#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৩।
সাদরাজ আর অফিসারের তোপের মুখে পড়ে শাহাদাত আহমেদ সবকিছু স্বীকার করলেন। তিনি কীভাবে তার স্ত্রীকে মেরেছেন, কীভাবে রাবীরকে ফাঁসিয়েছেন, সবকিছু। সব শুনে সাদরাজ উঠে দাঁড়াল। শক্ত গলায় বলল,
‘অফিসার, উনাকে এবার জেলে নিয়ে যান।’
শাহাদাত আহমেদ ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। অনেক ভাবে বললেন, তিনি অসুস্থ। তাকে যেন ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সাদরাজ তখন নিমিষ তার দিকে চেয়ে ছিল। বলেছিল,
‘আমার মাও অসুস্থ ছিলেন। আপনি সেই অসুস্থ মানুষটাকেও বাঁচতে দিলেন না। এত নিষ্ঠুর একটা মানুষকে আজ কী করে ক্ষমা করে দেই, বলুন। মায়ের সাথে এত বড়ো অন্যায় আমি করতে পারব না।’
ছেলের মুখের এমন কথায় ভীষণ আহত হোন শাহাদাত আহমেদ। আজ কি তবে সবকিছু শেষ? শাহাদাত আহমেদ নিষ্পলক চেয়ে রইলেন। অফিসার কনস্টেবলকে ডেকে তাকে জেলে পাঠালেন। সাদরাজ তখন বলল,
‘শাহাদাত আহমেদের সাথে যারা কাজ করেছেন, তাদেরও গ্রেফতার করবেন অফিসার।’
অফিসার বললেন,
‘ঠিক আছে। কালই আমরা আপনার বাবার কাছ থেকে সমস্ত জবানবন্দী নিয়ে সেই লোকগুলোকে গ্রেফতার করব।’
সাদরাজ এবার রাবীরের দিকে চাইল। মৃদু সুরে বলল,
‘তুই চাইলে আমার নামে মামলা করতে পারিস। আমিও তো কম অন্যায় করিনি। শাহাদাত আহমেদের কথায় অনেক অনেক ভুল করেছি। এর জন্য তো আমারও শাস্তির প্রয়োজন।’
কথা বলে সাদরাজ তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। রাবীর তার দিকে এগিয়ে আসে। সাদরাজের কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘আমি এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। খুব করে চাইতাম, একদিন সব সত্যি তোর সামনে আসুক। তোর আর আমার মাঝের দূরত্ব কমুক। আজ সেই দিন এসেছে। সব সত্যি তুই জানতে পেরেছিস। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস। এখন আর আমার কিছু চাই না। আর না তোর উপর আমার কোনো অভিযোগ আছে। শুধু চাইব, তুই আগের মতো হয়ে যা। আমার প্রিয় বন্ধু, সাদ হয়ে যা। এইটুকুই।’
সাদরাজ বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কী বলবে আজ? এত অন্যায়ের পর আজ আর কিছু বলতে পারছে না। নিজের উপরও যথেষ্ট রাগ আর ঘৃণা হচ্ছে। এত বিবেকহীন একটা মানুষ কী করে হতে পারে? কেন সেদিন রাবীরের কথা বিশ্বাস করল না? কেন সবকিছু ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখল না? কেন বোকার মতো বাবার কথা মানল সে, কেন? তাকে যে এই আফসোস নিয়েই সারাজীবন পার করতে হবে। তার জেদের কারণে, কত মানুষের কত ক্ষতি হয়েছে। রিতার মতো একটা ভালো মেয়ের জীবন নষ্ট হয়েছে। এতকিছুর পরেও কি তাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায়?
নিজের মনেই প্রশ্ন করে থমকে যায় সাদরাজ। রিতার দিকে এগিয়ে যায়। গম্ভীর মুখে বলে,
‘আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি, রিতা। জানি এর ক্ষমা হয় না। তবে আমি তোমাকে এই অন্যায় সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে দিয়ে নিজের প্রায়শ্চিত্ত করব। চিন্তা করো না, আমি খুব তাড়াতাড়িই আমাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করছি।’
রিতা হতভম্ব। কী বলবে সে? এই কথায় সে খুশি হবে, নাকি কষ্ট পাবে? চিন্তায় পড়ে রিতা। কী করবে সে? সাদরাজ রাবীরের দিকে চেয়ে বলে,
‘রিতা আপাতত তোদের কাছে থাক। ডিভোর্সের পর ওকে ওর বাড়িতে দিয়ে আসব।’
এই বলেই সাদরাজ বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পেছন থেকে রিতা অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
‘আমি কি বলেছি, আমার ডিভোর্স লাগবে?’
সাদরাজ চমকে তাকায়। রিতা এগিয়ে যায় তার দিকে। সাদরাজ এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রিতা কী বলতে চাইছে?
রিতা নিজেকে শক্ত করে বলল,
‘সবকিছু কি আপনার মর্জিতে হবে নাকি? ইচ্ছে হলে, বিয়ে করবেন; আবার ইচ্ছে হলে, ডিভোর্স দিয়ে দিবেন। আমার মত অমতের কি কোনো মূল্য নেই?’
সাদরাজ অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি কি ডিভোর্স চাও না?’
রিতা স্পষ্ট স্বরে বলে,
‘না। আমি এই কুৎসিত সমাজে ডিভোর্সের খেতাব নিয়ে বাঁচতে চাই না।’
সাদরাজ নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘এতকিছুর পরও তুমি আমার সাথে থাকতে চাও?’
‘হ্যাঁ।’
সাদরাজ তখন এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
‘তুমি তো অন্য কাউকে ভালোবাসতে।’
‘সে আমাকে ভালোবাসে কিনা জানি না। এখন ডিভোর্সের পর তার কাছে গেলে সে যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়? যদি বলে, কোনো ডিভোর্সি মেয়েকে সে বিয়ে করতে চাই না, তখন? আমি তখন আর এতকিছু সহ্য করতে পারব না। আমি একটা সুন্দর স্বাভাবিক জীবন চাই, সাদরাজ। আর সেই জীবনটা আপনি আমাকে দিবেন।’
রিতার কথা শুনে সাদরাজ নির্বাক। তার এখন কী করা উচিত বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভেবে সে বলল,
‘এত অন্যায়ের পর আমি নিজেই ভালো থাকতে পারব না, সেখানে তোমাকে আমি কীভাবে ভালো রাখব বলো? আমার সাথে থাকলে তুমি সুখী হতে পারবে না, রিতা।’
রিতা ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘আমি ডিভোর্স দিতে না চাইলে, আপনি কি আমার থেকে জোর করে ডিভোর্স নিবেন? আমি আপনার সাথেই থাকব। এবার আপনি ভেবে দেখুন, আপনি কী করবেন।’
সাদরাজ নিরব। রাবীর এগিয়ে এসে বলল,
‘বিয়ে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত না। হয়তো তখন তোর উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। কিন্তু, এখন তো তুই সব বুঝতে পেরেছিস। তাহলে এখন কেন রিতাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিস? তুই জানিস না এই সমাজ কেমন? সমাজ এই মেয়েটার জীবনকে নরক করে তুলবে। তাই এখন সবকিছু ভুলে, আবার নতুন করে শুরু কর। রিতাকে নিয়ে একটা ছোট্ট সুখের সংসার সাজা। দেখবি, আস্তে আস্তে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
সাদরাজের মাঝে আর কোনো অনুভূতি নেই। এসবের পরে এখন সে বড্ড ক্লান্ত। সম্পর্কের মায়াজালে যেন আর নিজেকে আটকাতে চাইছে না। তবুও এই মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে হবে। ওর সাথে আর কত অন্যায় করবে। সত্যিই তো, সমাজটা তো ভীষণ নিষ্ঠুর। এই সমাজে রিতার মতো অসহায় মেয়ের জায়গা হবে না।
সাদরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,
‘ঠিক আছে। রিতা আমার সাথেই থাকবে। চলো।’
সাদরাজ ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। মেহুল তখন রিতার কাছে এসে বলে,
‘আমি জানি, তুই ভাইয়াকে বদলাতে পারবি। উনি এখন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন। উনার এখন একটা শক্ত হাতের প্রয়োজন, যেটা ধরে আবার উঠে দাঁড়াতে পারবেন। সবকিছু ভুলে, সুখী হো। দোয়া করি, তোদের জীবনে অনেক সুখ নামুক।’
মেহুলকে জড়িয়ে ধরে রিতা সাদরাজের গাড়িতে উঠে বসে। সাদরাজ তার গন্তব্যের দিকে বেরিয়ে যায়। তারা চলে যাওয়ার পর মেহুল আর রাবীরও তাদের বাড়িতে ফিরে আসে।
_______
রাতে খাবার টেবিলে মা’কে রাবীর সব বলে। সব শুনে তিনি বললেন,
‘আমার আগেই ঐ শাহাদাত আহমেদকে সন্দেহ হয়েছিল। কতটা জঘন্য ঐ লোকটা, ভাবতেই গা ঘিন ঘিন করে উঠছে।’
এত বছর পর তিনিও মনে মনে বেশ খুশি হলেন। সাদরাজ আর রাবীরের সম্পর্ক ঠিক হয়েছে। আর কোনো ঝামেলা হবে না। এই ভেবেই তিনি এখন নিশ্চিত।
.
রাতে বারান্দায় দাঁড়ান মেহুল। আকাশের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবছে। হঠাৎ কোমরে উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে খানিক নড়ে উঠে। উপস্থিত মানুষটাকে চিনতে পেরে কিছু বলে না। রাবীর তার ঘাড়ে থুতনি ঠেকায়। বড়ো নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘জানেন মেহুল, আজ আমার ভীষণ শান্তি লাগছে। সবকিছু খুব সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর থেকে খুব বড়ো একটা পাহাড় নেমে গিয়েছে। আজ অনেকদিন পর আমি একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারব।’
রাবীরের কথা শুনে মেহুল মৃদু হাসে। তার ঘাড়ের উপর রাবীর ওষ্ঠাধরের স্পর্শ পেয়ে কিঞ্চিত কেঁপে উঠে। রাবীর মেহুলকে আরো কাছে আগলে নেয়। মেহুল কম্পিত নরম সুরে বলে,
‘আপনাকে শান্তি পেতে দেখলে, আমারও বড্ড শান্তি লাগে।’
মেহুল রাবীরের বুকে মাথা এলিয়ে দেয়। রাবীরের স্পর্শ আরো গভীর হয়। মেহুল চোখ বুজে অনুভব করে। মনে মনে খুব করে দোয়া করে, রিতাও যেন তার মতো করে এত এত ভালোবাসা পায়।
চলবে….
#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৪।
রাত দুইটা পনেরোতে রিতার হঠাৎ ঘুম ভাঙে। খেয়াল করে সাদরাজ পাশে নেই। উঠে বসে রিতা। ওয়াশরুমে খেয়াল করে, সেখানেও নেই। রিতা আস্তে আস্তে বিছানা ছাড়ে। বারান্দার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকারে লাল ফুলকির মতো এক আলোর উঠা নামা দেখা যাচ্ছে। রিতা ছোট পায়ে এগিয়ে যায়। সাদরাজের পাশে দাঁড়ায়। মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘ঘুমাচ্ছেন না কেন?’
সাদরাজ নিরব, নিস্তব্ধ। যেন কথা বলতেও আজ আর ইচ্ছে করছে না। সাদরাজের সামনে ফাঁকা জায়গাতে রিতা গিয়ে দাঁড়ায়। সাদরাজের মুখপানে চাওয়ার চেষ্টা করে। যদিও অন্ধকারে তার মুখ অস্পষ্ট। রিতা আলতো হাতে সাদরাজের গাল স্পর্শ করে। সাদরাজ এতে কপাল কুঁচকায়। সিগারেট’টা মুখ থেকে সরিয়ে রিতার মুখ বরাবর নিশ্বাস ছাড়ে। রিতা খুকখুক করে কেশে উঠে। সাদরাজ গম্ভীর স্বরে বলে,
‘আমাকে সহ্য করতে পারবে না, রিতা। তোমার কষ্ট হবে।’
রিতা মৃদু হেসে। বলে,
‘এতদিন তো কষ্ট পাচ্ছিলাম’ই। আরেকটু কষ্ট পেলে কিছু হবে না।’
সাদরাজ নিরব। রিতা কেন বুঝতে চাইছে না? সাদরাজ সিগারেট’টা নিচে ফেলে, পা মাড়িয়ে দেয়। হুট করেই রিতার কোমর জড়িয়ে ধরে। কাছে টেনে নেয়। রিতা নিমিষ চেয়ে থাকে। সাদরাজ রিতার কপালে কপাল ঠেকায়। তার কন্ঠস্বর কেন যেন কাঁপছে। কিছু বলতে গিয়েও বার বার জড়িয়ে যাচ্ছে। সাদরাজের উষ্ণ নিশ্বাসে রিতার বুক ঢিপঢিপ করছে। সাদরাজ জোরে শ্বাস টানে। থেমে যাওয়া কন্ঠে বলে,
‘আমার আর কেউ নেই, রিতা। আমার কাছ থেকে সবাই হারিয়ে গিয়েছে। মা, বাবা, রাবীর, সবাই। আমার কষ্ট হচ্ছে, রিতা। বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি এখন কীভাবে থাকব? আমার বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে। কীভাবে এই ব্যথা যাবে বলতো? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।’
রিতার গালে ভেজা স্পর্শ পেয়ে বুঝতে পারে, সাদরাজ কাঁদছে। রিতা দুহাত দিয়ে সাদরাজের মাথা তুলে। তারও কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে। যে মানুষটা কিছু সময় আগেও তার বড্ড অপছন্দের ছিল, তার প্রতি এখন হঠাৎ এত মায়া কেন জাগছে? কেন বুকের ভেতরে এমন খা খা করছে? রিতা কিছুক্ষণ সাদরাজের দিকে চেয়ে মৃদু সুরে বলে,
‘আমি কি আপনার কেউ না?’
সাদরাজ নির্বিকার। কী বলবে সে? রিতার কী পরিচয় দিবে? এত অন্যায় করার পরও এই মেয়েটাকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দেওয়ার অধিকার কি আদৌ তার আছে?
সাদরাজের নিরবতায় রিতা প্রশ্ন তুলে,
‘চুপ কেন? বলুন, আমি কি আপনার আপন না?’
‘তোমাকে আপন বলতেও বুক কাঁপছে আমার। আমি আমার নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। এই যন্ত্রণা থেকে নিজেকে কীভাবে মুক্ত করব? তুমি বলো, কীভাবে প্রায়শ্চিত্ত করব?’
রিতা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে। বলে,
‘আমাকে আপন করে নিন। একটা সুন্দর জীবন দিন। অন্যায় করছেন, কষ্ট পাচ্ছেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়েছেন। ব্যস, এইটুকুই। এবার অল্প অল্প করে জীবন গুছিয়ে নিন। ভালো কাজ করুন। নতুন করে ভালোবাসতে শিখুন। তারপর দেখুন, জীবন কীভাবে পাল্টে যায়।’
সাদরাজ ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শক্ত করে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?’
রিতা মাথা নাড়ায়। বলে,
‘না, যাব না।’
সঙ্গে সঙ্গেই খুব শক্ত করে সে রিতাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। খুব করে কাঁদে। রিতাও জড়িয়ে ধরে। কাঁদলে মন হালকা হবে। রিতা তাই সাড়া শব্দ করে না। সাদরাজ নিশব্দে কেঁদে যায়। মনের কষ্ট সব এভাবেই ঝরে যাক। সুখ আসুক, প্রচন্ড সুখে তাদের জীবন ভরে উঠুক।
রিতাকে অনেকক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখে। রিতাও যেন এই প্রশস্ত বক্ষে তার সুখ খুঁজে ফিরছে। কী হবে এত ঝামেলা করে। সুখ তো আর নিজে এসে ধরা দেয় না। তাকে খুঁজে আনতে হয়। সম্পর্কের শুরুটা যেমনই হোক। একটা তো পরিচয় আছে তার। এই পরিচয় নিয়ে বাঁচতে এখন আর তার মাঝে কোনো দ্বিধা নেই, নেই কোনো সংকোচ। আজ থেকে সেও সুখী, প্রচন্ড সুখী। আর অতীত নিয়ে ভাববে না। এবার বর্তমান আর ভবিষ্যতটাই গুছাবে দুজন।
_________________
পরদিন এক মিটিং শেষে বের হতেই রাবীরের পি.এ জানাল, সাদরাজ তার মনোনয়নপত্র বাতিলের জন্য আবেদন করেছে। সে নাকি এই নির্বাচনে দাঁড়াবে না। রাবীর কথাটা শুনে বিস্মিত হয়। পি.এ কে বলে এক্ষুনি সাদরাজের অফিসে যেতে।
সাদরাজের অফিসে গিয়ে রাবীর আরেক দফা অবাক হয়। চারদিক থেকে তার সব পোস্টার সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অফিসের বাইরে কোনো কোলাহল নেই। নির্বাচনের কোনো কর্মী নেই। রাবীর ভেতরে যায়। সাদরাজের অফিস রুমের দরজায় নক করে। ভেতর থেকে সাদরাজ বলে,
‘ভেতরে আসুন।’
রাবীর ভেতরে আসতেই সাদরাজ মৃদু হাসে। বলে,
‘তুই?’
রাবীর চেয়ার টেনে বসে। কপাল কুঁচকে বলে,
‘এসব আমি কী শুনছি?’
সাদরাজ সহজ স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়,
‘কেন, কী শুনছিস?’
‘তুই নাকি মনোনয়নপত্র বাতিলের জন্য আবেদন করছিস?’
‘করছি না। অলরেডি করে ফেলেছি।’
‘আশ্চর্য! এমন কেন করছিস তুই? তুই নির্বাচনে দাঁড়াবি না?’
‘না।’
সাদরাজের সহজ স্বীকারোক্তি। যেন এসবে তার কিছুই যায় আসছে না। রাবীর রেগে বলল,
‘মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তোর? শেষ মুহূর্তে এসে তুই এই সিদ্ধান্ত কেন নিলি?’
সাদরাজ এখনো অত্যন্ত স্বাভাবিক। সে স্পষ্ট সুরে বলে,
‘দেখ রাবীর, শাহাদাত আহমেদ আমাকে এই রাজনীতিতে এনেছিলেন, তোর সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য। উনি সবসময়ই চাইতেন, অন্যায় ভাবে সব দখল করে নিতে। কিন্তু, তোর জন্য পারতেন না। এই জন্য ভেবেছেন, যেভাবেই হোক আমাকে নির্বাচনে জেতাবেন। তারপর নিজের মর্জি মতো সমস্ত অন্যায় করে যাবেন, কেউ তার কিছু করতে পারবে না। এই নির্বাচনেও তাই অনেক কিছু ভেবে রেখেছিলেন উনি। তোকে যেভাবেই হোক হারিয়ে ছাড়তেন। তারপর তোর ক্ষমতা আমার হাতে তুলে দিয়ে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন। কিন্তু, তা আর হয়ে উঠল না। এর আগেই সব অন্যায় ধরা পড়ল। শাহাদাত আহমেদের কথায় আমি এতদিন এসব করেছি। এই রাজনীতিতে কোনো কালেই কোনো আগ্রহ আমার ছিল না। আজ থেকে তো আরো নেই। আমি এই নির্বাচনে দাঁড়াতে চাই না। বরং তোর হয়ে প্রচরনা করতে চাই। তাই আর এই নিয়ে আমাকে কিছু বলিস না, প্লিজ। আমি আমার মতো ভালো আছি। রাজনীতি একেবারে ছেড়ে দিব। একটা ছোট্ট ব্যবসা আছে। এখন থেকে সেখানেই মনোনিবেশ করার কথা ভাবছি।’
‘তুই আরেকবার ভেবে দেখ, সাদরাজ। শাহাদাত আহমেদ এখন আর নেই। অন্যায় করে না, ন্যায়ের পথে থেকে এবার চিতবি তুই। একবার ভেবে দেখ।’
‘ভেবে ফেলেছি। আর নতুন করে কিছু ভাবতে চাই না। ন্যায়, অন্যায় কোনোভাবেই আর চিততে চাই না। আমি আমার এই হার নিয়েই সন্তুষ্ট।’
রাবীর বিমূর্ত চেয়ে থাকে। সত্যিই, সাদরাজের এই রাজনীতির প্রতি কোনো কালেই কোনো আগ্রহ ছিল না। রাবীর তো ভার্সিটি লাইফ থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত। কিন্তু, সাদরাজ এসব বরাবরই উপেক্ষা করত। কেবল মাত্র এই শাহাদাত আহমেদের প্ররোচনায় পড়ে সে এতদিন এতকিছু করেছে। আজ সে মুক্ত। সেই জন্যই হয়তো আর এসবে জড়াতে চাইছে না।
রাবীর নিরবতা ভেঙে বলল,
‘চল, আজকে বিকেলে একটু কফি খেতে যাই। ঐ ক্যাফেতে, যেখানে আমরা ভার্সিটি লাইফে রোজ যেতাম।’
পুরোনো স্মৃতি চোখের সামনে চকচক করে উঠল। সাদরাজের ঠোঁটের কোণে হাসি। ঐ ক্যাফেতেই একসময় তাদের কত আড্ডা, কত গানের আসর ছিল। আজ হয়তো সব শূন্য পড়ে আছে। হ্যাঁ, আজ সে একবার যাবে। রাবীরের কাঁধে হাত রেখে হেঁটে চলবে। যেভাবে ভার্সিটি লাইফে হাঁটত। ক্যাফেতে বসে খুব আড্ডা দিবে। একের পর এক কফির গ্লাস শেষ করবে। তারপর বিল দেওয়ার বেলায়, দুই বন্ধু তুমুল ঝগড়া করবে।
ভেবেই ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে সাদরাজ। তার হাসি দেখে রাবীর বলে,
‘কিরে, পুরোনো কথা ভেবে হাসছিস? আজ কিন্তু বিল তুই দিবি। সেই লাস্ট বিলটা কিন্তু আমিই দিয়েছিলাম, মনে করে দেখ। আজ কিন্তু তবে তোর পালা।’
রাবীরের অমন কথায় সাদরাজ শব্দ করে হেসে ফেলে। তার হাসি দেখে রাবীরও হাসতে আরম্ভ করে। বাইরে থেকে তাদের এই হাসির শব্দে পি.এ উঁকি দেয়। দুজন শত্রুকে এত সখ্যতা সহিত হাসতে দেখে অবাক হয় সে। ভাবে, এভাবেও কি বন্ধুত্ব ফিরে আসে?
চলবে….