#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৭।
খালা আর কিছু বলার আগেই বাড়ির ল্যান্ড লাইনে কল আসে। খালা তখন ভয়ে পেয়ে যায়। রিতার দিকে চেয়ে বলে,
‘এই ফোনে তো খালি সাহেব’ই কল করেন। সাহেব কি তাইলে বুইঝা গেছেন?’
রিতা আর মেহুলও দুশ্চিন্তায় পড়ে। রিতা বলে,
‘খালা, আপনি ভয় না পেয়ে কলটা রিসিভ করুন। দেখুন, কী বলে?’
খালা ভয়ে ভয়ে ফোনটা তুলে কানে লাগায়। ওপাশ থেকে সাদরাজ তখন জিজ্ঞেস করে,
‘খালা, আমাদের বাসায় কেউ কি এসেছে?’
খালা ভয়ে ভয়ে রিতা আর মেহুলের দিকে তাকায়। কী বলবে বুঝতে পারছে না। মিথ্যে বলার পর ধরা পড়লে আরো বিপদ। এইদিকে সত্য বলারও উপায় নেই। সাদরাজ আবার জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, খালা? কিছু বলছো না কেন? আমি ক্যামেরাতে দেখেছি। কে এসেছে?’
‘আসলে সাহেব, একটা নতুন মহিলারে আমি খবর দিছিলাম। ঐ যে আমাদের ম্যাডাম বাসায় একা একা থাহেন। এহন তো আপনিও নাই। তাই ভাবছি এই মহিলা আইলে আমাদের ম্যাডামরে একটু সঙ্গ দিতে পারব। আমিই ওরে আনছি। আমাদের গ্রামের।’
সাদরাজ বলল,
‘খালা, যাকে তুমি এনেছো তাকে চলে যেতে বলো। আমার অবর্তমানে, আমাকে না জানিয়ে তুমি বাইরের মানুষ কী করে আনলে? উনাকে এক্ষুনি যেতে বলো। আমি যেন বাসায় এসে কাউকে না দেখি।’
‘মাফ করবেন, সাহেব। আমি এক্ষুনি ওরে বাইর কইরা দিতাছি।’
‘ঠিক আছে। রাখছি।’
সাদরাজ ফোন রাখার পর খালা মেহুলকে তাড়া দিয়ে বলল,
‘খালা, আপনি এক্ষুনি যান। সাহেব আপনারে দেখছে। সাহেব আইতাছে, আপনারে আইসা দেইখা ফেললে কেলেঙ্কারি হইব। তাড়াতাড়ি বাইর হোন, খালা।’
মেহুল বলল,
‘আচ্ছা। চলে যাচ্ছি।’
সে তখন তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট বাটন ফোন বের করে রিতার হাতে দেয়। তাকে বলে,
‘এই ফোনটা লুকিয়ে রাখিস। আর, প্রয়োজন মতো কল দিস আমাকে। এখন আমি যাই। আমারও অনেক লেইট হয়ে গিয়েছে।’
‘আচ্ছা। সাবধানে যাস, দোস্ত।’
‘ঠিক আছে। তুইও সাবধানে থাকিস। কোনো অসুবিধা হলে কল দিয়ে জানাবি। সিমও আছে। চিন্তা করিস না, আমরা আছি তোর পাশে।’
রিতাকে বিদায় জানিয়ে মেহুল ছুটল। গেইট পেরিয়ে তার গাড়ির কাছে গেল। গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে বলল, তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে।
__________
বাসায় পৌঁছে ড্রয়িং রুমে রাবীরকে দেখে মেহুল থমকে দাঁড়ায়। রাবীর মেহুলকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কোথায় ছিলেন, মেহুল। আপনার ফোনও এতক্ষণ বন্ধ বলছিল। আর ড্রাইভারকেও কল দিচ্ছিলাম, সেও তো কল রিসিভ করেনি।’
মেহুল মনে মনে কথা সাজাল, কী বলবে। পরে সে হেসে রাবীরের দিকে এগিয়ে যায়। রাবীরের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘বাবা, নেতা সাহেব দেখছি তার বউয়ের দুশ্চিনায় একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছে।’
‘তা তো হতেই হবে। সামনে নির্বাচন। আমার শত্রুরা এখন আরো বেশি জেগে উঠবে। আমাকে হারাতে ওরা যেকোনো কিছু করতে পারে। তাই আপনাকে এখন আরো বেশি সাবধানে থাকতে হবে। একদম একা কোথাও যাবেন না। আর প্রয়োজন পড়লে আমাকে কল দিবেন, বুঝেছেন?’
