শেষটা সুন্দর পর্ব-৬৩+৬৪

0
847

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৩।

ঈদের দিন খুব সকালে মেহুলের খুব ভাঙে। চোখ মেলে তাকাতেই দেখে, বাইরে ফকফকা সকাল। চারদিক কেমন যেন ঝলমল করছে। যেন প্রকৃতিও বুঝেছে, আজ ঈদ। সে পাশে ফিরতেই দেখে, রাবীর নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ পেতেই সে বুঝতে পারল, রাবীর সেখানেই। আলগোছে উঠে দাঁড়াল সে। বড়ো করে হাই তুলে হাত নিচের দিকে আনতেই চোখ পড়ল, হাতের উল্টো পৃষ্ঠে। মেহেদি দিত না। তবে, রাবীর খুব জোর করেছে বিধেয় ছোট্ট একটা ডিজাইন করে, মাঝখানে রাবীরের নাম লিখেছে। সেই মেহেদি রাখা হাতটা দেখে মেহুল তপ্ত শ্বাস ছাড়ে। পরে বিছানা ঝেরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।

খান বাড়ির এইদিকটাই খুব একটা শোরগোল নেই। দিনের অর্ধেকটা সময়ই কাটে নিরবতায়। তবে বিকেলের দিকে এইদিকে মানুষ হাঁটতে আসে। ঐ পাশের রাস্তাটা আবার ভীষণ পরিষ্কার। দু ধারে নারকেল গাছ সটান দাঁড়ান। বেশ ছায়াযুক্ত একটা জায়গা। বিকেলের দিকটায় হাঁটার জন্য সুন্দর একটা পরিবেশ বটে।

এসবের মাঝেই, ওয়াশরুমের দরজায় খট করে শব্দ হয়। মেহুল সতর্ক হয়ে পেছন ফিরে। রাবীর বেরিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে। এক পলক মেহুলের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলে,

‘ঈদ মোবারক, মিসেস খান।’

মেহুল খরখরে শুকনো ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। বলে,

‘ঈদ মোবারক।’

রাবীর তোয়ালেটা বারান্দায় এসে রাখে। জিজ্ঞেস করে,

‘গোসল করবেন এখন?’

‘না, আপনি নামাজে যাওয়ার পর করব। এখন ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে আগে আপনাদের জন্য নবাবী সেমাই বানাব। খেয়ে যাবেন।’

রাবীর হেসে জবাবে বলে,

‘অবশ্যই।’

মেহুল কথা না বাড়িয়ে চলে যায় ফ্রেশ হতে।

_______________

মিষ্টি জাতীয় জিনিস রিতার খুব একটা পছন না হলেও, এই সেমাই জিনিসটা তার বড্ড পছন্দের। অথচ, আজ এই জিনিসটাকেই সে মুখের কাছে নিতে পারছে না। কাল খালাকে বেশ শখ করে বলেছিল,

‘খালা, কাল আমাকে একটু বেশি করে দুধ দিয়ে সেমাই করে দিবে?’

খালাও বিনাবাক্যে রাজি হোন। অথচ মেয়েটা আজ সেই সেমাই মুখেই তুলতে পারছে না। গন্ধ পেয়েই নাক চেপে ধরে বসে আছে। ওর এমন কান্ডে সাদরাজ অধৈর্য হয়ে বলে,

‘তাহলে তুমি কী খাবে? নুডুলস করব? নাকি বাইরে থেকে কিছু আনব?’

রিতা হাঁসফাঁস করে। কী খাবে? কোনো খাবারই তো এখন গলা দিয়ে নামে না তার। কাছে নিলেই, বমি আসে। সে চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকায়। হুট করে প্রশ্ন করে,

‘আপনি নামাজে যাবেন না?’

‘হ্যাঁ, এখন বের হব। কিন্তু, তার আগে তো তোমার খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। কী খাবে, বলো?’

সাদরাজ বরাবরের মতোই অস্থির। বাবা হওয়ার কথা শুনে, ছেলেটা আর একটুও স্থির হতে পারছে না। কী করবে, কী না করবে, সেটাই বুঝে উঠতে পারে না সে। রিতাকে পারলে সারাক্ষণ বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখত বোধ হয়। মেয়েটার একটু অসচেতনতা তাকে ভীত করে তুলে।

রিতা পাতলা অধর ছড়িয়ে আলতো হাসে। বলে,

‘আমাকে নিয়ে ভাববেন না। খালা তো কত কিছু বানিয়েছেন। কিছু একটা ঠিক খেয়ে নিব। আপনি বরং ঐ খয়েরী পাঞ্জাবীটা পরে নামাজে যান। ঐ রংটায় আপনাকে খুব মানায়।’

রিতার এমন দায়সাড়া ভাব দেখে, সাদরাজের চিন্তা বিস্তর হয়। মেয়েটাকে কী করে বোঝাবে, সারাক্ষণ যে সে কী পরিমাণ দুশ্চিন্তায় থাকে তাকে নিয়ে। অথচ, এই মেয়ে সর্বদা স্বাভাবিক। কোনো কিছুতেই যেন কোনো কিছু আসে যায় না তার।

সাদরাজ উঠে দাঁড়ায়। খালাকে ডেকে বলে,

‘খালা, এক বাটি চিকেন স্যুপ করে নিয়ে এসো। আমি এটা ওকে খাইয়ে তবে নামাজে যাব।’

সাদরাজের কথা শুনে রিতা কপাল চাপড়ে বলে, ‘এই মানুষটা তার চিন্তায় চিন্তায় কবে যে পাগল হয়ে যায়, কে জানে!’

____________

আজ অনেকদিন পর, সাদরাজ আবার রাবীরের মায়ের মুখোমুখি হয়েছে। এতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। উপর দিয়ে হেসে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও, ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড হাঁসফাঁস করছে। সেই সময়টাই এই মানুষটাকেও কত কিছু বলেছিল সে। আজ কি উনি তাকে ক্ষমা করবেন?

সংশয় নিয়ে নিজেকে শুধায়, উত্তর পায় না। তবে, রাবীরের মা ভীষণ ধাতস্ত ভাব ভঙ্গি নিয়ে তাদের সাথে কথা বলছেন। এমন একটা ভাব, যেন কিছুই হয়নি। রিতার প্রেগন্যান্ট এর খবরে মারাত্মক খুশি তিনি। ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করছেন, তিনিও এই বাড়িতে এমন খুশির খবর চান। মেহুল রাবীর দুজনেই বুঝতে পারে ব্যপারটা। মা’কে কিছু জানানো হয়নি। রাবীর’ই বারণ করেছে; বলেছে সে নিজে সময় হলে কথা বলবে। মেহুল তো ভাবছে, সব শুনে এই ভদ্র মহিলা কেমন প্রতিক্রিয়া করবেন। বিয়ের পর থেকেই তো উনি নাতি নাতনি বলে চেঁচিয়ে মরছেন। এখন এই বিদঘুটে সত্যটা তিনি মেনে নিতে পারবেন তো?

__________

নাস্তার ছোট্ট পর্ব চুকিয়ে রিতা মেহুলের সাথে সাথে তার রুমে যায়। রাবীর আর সাদরাজ নিচে বসেই আড্ডাতে মগ্ন। তার শাশুড়ি মা উঠে গেছেন অনেক আগে।
মেহুল রুমে এসে রিতাকে বিছানায় বসতে বলল। তারপর সে গিয়ে আলমারি খুলে একটা ফাইল বের করে এনে বলল,

‘এটা দেখ।’

রিতা ফাইলটার আপাদমস্তক দেখে শুধাল,

‘কী এটা?’

মেহুল বস্তটা নাড়িয়ে চাড়িয়ে চাপা স্বরে বলল,

‘সেদিন ডাক্তারের দেওয়া টেস্ট গুলো আমি করিয়ে ছিলাম।’

একটু থেমে শ্বাস ফেলে বলে,

‘তবে, রিপোর্ট ভালো আসেনি। আমার জরায়ুতে সমস্যা। ডাক্তার বলেছেন, আমি কখনো মা হতে পারব না।’

মেহুল যতটা স্বাভাবিক থেকে কথাটা তাকে বলল, রিতা ঠিক ততটাই অস্বাভাবিক ভাবে আঁতকে উঠল। কন্ঠনালী আটকে গেছে। কথা বের হচ্ছে না। এটা কীভাবে সম্ভব? এত বড়ো একটা ধাক্কা, মেয়েটা কী করে সামলাচ্ছে? রিতার চোখ ভিজে উঠে। কম্পিত গলায় বলে,

‘তুই আমাকে আগে কেন বলিসনি এসব?’

মেহুল অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলে,

‘আজও বলতাম না। নেহাতই তখন আমার শাশুড়ি মায়ের সামনে খুব বড়ো মুখ করে বলছিলি, তিনিও খুব তাড়াতাড়ি খুশির সংবাদ শুনবেন; তাই তোকে বলে রেখেছি। নয়তো এই সময় তোকে আর কোনো আলাদা দুশ্চিন্তা দিতে চাইছিলাম না।’

মেহুলের কথা রিতা গ্রাহ্য করল না। খড়খড়ে গলায় বলল,

‘তাই বলে, এত বড়ো একটা কথা তুই লুকিয়ে গেলি?’

মেহুল মাথা নুইয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পরে ওর দিকে চেয়ে চমৎকার হেসে বলে,

‘আমার এই ড্রেসটা কেমন হয়েছে, বলতো? রাবীর নিজে পছন্দ করে নিয়ে এসেছেন। এবার আর আমি শপিং এ যাইনি। কেন যেন ইচ্ছেই করছিল না।’

রিতা বেশ বুঝতে পারছে, মেহুল যে কথা ঘুরাচ্ছে। তাই সে চোখ পাকিয়ে বলল,

‘একদম কথা ঘুরাবি না। আমি বুঝি তোর এতই পর হয়ে গেছি যে, এখন তুই আমাকে কিছুই বলিস না। ঐদিকে আমি অসুস্থ বলে, ঠিক মতো তোর খবরই নিতে পারিনি। তাই বলে, তুই আমাকে কিছু বলবিও না।’

মেহুল নিরব। একটু রাগ করুক না, তাতে কী হবে। মেয়েটা তো তাকে ভালোবাসে। তার অধিকার আছে, তার উপর রাগ দেখানোর। রিতা বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে শান্ত হয়। মেহুলের কুন্ঠিত মুখপানে চেয়ে দরদমাখা কন্ঠে শুধায়,

‘কষ্ট পাচ্ছিস?’

মেহুল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে হাসে। বলে,

‘একটুও না।’

‘রাবীর ভাইয়া জানে সব?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী বলেছেন?’

‘বলেছেন, উনার বাচ্চা চাই না। আমি হলেই চলবে।’

শেষের কথা বলতে গিয়ে আত্মতৃপ্তিতে বুক ভরে উঠে তার। কথাটা শুনে রিতাও ভীষণ খুশি হয়। আশ্বস্ত হয়ে বলে,

‘ভাগ্য করে এমন একটা মানুষ পেয়েছিস। কখনো ছেড়ে যাস না।’

মেহুল মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘উঁহু, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি উনাকে আকড়ে ধরেই বেঁচে থাকব।’

পরে সে আলতো করে রিতার পেটের উপর হাত রাখে। অক্ষি কোটরে জল জমে ততক্ষণাৎ। ফিনফিনে স্বরে বলে,

‘তোর ছেলের সাথে আমার মেয়ের আর বিয়ে দেওয়া হলো নারে। ওর জন্য তুই অন্য কোথাও বউ দেখিস।’

কথাটা শেষ করতে জল যেন ঝাপিয়ে পড়ল গালের উপর। মেহুল ব্যস্ত ভঙিতে হাত নাড়িয়ে জল মুছল। মেহুলের এমন হাহাকার দেখে, বুকে ফেটে কান্না আসছে রিতার। কেন সব পরীক্ষা কেবল মেহুলের মতো ভালো মানুষগুলোকেই দিতে হয়?

রিতা মেহুলের গালে হাত রেখে শক্ত গলায় বলে,

‘তোর মেয়েকেই আমি আমার ছেলের বউ বানাব। নয়তো, ছেলের বিয়েই দিব না। একেবারে কনফার্ম।’

রিতার এমন জেদ দেখানো কথা শুনে মেহুল হেসে ফেলে। মনে মনে ভাবে,

‘তাদের স্বপ্নটা বুঝি স্বপ্ন’ই রয়ে গেল।’

চলবে …

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৪।

ঈদের ছুটি কাটিয়ে ঢাকা শহর আবার ব্যস্ত। চারদিকে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সব আবার শুরু। বাচ্চারা কাঁধে ব্যগ নিয়ে বিরক্ত ভঙিতে হেঁটে চলছে। এতদিনের বন্ধের পর প্রথম দিন স্কুলে যেতে ভীষণ কষ্ট হয় যেন। কিন্তু, মা বাবা কি আর তাদের সেই কষ্ট বোঝে?

রাবীরের অফিসে আজ জরুরি মিটিং। তাই সকাল সকাল বেরিয়েছে সে। নাস্তা অবধি করেনি। মেহুলের দু মাস পর সেমিস্টার ফাইনাল। এই তো, তার অনার্স শেষের পথে। সারাবছর খুব উত্তেজনা নিয়ে কাটালেও, এখন কেন যেন তার আর পরীক্ষা দিতে ইচ্ছে করছে না। সে বই খুলে ঝুঁকে বসে আছে কেবল। এক অক্ষর ও পড়া হচ্ছে না। মনে ভারী দুশ্চিন্তা তার। রাবীর সবকিছু সহজ ভাবে মেনে নিলেও, তার শাশুড়ি কিছু জানেন না। ভদ্র মহিলা এত সহজে সবকিছু মেনে নিবেন না, এটা সে জানে। এই নিয়েই যত চিন্তা তার। আর তাই এত চিন্তার ভিড়ে তার মস্তিষ্কে পড়ার শব্দযুগল ঠিক প্রবেশ করতে পারছে না।

_____

দরজায় দুবার টোকার শব্দ হয়। তৎক্ষণাৎ কান খাড়া করে মেহুল। ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় কেউ শুধায়,

‘আসব, মেহুল?’

শাশুড়ির গলা পেয়ে, মেহুল নড়ে চড়ে বসে। বিনয়ের সুরে বলে,

‘আসুন, মা।’

তিনি ভেতরে প্রবেশ করেন। হেসে হেসে বিছানায় বসতে বসতে বলেন,

‘পড়ছিলে?’

মেহুল মুখে হাসি রেখে মাথা নাড়ায়। তিনি পুনারায় জিজ্ঞেস করেন,

‘তোমার ফাইনাল যেন কবে?’

‘ঐ তো মা, আর দু মাস পর।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা। বেশ, পড়ো মনোযোগ দিয়ে।’

মেহুল আবার মুখ ঘুরিয়ে বইয়ের দিকে তাকায়। শাশুড়ি মা বসে বসে এদিক ওদিক চোখ বুলালেন। ছেলের রুমে খুব একটা আসা হয়না তার। মেয়েটা বেশ সুন্দর গুছিয়ে গাছিয়ে রাখে সবকিছু। সব দেখে তিনি গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। মেহুল পেছনে ঘুরে থাকলেও যেন শাশুড়ির হাবভাব টের পাচ্ছে। উনি যে এমনি এমনি রুমে আসেননি, সেটা মেহুল ঠিকই আন্দাজ করতে পারছে। আবার নতুন কোনো মর্জি নিয়ে এসেছেন হয়তো। হ্যাঁ, তাই। তার শাশুড়ি মা নিরবতা ভাঙলেন। উৎক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,

‘একটা কথা বলি, মেহুল?’

মেহুল আবার ঘুরে তাকায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে,

‘জি মা, বলুন না।’

তিনি সুন্দর করে হাসলেন। নরম গলায় বাক্যের তাল সাজিয়ে বললেন,

‘তোমার অনার্সের পর পরই তোমরা বাচ্চা নিয়ে নিও। বেশি লেইট হলে আবার সমস্যা। আর আমারও তো বয়স বাড়ছে, কখন কী হয়। যদি একটা নাতি নাতনির মুখ দেখে যেতে পারতাম।’

“পারতাম” শব্দটা ভীষণ আফসোসের সুরে বলেই তিনি ক্ষান্ত হলেন। ঐদিকে মেহুলের বুক ধকধক করছে। এই তো, এই ভয়টাই পেয়েছিল সে। এবার এই মানুষটাকে সে কীভাবে সবটা বলবে। আর বললেও, মানুষটা মানতে পারবেন সবকিছু? ভীষণ রকম নারাজ হবেন তার উপর। দেখা গেল, তাকে আর এই বাড়িতেই রাখতে চাইলেন না। আবার তাকে নিয়ে মা ছেলের মধ্যে দ্বন্দ্ব হওয়ারও বিরাট সম্ভাবনা আছে। এত সব মহা চিন্তা উপেক্ষা করে, সে তার শাশুড়িকে কীভাবে এখন সত্যিটা বলবে?

মেহুলের চিন্তিত চোখ মুখ শাশুড়ির দৃষ্টি এড়ায় না। তিনি কপাল কুঁচকে বলল,

‘কী হলো, মেহুল? কী ভাবছো?’

মেহুল ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করল। সফলও হলো তাতে। শাশুড়ি মা মৃদু হেসে পুনরায় প্রশ্ন করলেন,

‘তা, আমার কথা রাখবে তো?’

মেহুল পরপর ঢোক গিলে। ভয় ঝিমিয়ে যায় শরীর। চোখ মুখে ছেয়ে আসে অন্ধকার। মাথার ভেতর শব্দের ভান্ডার খুলে বসেছে, কথা সাজাবে। সুন্দর করে গুছিয়ে একটা কথা বলার প্রয়াস। কিন্তু, পারল কই? শব্দ তো সব ফুরিয়ে গিয়েছে। আন্তপান্ত খুঁজেও কোনো বাক্য আওড়াতে পারল না। শেষে নিজের উপর’ই মাত্রাধিক বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার মধ্যে সেই সৎ সাহস নেই। তাই সে মাথা নুইয়ে গুমোট স্বরে বলল,

‘এই নিয়ে আপনার ছেলের সাথে কথা বলবেন, মা।’

ভদ্রমহিলার দু ভ্রু এর মাঝখানে ঠিক তিনটে ভাঁজ পড়ল। কথাটা মোটেও পছন্দ হলো না তার। ছেলের সাথে কথা বলবেন, মানে কী? তার ছেলে কি তবে বাচ্চা নিতে চাই না? হ্যাঁ, রাবীরও তো খাবার টেবিলে একদিন এমন একটা কথা বলেছিল। বাচ্চা নিয়ে যেন তিনি কোনো কথা না বলেন, এও বলেছিল। তাহলে কি সত্যিই তার ছেলে বাচ্চা নিতে চায় না। কিন্তু, কেন? কোন ছেলে বাবা হতে চাইবে না?

মুখের উপর বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলিয়ে শাশুড়ি মা উঠে দাঁড়ালেন। চিন্তিত গলায় বললেন,

‘আচ্ছা, তুমি পড়ো। আমি রাবীর আসলে, ওর সাথেই কথা বলব।’

অতঃপর শাশুড়ি মা রুম ছাড়তেই, মেহুল যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে।

__________

রাবীর দুপুরে ফিরে। বাইরে তখন কটকটে রোদ। রাবীর গাড়ি থেকে নেমে কয়েক কদম এগিয়ে বাসা অবধি আসতে আসতেই ঘেমে গেয়ে একাকার হয়ে যায়। গায়ের পাঞ্জাবীটা রুমে এসেই খুলে ফেলে। পরে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে মেহুলকে খোঁজে। মেহুল রুমে নেই; আওয়াজে বুঝতে পারল, ওয়াশরুমে। সে উদম গায়ে এসি চালিয়ে বসে। চোখ বুজে আসতে নিলেই দরজার শব্দে খানিক নড়ে উঠে। মেহুল ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। রাবীরকে দেখে প্রশ্ন ছুড়ে,

‘কখন এলেন?’

রাবীর নরম সুরে বলে,

‘এই তো, এক্ষুণি।’

মেহুল তারপর চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় পা রাখে। তোয়ালে নেড়ে পেছনে ফিরতেই প্রশ্বস্থ বক্ষের সাথে নাক ঠেকে তার। সে দু কদম পিছিয়ে দাঁড়ায়। রাবীরকে দেখে প্রশ্ন করে,

‘কী হয়েছে, কিছু লাগবে?’

রাবীর আর বিলম্ব না করে মেহুলের কোমর টেনে তাকে খুব কাছে নিয়ে আসে। সদ্য স্নান সারা মেহুলের চোখ মুখ স্নিগ্ধ। রাবীর চেয়ে চেয়ে তার চোখ, নাক, ঠোঁট পরখ করে। চুল থেকে পড়া টপটপ পানিতে মেহুলের পিঠ ভিজছে। সেদিকে তার লক্ষ্য নেই। সে ব্যস্ত রাবীরের উষ্ণ শ্বাস গুণতে। রাবীরের এই মোহিত দৃষ্টি মেহুলকে বরাবরই অচল করে দেয়। সে জমে যায়। রাবীরের উষ্ণ স্পর্শে প্রতিবারই বুক ধরফর করে তার। শরীরের প্রতিটা অঙ্গ শিরশির করে উঠে যেন।
মেহুলের অস্থিরতা টের পেতেই রাবীর তার ঠোঁট মেহুলের কানের কাছে এগিয়ে নেয়। অত্যন্ত সন্তর্পণে বলে,

‘আমার না ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, মেহুল। এই মুহুর্তে একটু এনার্জি না পেলে চলবেই না।’

মেহুল কেঁপে উঠে খানিক। ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,

‘লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে আসব?’

রাবীর অধর বাকিয়ে হাসে। মেহুলের দিকে চেয়ে তার ওষ্ঠ্য জোড়ার উপর বৃদ্বাঙ্গুল ছোঁয়ায়। গলার স্বরে খাদ নামিয়ে বলে,

‘ওসবে হবে না। এর থেকেও বেশে কিছু লাগবে।’

খুলে না বললেও, মেহুল বুঝতে পারে। রাবীরের প্রতিটা মুহুর্তের প্রয়োজন সে এখন জানে, বুঝে। তাকে এখন আর খুলে বলতে হয় না। এর আগেই সে তটস্থ হয়ে উঠে, তার প্রয়োজন মেটাতে।

________

ওড়নাটা গায়ে জড়াতে জড়াতে মেহুল গম্ভীর স্বরে বলল,

‘মা আজ আমাকে বাচ্চা নেওয়ার কথা বলছিলেন, রাবীর।’

রাবীর শোয়া থেকে উঠে বসে। আয়নায় মেহুলের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘তো, আপনি কী বললেন?’

‘কিছু বলেনি। শুধু বলেছি, আপনার সাথে কথা বলার জন্য। আমার মধ্যে কিছু বলার সাহস নেই। কথা বলতে নিলেই গলা জড়িয়ে আসে। কথা খুঁজে পাই না। পেট মোচড় দেয়। তাই প্লিজ, আপনিই সবকিছু মা’কে বলবেন।’

রাবীর চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাথা তুলে মেহুলকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

‘চিন্তা করবেন না। আমিই সব বলব।’

_________

খাওয়া শেষ করে, রাবীরের মা ড্রয়িং রুমের সোফায় গিয়ে বসলেন। রাবীর আর মেহুলকেও ডাকলেন তার সাথে।তারা ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। রাবীর এক পাশে বসলেও, মেহুল ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। রাবীর তাকে বসতে বললেও, সে বসে না। দুশ্চিন্তায় আত্মার রফাদফা অবস্থা। বসার মতো অবস্থা নেই তার।

রাবীরের মা বেশ শান্ত ভাবে বসে কয়েক পল শব্দ বিন্যাস করলেন। হুটহাট ছেলেকে কিছু বলা যাবে না। প্রতিটা শব্দ গুছিয়ে বলতে হবে। এমন ভাবে বলতে হবে, ছেলে যেন কোনো কথা আর ফেলতে না পেরে। অথচ, তিনি কথা সাজাতে সাজাতেই তার ছেলে বলে উঠে,

‘মা, তোমার সাথে একটা জরুরি কথা বলার ছিল।’

তিনি ভ্রু কুঁচকালেন। মুখ কালো করলেন। তিনি কি তবে আন্দাজ করতে পারলেন, ছেলে কী বলবে?

স্বাভাবিক গলায় বললেন,

‘হ্যাঁ, বলো কী বলবে।’

কথা শুরু করার আগে রাবীর একপলক মেহুলকে দেখে। ভয় আর চিন্তায় চিন্তায় মেয়েটা না মূর্ছে যায়। রাবীর মাথা নুইয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে। কথাটা আজ বলতেই হবে। তাই আর এত ভণিতা না করে সে সরাসরি বলল,

‘মা, মেহুল কখনো মা হতে পারবেন না।’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে