শেষটা সুন্দর পর্ব-৫৫+৫৬

0
917

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৫।

কাল থেকে রোযা শুরু। আর রোযার মাঝখানেই রাবীরের নির্বাচন। রাবীরের তাই দিনগুলো ব্যস্ত কাটছে। মেহুলেরও তাই। শাশুড়ির সাথে রোযার সব প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজকাল মেহুল বেশ খুশি খুশি থাকে। রিতা আবার ভার্সিটিতে যাওয়া আরম্ভ করেছে। দুই বান্ধবী একসাথে সময় কাটাতে পারে। আনন্দ করতে পারে। রিতার জীবন ও আস্তে আস্তে এগুচ্ছে। সাদরাজ আগের তুলনায় ভীষণ যত্নশীল হয়েছে। রিতার প্রতি অগাধ মায়া জন্মেছে তার। একটা ছোট্ট ব্যবসা দিয়েছে। রিতা এতে ভীষণ খুশি। আর পাঁচটা মেয়ের মতো সেও ছোট্ট সংসার শুরু করেছে। সাদরাজের ব্যবহারে এখন সে মুগ্ধ হয়। ভাবে, সত্যিই মানুষ চাইলে খুব সহজেই অন্য একটা মানুষকে বদলে দিতে পারে।

আজ আকাশটা নরম। মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। রোযার আগের দিনটা এমনিতেই মন ফুরফুরে থাকে। তার উপর এমন আকাশ আর আবহাওয়া দেখলে, মন তো আরো খুশি হয়ে যায়।

ক্লাস শেষে দুই বান্ধবী গেল ফুচকা খেতে। অনেকদিন পর ফুচকা খাবে তারা। ঝাল দিয়ে দু প্লেট ফুচকা অর্ডার করে দুজন চেয়ারে বসল। মেহুল বলল,

‘আজকের আকাশটা দেখ, কত সুন্দর!’

রিতা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ, আসলেই। কেমন আরাম আরাম লাগছে।’

মেহুল জিজ্ঞেস করল,

‘সাদরাজ ভাইয়া এখন নিশ্চয়ই তোকে খুব ভালোবাসেন?’

রিতা নিশ্বাস ফেলে বলে,

‘ভালোবাসা তো আর হুট করেই হয় না। ধীরে ধীরে হয়। তবে উনি এখন আমার ভীষণ যত্ন নেন। আমার কথা ভাবেন সবসময়। উনি ধীরে ধীরে নিজেকে পাল্টাচ্ছেন। আমারও কোনো তাড়া নেই। আস্তে আস্তেই সব হোক।’

‘আন্টি আংকেলের সাথে দেখা করবি না?’

‘হ্যাঁ, সাদরাজকে বলেছিলাম। উনি বলছেন, শুক্রবারে নিয়ে যাবেন।’

তাদের কথার মাঝেই ফুচকাওয়ালা মামা দু প্লেট ফুচকা নিয়ে হাজির হলো। মেহুল রিতা প্লেট দুটো হাতে নেয়। মেহুল খুশিতে খেতেও আরম্ভ করে। তবে রিতা থেমে থাকে। তার নাকে একটা গন্ধ ঠেকছে। গন্ধটা তার ভালো লাগছে না। তাকে খেতে না দেখে মেহুল জিজ্ঞেস করে,

‘কিরে, খাচ্ছিস না কেন?’

রিতা ফুচকা একটা তুলে মুখে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো, তার বমি চলে আসবে। ফুচকাটা জলদি মুখ থেকে বের করে ফেলে দেয়। রিতার এমন কাজে মেহুল খাওয়া ভুলে তার দিকে হা করে চেয়ে থাকে। রিতা চেয়ে বলে,

‘মামা আজ কী দিয়ে ফুচকা বানিয়েছে, এমন গন্ধ লাগছে কেন?’

মেহুল অবাক হয়। তার ফুচকাটা নাকের কাছে ধরে বলে,

‘কই, কোনো গন্ধ নেই তো।’

‘আমার কাছে তো লাগছে। খেতে পারছি না, বমি আসছে।’

মেহুল বলে,

‘আচ্ছা, তুই আমার প্লেট থেকে খা।’

মেহুলের প্লেট থেকে একটা ফুচকা নিয়ে মুখে পুরল। এটাও একই মনে হলো তার। জোর করে দুইবার চিবিয়ে মুখ থেকে বের করে ফেলে দেয়। মেহুল হতভম্ব। হলো কী মেয়ের?

মেহুল চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে তোর? শরীর খারাপ করছে নাকি?’

রিতা দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘না, শুধু খেতে পারছি না। গন্ধ লাগছে। বমি পাচ্ছে।’

মেহুল অতি মনোযোগের সহিত রিতাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করল,

‘তোর পিরিয়ড কি রেগুলার?’

রিতা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,

‘না, আগের মাসে ডেইট মিস গিয়েছিল, এখনো হয়নি।’

মেহুল ততক্ষণে অস্থির হয়ে উঠেছে। জিজ্ঞেস করে,

‘মাথা ঘুরায়, শরীর দুর্বল লাগে?’

রিতা ভেবে বলে,

‘মাথা ঘুরায় না। তবে শরীর মাঝে মাঝে একটু দুর্বল লাগে।’

মেহুল অস্থিরতায় উঠে দাঁড়ায়। চোখ মুখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। কী বলবে সে? কী করবে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। রিতা বুঝতে পারছে না কিছু। মেহুল এমন কেন করছে? রিতা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে, এমন করছিস কেন?’

মেহুল নিজের অস্থিরতা আর ধরে রাখতে না পেরে বলে,

‘প্রেগন্যান্সি টেস্ট কর।’

রিতার হঠাৎ টনক নড়ল। সে সবকিছু মনে মনে মেলাল। আঁতকে উঠল। সত্যিই এমন কিছু হতে চলছে নাকি? আবেগে সে চোখ পিটপিট করে মেহুলের দিকে তাকায়। মেহুলের চোখে মুখে উত্তেজনা উপচে পড়ছে। রিতা নিমিষ চেয়ে আছে তার দিকে। মেহুল খুশি খুশি গলায় বলে,

‘চল, ফার্মেসিতে যাই।’

_________________

রাতে সাদরাজের সাথে খাবার টেবিলে বসতেই রিতার আবারও গা গুলাতে আরম্ভ করল। তবে সে সেটা সাদরাজকে বুঝতে দিল না। খালা তার আর সাদরাজের প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়। খাবার দেখে রিতার যেন বমি আসছে। সাদরাজ সামনে। ভয়ে ভয়ে এক লোকমা মুখে তুলে সে। অনেকক্ষণ মুখে নিয়ে বসে থাকে। গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না। উগলে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে। খালা ব্যাপারটা দেখে। জিজ্ঞেস করে,

‘কী হলো, খালা? আপনি দেহি খাইতেছেন না।’

খালার কথা শুনে সাদরাজ রিতার দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

‘কী ব্যাপার, রিতা? কোনো অসুবিধা?’

রিতা ফট করে মুখের খাবারটা গিলে ফেলে। হেসে বলে,

‘না না, কিছু না। আপনি খান।’

সাদরাজ আবার খাবারে মনোযোগ দেয়। রিতা খুব কষ্টে দু থেকে তিন লোকমা গলাধঃকরণ করে। পরে আর খেতে পারে না সে। চেয়ার ছেড়ে উঠতেই সাদরাজ জিজ্ঞেস করে,

‘উমা, তোমার খাওয়া শেষ! প্লেটের ভাতও তো শেষ করোনি।’

রিতা হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘আমার খিদে নেই। সন্ধ্যায় অনেক নাস্তা করেছি তো, তাই এখন খেতে পারছি না। আপনি খান, আমি রুমে যাচ্ছি।’

রিতা এই বলে রুমের দিকে পা বাড়ায়। সাদরাজ কিছু না বুঝলেও খালা অনেক কিছু বুঝতে পারেন। আর সব বুঝতে পেরে মুচকি হাসেন তিনি।

.

রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায় রিতা। আপনা আপনি ডান হাতটা পেটে যায়। বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। যেন কিসের জন্য মনে প্রচন্ড অস্থিরতা হচ্ছে। সে যা ভাবছে, সত্যিই কি তেমনটা হতে চলেছে? যদি এমন হয়, তবে ব্যাপারটাই সাদরাজ কীভাবে রিয়েক্ট করবে? রিতার ভয় হচ্ছে, ভালো লাগছে। সবকিছু মিলিয়ে যেন এ এক অন্যরকম অনূভূতি। কাল সকালেই টেস্ট করে সবকিছু সিউর হবে। আর কাল সকালের কথা ভেবে এখনই খুশিতে গা শিউরে উঠছে তার।

______________

অন্যদিনের মতো রাবীর আজও লেইট করে বাড়ি ফিরে। যার দরুন, মেহুলকে একাই রাতের খাবার খেতে হয়। এটা আজকাল রাবীরের নিত্যদিনের অভ্যাস। সেই সকালে বের হয়, মাঝখানে দুপুরে এসে কিছু খায়। তারপর আবার বের হয়, ফিরে রাত একটার পর। মেহুল ততক্ষণে শাশুড়ির সঙ্গে খেয়ে দেয়ে ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়ে। প্রায়ই মেহুলকে এসে রাবীর ঘুমে পায়। জাগায় না সে। খেয়ে দেয়ে এসে তার পাশে শুয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে খুব একা লাগলে ঘুমন্ত মেহুলকেই টেনে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়। কখনো কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। কখনো তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, শরীরে ঘ্রাণ নেয়। এভাবেই তার জীবন যাচ্ছে। ব্যস্ততায় বউকে সময় দিতে না পারার ভীষণ আক্ষেপ তার মনে। ব্যাপারটা মেহুলও বুঝতে পারে। তাই তো, সে অভিমান করে না। নিজেকে এসবের মাঝেই অভ্যস্ত করে নিয়েছে।

অন্ধকার রুমের লাইট জ্বালতেই রাবীর মেহুলকে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে। কিছুটা অবাক হয়ে ঘড়িতে তাকায়। দেড়টা বাজছে। মেয়েটা এখনো ঘুমায়নি? রাবীর পাঞ্জাবীর বোতাম খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে,

‘এখনো ঘুমাওনি যে?’

‘ঘুম আসছে না।’

মেহুলের স্পষ্ট আওয়াজে রাবীর পেছন ফিরে তাকায়। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে, শরীর খারাপ?’

মাথা দুই দিকে ঝাঁকিয়ে বলে,

‘উঁহু।’

‘তাহলে?’

রাবীর প্রশ্ন করে। মেহুল জবাবে বলে,

‘মন খারাপ।’

রাবীর উত্তর পেয়ে হাত থেকে ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখে। ধীর পায়ে এগিয়ে মেহুলের পাশে গিয়ে বসে। মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করে,

‘কেন, মনের আজ হঠাৎ কী হলো?’

মেহুল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে রাবীরের মুখ পানে। কত ক্লান্তি ঐ চোখে মুখে। দেখে মায়া হয়। তাই তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে,

‘না, কিছু না।’

রাবীর সন্দিহান চোখে তাকায়। ছোট ছোট চোখ করে মিনমিনিয়ে বলে,

‘কিছু তো একটা হয়েছে। না বলতে চাইলে জোর করব না। তবে বলে ফেলা ভালো।’

মেহুল খানিক ভাবে, বলবে কী বলবে না। পরে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়, বলবে। তার বলা উচিত। তবে বলতে গিয়েও জড়তা কাজ করছে। রাবীর চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। মেহুল ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘অমন ভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি কথা গুলিয়ে ফেলছি তো।’

রাবীর মৃদু হাসে। বলে,

‘আচ্ছা, চোখ বন্ধ করলাম। এবার বলে ফেলো।’

মেহুল সব জড়তা কাটিয়ে মনে সাহস জুগাল। কম্পিত সুরে বলল,

‘আমার বাচ্চা চাই, রাবীর।’

চলবে….

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৬।

রাবীর একটুও অবাক হলো না। যদিও এই মুহুর্তে তার অবাক হওয়াটা ভীষণ জরুরি। তবে সে এই জরুরি কাজের প্রতি কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল,

‘হঠাৎ বাচ্চা নেওয়ার প্রসঙ্গ উঠাচ্ছেন যে? আপনার তো এখনো অনার্স শেষ হয়নি।’

মেহুল খানিক নড়ে চড়ে বসে। মাথায় তার কথা সাজানো আছে। এবার সব গুছিয়ে বলতে পারলেই হলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে অতঃপর বলে,

‘শুনুন, আমি আর রিতা খুব আগে থেকেই প্ল্যান করেছিলাম, আমরা একসাথে বেবি নিব। একসাথে না পারি, অন্তত কাছাকাছি সময়ে নিব। যেন আমাদের বাচ্চার বয়সের পার্থক্যটা খুব বেশি না হয়। তাতে লাভ হবে যে, আমাদের যার আগে ছেলে বাচ্চা হবে, তার সাথে আমাদের মেয়ে বাচ্চার বিয়ে দিতে পারব। তাই সেইজন্যই বলছিলাম, এখনই বাচ্চা নিয়ে ফেললে ভালো হয়। আমাদের ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারব।’

মেহুলের এই উদ্ভট যুক্তি শুনে, রাবীর কিছুক্ষণের জন্য কথা হারিয়ে ফেলে। মানে, এমনও কারোর চিন্তাধারা হয়? এই মেয়ের এসব কথাবার্তা শুনলে কেউ বুঝবে, মেয়েটা যে অনার্স পাস করতে চলছে?

রাবীরকে নিরব দেখে মেহুল বিচলিত হয়। জিজ্ঞেস করে,

‘কী হলো, কিছু বলছেন না কেন?’

রাবীর বড়ো করে নিশ্বাস ছাড়ে। মাঝে মাঝে ভাবে, এত ব্যস্তময় জীবনে এমন একটু আধটু বিনোদনের প্রয়োজন আছে। নয়তো জীবন পানসা হয়ে উঠবে। সে মৃদু হাসে। বলে,

‘তা, দুই বান্ধবী মিলে এখন বাচ্চা নেওয়ার কথা ভাবছেন নাকি? আর রিতাও কি সাদরাজের সাথে এই নিয়ে কথা বলেছেন?’

‘না না। ও এসব নিয়ে কেন কথা বলবে।’

পরে আবার মেহুল ভীষণ লজ্জামাখা স্বরে বলল,

‘ওরা তো কথা না বলেই কাজ সেরে ফেলেছে।’

মেহুলের লজ্জামাখা মুখের দিকে রাবীর অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। মেয়েটা কী বলছে, তা তার বোধগম্যের বাহিরে। সে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েই থাকে। মেহুল তা দেখে ঠোঁট চেপে হাসে। বলে,

‘কী ব্যাপার, বুঝতে পারছেন না কিছু?’

রাবীর মাথা নাড়ায়। সে বুঝতে পারছে না। মেহুল আবার হাসে। এত হাসির কী আছে, সেটাও রাবীর বুঝতে পারছে না। মেহুল হাসি থামিয়ে পুনরায় লজ্জাভাব ফুটিয়ে তুলে বলে,

‘আপনি খালু হতে যাচ্ছেন, আর আমি খালা।’

এই বলে আবারও হাসে সে। রাবীরের দুই ভ্রু এর মাঝে এবার ভাঁজ পড়ে। সে বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা। অনেক ভেবে সবকিছু মিলিয়ে হঠাৎ বিস্মিত হলো সে। আঁতকে উঠে বলল,

‘সাদরাজ কি বাবা হতে চলেছে নাকি?’

মেহুল খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,

‘হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়।’

রাবীরের বিস্ময়ভাব উবে গেল। বলল,

‘আপনার মনে হয়? এটা সিউর না?’

‘না, সিউর ও। আসলে এখনো টেস্ট করা হয়নি। কালই টেস্ট করে একেবারে সিউর হওয়া যাবে।’

রাবীর এবার থমথমে সুরে বলে,

‘যদি এমন না হয়?’

‘আলবত হবে, আমি একদম সিউর। আর ওর টেস্ট একবার পজিটিভ আসলেই, আমি আর দেরি করব না।’

মেহুলের কথাবার্তা শুনে এখনো কিছু বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। তাই সে এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। উঠে দাঁড়ায়। হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে,

‘খেয়েছেন?’

মেহুলের কাছে এই প্রশ্নটা এই মুহুর্তে মাত্রাতিরিক্ত অপ্রাসঙ্গিক মনে হলো। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

‘আমি কী বলেছি, আর আপনি কী বলছেন?’

রাবীর ভীষণ স্বাভাবিক গলায় বলল,

‘আপনি যা বলেছেন, আমি তা শুনেছি। সময় হলে সবকিছুই হবে। আপাতত পড়াশোনাটা আগে শেষ করুন।’

মেহুল রেগে যায়। রাগটা মনের মাঝেই চেপে রাখে। রাবীর ওয়াশরুমে চলে যায়, ফ্রেশ হতে। এসে দেখে, মেহুল চোখ বুজে শুয়ে আছে। সে এসে পাশে বসে। মেহুলের গাল স্পর্শ করে মিহি সুরে জিজ্ঞেস করে,

‘ঘুমিয়ে পড়েছেন?’

‘জি।’

মেহুলের রাগে ভরা স্বর। রাবীর ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। বলে,

‘তাহলে জবাব দিলেন কী করে?’

মেহুল সেই রাগ জারি রেখেই বলে,

‘জানি না।’

‘খেয়েছিলেন রাতে?’

‘জি।’

রাবীর চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করল,

‘সত্যি তো?’

ফট করে মেহুল চোখ মেলে তাকায়। বিরক্তির সুরে বলে,

‘আপনাকে মিথ্যে বলে আমার কী লাভ? আমি খিদে নিয়ে ঘুমাতে পারি না। যান, আপনিও গিয়ে খেয়ে আসুন।’

কথা শেষ করেই আবার চোখ বুজল সে। রাবীর তার কর্মকান্ড দেখে মুচকি হাসে। যতই ম্যাচিউর হয়ে যাক না কেন, মেয়েরা তার স্বামীর কাছে সবসময়ই আহ্লাদী।

______

চোখ বুজে শুয়ে থাকলেও মেহুলের চোখে ঘুম আসে না। পাশে কিছুক্ষণ আগে রাবীর এসে শুয়েছে। রাবীরের উপস্থিতি টের পেয়েই আরো গভীর ভাবে ঘুমের ভান করছে সে। কিন্তু, তাও ঘুমকে কাবু করতে পারছে না। এর মাঝেই তার উদরে অল্প উষ্ণতা পেতেই সেদিকে তাকায়। চেয়ে দেখে রাবীর তার হস্তের বাঁধনে তাকে জড়িয়ে নিয়েছে। এটা দেখে মেহুল একটু নড়ে চড়ে উঠে। রাবীর আরো কিছুটা অগ্রসর হয়। হাতের স্পর্শ দৃঢ় হয়। ঘাড়েও তখন উগ্র শ্বাসের অনুভূতি হচ্ছে। রাবীরের হাতের স্পর্শ আরেকটু উপরে উঠতেই মেহুল চট করে তার হাত সরিয়ে দেয়। রাবীর মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকায়। মেহুল তখনো চোখ বুজা। সে নিমিষ চেয়ে থাকে। মেহুলের ভাবসাব বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে, ঘুমের অভিনয় করছেন কেন?’

মেহুল তাতে জবাব দেয় না। তাতে অবশ্য রাবীরের কিছু যায় আসে না। সে জানে জবাব কীভাবে আদায় করতে হয়। সে তাই ইচ্ছে করে তখন তার হাতটা মেহুলের অনাবৃত উদরে ছোঁয়ায়। স্পর্শ যত গভীর হয়, মেহুলের মধ্যে অস্থিরতা তত বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সে আর থাকতে না পেরে চোখ মেলে তাকায়। তেতিয়ে উঠে বলে,

‘কী সমস্যা আপনার? ঘুমাচ্ছেন না কেন?’

রাবীর থেমে তাকায়। বাঁকা হেসে বলে,

‘আপনিও তো ঘুমাচ্ছেন না।’

‘আপনি আমাকে ঘুমাতে না দিলে, কীভাবে ঘুমাব?’

‘কেন, আমি আবার কী করলাম?’

রাবীরের এমন ভোলাভালা ভাবে মেহুল আরো চেতে যায়। গরম দেখিয়ে বলে,

‘অনেক কিছু করেছেন। এখন দয়া করে সরে গিয়ে, নিজের বালিশে মাথা রাখুন। নিজে ঘুমান, আর আমাকেও ঘুমাতে দিন।’

মেহুল শুয়ে পড়তেই রাবীর হাসে। তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘বিয়ে করেছি কি, বউ রেখে অন্য বালিশে শোয়ার জন্য? উঁহু, একদমই না।’

বলেই মেহুলের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় সে। রাবীরের স্পর্শে মেহুলের সেই কিঞ্চিত রাগ বেশিক্ষণ ঠাই পায় না। একসময় সব হাওয়ায় মিশে যায়…

___________

বাইরে সূর্য উঠেছে আরো এক ঘন্টা আগে। চারদিকে পাখিদের ব্যস্ততা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। আরেকটা নতুন দিন, নতুন সকাল। একটু পরেই হয়তো মানুষ প্রজাতির ও ব্যস্ততা শুরু হবে। নিরব, নিস্তব্ধ শহর হয়ে উঠবে কোলাহলে পূর্ণ। ব্যস্ত নগরীতে ছুটে চলবে রোজকার দিনের সমস্ত কার্যক্রম।
তবে আজ অন্যদিনের মতো সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে হলেও রিতার আজ কেন যেন সবকিছু নতুন লাগছে। আশ্চর্য, এমন কেন হবে! এইতো সেই পুরোনো সকাল। একই রূপ, একই রং। এর মধ্যে নতুনত্বের কী আছে? সবকিছুই তো পুরোনো। প্রতিদিনকার একই জীবনচক্র। অথচ, আজ যেন নিমিষেই সবকিছু নতুন হয়ে উঠেছে। নতুনের মতো ফকফকা চারিদিক। এত আনন্দ কেন আজ বাতাসে? এত সুখ কেন? এই এত এত সুখ, আনন্দ সে রাখবে কোথায়? চোখ ছলছল করছে তার। মুখ চেপে ধরে বসে আছে। কীভাবে শুরু করবে, কীভাবে বলবে? কাকে আগে বলবে, মেহুলকে নাকি মা’কে আর নাকি সাদরাজকে? কম্পিত মনে উত্তর মেলাতে পারছে না। হাতের ছোট্ট কিটটাকে এখনো অবিশ্বাস্য চোখে দেখে যাচ্ছে। এটা কি আদৌ সত্যি? কোনো স্বপ্ন নয়তো?
সাদরাজের ঘুমন্ত মুখের দিকে চোখ পড়তেই বুঝে, না, এটাই সত্যি। আর এর থেকে ভয়ংকর সুন্দর কোনো সত্যি হতেই পারে না।

কাঁপা কাঁপা হাতে রিতা মেহুলকে কল দেয়। রিংটোনের শব্দ পেতেই মেহুল ঘুমের মাঝেই ফোনটা মাথার পাশ থেকে হাতড়ে বের করে। না দেখেই কোনোরকম রিসিভ করে কানে লাগায়। ওপাশ থেকে রিতার কম্পিত সুর। বলে,

‘দদোস্ত, প-পপজিটিভ এসেছে।’

ঘুমের ঘোরে কিছুই বুঝে না মেহুল। কিঞ্চিত চোখ মেলে চেয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,

‘কী পজিটিভ এসেছে?’

রিতা আগের মতোই কাঁপা স্বরে বলে,

‘প্রেগন্যান্সি টেস্ট।’

‘ওহ।’

“ওহ” টা মুখ থেকে বের করে চোখ বুঝতেই হঠাৎ মস্তিষ্ক সজাগ হলো তার। রিতার বলা কথাগুলো নিউরনে নিউরনে ছড়িয়ে পড়ল। চট করে উঠে বসল মেহুল। প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল,

‘কী, আসলেই?’

‘হ্যাঁ।’

রিতার ছোট্ট করে বলা এই “হ্যাঁ” শব্দটাই মেহুলকে পুরো পাগল বানানোর জন্য যথেষ্ট। সে প্রচন্ড জোরে চেঁচিয়ে উঠে। রাবীর তার গলা পেয়ে ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠে। ভীত হয়। মেহুলের দিকে চেয়ে বিচলিত সুরে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে, মেহুল?’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে