#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬১।
রিপোর্ট হাতে ডাক্তারের কেবিনে প্রবেশ করে মেহুল। মনে ভীষণ সংশয় তার। কিঞ্চিত চিন্তাও হচ্ছে, সবকিছু ঠিক আছে তো? তাকে দেখে ডাক্তার বসতে বললেন। রিপোর্ট নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পরখ করে বললেন,
‘আপনার হাজবেন্ড কী করেন?’
হঠাৎ এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে মেহুল অবাক হয়। এসবের সঙ্গে হাজবেন্ডের কর্মের কী সম্পর্ক, সেটা সে বুঝে না। তাও জবাবে বলে,
‘এই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র।’
মহিলা ডাক্তার যেন এবার চকিত হলেন। ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
‘আচ্ছা, আপনি রাবীর খানের ওয়াইফ। আগে বলবেন না।’
মেহুল অপ্রস্তুত হাসল। বলল,
‘না, এখানে উনার পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। আচ্ছা, আমার রিপোর্টে সব ঠিক আছে?’
ডাক্তার আরো একবার রিপোর্ট’টা পরখ করলেন। কেন যেন উনার মুখটা বেশ থমথমে। যা দেখে ভীষণ ভয় লাগছে মেহুলের। হাত কচলাচ্ছে। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করে,
‘ডক্টর, কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?’
ডাক্তার রিপোর্ট’টা বন্ধ করে রাখলেন। গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্ত স্বরে বললেন,
‘আমার মনে হয়, আপনার একবার আপনার হাজবেন্ডকে নিয়ে এখানে আসার প্রয়োজন। উনার সামনেই কথাগুলো বললে ভালো হয়।’
ডাক্তারের এমন ঠান্ডা স্বরে মেহুল আরো বেশি ঘাবড়ে যায়। এসি চালিত রুমেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে তার। ওড়নার একপাশ দিয়ে কপাল মুছে। তারপর হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘ডক্টর, উনি কিছু জানেন না। আমি উনাকে না জানিয়েই এখানে এসেছি। প্লিজ, আমাকে বলুন কী হয়েছে। উনাকে আমি এখন কিছু জানাতে পারব না।’
ডাক্তার মহিলা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উনার হঠাৎ মেহুলের জন্য ভীষণ মায়া হচ্ছে। মেয়েটা ভারি মিষ্টি। কেন যে এত মিষ্টতার মাঝেও সৃষ্টিকর্তা একটু তেঁতো ছিটিয়ে দেয়, কে জানে। ডাক্তারের গুরুগম্ভীর মুখখানা দেখে মেহুলের আরো দুশ্চিন্তা বাড়ে। তার গলা শুকিয়ে উঠছে বারবার। ডাক্তার এবার বলেন,
‘আপনার রিপোর্ট ভালো আসেনি।’
মেহুলের বুক ধুকধুক করছে। যেন এখনই হার্ট ফেল হবে তার। সে নিজেকে যথাসম্ভব স্থির করার চেষ্টা করে। প্রশ্ন করে,
‘আমার কী হয়েছে, ডক্টর? খুব কঠিন কোনো রোগ হয়েছে?’
ডাক্তার টেবিলের উপর দুহাত লম্বা করে রাখলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
‘না, কোনো কঠিন রোগ হয়নি। তবে কিছু জটিল সমস্যা আছে, যার দরুন আপনি কখনো মা হতে পারবেন না।’
মেহুলের মাথাটা চক্কর খেল। ভ্রু উঁচিয়ে এদিক ওদিক চাইল সে। দেখল, সবকিছু স্বাভাবিক। তারই কেবল মাথা ঘুরছে। চেয়ারের হাতল ধরে শক্ত করে বসল। ঢোক গিলে মিনমিনিয়ে বলল,
‘এসব কী বলছেন, ডক্টর? আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। রিপোর্ট’টা ভালো করে দেখুন না।’
ডাক্তার স্বাভাবিক গলায় বললেন,
‘আমি ভালো করেই দেখেছি, ম্যাডাম। সমস্যাটা আপনার জন্মগত। সেই ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আপনার অবগত হওয়ার কথা। আপনার কখনও পিরিয়ডে প্রবলেম হয়নি?’
মেহুল নিরুদ্বেগ মাথা নাড়ায়। ফোস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘হয়েছে। ক্লাস টেনের পর। খুব সমস্যা হয়েছিল তখন।’
‘তখন ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?’
‘জি।’
‘ডাক্তার তখন কিছু বলেননি?’
‘আমাকে তো কিছু বলেননি। তবে মা’কে বলেছিলেন। কিন্তু, মা তখন আমাকে বলেছিলেন, সব ঠিক আছে। ঠিক মতো ঔষধ খেলে নাকি পিরিয়ড ঠিক হয়ে যাবে।’
ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
‘আপনার মা হয়তো সব জানেন। সেইজন্যই ইচ্ছে করে আপনাকে কিছু বলেননি। আপনার জরায়ুতে সমস্যা আছে। আর সেটা জন্ম থেকেই। তাই আপনার পিরিয়ড নিয়ে এত সমস্যা হতো। আর সেই জন্যই এখন আপনি কনসিভ করতে পারছেন না।’
মেহুল বাকরুদ্ধ। সব কথা উবে গিয়েছে। শুকনো মুখে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয় সে। এখন কী হবে তার? সব তো শেষ। মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই তো তার বৃথা হয়ে গেল। এবার সে রাবীরের সামনে কোন মুখে দাঁড়াবে? কী বলবে সে, যে সে কখনো রাবীরকে বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারবে না? এই বিদঘুটে সত্য কথাটা সে রাবীরকে কী করে জানাবে? এত সাহস কোথায় পাবে সে? তার শাশুড়ির চোখে চোখ রেখে কী করে কথা বলবে? সেই মানুষটার এত অপেক্ষা সব বৃথা যাবে? সত্যিই, সে কোনোদিন মা হতে পারবে না? চিকিৎসাশাস্ত্র না আজকাল এত উন্নত, তাহলে কোনোভাবে চিকিৎসা করেও কি সে মা হতে পারবে না?
মেহুল ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে। আটকে যাওয়া গলায় শুধায়,
‘এর কি কোনো চিকিৎসা নেই, ডক্টর?’
ডাক্তার রয়ে সয়ে বলেন,
‘দেখুন, এখনই ভেঙে পড়বেন না। আজকাল বাচ্চা নেওয়ার অনেক পদ্ধতি আছে। আপনি আগে আপনার হাজবেন্ডের সাথে কথা বলুন। তারপর দুজন মিলে আমার কাছে আসুন। আমি আপনাদের সবটুকু দিয়ে সাহায্য করব।’
মেহুলের কোটর ভরে উঠে উষ্ণ জলে। সে ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
‘আমি এই কথাটা কী করে রাবীরকে বলব? আমার তো সেই সাহস নেই।’
ডাক্তার নরম গলায় বললেন,
‘সাহস করতে হবে। এতে তো আর আপনার কোনো দোষ নেই। আপনি আপনার হাজবেন্ডকে বুঝিয়ে বলুন। উনি তো বিচক্ষণ মানুষ। আশা করছি, উনি বুঝবেন।’
____________
গাড়িতে বসে এক ধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে মেহুল। বাইরের জমজমাট রঙিন দুনিয়াটাকেও কেমন তামাটে লাগছে তার কাছে। একটা ধূসর ভাবে ছেয়ে আছে তার দিক। আজ খুব বেশি মানুষের কোলাহল বাইরে। ঈদের আর মাত্র তিন দিন বাকি। মানুষের তাই কেনাকাটার শেষ নেই। মেহুলেরও এই কয়দিন উৎসাহের শেষ ছিল না। বিয়ের পর রাবীরের সাথে তার প্রথম ঈদ। ভীষণ স্পেশাল হবে এই দিনটা। কিন্তু, হুট করেই সব কেমন হাওয়ায় মিশে গেল। এত বড়ো একটা ধাক্কা সে জীবনেও খায়নি। পথিমধ্যে সে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল। তারপর গাড়ি থেকে নামল সে। রাস্তার এক পাশে বড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে সিমেন্ট দিয়ে বসার জায়গা করা। মেহুল সেখানেই পা ঝুলিয়ে বসেছে। তার রুক্ষ শুষ্ক দৃষ্টি সামনের পিচ ঢালা রাস্তাতে। হঠাৎ কী ভেবে সে পার্স থেকে ফোনটা বের করে। ডায়েল নাম্বারে গিয়ে মা’কে কল করে সে। দু’বার কল বাজতেই রিসিভ হয়। তার মা আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করেন,
‘কেমন আছিস, মা?’
