#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৭।
মেহুলের চিৎকারে রাবীর হতভম্ব। মেহুল বিছানা ছেড়ে উঠে রীতিমতো নাচ ধরেছে। এই সকাল সকাল এমন দৃশ্য দেখে রাবীরের আর পলক পড়ছে না। সে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। পুনরায় প্রশ্ন করে,
‘কী হয়েছে, বলবেন তো।’
মেহুল নিজেকে স্থির করতে পারছে না। পারবে কী করে? এতবড়ো একটা খবর পেয়ে কেউ নিজেকে স্থির রাখতে পারে। ফোনের ওপাশ থেকে রিতাও তার হৈ চৈ এর শব্দ পাচ্ছে। মেয়েটা ঠোঁট চেপে হাসে। কলটা কেটে দিয়ে পিলপিল পায়ে এগোয়, সাদরাজের দিকে। সাদরাজ এখনো ঘুমে। রিতা তার মাথার পাশে বসে। ঘুমে জবুথুবু হয়ে থাকা সাদরাজের মুখশ্রীটা বেশ কিছুক্ষণ পরখ করে লজ্জা পেল সে। এই অনুভূতিটা অদ্ভুত। সে প্রকাশ করতে পারছে না ঠিক। এখন কি একবার সাদরাজকে ডেকে তুলবে? সব শোনার পর সাদরাজের প্রতিক্রিয়াটা কেমন হবে? রিতা ভাবছে। তার মাঝেই সাদরাজের চুলে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দেয়। সাদরাজ টের পায় না। রিতা নিমিষ চেয়ে থাকে তার পানে। কখনো এত মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখা হয়নি। মানুষটার সাথে পরিচিতিটা ভীষণ কুৎসিত ভাবে হলেও, এখন যেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সেই কুৎসিত ভাবটা ঘুঁচে যাচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে, সুন্দর এক অনুভূতির। তার প্রথম রাতের কথা তার মনে আছে, মনে আছে প্রথম স্পর্শের কথাও। সেদিন যতটা ঘৃণা লেগেছিল, আজ ততটাই রোমাঞ্চকর লাগছে। যেন এক মুহুর্তেই সব ক্লান্তি, সব দুঃখ হাওয়ায় মিশে গিয়েছে।
রিতা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। উঠে দাঁড়ায় সে। এখনই বলবে না। সাদরাজকে একটু না জ্বালিয়ে, এত বড়ো খবর সে কী করে দিবে।
সেই কিটটা, আলগোছে তার একটা ড্রয়ারে রেখে দেয়। এখানে সচরাচর সাদরাজের হাত পড়বে না। পরে চুপিসারে এসে সাদরাজের পাশে শুয়ে পড়ে। চোখ বুজে এমন একটা ভান ধরে, যেন কিছুই হয়নি।
.
.
ঐদিকে মেহুলের চোটপটে রাবীর যেন এবার কিঞ্চিত বিরক্ত হয়। এই সকাল সকাল মেয়েটা এমন করছে কেন? রাবীর উঠে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই মেহুল দৌড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে বলে,
‘আপনি জানেন, কী হয়েছে?’
রাবীর হতাশ চোখে তাকায়। না বললে সে কোথ থেকে জানবে। নিরস মুখে বলে,
‘আপনি না বললে, কী করে জানব?’
মেহুল এবার কিছুটা স্থির হলো। নিজেকে ধাতস্ত করে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘নিউজ তো কনফার্ম।’
রাবীর বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,
‘কীসের নিউজ?’
মেহুল তড়িগড়ি করে জবাবে বলে,
‘আপনি খালু, আর আমি খালা হতে যাচ্ছি। টেস্ট পজিটিভ এসেছে।’
রাবীর চমকায়। প্রশ্ন ছুড়ে,
‘আসলেই?’
মেহুল হেসে বলে,
‘হ্যাঁ, একদম সত্যি।’
রাবীর নির্বাক চেয়ে আছে। কী বলবে সে। এত বড়ো খুশির সংবাদ শুনে এখন আর কোনো কথা বের করতে পারছে না। অবশেষে, সাদরাজ বাবা হতে চলেছে। ছেলেটা এই খবর পাওয়ার পর, নিশ্চয়ই খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠবে। রাবীরের যেন আর তর সইছে না। মেহুলকে বলল,
‘চলুন। এক্ষুনি গিয়ে ওদের সাথে দেখা করে আসি।’
মেহুল মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘না। রিতা এখনো সাদরাজ ভাইকে কিছু বলেনি। আগে ওদের মধ্যে কথা হোক, তারপর আমরা যাব।’
রাবীর ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
‘আমি তো আর খুশি ধরে রাখতে পারছি না।’
মেহুল এগিয়ে আসে। রাবীরের খুব কাছে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,
‘আমিও এত খুশি হতে চাই, রাবীর। প্লিজ।’
রাবীর আলতো হাতে মেহুলের গাল স্পর্শ করে। নরম সুরে বলে,
‘অবশ্যই। আমার ওয়াইফের জন্য পৃথিবীর সমস্ত সুখ আমি এক করে নিয়ে আসব।’
মেহুল অস্থির হয়ে বলে,
‘কখন?’
রাবীর মৃদু হেসে জবাবে বলে,
‘খুব তাড়াতাড়ি।’
______________
বিকেলে রাবীর ফিরতেই মেহুল জেদ ধরল, রিতা আর সাদরাজের বাড়িতে যাবে। রাবীরও সকালে চেয়েছিল। তবে একটু পর তার মিটিং ছিল বলে সে প্রথমে না করলেও পরে মেহুলের কথা ভেবে রাজি হয়। যাওয়ার পথে অনেক প্যাকেট মিষ্টি কিনে তারা। মেহুল পুরো গাড়ি অস্থিরতায় কাটিয়েছে। কখন গিয়ে পৌঁছাবে, আর কখন গিয়ে রিতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে।
গাড়ি থেকে নেমেই মেহুল বাড়ির দিকে ছুট লাগাল। রাবীর পেছন থেকে মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিতে নিতে মৃদু হেসে বলল,
‘খুশিতে পাগল হয়ে গিয়েছে মেয়েটা।’
রাবীরকে এগিয়ে আসতে দেখে, বাড়ির দারোয়ান দ্রুত পায়ে এলেন। রাবীরের হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটগুলো নিয়ে বললেন,
‘আপনি ভেতরে যান, স্যার। আমি এগুলো নিয়ে আসছি।’
রাবীর বসার রুমে ঢুকতেই দেখে, মেহুল রিতার দু কাঁধ ধরে লাফাচ্ছে। চোখে মুখে আনন্দ, খুশি উপচে পড়ছে তার।রিতারও সেইম অবস্থা। তবে তার মাঝেও যেন চোখে মুখে কেমন লজ্জার ছাপ। রাবীরকে দেখে আরো বোধ হয় লজ্জা পেল। প্রশ্বস্থ হেসে বলল,
‘ভাইয়া, আসুন।’
রাবীর এগিয়ে যায়। হেসে বলে,
‘কনগ্রেচুলেশন, রিতা।’
রিতা প্রচন্ড লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। মেহুল তার লজ্জা দেখে ঠোঁট টিপে হাসল খুব। রাবীর প্রশ্ন তুলল,
‘তা, আমাদের বাচ্চার বাপ কই? তাকে দেখছি না যে?’
লজ্জামাখা মুখটাই রিতা একটু উপরে তুলে বলল,
‘সকালে বেরিয়েছে, এখনো তো ফেরেনি।’
রাবীর কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
‘সেকি, এত বড়ো একটা খবর। আর সাদরাজ এখনো বাসায়ই ফেরেনি। দাঁড়ান, আমি এক্ষুনি ওকে কল করছি।’
লজ্জাকে আরো ফুটিয়ে তুলে রিতা বলল,
‘উনি এখনো কিছু জানেন না।’
মেহুল আর রাবীর অবাক হয়ে তাকায়। মেহুল জিজ্ঞেস করে,
‘এখনো ভাইয়াকে কিছু জানাসনি কেন?’
রিতা তার উদ্দেশ্যের কথা বলে না। শুধু বলে,
‘এমনি।’
তখনই সেই কাঙ্খিত ব্যক্তি বাড়িতে এসে হাজির হয়। বসার রুমে এসেই এমন অপ্রত্যাশিত মানুষ যুগলকে দেখে বিস্ময়ে এদিক সেদিক তাকায়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘রাবীর, তোরা?’
রাবীর হাসে। সাদরাজের কাছে এসে তার পিঠে চাপড় মেরে বলে,
‘কিরে শালা, মিষ্টি না খাওয়ানোর ধান্দাতে আছিস নাকি?’
সাদরাজ বোকার মতো রিতার দিকে এক পলক তাকায়। রিতার মাথা নুয়ানো। সে কিছুই আন্দাজ করতে পারছে না। যার দরুন কপালে চওড়া ভাঁজ পড়ে। প্রশ্ন তুলে বলে,
‘কী বলছিস? কীসের মিষ্টি?’
‘আমাকে বুড়ো বানানোর মিষ্টি।’
সাদরাজের ভাঁজ পড়া কপালটা দৃঢ় হয়। সে এখনো কিছুই বুঝতে পারছে না। সবার হাবভাবও কেমন যেন অন্যরকম। বুঝতে না পেরে সে আবার প্রশ্ন করে,
‘রাবীর, একটু খুলে বলতো কী হয়েছে? তুই কীসের মিষ্টির কথা বলছিস? কে কাকে মিষ্টি খাওয়াবে?’
রাবীর তপ্ত শ্বাস ছাড়ে। রিতার দিকে চেয়ে বিমূঢ় সুরে বলে,
‘রিতা, আপনি ছাড়া ওকে আর কেউ বুঝাতে পারবে না। ওকে আপনি রুমে নিয়ে যান। তারপর বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার নিয়ে আসবেন।’
রিতা ঠোঁট কামড়ে আড় চোখে সাদরাজের দিকে চাইল। সাদরাজ তার দিকেই চেয়ে আছে। রিতা সঙ্গে সঙ্গেই চোখ সরায়। অস্থির চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে,
‘চলুন, সাদরাজ।’
সাদরাজ উদ্ভ্রান্তের মতো চেয়ে থাকে। কোনোকিছুর আগা মাথা মেলাতে পারছে না সে। কী কথা বোঝানোর কথা বলছে রাবীর? সাদরাজ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রাবীরের দিকে তাকাতেই রাবীর হেসে বলে,
‘আরে যা, রিতার কাছ থেকেই সবকিছু বুঝে আয়। আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।
কথা শেষ করে, রাবীর খুব আরাম করে সোফার উপর শরীর এলিয়ে বসে। মেহুলও হেসে হেসে তার পাশে বসে। সাদরাজ এখনো আগের মতোই চেয়ে আছে। রিতা মিনমিনিয়ে বলল,
‘রুমে চলুন।’
হঠাৎ রিতার এমন অদ্ভুত পরিবর্তন দেখে সাদরাজের আরো বেশি খটকা লাগে। সবাই মিলে কী করতে চাইছে? রিতা পা বাড়ায়। সাদরাজ ও আগাগোঁড়া কিছু না বুঝেই তার পেছনে হাঁটা ধরে।
রুমে এসেই ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘কী ব্যাপার, রিতা? কিছু কি হয়েছে?’
রিতা ফিরে তাকায়। ভীষণ অস্বস্তি আঁকড়ে ধরেছে তাকে। কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। বুকের ভেতর ধুকধুক করছে, সাদরাজের প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। সাদরাজ এবার বিরক্ত হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘আজব, কিছু বলছো না কেন? কী হয়েছে?’
রিতা অস্বস্তিকে ঝেরে ফেলে। নিজেকে শান্ত করে। সাদরাজের চোখে চোখ রাখে। নরম গলায় বলে,
‘একটা কথা বলার ছিল।’
সাদরাজ স্বাভাবিক গলায় বলে,
‘হ্যাঁ, বলো কী বলবে।’
সাদরাজ আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থাকে। রিতা ঢোক গিলে প্রথমে। বলে খানিকক্ষণ নিরব থাকে। অতঃপর জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘আপনি বাবা হতে চলছেন, সাদরাজ।’
চলবে….
#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৮।
সাদরাজের স্থির, নিমিষ দৃষ্টি রিতাতে আবদ্ধ। রিতার চক্ষু জোড়া অস্থির। হাতে মৃদু কম্পন। সাদরাজ নিরব, নিস্তব্ধ। এই ছোট্ট, সুন্দর কথাটাও তার মস্তিষ্কে ঠাই পাচ্ছে না। সে হতভম্ব। কী বলবে এখন? খুশি হবে? খুব খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরবে রিতাকে? সাদরাজ ভাবছে। সাদরাজের এমন ঠান্ডা রূপ দেখে রিতা কেন যেন ভয় পাচ্ছে। আচ্ছা, সাদরাজ মেনে নিবে তো? আর যদি মেনে না নেয়, তখন?
রিতা জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজায়। খানিক সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি খুশি হোননি, সাদরাজ?’
সাদরাজ আগের মতোই। অনুভূতি যেন সব হারিয়ে গিয়েছে। সে কীভাবে প্রতিক্রিয়া করবে, সেটাও সে বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ চুপ থাকে সে। ভাবে। রিতা ভয় নিয়ে চেয়ে থাকে। সময়ের সাথে সেই ভয় বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে গিয়ে সাদরাজের নিরবতা ভাঙে। সে ঠোঁট নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এটা সত্যি?’
রিতা চট করে উপর নিচে মাথা নাড়ায়। সাদরাজ এদিক ওদিক তাকায়। তার এই অস্থিরতা রিতাকে আরো ঘাবড়ে তুলছে। সাদরাজ ঢোক গিলে। ঠোঁট কাঁপছে তার। কিছু বলতে চাইছে। বলতে পারছে না। রিতা তখন সাদরাজের দু হাত আগলে ধরে। আবারও জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি খুশি হোননি?’
সাদরাজের চোখ হঠাৎ টলমল করে উঠে। কম্পিত সুরে বলে,
‘আমি তো ভালো বাবা হতে পারব না, রিতা। আমি ঐ শাহাদাত আহমেদের মতোই হব, ভীষণ খারাপ বাবা।’
রিতার ব্যথিত হয়। নরম গলায় বলে,
‘কে বলেছে, আপনি খারাপ বাবা হবেন? আপনি ভীষণ ভালো বাবা হবেন। আপনার বাবা ভালো হতে পারেনি তো কী হয়েছে? আপনি হবেন। পৃথিবীর সবথেকে ভালো বাবা।’
সাদরাজ ঠোঁট কামড়ে নিজের চোখের পানি ধরে রাখে। তার মনে ভয়। যদি সেও তার বাবার মতো খারাপ বাবা হয়? যদিও সেও তার সন্তানের সাথে এমন অন্যায় করে, তখন?
সাদরাজ উদ্বিগ্ন গলায় বলে,
‘আমার ভয় হয়, রিতা। যদি আমিও আমার স্বার্থের কথা ভেবে আমার সন্তানের সাথে অন্যায় করে বসি? আমার নিজের উপর আমার ভরসা নেই। আমি আমার সন্তানদের কষ্ট দিতে পারব না।’
রিতা সাদরাজের হাত জোড়া শক্ত করে ধরে। ভরসা দিয়ে বলে,
‘তেমন কিছুই হবে না। আমি বলছি তো, আপনি বেস্ট বাবা হবেন। কেন ভয় পাচ্ছেন? আপনি ভালো মানুষ। আপনি আপনার বাবার মতো স্বার্থপর না। প্লিজ সাদরাজ, মেনে নিন।’
সাদরাজ রিতাকে টেনে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। সাদরাজের লম্বা, চওড়া বুকে তুমুল ভাবে হয়ে চলা স্পন্দনের শব্দগুলো সে শুনতে পারছে। বুকের উপর হাত দিয়ে চেপে ধরে। মিহি সুরে বলে,
‘শান্ত হোন, সাদরাজ। আপনার হৃদপিন্ড এবার বেরিয়ে আসবে তো।’
কিন্তু, বললেই কি আর শান্ত হওয়া যায়? সাদরাজ শান্ত হতে পারছে না। এত বড়ো একটা খবর পাওয়ার পর কী করে শান্ত হবে সে? ভয়, আনন্দ, চিন্তা, অস্থিরতা সবকিছু একসাথে চেপে ধরেছে তাকে। যেই সম্পর্কটা এত অগোছালো, সেই সম্পর্কের পরিণতি এত সুন্দর হবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। রিতাকে অনেকক্ষণ বুকে চেপে রাখে। রিতাও খুব মনোযোগ দিয়ে সাদরাজের বুকের ভেতরের ঢিপঢিপ শব্দগুলো শুনে। যেন সেগুলো কোনো যন্ত্রের সুর।
রিতার মুখ তুলে সাদরাজ তার কপালে আলতো করে চুমু খায়। এই প্রথম সাদরাজের স্পর্শে ভীষণ রকম লজ্জা পায় সে। চোখ বুজে নেয়। সাদরাজ মাথা তুলে চেয়ে মুচকি হাসে। রিতার ঠোঁটে আঙ্গুল ছোঁয়ে বলে,
‘নিজের সবটুকু দিয়ে আমি তোমাকে আর আমাদের সন্তানকে আগলে রাখব, রিতা। কখনো এইটুকু কষ্টও পেতে দিব না, প্রমিস।’
রিতা চোখ মেলে তাকায়। সাদরাজে চোখে চোখ রাখে। মনে তখন সে দারুণ কিছু একটা করে ফেলার ফন্দি আটে। সাদরাজ বুঝে উঠে না। এর আগেই সে সাদরাজের আঙ্গুল সরিয়ে তার ওষ্ঠপল্লবে ভালোবাসা ছোঁয়ায়। সাদরাজ শিউরে উঠে। মেয়েটা কী ভয়নাক কাজ করে ফেলেছে।
রিতা চট কর পেছনে চলে যায়। সাদরাজ হাত দিয়ে ঠোঁট ধরে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রিতার লজ্জায় যেন মরমর অবস্থা। সে মাথা নুইয়ে কোনোরকমে বলল,
‘নিচে মেহুল আর ভাইয়া অপেক্ষা করছেন, মিষ্টি খাওয়ার জন্য। চলুন।’
বলেই ছুট লাগাল দরজার বাইরে। সাদরাজ যেভাবে ড্যাবড্যাব চেয়ে ছিল, আজ ঐ চাউনিতেই সে মৃত্যু অবধারিত ছিল।
রিতা নিচে আসতেই মেহুল তার কাছে ছুটে আসে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কিরে, ভাইয়া কী বলেছেন?’
রিতা হাসে। বলে,
‘খুশিতে বোধ হয় কথাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শোনার পর স্তব্ধ হয়ে এক ঘন্টা চেয়েছিল।’
সোফা থেকে তখন রাবীর হেসে বলে,
‘তা তো হবেই। আমার ছোট্ট হৃদয়ের বন্ধু, এত বড়ো একটা খবরের দখল সে কীভাবে সামলাবে বলো?’
সাদরাজ পেছন পেছনেই নামে। রিতার দিকে একপলক চেয়ে রাবীরের পাশে সোফায় গিয়ে বসে। রাবীর হেসে বলে,
‘কিরে শালা, আমার পরে বিয়ে করে আগে বাপ হয়ে যাচ্ছিস। ব্যাপারটা মোটেও ঠিক হয়নি কিন্তু।’
সাদরাজ তখন শব্দ করে হাসে। বলে,
‘তোর মতো এত দিন, মাস ঠিক করে সব করতে গেলে, কিছুই হবে না। আমাদের মতো হুট হাট সব ঘটিয়ে ফেলবি, তাহলেই দেখবি, আর কোনো ঝামেলা নেই।’
রাবীর কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মেহুল চোখ মুখ কুঁচকে বলে উঠে,
‘হ্যাঁ, সেটাই। উনার তো সব কিছুতেই পারফেক্ট সময় লাগে।’
সাদরাজ আর রিতা তার কথা শোনে হেসে উঠে। রাবীর কপাল কুঁচকায়। একটা মিষ্টি তুলে সাদরাজের মুখে পুরে দিয়ে বলে,
‘নে, না হেসে মিষ্টি খা।’
সাদরাজ কোনো রকমে মিষ্টি চিবিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এই মিষ্টি কে এনেছে? আমি তো মিষ্টি অর্ডার দিয়েছি।’
‘এটা আমরা এনেছি। আপাতত এখন আমাদেরটা দিয়েই মিষ্টি মুখ কর।’
রাবীর উত্তরে বলে। মেহুলও তখন একটা মিষ্টি এনে রিতার মুখে দেয়। রিতা অল্প খেয়ে মেহুলকেও খাইয়ে দেয়। তারপর সবাই বসে গল্প জুড়ে। এর মাঝে সাদরাজের অর্ডার করা মিষ্টিও চলে আসে। তখন আরেকদফা মিষ্টি খাওয়া দাওয়া হয়।
____________
রাতে রিতা অনেকবার বলেছে, খেয়ে আসার জন্য। তবে মেহুল আর রাবীর রাজি হয়নি। এই সময় রিতাকে আর এত দখল দেওয়ার দরকার নেই। বাড়ি ফেরার পথে মেহুলের মন খারাপ। আজ প্রথম সেহরি। কাল থেকেই রোযা শুরু। বাড়িতে সব আয়োজন শেষ। তবে সেসব নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। চিন্তা তার অন্য জায়গায়। বিয়ের পরই শাশুড়ি মায়ের কথায় তার গান গাওয়া বন্ধ হয়েছে। সোজা ভাষায় বলে দিয়েছিলেন, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করতে। এসব গান ফান নিয়ে যেন আর না ভাবে। প্রথমে খুব কষ্ট হলেও পরে সে মানিয়ে নিল। এখন আবার বাচ্চার প্রতিও আগ্রহ জন্মাল তার। তবে রাবীর কেন এখন এমন করছে? ওর যেন বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ’ই নেই। রিতার বাড়িতে সাদরাজও দু একবার তাকে এই নিয়ে বলেছিল, তবে সে সেখানেও ব্যাপারটা উপেক্ষা করেছে। কেন? রাবীর কি ইচ্ছে করেই এসব করছে, নাকি মেহুলের কথা চিন্তা করে? যেখানে মেহুল চাইছে, সেখানে এত ভাবার কী আছে? এই প্রশ্নটা মেহুল এখন সরাসরি রাবীরকে করতেও পারছে না। জড়তা কাজ করছে ভীষণ। রাবীর ভীষণ বিচক্ষণ মানুষ, সেটা মেহুল জানে। রাবীর যা করে ভেবে চিন্তে করে, ঠান্ডা মাথায় করে। তবে সব ব্যাপারে এত ভাবার কোনো মানে হয়? বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হবে, স্বাভাবিক। এটা নিয়ে এত ভাবার কী আছে, আশ্চর্য!
মেহুলের মনের কথা রাবীর কিছু হলেও আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু সেও যে নিরুপায়। মেহুলকে সে কোনোভাবেই কষ্ট পেতে দেখতে পারবে না। যদিও সত্য বেশিদিন চেপে রাখা যায় না। কিন্তু, তাও এখনই না জানুক। আরো সময় পরে জানুক। জানলেই তো মেহুল থমকে যাবে, ভীষণ কষ্টে মুচড়ে উঠবে সে। রাবীর যে তাকে এখনই এত কষ্ট দিতে চাইছে না। এই কথাটা সে এখন কী করে মেহুলকে বোঝাবে?
চলবে…