‘জি, নেতা সাহেব। বুঝেছি।’
‘আর আজকে এত লেইট হয়েছে কেন? ড্রাইভার কি ঠিক টাইমে যায়নি?’
‘না আসলে, আমার আজকে এক্সট্রা ক্লাস ছিল। তাই একটু লেইট হয়ে গিয়েছে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, ফ্রেশ হোন গিয়ে।’
‘আপনি রুমে যাবেন না?’
‘হ্যাঁ, আপনি যান; আমি আসছি।’
মেহুল রুমের দিকে যায়। রাবীর তখন একবার ভাবে ড্রাইভারের কাছে যাবে। পদক্ষণেই তার মনে পড়ে, সে কি মেহুলকে সন্দেহ করছে? না না, এটা ঠিক না? সে অবশ্যই মেহুলকে অনেক বিশ্বাস করে। সে কোনোভাবেই ড্রাইভারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারে না। তাতে তো মেহুলকে অসম্মান করা হবে।
মেহুল গোসল সেরে বেরিয়ে রাবীরকে দেখে, ফোনে কথা বলছে। সে চুল মুছে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাবীর তখন কল কেটে ভেতরে আসে। মেহুল গায়ে তখন লোশন মাখছিল। রাবীর মেহুলের দিকে চেয়ে দু কদম এগুতেই আবার ফোন বাজে তার। সে বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করে। কথা শেষ করে মেহুলের পেছনে এসে দাঁড়ায় সে। মেহুলের ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে বলে,
‘আজকাল আপনাকে একটুও সময় দিতে পারছি না, তাই না?’
মেহুল রাবীরের দিকে ঘুরে তাকায়। চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
‘জি। আজকাল আপনি আমাকে একদমই সময় দিচ্ছেন না। এত ব্যস্ত কেন আপনি?’
‘সামনে নির্বাচন। ব্যস্ততা তো থাকবেই।’
‘আচ্ছা, এবার যদি আপনি হেরে যান?’
রাবীর তখন মেহুলের কোমর জড়িয়ে তাকে কাছে টেনে আনে। নরম গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘আপনার কী মনে হয়, হেরে যাব?’
‘না, বলছি আরকি; সবসময়ই তো জিতেন। যদি এবার হেরে যান, তাহলে মানুষ বলবে বউয়ের কারণে হেরেছেন। কারণ সবাই তখন ভাববে, বউটা বুঝি অলক্ষী। নাহলে সে আসার পরেই জামাইটা কেন হারল।’
‘ব্যাপারটা ভীষণ হাস্যকর, মেহুল। আমার হার জিতের সাথে আপনার কী সম্পর্ক?’
‘সম্পর্ক আছে। ঐসব আপনি বুঝবেন না। আচ্ছা, আপনি আমাকে একটা কথা বলুন তো; আপনি আমাকে তুমি করে কেন সম্বোধন করেন না? আপনি করে কেন বলেন?’
‘আপনিও তো আপনি করে বলেন।’
‘সেটা আপনি আমার বড়ো, তাই।’
‘হ্যাঁ। তাহলে আপনিও আমার চেয়ে বড়ো, তাই।’
মেহুল ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘আমি কী করে আপনার থেকে বড়ো হলাম?’
‘সম্মানের ক্ষেত্রে আপনি আমার থেকেও বড়ো। আমি আপনাকে নিজের থেকে বেশি সম্মান করি বলেই আপনাকে আপনি বলে সম্বোধন করি। আপনার কি পছন্দ না?’
‘না, পছন্দ। আসলে সেদিন একটা আন্টি বলছিল…’
‘ঐসব আন্টির কথা বাদ দিন। আপনি যেটাতে অভ্যস্ত আমার কাছে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
মেহুল কিছুক্ষণ রাবীরের দিকে চেয়ে থাকে। রাবীর ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী দেখছেন?’
‘আপনি কত ভালো। আমার কত ভাগ্য যে আমি আপনাকে পেয়েছি। যদি এমন ভাগ্য রিতারও হতো।’
রাবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আল্লাহ ভালো মানুষের সাথে খারাপ কিছু হতে দিবেন না, মেহুল। আল্লাহ আছেন তো। উনি সব ঠিক করে দিবেন।’
মেহুল তখন বলল,
‘একটা কথা বলব?’
‘বলুন।’
‘রাগ করবেন না তো?’
‘না, বলুন।’
‘আপনার আর সাদরাজ আহমেদের সম্পর্কটা আবার ঠিক হয়ে গেলে ভালো হতো না?’
‘এটা সম্ভব না।’
‘কেন সম্ভব না?’
‘জানি না। তবে এইটুকু জানি, এটা আর সম্ভব না।’
‘চাইলে সব সম্ভব।’
রাবীর মেহুলকে ছেড়ে দাঁড়ায়। ঘড়ির দিকে চেয়ে বলে,
‘চারটা বাজে। চলুন, খেতে হবে।’
__________
মেহুল রাবীরের পেছন পেছন ডাইনিং রুমে যায়। সেখানে খালা সব বেড়ে রেখেছেন। রাবীর একটা চেয়ার টেনে বসল। খালাকে জিজ্ঞেস করল,
‘মা কি ঘুমাচ্ছেন?’
‘জি। খালা খেয়ে দেয়ে ঘুমাই পড়ছেন।’
‘আচ্ছা।’
মেহুল ধীরে ধীরে খাচ্ছে। মনের ভেতরে কথার প্যাঁচ চলছে তার। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। এত কথা মনে চেপে রাখলে খাবার কি আর গলা দিয়ে নামে? নামে না।তাই সেও খেতে পারছে না। রাবীর খেয়াল করে ব্যাপারটা। মেহুলের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, মেহুল? আপনি খেতে পারছেন না?’
‘না, খাচ্ছি তো।’
‘কই? প্লেটের খাবার তো নড়ছে না। কী হয়েছে, শরীর খারাপ লাগছে?’
‘না না, আমি একদম ঠিক আছি। আসলে অস্থির লাগছিল।’
‘কেন? কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা? ভার্সিটিতে কোনো প্রবলেম হয়েছে?’
‘না।’
‘তাহলে?’
মেহুল ইতস্তত স্বরে বলল,
‘আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আপনি বিকেলে বাসায় থাকবেন, প্লিজ।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে; থাকব। এখন খেয়ে নিন।’
খাওয়া দাওয়া শেষ করে মেহুল আর রাবীর তাদের রুমে যায়। রাবীর ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে মেহুল বিছানায় বসে বসে হাত কচলাচ্ছে। রাবীর খেয়াল করেছে, মেহুল যখন কোনো ব্যাপার নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকে তখন সে এমন করে। সে মেহুলের পাশে গিয়ে বসে। মেহুলের দু হাতের উপর হাত রেখে মোলায়েম সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, মেহুল?’
মেহুলের অস্থির চোখ জোড়া একটু শান্ত হয়। রাবীরের দিকে চেয়ে বলে,
‘আপনাকে কিছু কথা বলব। আপনি আগে প্রমিস করুন, সব শুনে আপনি আমার উপর রেগে যাবেন না।’
‘না, রাগব না। বলুন।’
‘প্রমিস করছেন?’
‘হ্যাঁ, প্রমিস।’
‘আপনি কি জানেন, আপনার আর সাদরাজ আহমেদের মাঝে এসব ঝামেলা কে তৈরি করেছেন?’
রাবীর কপাল কুঁচকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘এসব কথা আবার কেন তুলছেন?’
‘বলুন না।’
রাবীর বড়ো করে নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘হ্যাঁ, জানি।’
‘কে?’
‘সাদরাজ আহমেদের বাবা, শাহাদাত আহমেদ।’
‘আর, সাদরাজের আহমেদের মা’কে কে খু ন করেছে জানেন?’
‘আপনি এসব কথা কী করে জানলেন?’
রাবীর অবাক হয়। মেহুল বলে,
‘জেনেছি। এখন আপনি বলুন, আপনি এটা জানেন কিনা?’
রাবীর মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘না, এটা জানলে তো সব সমস্যার সমাধানই হয়ে যেত।’
‘আমি জানি।’
রাবীর বিস্মিত হয়। মেহুল বলে,
‘সাদরাজ আহমেদের মা’কে উনার বাবা, শাহাদাত আহমেদ’ই খু ন করেছেন। তারপর সব দোষ আপনার উপর চাপাতে চেয়েছেন।’
রাবীরের বিস্ময় কাটছে না। সে কিছু বুঝতেই পারছে না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি এতকিছু কীভাবে জানলেন, মেহুল? কার কাছ থেকে আপনি এসব শুনেছেন?’
চলবে…
#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৮।
মেহুল খানিক চুপ থেকে বলে,
‘রিতা আমাকে এসব বলেছে।’
রাবীর কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
‘আর উনি এসব কার কাছ থেকে জেনেছেন?’
‘রিতা যে বাড়িতে থাকে, সেখানে একজন খালা আছেন; উনিই রিতাকে এসব বলেছেন। আর রিতা এসব রিসিপশনের দিন আমাকে বলেছিল। আপনি ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন বলে আপনাকে আর বলার সুযোগ পাইনি।’
রাবীর চিন্তায় পড়ে। এত বছর পর পুরোনো সেই ঘটনাগুলো আবার মস্তিষ্কে সজাগ হয় তার। তখনও তার সন্দেহ হয়েছিল, শাহাদাত আহমেদের উপর। কিন্তু, প্রমাণ ছিল না বলে কিছু বলতে পারেনি। সাদরাজও অবিশ্বাস করেছিল। তার কাছে বন্ধুত্ব আর বিশ্বাসের কোনো মূল্যই ছিল না। সেসব কথা ভাবলে এখনো কষ্ট লাগে তার।
রাবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘এখন আর সত্যি জেনেই বা কী হবে? আর তো কিছু করার নেই।’
মেহুল অস্থির গলায় বলে,
‘কে বলেছে, কিছু করার নেই? আপনি ঐ শাহাদাত আহমেদের শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। উনি অন্যায় করেছেন। উনাকে তো শাস্তি পেতেই হবে।’
‘সম্ভব না, মেহুল। প্রমাণ ছাড়া কিছু সম্ভব না। পাঁচ বছর আগে যে জিনিসের কোনো প্রমাণ বের করতে পারিনি, পাঁচ বছর পর সেই জিনিসের উপযুক্ত প্রমাণ কোথ থেকে বের করব?’
‘পারবেন। আপনাকে চেষ্টা করতে হবে। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। খালা, খালা সব জানেন। উনিই আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।’
‘উনি কেন আমাদের সাহায্য করতে যাবেন? নিজের জীবন রিস্কে ফেলে কেউ কাউকে সাহায্য করে না, মেহুল।’
মেহুল ভাবে কী করবে। পরে বলে,
‘খালাকে আমি আর রিতা রাজি করাব।’
রাবীর ফিচের স্বরে বলে,
‘এসবের মাঝে আপনাদের জড়ানোর দরকার নেই। আমি পরে সব ব্যবস্থা করব। নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন না, প্লিজ। হিতে পরে বিপরীত হবে।’
‘আপনি আমার পাশে আছেন তো; আমার কিছু হবে না।’
‘মেহুল, আমি কিন্তু বারণ করেছি।’
‘রাবীর, প্লিজ।’
‘ঠিক আছে। তবে আপনি আপাতত কিছু করবেন না। যখন আমি বলব, তখন করবেন। নিজে থেকে কোনো স্টেপ নিবেন না। এমনিতেই খুব দুশ্চিন্তায় আছি। আমি চাই না, আর নতুন করে কোনো বিপদ আসুক।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি যা বলবেন, যেভাবে বলবেন; সেভাবেই সব হবে।’
____________
সাদরাজ রুমে এসে দেখে রিতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আয়নায় সাদরাজের প্রতিবিম্ব দেখে সে ঘুরে তাকায়। সাদরাজকে দেখে মেকি হাসে। সাদরাজ তার দিকে এগিয়ে আসে। রিতার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার আসার কথা শুনে শাড়ি পরেছো? একটু আগেও তো কামিজ পরা দেখলাম।’
রিতা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। মনে মনে ভাবে, লোকটা কত কিছু খেয়াল করে। পরে সে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
‘জি, আপনি আসবেন বলে শাড়ি পরেছি।’
সাদরাজ বাঁকা হাসে। বলে,
‘রূপ দিয়ে মন গলবে না। বাই দ্যা ওয়ে, একটু আগে কে এসেছিল?’
রিতা মৃদু সুরে বলে,
‘একটা মহিলা।’
সাদরাজ তার দিকে আরেকটু এগিয়ে আসে। বলে,
‘মহিলাটা বোধ হয় তোমার খুব কাছের। তাই তো এত সাদরে তাকে বাসার ভেতর নিয়ে এলে। তা কে সে? আমি কি চিনি?’
রিতা কথা সাজায়। একদম ঘাবড়ানো যাবে না। সে নিজেকে স্থির করে বলে,
‘আমি উনাকে চিনি না। খালা বলেছেন আনার জন্য, তাই এনেছি।’
‘কিন্তু, দারোয়ান তো বলল, তুমি বলেছো। এখন কে মিথ্যে বলছে, বলো তো? তুমি নাকি দারোয়ান আর নাকি খালা?’
‘কেউ মিথ্যে বলছে না। দারোয়ানকে আমি বলেছি, মহিলাটি আমার পরিচিত। তাই উনি হয়তো বলেছেন, আমি তাকে ডেকেছি। আসলে তাকে খালা ডেকেছেন। খালার পরিচিত নাকি।’
সাদরাজ রিতার কপালে বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ঘষে বলল,
‘ঘামছো কেন? তোমাকে তো আমি বিশ্বাস করি।’
রিতা হাসার চেষ্টা করে। বলে,
‘গরমে ঘামছি হয়তো।’
‘হ্যাঁ, এসিটা বোধ হয় ঠিকঠাক কাজ করছে না।’
রিতা বুঝতে পারছে, সাদরাজ মোটেও তার বা খালার কথা বিশ্বাস করেনি। এবং সে এই সত্যি বের করেই ছাড়বে। রিতা তখন কথা ঘুরানোর জন্য মোলায়েম সুরে বলল,
‘এতদিন কোথায় ছিলেন? আমার এখানে একা থাকতে একদম ভালো লাগছিল না।’
সাদরাজ আবার হাসে। বলে,
‘এই যে, আমি চলে এসেছি। এখন থেকে আবার তোমার খুব ভালো লাগবে।’
রিতাও মেকি হাসে। সাদরাজ চোখ মুখ কুঁচকে সরে যায় সেখান থেকে। ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
___________
সন্ধ্যার দিকে রাবীর বেরিয়ে যাওয়ার পর মেহুল তার শাশুড়ি মায়ের রুমে যায়। তিনি তখন বসে বসে কিছু একটা সেলাই করছিলেন। মেহুল রুমের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আসব, মা?’
‘হ্যাঁ, এসো।’
মেহুল রুমে এসে বিছানার এক কোণে বসে। মনে মনে ভাবে শাশুড়িকে এইসব ব্যাপারে কিছু বলা ঠিক হবে কিনা? বা উনি কিছু জানেন কিনা, সেটাও মেহুলের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, জিজ্ঞেস করার মতো সাহস সে পাচ্ছে না। তার হাবভাব দেখে শাশুড়ি মা জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিছু বলবে তুমি?’
মেহুল চেয়ে বলল,
‘জি, মা। একটা কথা বলার ছিল।’
‘বলো।’
মেহুল এবার আমতা আমতা করে বলে,
‘মা, আপনি কি জানেন রাবীর আর সাদরাজ খানের সম্পর্ক কেন নষ্ট হয়েছে?’
‘না, আমার এসব জানার প্রয়োজন নেই।’
মেহুল খানিকটা অবাক হলো। তাও সে বলল,
‘এসব হয়েছে সাদরাজ আহমেদের বাবা,শাহাদাত আহমেদের জন্য। উনিই সব নষ্টের মূল। উনি…’
‘মেহুল, এসব নিয়ে তুমি কেন কথা বলছো? কী দরকার? কে কী করেছে না করেছে সেসব জেনে আমার আর তোমার কারোরই কোনো কাজ নেই। তাই অযথা এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করো না। তোমার কাজ পড়াশোনা আর সংসার করা। তুমি সেসব নিয়েই ব্যস্ত থাক। আর ইলেকশনের পর একটা সুখবর যেন পাই, সেই ব্যবস্থাই করো। এছাড়া আর অন্য কোনো ঝামেলায় নিজেকে জড়িও না।’
মেহুলের আশা সব হতাশায় পরিণত হলো। তার শাশুড়ি বরাবরই এমন অদ্ভুত টাইপের মানুষ। কোনো কিছুতেই উনার কিছু যায় আসেনা। খালি, ছেলে আর ছেলের বউকে হাতে রাখতে পারলেই চলল। বাকি সব রসাতলে যাক, তাতে উনার কী।
মেহুল পরে আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে যায়।
__________
সাদরাজ বারান্দায় বসে লেপটপে কিছু একটা করছে। রিতা খুব সাহস করে তার দিকে একটা কফির মগ এগিয়ে দেয়। সাদরাজ কপাল কুঁচকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘হঠাৎ এত যত্ন?’
‘নিজের জন্য বানাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনার জন্যও বানাই। খেতে ইচ্ছে না করলে সমস্যা নেই।’
সাদরাজ কফির মগটা হাতে নেয়। রিতা তখন আবার ইতস্তত সুরে বলে,
‘আমি একটু এখানে বসব?’
‘হু।’
রিতা বসে। সাদরাজ কফিতে চুমুক দিয়ে নিজের কাজে আবার মনোযোগ দেয়। রিতাও কিছুক্ষণ চুপচাপ কফি খায়। অনেক ভেবে সাহস নিয়ে বলে,
‘আপনার মা বাবার সাথে আমার দেখা করাবেন না?’
কথাটা হয়তো সাদরাজের পছন্দ হয়নি। সে ক্ষুব্ধ চোখে রিতার দিকে চেয়ে বলল,
‘তুমি কি বারবার ভুলে যাও,তোমাকে আমি কেন বিয়ে
করেছি? তোমাকে আমি সারাজীবন বউ হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্য বিয়ে করিনি যে, মা বাবার সাথে ঘটা করে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আমার যেই কয়দিন প্রয়োজন, সেই কয়দিনই তুমি এখানে থাকবে। তার বেশি একদিনও না। বুঝতে পেরেছ?’
রিতার এখন আর খারাপ লাগে না। সে অন্যদিকে ঘুরে কফিতে চুমুক দেয়। জিজ্ঞেস করে,
‘কফিটা কেমন হয়েছে?’
রাবীর ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মেয়েটার মুড মিনিটেই বদলে গেল কী করে। সে আর জবাব দেয় না। রিতা তার দিকে তাকায়। মৃদু হেসে বলে,
‘মানুষ কত অদ্ভুত না? এক নিমিষেই সব শেষ করে ফেলতে পারে। তাহলে এই বন্ধুত্ব, এই ভালোবাসার আর কোনো মূল্যই রইল না। একটা মিথ্যে কথা কত সহজে সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। অথচ বোকা মানুষ, সেই মিথ্যেটা ধরতেই পারে না। ইশ, মানুষটা কী বোকা!’
সাদরাজ লেপটপটা বন্ধ করে রিতার দিকে তাকায়। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘এসব তুমি কী বলছো, কাকে বলছো?’
রিতা আফসোসের সুরে বলে,
‘আর বলবেন না, আমার একটা বন্ধু আছে; মেহুল না কিন্তু, অন্য একজনের কথা বলছি। আমার সেই বন্ধু তার বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেয়, শুধুমাত্র একটা মিথ্যা কথার ভিত্তিতে। অথচ সে একবার যাচাইও করেনি, আদৌ সেই কথাটা সত্যি নাকি মিথ্যা। ও যা শুনেছে তাই বিশ্বাস করেছে। আর সেই মিথ্যা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে সে তার এত বছরের বন্ধুত্বকে নিমিষেই শেষ করে দিয়েছে। একবারও তার বেস্টফ্রেন্ডের কথা ভাবেনি, তার কষ্টের কথা ভাবেনি। কত বোকা ও, তাই না? আমার তো ওর জন্য খুব আফসোস হয়।’
সাদরাজ হঠাৎ করেই ভীষণ ভাবে রেগে যায়। সে রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘কী সমস্যা তোমার? তুমি এসব কথা আমাকে কেন বলছো? আমি কি কিছু শুনতে চেয়েছি? চাইনি তো। তাহলে এসব ফালতু কথা আমাকে বলছ কেন?’
রিতা উঠে দাঁড়ায়। অসহায় সুরে বলে,
‘আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি তো কেবল আমার সেই বন্ধুর কথা মনে পড়ছিল বলে বলছিলাম।’
সাদরাজের রাগ কমে না। সে ক্ষিপ্ত সুরে বলে,
‘যাও, রুমে যাও। আর ভবিষ্যতে এসব ফালতু কথা ভুলেও আমার সামনে বলবে না। বুঝতে পেরেছ?’
রিতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘আচ্ছা।’
সে তারপর রুমে চলে আসে। কিন্তু, সাদরাজের রাগ আর কমে না। পুরোনো ঘা এ যেন আবার নুনের ছিটা পড়েছে। তাই এত বছর পর সেই ঘা আবারও তার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠে।
চলবে….