মেহুল থমথমে স্বরে জবাব দেয়,
‘ভালো না, মা। একদমই ভালো না। তুমি এত বড়ো একটা কথা আমার থেকে কী করে লুকালে?’
রামিনা বেগম আন্দাজ করতে পারলেন না। তিনি ফের প্রশ্ন করেন,
‘কী কথা?’
‘এই যে, আমি কখনো মা হতে পারব না, এটা তো তুমি আমাকে কখনো বলোনি? কেন লুকালে, মা? কেন আমাকে আগে বললে না?’
রামিনা বেগমের বুকে মোচড় দিল। মেয়ে তার সব জেনে গিয়েছে। জানবেই তো, এত বড়ো একটা খবর। একদিন না একদিন তো ঠিকই জানতো। তিনি শুকনো মুখে বললেন,
‘তুই কষ্ট পাবি বলে জানায়নি।’
‘এখন যে জেনে কষ্ট পাচ্ছি। তখন জানলে তো এত কষ্ট লাগতো না, এখন যেমন লাগছে। মা, আমি রাবীরকে কী বলবো, বলতো? কী বলে বোঝাব উনাকে?’
রামিনা বেগম জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন। শান্ত গলায় বললেন,
‘তোকে কিছু বোঝাতে হবে না। রাবীর সব জানে।’
মেহুল হতভম্ব। রাবীর জানে? আর সে জানে না? কীভাবে সম্ভব? সে মা’কে প্রশ্ন করে,
‘রাবীর কীভাবে জানলেন?’
রামিনা বেগম সোজা সাপ্টা জবাবে বললেন,
‘আমি বলেছি।’
মেহুল রাগে, দুঃখে, কষ্টে সব কথা হারিয়ে ফেলল। আর কী বলবে সে? কাকে বলবে? আক্ষেপে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। তার এত বড়ো সমস্যার কথা সবাই জানে, অথচ সে নিজেই জানে না। এত বিচ্ছিরি লাগছে ব্যাপারটা তার কাছে! সে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। কিছুটা গরম।দেখিয়ে মা’কে বলল,
‘মা, ফোন রাখছি।’
খট করে কলটা কাটে সে। প্রচন্ড রকমের রাগে মাথা ফাটছে তার। এই রাগ কার উপর, সেটা এখনো ঠিক ভাবে বলা যাচ্ছে না। বেঞ্চে দুহাত ধরে চেপে বসে মনে মনে ভাবে, ‘আজ আর এখান থেকে নড়বে না সে। দুনিয়া উল্টে গেলেও না।’
কিয়ৎক্ষণ পর ফোন বেজে উঠে তার। সেদিকে তাকানোর মতোও কোনো আগ্রহ নেই। ফোন ফোনের মতো বাজছে। আর সে তার মতো বসে বসে রাস্তায় সা সা করে ছুটে চলা গাড়িগুলো দেখছে। সেই সময় সেখানে তার গাড়ির ড্রাইভার আসে। মৃদু আওয়াজে বলে,
‘ম্যাডাম, আপনি যাবেন না?’
মেহুল তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘না, আপনি যান।’
‘না ম্যাডাম, আপনাকে না নিয়ে কীভাবে যাব।’
‘তাহলে, বসে থাকুন।’
ড্রাইভার দুই দিকে মাথা হেলিয়ে আবার তার জায়গায় গিয়ে বসে। আরো কিছুটা সময় এভাবেই কাটে। হঠাৎ দূর থেকে একটা পরিচিত গাড়িকে সে ছুটে আসতে দেখে। মেহুল চট করে উঠে দাঁড়ায়। ডানে বামে না তাকিয়েই সোজা হাঁটা ধরে সে। রাবীর গাড়ি এক সাইডে রেখে, দ্রুত মেহুলের দিকে এগিয়ে যায়। দূর থেকে ডেকে উঠে,
‘মেহুল, দাঁড়ান। কোথায় যাচ্ছেন?’
কে শুনে কার কথা। রাবীরকে তোয়াক্কা না করেই মেহুল আপন মনে হেঁটে চলল।
চলবে….
