা নারীর চেয়ে বেশি কেউ বুঝে না। উনার পাশে এখন আমাদের দাঁড়াতে হবে। তাই প্লিজ, অভিমান ঝেরে মা হয়ে তুমিও উনার পাশে দাঁড়াও।’

মা গুমোট হয়ে বসে রইলেন। ছেলের প্রতিটা কথা মস্তিষ্কে তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে তাঁর। কেমন থমথমে হয়ে বসে আছেন যেন। রাবীর তাঁর দু’হাত আগলে নিল। আবেগ ভরা গলায় বলল,

‘মা, তুমিতো এখন আর আমার একার মা নও। মেহুলের ও মা। আজ তোমার নিজের মেয়ে এমন সমস্যায় পড়লে, কী করতে তুমি? না ছিটকে দূরে সরিয়ে দিতে, নাকি ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে?’

প্রশ্ন শুনে থমকায় মা। জবাব দিতে পারে না। সে তো এত নিষ্ঠুর না। সত্যিই তো, কেউ তো আর ইচ্ছে করে এমন সমস্যা নিয়ে জন্মায় না। সব তো হয় আল্লাহর ইচ্ছাতে। তাহলে, মেহুলের প্রতি এত অভিযোগ করে কী হবে? ওর তো এখানে কোনো দোষ নেই। বরং সে তো নিজেই ভুক্তভোগী। মা’কে ভাবতে দেখে, রাবীর কিছুটা আশ্বস্ত হয়। হয়তো মা বুঝবে। মায়ের উপর এই বিশ্বাসটুকু আছে তার। তাই আর সাড়াশব্দ না করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

রুমে গিয়ে মেহুলকে বারান্দায় আবিষ্কার করে। রাবীর ত্রস্ত পায়ে এগোয় সেদিকে। মেহুলকে পেছন থেকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে। মেহুল আজ নড়ে না। কাঁপেও না একটু। ক্রমে ক্রমে তপ্ত শ্বাস ফেলে কেবল। রাবীর ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে চেয়ে বলে,

‘এত দুশ্চিন্তা করছেন কেন? সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, মেহুল। আমি সব ঠিক করে দেব।’

মেহুলের এই মুহুর্তে কেন যেন গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কেঁদে কেটে সব ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, জড়তার বেড়াজালে আটকে সেসব পারছে না। বার কয়েকবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। ঠোঁট গলা যেন সব শুকিয়ে উঠছে। রাবীর তার নিরবতা দেখে পুনরায় বলল,

‘আমরা না হয় বাচ্চা দত্তক নিব?’

রাবীরের প্রশ্নে মেহুল ঘুরে তাকায়। বিষন্ন সুরে জিজ্ঞেস করে,

‘দত্তক নিলেই কি নাড়ীর টান অনুভব করা যায়?’

রাবীর বিধ্বস্ত চোখে চেয়ে থাকে। এই প্রশ্নের কী জবাব দিবে সে? মেহুলের সামনে হঠাৎ বড্ড অসহায় লাগে নিজেকে। সে কি তার স্ত্রীর জন্য কিছুই করতে পারল না। তাহলে এত ক্ষমতা, এত সম্পদ থেকে কি লাভ, যদি স্ত্রীর এইটুকু ইচ্ছেই পূরণ করতে না পারল? ভেবে, নিজের অজান্তেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। সত্যিই সকল ক্ষমতা আর সম্পদ আল্লাহর সিদ্ধান্তের কাছে বড্ড ফিকে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে