#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৯।
ফজরের নামাজ শেষ করে বারান্দায় তাকাতেই দেখে এক সুন্দর সকালের সূচনা। জায়নামাজ ভাঁজ করে মেহুল উঠে দাঁড়ায়। চারদিক তখন পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে রি রি করছে। সকাল হয়েছে, সেটাই দলবেধে হৈ চৈ করে জানান দিচ্ছে তারা। বারান্দায় এসে মেহুল দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে এখন অনেকটাই আলোকিত চারদিক। কেমন একটা ঘোলাটে পরিবেশ। মৃদু মন্দ বাতাসটা গায়ে স্পর্শ করতেই যেন শিহরণ জাগে। রোযার সময়টাই অদ্ভুত সুন্দর। সেই সময় বাতাসেও যেন শান্তির পরশ পাওয়া যায়।
মেহুল গ্রিল আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে। বাইরের ঠান্ডা বাতাস শরীরে মিশছে তার। ভীষণ শান্তি পাচ্ছে মনে। নিজের মাঝে এতটাই বিভোর ছিল যে, রাবীরের উপস্থিতি সে টের পায়নি। কয়েক পল পরে তার উষ্ণ স্পর্শে ধ্যান ভাঙে। ঠোঁট নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কখন এলেন?’
রাবীর মুখ এনে কানের কাছে মিহি সুরে বলে,
‘মাত্রই।’
মেহুল আবার আগের মতোই চক্ষু রুদ্ধ করে। রাবীর আরেকটু এগিয়ে আসে। মেহুলের মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো খুব যত্নে কানের পিছে গুঁজে দেয়। তার গালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মেহুল বরাবরের মতোই নিরব। রাবীর পাশাপাশি দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,
‘ঘুমাবেন না?’
মেহুল তার দিকে না তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করে,
‘ঘুম আসছে না।’
রাবীর সময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
‘কোনো ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন?’
মেহুল এবার তাকায়। রাবীর ভীষণ স্বাভাবিক। তবে মেহুল কিছুতেই স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। সেহেরির পর খাবার টেবিলে, রাবীর তাকে মা’কে বলেছিল, “মেহুলকে যেন তিনি বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে কোনোপ্রকার চাপ প্রয়োগ না করেন। বাচ্চা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করাটা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই এই নিয়ে ভবিষ্যতে কেবল সে আর মেহুল’ই কথা বলবে।” মেহুল আড়ালে দাঁড়িয়ে এসব কিছু শুনেছিল। আর এটা শোনার পর থেকেই মনটা আরো বেশি খচখচ করছে তার। মনে বলছে, কিছু তো একটা ব্যাপার আছে; যার জন্য রাবীর এমন করছেন। কিন্তু, সেই ব্যাপার জানার জন্য সে রাবীরকে সরাসরি প্রশ্ন করার মতো সাহসও জুগাতে পারছে না।
মেহুল তাই আর প্রশ্ন করে না। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বিমূঢ় সুরে বলে,
‘চলুন, শুয়ে পড়ি।’
মেহুল শরীর টেনে বিছানায় যায়। চুপচাপ শুয়ে পড়ে সেখানে। রাবীরও তার পেছন পেছন আসে। সাড়াশব্দ না করে সেও শুয়ে পড়ে।
______________
সকাল থেকেই রিতার বেশ দুশ্চিন্তা। সে খেয়াল করেছে, কিছু একটার গন্ধেই তার বমি বমি পাচ্ছে। মূলত এই নিয়েই যত দুশ্চিন্তা তার। রোযা রেখেছে, এখন বমি করলেই রোযা শেষ। তাই এখন পর্যন্ত রুমেই ঘাপটি মেরে বসে আছে সে। নিচে নামলেই আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে গন্ধ এসে নাকে ঠেকে তার। বিশেষ করে, রান্নাঘর। এই ঘরে কিছু রান্না হোক বা না হোক, একটা ভ্যাপসা গন্ধ ঠিকই করবে। তাই সেদিকে তো ভুলেও ফিরে চাচ্ছে না সে।
তবে সে যে একাই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ তা কিন্তু না। সাদরাজও সমান তালে দুশ্চিন্তা করে যাচ্ছে। সে প্রথমবারের মতো বাবা হতে চলেছে। ঠিক বুঝতে পারছে না, বাবাদের কী কী করতে হয়। এই নিয়েই যত অস্থিরতা তার। রিতাকে তো প্রথমে রোযাই রাখতে দিচ্ছিল না। পরে ডাক্তারের সাথে কথা বলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়।
.
রিতা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সাদরাজের দিকে চেয়ে রইল। সাদরাজের হাবভাব ঠাহর করতে না পেরে প্রশ্ন ছুড়ল,
‘কী ব্যাপার, আজকে আপনি অফিসে যাবেন না?’
সাদরাজ লেপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে চাইল। বলল,
‘অফিসের কাজ বাসায় করছি তো।’
রিতা ভ্রু দৃঢ় করে বসে। লোকটার দিকে নিমিষ চেয়ে থাকে। এই লোকটাকে ঠিকভাবে চিনে উঠা বড়ো দায়। কখনোই উনার কোনো কাজের মিল পাওয়া যাবে না। যখন যা মন চায়, তাই করেন। রিতা বসে বসে এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
____________
দুপুরের নামাজ শেষ করে মেহুল রিতাকে কল দেয়। রিতাও তখন মাত্র নামাজ শেষ করে উঠেছে। মেহুলের কল দেখে খুশি হয়। বিছানায় আরাম করে বসে কলটা রিসিভ করে। অনেকক্ষণ একে অপরের নানান প্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলে একপর্যায়ে মেহুল বেশ হতাশ সুরে বলে,
‘জানিস রিতা, আমি বাচ্চা নিতে চাইলেও রাবীর কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, যেন এই রাজি না হওয়ার পেছনে কোনো গুরুতর কারণ আছে, যেটা এখন উনি আমাকে বলতে চাইছেন না।’
রিতা কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘আশ্চর্য, ভাইয়া এমন কেন করবেন? এখানে লুকানোর কী আছে?’
‘সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। না উনিও আমাকে সরাসরি বলছেন কিছু।’
‘তাহলে তুই নিজ থেকে সরাসরি কথা বল। দুজনে একসাথে বসে আলোচনা কর। দেখবি, সবকিছু ঠিক আছে।’
মেহুল তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। বলল,
‘উনি যেভাবে ব্যাপারটাকে অগ্রাহ্য করছেন; আমার তো এখন এই ব্যাপারে কথা বলতেই অস্বস্তি হচ্ছে।’
‘আরে ভাই, উনি তোর হাজবেন্ড। উনার সামনে আবার কীসের অস্বস্তি?’
‘আচ্ছা, কথা বলব।’
‘ঠিক আছে। কথা বল, আর খুব জলদি আমাকেও খালা বানা।’
মেহুল হেসে ফেলে। বলে,
‘আচ্ছা, বানাব।’
_____________________
রমজানের প্রথম পাঁচদিন খুব স্নিগ্ধতায় কেটে গেল। কীভাবে, কোন ফাঁকে গেল মেহুল তা একদমই টের পায়নি। সেহেরি, ইফতার, নামাজ-কালাম এসব নিয়ে খুব সুন্দর সময় কাটছে তার। দিনগুলোও যেন তাই দ্রুত কাটছে বলে মনে হচ্ছে। এই কয়দিন মেহুল আর রাবীরের সামনে কোনো বাচ্চার কথা উল্লেখ করেনি। সেও রাবীরের মতো বেশ স্বাভাবিক ছিল। তবে সবকিছুর মাঝেও তার মনে কী চলছিল, সেটা কেবল সে’ই জানে।
আজ ষষ্ঠ সেহেরি। ইফতারের পর রাতে আর কেউ ভারি কোনো খাবার খায় না। খুব খিদে পেলে, অল্প ফলমূল খায়। রাতে তাই আর কোনো কাজও থাকে না। সেজন্য মেহুলের শাশুড়িও নামাজ শেষ করে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন। রাবীর নামাজ শেষ করে বেশ রাতেই ফিরে। তার নির্বাচনের দিন যত এগুচ্ছে, ব্যস্ততাও তত বাড়ছে। তবে আজ কী ভেবে, সে একটু তাড়াতাড়িই বাড়িতে ফিরেছে। রুমের কাছে এসে দেখে ভেতর থেকে দরজা আটকানো। অবাক হয়ে, দরজায় নক করে। ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। রাবীর এদিক ওদিক তাকায়। মেহুল তো কোথাও নেই। তাহলে রুমেই হবে। সে আবার দরজায় নক করে। মেহুল তো সচরাচর দরজা ভেতর থেকে লক করে না। তবে আজ কী হলো?
রাবীর লাগাতার দরজায় নক করে যাচ্ছে। এবার চিন্তা হচ্ছে তার। কপালে আঙ্গুল ঘষে ঘাম মুছে। মায়ের রুমের দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যোত হতেই দরজাটা খট করে খুলে যায়। রাবীর তড়িগড়ি করে পেছনে ফিরে। রুমের দিকে পা বাড়ায়। অন্ধকার রুম। রাবীর হাতড়ে সুইচ অন করে। রুম ফাঁকা। রাবীর চিন্তায় পড়ে ভাবে, মেয়েটা কী করতে চাইছে। সে হাত থেকে ঘড়িটা খুলে রাখে। পাঞ্জাবীর বোতাম দুটো খুলে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। বারান্দার দরজার কাছে যেতেই থমকে দাঁড়ায়। স্কাউচে বসা শুভ্ররাঙা পরীতে তার চোখ আটকায়। মেহুল চমৎকার হেসে লজ্জামাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘আমাকে কেমন লাগছে, নেতা সাহেব?’
রাবীর ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। মেহুলের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে। তাকে মনোযোগ সহিত দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘হঠাৎ, এত সাজ?’
মেহুল যেন লজ্জা পায়। মাথা নুইয়ে বলে,
‘আপনার জন্য সেজেছি। আমাকে ভালো লাগছে না?’
‘ভীষণ ভালো লাগছে।’
মেহুল লজ্জা পায়। মাথা নুইয়ে মিটমিট করে হাসে। রাবীর তার দু’হাত আগলে নিয়ে হাতের পিঠে চুমু খায়। মেহুল জোরে নিশ্বাস ফেলে। রাবীরের চোখে চোখ পড়তেই ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে। তাও সে নিজেকে সামলে নেয়। রাবীরের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘আমায় ভালোবাসবেন, নেতা সাহেব? যে ভালোবাসা আমার শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ জাগাবে, সেরকম ভালোবাসা। যে ভালোবাসা বুকের স্পন্দন বাড়িয়ে শরীরকে নিস্তেজ করে দিবে, সেরকম ভালোবাসা। বাসবেন, নেতা সাহেব?’
মেহুলের কন্ঠে এমন আকুতি কানে বাজে রাবীরের। সে বুঝতে পারছে, মেহুল কী চাইছে। সে এগিয়ে মেহুলের কপালে কপাল ঠেকায়। মিহি সুরে বলে,
‘আপনার জন্য আপনার নেতা সাহেবের ভালোবাসা কখনোই ফিকে হয়ে পড়বে না, মেহুল। আমার সবটুকু আমিটা তো আমি আপনাকেই বিলিয়ে দিয়েছি। তবে, আজ এত অনুনয় করে কেন ভালোবাসা চেতে হবে? আপনার জন্য আমার ভালোবাসা সবসময় মুক্ত।’
সে আলতো করে মেহুলের কপালে কপাল ঘষেই ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। আর সেই প্রতিটা স্পর্শে সত্যিই তার সমস্ত শিরা উপশিরায় শিহরণ জেগে উঠে।
চলবে…
#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬০।
আগামীকাল রাবীর এর নির্বাচন। আজকের দিনটা তাই সে নাকে মুখে ছুটছে। নির্বাচনের সময় তার যত দুশ্চিন্তা থাকে, ভোট চুরি নিয়ে। প্রতিপক্ষ দল আর কিছু পারুক বা না পারুক, ভোট ঠিকই চুরি করবেই। তাই এবার শুরু থেকেই রাবীর বেশ সতর্ক। ন্যায় ভাবে কেউ জিতলে তাতে তার কোনো অসুবিধা নেই। তবে কোথায় দুর্নীতি দেখলে তার আর মাথা ঠিক থাকে না। তাই এবার প্রত্যেকটা কেন্দ্রে আগে থেকেই বেশ পুলিশ মোতায়েনের ব্যবস্থা করেছে। এসবের মাঝে সাদরাজ ও তাকে বেশ সাহায্য করছে। যখন যেখানে যেতে হচ্ছে, সাদরাজও তার সাথে সাথেই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে অনেক মানুষ আবার তাদের একসাথে দেখে অবাক হচ্ছে। দু’দিন আগের ভয়ানক শত্রুতা হঠাৎ এত ভালো বন্ধুত্বে পরিণত হলো কী করে, সেটাই তাদের বোধগম্য হচ্ছে না।
মেহুল নামাজে বসে দোয়া করে, যেন ভোটটা ন্যায় ভাবে হয়। কারণ, ন্যায় ভাবে হলে তার স্বামী অবশ্যই জয় লাভ করবে। এটাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। তবে আজকাল দুর্নীতি যা বেড়েছে, এই ন্যায়ের তো আর কোনো মূল্যই নেই সমাজে।
মেহুল আজ ইফতারের পর একটু রিতার সাথে দেখা করতে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু, রাবীরকে ফোন করতেই সে সাফ মানা করে। সে চায় না, এই সময় মেহুল বাসা থেকে বের হোক। বাইরের পরিবেশ এখন খুব একটা সুবিধার না। রাবীরের শত্রুরা হয়তো উৎ পেতে আছে, সুযোগ বুঝেই হামলা করতে চাইবে তারা। মূলত সেই জন্যই সে মেহুলকে বারণ করেছে। মেহুলও বুঝতে পারে ব্যাপারটা। তাই সেও আর জেদ ধরেনি। রিতার সাথে ফোন করেই কথা বলে নেয় সে।
রিতার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। প্রথম তিন মাস শরীর একটু বেশিই খারাপ থাকে। সেটা মেহুলও জানে। তাই রিতা এখন তার বাবার বাড়িতে আছে। সেই বাড়িতেও খুশির আমেজ। রিতার মা বাবাও তাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছেন। রিতার জীবনে এখন খালি সুখ আর সুখ। মেহুলের দোয়া যেন কবুল হয়েছে। রিতাকে সুখী হতে দেখে মেহুলের এখন ভীষণ শান্তি লাগে।
_____________
একটা রোদ ঝলমলে সকাল। ফজরের পর থেকেই মেহুল আজ ঘুমাতে পারেনি। ঘুমাবে কী করে, এত টেনশনে কি আর ঘুম আসে? রাবীর ফজরের নামাজ শেষ করেই অফিসে বেরিয়ে গেছে। খুব সকালেই ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে যায়। প্রার্থীরা যার যার মতো কেন্দ্রে ভিড় জমায়। রাবীর একবার তার লোক নিয়ে সবগুলো কেন্দ্রে টহল দিয়ে আসে। সাথে কেন্দ্রে দায়িত্বরত লোকদের বুঝিয়ে আসে, যেন কোনোপ্রকার দুর্নীতি না হয়। অফিসে ফিরে এসে শান্ত হয়ে চেয়ারে বসে সে। ঘেমে সাদা পাঞ্জাবী শরীরে চিপকে আছে তার। এসি আরো কমিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর সাদরাজ তাকে কল দিয়ে জানায়,সেও কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘুরে খোঁজ নিয়েছে এবং এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে। পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে। সব শুনে রাবীর নিশ্চিন্ত হয়। মেহুলকে কল দিয়ে তাকেও দুশ্চিন্তা করতে বারণ করে।
ঠিক বিকেল পাঁচটায় ভোট গণনা শেষ হয়। রেজাল্ট আসে আরো আধ ঘন্টা পর। চারদিকে হৈ চৈ লাগে। খবর আসে, দ্বিতীয়বারের মতো আবারও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আরিয়ান খান রাবীর বিপুল সংখ্যক ভোটে জয়লাভ করেছেন। খবরটা বাতাসের ন্যায় চারদিক ছড়িয়ে যায়। রাবীরের অফিসের বাইরে জনগনের ভিড় জমে যায়। সবাই যেন বেশ খুশি, তাদের যোগ্য নেতাকে আবার বিজয়ী হতে দেখে। রাবীরও খুশি ভীষণ। জনগনের সামনে দাঁড়িয়ে সবার সাথে খুশবিনিময় করে। সাদরাজও আছে। সে অনেক মিষ্টি এনে নিয়ে আসে। বন্ধুকে মিষ্টি খাইয়ে দেয়। ঐদিকে টিভিতে খবর দেখে মেহুল আর তার শাশুড়িও বাড়িতে বসে উচ্ছ্বাস করছেন। মেহুল কল দিয়ে তার মা বাবাকে জানায়। এই খবর শুনে সবাই খুব খুশি হয়।
____________________________________________
দেখতে দেখতে রোযা শেষের দিকে। আর মাত্র পাঁচটা রোযা বাকি। তারপর খুশির ঈদ। যদিও এর মাঝে রোযা চলে যাওয়ায় মনের মাঝে একটা আক্ষেপ ও থাকে। প্রতিবারই ভেবে কষ্ট হয়, পরের বছরের রোযা আদৌ পাবো কিনা? আর প্রতিবছর’ই রোযার শেষে মেহুলের এমন একটা আক্ষেপ হতো। এবারও হচ্ছে। তবে আজ সকাল থেকেই মনটা ভীষণ রকম খারাপ তার। রোযা চলে যাচ্ছে বলে না শুধু, আরো একটা বিশেষ কারণ আছে। এই মন খারাপের সূচনা সময়ে সে কেঁদেও ফেলেছিল। কেন এমন হলো ভাবতে ভাবতে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ডাক্তার দেখাবে। তাও আবার রাবীরকে না জানিয়ে।
রিতাকে বিকেলে কল দেয় সে। বলে,
‘রিতা, তুই রেডি হয়ে থাক। আমি আসছি, তোকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব।’
রিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন? এখন হঠাৎ ডাক্তারের কাছে কেন যাবি?’
‘তোর চেকআপের জন্য। এই সময় বেশি বেশি ডাক্তারের ফলোআপে থাকতে হয়। এত কথা না বলে, এখন রেডি হয়ে থাক। আমি আসছি।’
রিতাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেহুল কল কাটে। বাসায় রিতার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে বলে, সে তৈরি হয়ে বেরিয়ে যায়। রিতা সাদরাজকে কল দিয়ে জানিয়ে রাখে, সে যে মেহুলের সাথে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে। নয়তো, পরে লোকটা আবার অযথা টেনশন করত।
হসপিটালে পৌঁছেই রিতা বলল,
‘আমাদের তো সিরিয়াল দেওয়া হয়নি। এখন তো এর জন্য অনেক লেইট হবে।’
মেহুল বলল,
‘হবে না। আমি সিরিয়াল দিয়ে রেখেছি। তুই এখানেই বস, আমি দেখে আসি কত নাম্বার চলছে।’
মেহুল দেখতে যায়। আর বেশি না, একজনের পরেই তাদের নাম্বার। মেহুল তাই রিতাকে নিয়ে কাছে বসে যেন ডাকতেই চলে যেতে পারে।
ডাক্তারের সামনে বসে রিতা বুঝতে পারছে না কী বলবে। তার তো এখন মোটামুটি সবকিছুই স্বাভাবিক। ডাক্তার দেখানোটা জরুরি ছিল না। তাও কেন যে মেহুল জোর করল কে জানে। ডাক্তার তাও রিতাকে ভালোভাবে চেকআপ করে বলল,
‘উনার সবকিছু নরমাল আছে। চিন্তা করার কিছু নেই।’
রিতা তখন মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘দেখেছিস, আমি বলেছিলাম না; সবকিছু ঠিক আছে। ডাক্তার দেখানোর দরকার নেই। কিন্তু, তুই তো আমার কোনো কথাই শুনিসনি।’
মেহুল এতক্ষণে মুখ খুলে। মূলত সে নিজেই এখানে ডাক্তার দেখাতে এসেছে। এই কথা শুনে রিতা চমকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘তোর আবার কী হয়েছে?’
মেহুল হতাশ মুখে রিতার দিকে তাকায়। বলে,
‘আমি কনসিভ করতে পারছি না।’
রিতার কপালে চওড়া ভাঁজ পড়ে। সে ডাক্তারের দিকে উত্তরের আশায় তাকায়। ডাক্তার মেহুলকে কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেন। সবকিছুর গুছিয়ে জবাব দেয় মেহুল। সব শুনে ডাক্তার বলেন,
‘আপনাকে একটা টেস্ট করাতে হবে। আর সেই টেস্টের রিপোর্ট দেখেই বলা যাবে, সমস্যা কোথায়।’
মেহুল জিজ্ঞেস করে,
‘আজকে টেস্ট করে কি আজকেই রিপোর্ট পাওয়া যাবে?’
ডাক্তার বলেন,
‘না, আজকে আপনি টেস্ট করে যান। রিপোর্ট কালকে দিবে। তখন রিপোর্ট নিয়ে আবার আমার কাছে আসবেন।’
মেহুল মাথা ঝাঁকিয়ে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে টেস্ট করাতে চলে যায়।
ফেরার পথে মেহুলের অস্থির মুখখানা দেখে রিতা তার হাতের উপর হাত রেখে বলে,
‘চিন্তা করিস না, দোস্ত। কিচ্ছু হবে না।’
মেহুল ঢোক গিলে। ভীত সুরে বলে,
‘আমার না কেমন যেন ভয় হচ্ছে। যদি কোনো সমস্যা ধরা পড়ে?’
‘আরে না। সবকিছু নরমাল আছে। ঠিক হয়ে যাবে। তুই কোনো চিন্তা করিস না।’
রিতা তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু, মেহুল কোনোভাবেই তার মনের ভয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। সে মৃদু আওয়াজে বলে,
‘সাদরাজ ভাইয়াকে এখনই কিছু জানানোর দরকার নেই।’
‘ঠিক আছে। আর তুই রাবীর ভাইয়াকে কিছু জানাবি না?’
মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘না, এখনই না।’
চলবে….