#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬২।
রাবীর ছুটে গিয়ে মেহুলের হাত আঁকড়ে ধরে। সে ক্ষুব্ধ হয়ে চায়। হাত মুচড়িয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। রাবীর তাতে বাঁধন আরো শক্ত করে। চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘এমন করছেন কেন, মেহুল?’
মেহুল জবাব দেয় না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। নাকের পাল্লা ফুলিয়ে কান্না দমানোর চেষ্টা করলেও, পেরে উঠে না। রাবীর তার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় বলে,
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আযান দিবে। বাসায় চলুন, ইফতারের পর আপনার সব কথা শুনব।’
সে মেহুলের হাত চেপে ধরে তাকে গাড়িতে নিয়ে বসায়। মেহুল নিরব। ঠোঁট কামড়ে নাক টানছে কেবল। রাবীর ড্রাইভিং সিটে বসে মেহুলকে এক পলক দেখে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
_________
সবার সাথে ডাইনিং এ বসলেও, খুব বেশি কিছু মেহুলের গলা দিয়ে নামে না। কোনোরকমে দুটো খেজুর আর এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। তার শাশুড়ি মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন,
‘ওমা, কোথায় যাচ্ছো?’
মেহুল নিরুত্তাপ সুরে বলে,
‘নামাজ পড়তে যাচ্ছি, মা।’
রাবীর বসে বসে মেহুলের যাওয়া দেখল। তারপর বিধ্বস্ত দৃষ্টিতে খাবারের দিকে চেয়ে রইল। ঠিক এই ভয়েই, এতদিন সে মেহুলকে কিছু বলেনি। মেয়েটাকে এত কষ্ট পেতে দেখতে পারবে না সে। কিন্তু, আটকাতে পারল কই? ঠিকই তো মেহুল সব জানল। রাবীরও খুব বেশি কিছু খেতে পারল না। খালাকে ডেকে, খাবারগুলো ঢেকে রাখতে বলে, সে উপরে রুমে চলে যায়।
মেহুল নামাজ শেষ করে মোনাজাত ধরতেই যেন, ভুবন কাঁপিয়ে তার কান্না আসে। সে চাইছে শব্দ না করতে কিন্তু, পারছে না। কান্নার বেগ বাড়তেই, সে দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,
‘আল্লাহ, কেন এমন হলো? কেন? আমি কেন মা হতে পারব না? কী অন্যায় করেছি আমি, বলোনা। কোন দোষের শাস্তি দিচ্ছ আমায়? আমি কীভাবে সহ্য করব, আল্লাহ? আমার যে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে।’
মেহুলের কান্না থামার নাম নেই। সে এসবের মাঝে খেয়াল করেনি, রাবীর যে তার পাশেই নামাজে দাঁড়িয়েছে। হুট করেই তার গলার স্বরে মেহুল সম্বিত হয়। রাবীরও মোনাজাত ধরেছে ততক্ষণে। সে হাত তুলে বলে,
‘আল্লাহ, আমি জানি তুমি যা করো ভালোর জন্য করো। তোমার থেকে নিশ্চয়ই তোমার বান্দাকে বেশি কেউ ভালোবাসে না। তুমি তো উত্তম পরিকল্পনাকারী। আমার বিশ্বাস আছে তোমার উপর। তোমার সব সিদ্ধান্তে, আমি সন্তুষ্ট। আমার কোনো অভিযোগ নেই। বাবা না হতে পারার কোনো আক্ষেপও নেই। আমি জানি, তুমি কিছু কেড়ে নিলে তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দাও। আর সেই ভরসা আর বিশ্বাস থেকেই বলছি, আমি তোমার সব সিদ্ধান্ত হাসি মুখে মেনে নিয়েছি। এবার তুমি কেবল, আমার স্ত্রীকে সেই বোঝ দাও। উনার মনোবল বাড়িয়ে দাও। উনার সব কষ্ট দূর করে দাও। তুমি সহায় হও আমার স্ত্রীর। উনাকে তুমি সর্বোচ্চ সুখ দাও, খোদা।’
তারপর সে দোয়া পড়ে মোনাজাত শেষ করে। মেহুলও তখন “আমিন” বলে তার মোনাজাত শেষ করে। মাথা নুইয়ে বসে থাকে। রাবীরের দিকেও ফিরে তাকায় না। কেঁদে কেটে নাক মুখ লাল করে ফেলেছে সে। এখন ভীষণ অস্বস্তিতে ঝিম মেরে বসে আছে। রাবীর একটু স্বাভাবিক হয়। মেহুলকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। মেহুলের মাথার সাথে তার মাথা ঠেকিয়ে ধীর গলায় বলে,
‘মেহুল, আপনি জানেন, আমার মায়ের পর আমার কাছে সবথেকে প্রিয় নারী আপনি। আপনাকে আমি ঠিক কতটা মহব্বত করি, সেটা আপনাকে কখনও বুঝিয়ে বলতে পারব না। শুধু এইটুকুই বলতে পারব, আপনার ভেজা চোখ আমার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে। আমার তো দরকার নেই। কোনো সন্তানের দরকার নেই। আমার কোনো আফসোসও নেই। আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছে, যতটুকু দিয়েছে, আমি তাতেই সন্তুষ্ট। আমার প্রয়োজনের বেশি কিছু চাইনা। আপনি আছেন, আমার তাতেই চলবে। সন্তানের জন্য আমি আপনাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারব না। প্লিজ, ভেঙে পড়বেন না। তারপরও যদি আপনার সন্তানের প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা বাচ্চা দত্তক নিব। প্রয়োজন পড়লে, সারোগেসি পদ্ধতি অবলম্বন করব। তাও আপনি নিজেকে সামলে নিন, প্লিজ। এইভাবে আমি আপনাকে দেখতে পারব না।’
রাবীর থামে। মেহুল খুব মনোযোগের সহিত এসব শুনে। টু শব্দও করেনা। তার এই নিরবতা রাবীরকে যে আরো জ্বালাচ্ছে। সে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। মেহুলের দৃষ্টি এখনও জায়নামাজেই নিমজ্জিত। রাবীর মেহুলের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
‘কী হলো? কথা বলছেন না কেন, মেহুল?’
মেহুল ফোলা ফোলা চোখ দুটো নিয়ে এবার রাবীরের অস্থির সুশ্রী মুখটার দিকে তাকায়। নিমিষেই মন হালকা হয় তার। এই মুখটা দেখলেই, সব কষ্ট উবে যায় তার। বুক ভার লাগা কমে যায়। মনে স্বস্তি ফিরে। সে কম্পিত হাতে রাবীরের খোঁচা খোঁচা অমসৃণ দাঁড়িওয়ালা গালটাতে হাত রাখে। গলার স্বর কাঁপছে তার। কথাগুলো গলাতেই জমে আছে। বের হচ্ছে না। মেহুল খুব চেষ্টা করে একটা শুকনো ঢোক গিলে। মৃদু আওয়াজে শুধায়,
‘আপনি সব জেনেও, কেন আমাকে কিছু বলেননি?’
রাবীর মেহুলের সেই হাতটা ধরে তার ঠোঁটের কাছে নিয়ে চুমু খায়। পরে হতাশ সুরে বলে,
‘জানালে যে এইভাবে কষ্ট পেতেন, তাই জানাতে চাইনি।’
মেহুল বড়ো করে শ্বাস ফেলে। অস্থির চোখে মুখে এদিক ওদিক চেয়ে ফের জায়নামাজের দিকে তাকায়। মিনমিনিয়ে কম্পিত সুরে বলে,
‘আপনি আমাকে সান্ত্বনা দিতে এসব বলেছেন, তাই না?’
রাবীর কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
‘কোন সব?’
‘ঐ যে, আপনার বাচ্চা লাগবে না বললেন যে। এটা কি আদৌ সম্ভব? কোন ছেলে বাবা হতে চায় না, বলুন?’
রাবীর মেহুলের কাঁধ ধরে তাকে তার দিকে ঘুরায়। মেহুল দৃষ্টি তুলছে না। রাবীর মিহি সুরে বলে,
‘তাকান আমার দিকে।’
মেহুল তাকাতে চায় না। রাবীর পুনরায় বলে,
‘কী হলো, তাকান।’
মেহুল বাধ্য হয়ে চোখের পল্লব নাড়ায়। রাবীরের চোখে চোখ পড়তেই ভীষণ মন ভার হয় তার। এই মানুষটাকে যে সে কিছুই দিতে পারল না। এই আফসোসেই তো জীবন শেষ হয়ে যাবে তার। মেহুলের চোখ জল জমতেই, এবার রাবীর ধমকে উঠে,
‘খবরদার, যদি আর এক ফোটা পানিও গাল বেয়ে পড়েছে। বলেছি না, আমার কিছু লাগবে না। কোনো বাচ্চা লাগবে না। আমার আপনাকে হলেই চলবে। আর আপনাকে নিজের করে রাখতে যদি পুরো দুনিয়াও এক দিক করে ফেলতে হয়, আমি তাই করব। বাট স্টিল, আই উইল নেভার লিভ ইউ।’
কথাটা শেষ করেই সে মেহুলকে আষ্টেপৃষ্ঠে বুকে জড়িয়ে নিল। যেন, ছাড়লেই সে পালাবে। মেহুল আর কিছু ভাবতে পারে না। এক মুহুর্তের জন্য সব কষ্ট ভুলে যায় সে। সেও রাবীরকে সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
‘আমিও আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না, নেতা সাহেব।’
__________
গড়গড়িয়ে সব বমি করে, তবেই ক্ষান্ত হলো রিতা। কোনোরকমে শ্বাস টেনে সামনে তাকাতেই দেখল, বেচারা সাদরাজের গলা থেকে কোমর অবধি সব ভরে শেষ। সাদরাজ হতভম্বের মতো চেয়ে আছে তার দিকে। এমন কিছু যে হবে সে বুঝতে পারেনি। রিতা ততক্ষণে দাঁত দিয়ে জিভ কেটে, অসহায় সুরে বলে,
‘স্যরি।’
সাদরাজ স্বাভাবিক গলায় বলে,
‘ইট’স ওকে। আমি পরিষ্কার হয়ে আসছি।’
রিতার মুখ মুছিয়ে রাবীর খাবার নিয়ে রান্নাঘরে রেখে এল। তারপর সে একটা তোয়ালে আর টাউজার নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে, ফ্রেশ হতে। রিতা ঐদিকে বসে বসে অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে। সে এটা কী করল? কোন আক্কলে সে সাদরাজের গায়ের উপর বমি করল? ইশ, কী একটা বিশ্রী অবস্থা। নিজের উপর’ই ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। সাদরাজ তাকে নিয়ে কী ভাবছে কে জানে?
সাদরাজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চুল মুছতে মুছতে রিতার সামনে বসে। রিতা মুখ কালো করে কাচুমাচু করে বলে,
‘স্যরি, আমি আসলে বুঝতে পারিনি।’
সাদরাজ মৃদু হাসে। বলে,
‘আর কতবার স্যরি বলবে? বললাম তো, ঠিক আছে। এই সময় বমি হওয়াটা স্বাভাবিক।’
‘কিন্তু, আমি তো বমি করে আপনাকে নোংরা করেছি। আপনার নিশ্চয়ই ভীষণ বিরক্ত লাগছে?’
রিতা মাথা নুইয়ে কথাটা শেষ করে। সাদরাজ কথার পিঠে নরম গলায় বলে,
‘যেখানে আমার মতো এই জঘন্য মানুষটাকে তুমি একটু সুখী করতে এত কষ্ট করছো, সেখানে এই ছোট খাটো ব্যাপারগুলো আমার জন্য কিছুই না।’
রিতার চোখ ছলছল করে উঠে। সে এগিয়ে এসে সাদরাজের উদোম বুকে মাথা ঠেকায়। মিহি সুরে বলে,
‘আমি আমার সন্তানের বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি, সাদরাজ।’
সাদরাজ আগলে নেয় রিতাকে। ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,
‘আর আমাকে বাবা হওয়ার সুখ দেওয়া, সেই নারীকে আমিও ভীষণ ভালোবাসি।’
রিতা সাদরাজের খোলা বুকে নাক ঘষে। মিষ্টি এক ঘ্রাণে, শরীর কেঁপে উঠে তার। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে মনে মনে ভাবে,
‘এই ঘ্রাণটা পাওয়ার জন্য হলেও, আজীবন তাকে এই বুকেই মুখ লুকাতে হবে।’
চলবে….