#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৫।
‘হ্যাঁ, উনারা একসময় নাকি বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন। আর একজন অন্যজনকে তখন অনেক ভালোও বাসতেন।’
‘তাহলে তারপর এমন কী হলো যে দুজন এখন একজন অন্যজনকে একদম সহ্যই করতে পারেন না?’
‘জানি না, আমাদের সেই কারণটাই খুঁজে বের করতে হবে। আমি তো আর সাদরাজকে এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে পারব না তাই তুই ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করবি। ভাইয়ার কাছ থেকে সব জানবি। আর ঐদিকে আমি চেষ্টা করব খালার কাছ থেকে আরো কিছু জানা যায় কিনা।’
মেহুল চিন্তিত সুরে বলে,
‘কিন্তু, রাবীর কি আদৌ আমায় সব বলবে?’
‘বলবে। তুই জোর করলেই ভাইয়া সব বলবে।’
‘আচ্ছা, আমি চেষ্টা করব। কিন্তু, তুই কি এখন সাদরাজের সাথেই থাকবি? উনি যদি তোর সাথে খারাপ কিছু করে বসে?’
রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘আর খারাপ কিছু। তোর কি মনে হয়, পুলিশকে সব বলে দিলে আমি রেহাই পেয়ে যাব? উনি জেল থেকে বেরুতে পারবেন না? উনার কাছে এইটা দু মিনিটের ব্যাপার। আর তারপর উনি আমার উপর আরো ক্ষেপে যাবেন। আমার উপর রাগ মেটাতে গিয়ে উনি সিয়ামের তো ক্ষতি করবেনই সাথে আমার মা বাবারও ক্ষতি করবেন। আর এতকিছুর পরও আমি কীভাবে এখন সত্যি কথাটা বলব বল?’
‘কিন্তু রিতা, এই খারাপ লোকটাকে তো শাস্তি দিতেই হবে। এভাবে তো ছাড় দেওয়া যায় না।’
‘হ্যাঁ, শাস্তি দিতে হবে। আর সেই শাস্তি আমি দিব।’
‘কীভাবে?’
‘জানিস, উনাদের বাড়ির খালা আমাকে একটা কথা বলেছেন। বলেছেন, মেয়েরা নাকি ভালোবাসাকে অস্ত্র বানিয়ে সব করতে পারে। আর আমি এই ভালোবাসাকেই অস্ত্র বানাব। উনি টেরও পাবেন না, উনাকে আমি কীভাবে মারব। শুধু তুই আমাকে পাশে থাকিস, তাহলেই হবে।’
মেহুল রিতার দুহাত ধরে বলে,
‘আমি, রাবীর, আমরা সবাই তোর পাশে আছি।’
‘ঠিক আছে, চল এখন। সাদরাজ নয়তো পরে সন্দেহ করবে।’
মেহুল রিতাকে নিয়ে আবার স্টেজের কাছে যায়। গিয়ে দেখে সাংবাদিকদের প্রশ্ন এখনো চলছে। রিতা তা দেখে কিছু স্বস্তি পায়।
সাংবাদিকদের কাছ থেকে সরেই সাদরাজ রিতার কাছে আসে। তার কাছে গিয়ে মৃদু সুরে বলে,
‘কোনো চালাকি করছো না তো?’
রিতা মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,
‘আমার কি আর অত সাহস আছে?’
সাদরাজ বাঁকা হাসে। বলে,
‘গুড। তা, তোমার বান্ধবীকে আমাদের পক্ষ থেকে উপহারটা দিয়েছ?’
‘না, সেটা তো আপনার কাছে।’
‘হ্যাঁ, তাই তো। চলো, উপহারটা দিয়ে আসি।’
রিতা আর সাদরাজ আবার তাদের কাছে যায়। সাদরাজ হেসে বলে,
‘আমার সবথেকে প্রিয় শত্রু, ওহ সরি, প্রিয় মানুষদের জন্য আমাদের তরফ থেকে একটা ছোট্ট গিফ্ট। গিফ্টটা গ্রহণ করলে আমরা খুব খুশি হব।’
রাবীর সাদরাজের হাত থেকে গিফ্টের বক্সটা নিল। সাদরাজ বলল,
‘খুলে দেখো, পছন্দ হয় কিনা?’
বক্সটা খুলে দেখল বড়ো দুটো রিং। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ডায়মন্ড। রাবীর মৃদু হাসে। বলে,
‘হ্যাঁ, ভীষণ পছন্দ হয়েছে।’
পরে সে মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,
‘মেহুল, আমাদের গিফ্টটাও দিন।’
মেহুল হেসে আরেকটা বক্স রিতার হাতে দিল। রিতা সেটা খুলে দেখল, সেখানে একটা বড়ো নেকলেস। নেকলেসটা দেখে রিতা বেশ অবাক হয়। মেহুল হেসে বলে,
‘তোর মনে আছে, একবার তুই বলেছিলি, তোর বিয়েতে যেন আমি এমন একটা নেকলেস দেই। তাই দিলাম, নিজের টাকায় পারিনি যদিও। তবে হাজবেন্ডের টাকা মানেও তো নিজের টাকাই তাই না? পছন্দ হয়েছে তোর?’
রিতা খুশি হয়ে বলল,
‘ভীষণ।’
তবে সাদরাজ এতে খুশি হতে পারেনি। কারণ সাদরাজের দেওয়া গিফ্টের তুলনায় রাবীরের দেওয়া গিফ্টের দাম বেশি। তাই সে রিতার দিকে চেয়ে বলল,
‘রিতা, চলো। তাড়াতাড়ি খেয়ে আমাদের বেরুতে হবে।’
রাবীর সাদরাজকে জ্বলতে দেখে বেশ খুশি হয়। রিতা আর সাদরাজের সাথে রাবীরও মেহুলকে নিয়ে একই টেবিলে গিয়ে বসে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সাদরাজ আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে রিতাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। আর মেহুল আর রাবীরও রওনা হয় তার বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
________
গাড়ি থেকে নেমেই সাদরাজ রিতার হাত থেকে সেই গয়নার বক্সটা টেনে নিয়ে বলে,
‘এটা তোমার নিতে হবে না?’
‘কেন?’
‘এমনি। যাও ভেতরে যাও।’
‘কিন্তু, এটা…’
‘কী বলেছি কানে যায়নি? ভেতরে যাও।’
‘এটা ফেলবেন না, প্লিজ।’
‘রিতা, ভেতরে যাও।’
সাদরাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল। রিতা ভয়ে আর দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে চুপচাপ ভেতরে চলে যায়।
____________
মেহুল বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। রাবীর তার পাশে চোখ বুজে শুয়ে আছে। মেহুল মনে মনে ভাবছে এখন তাকে একবার সাদরাজের কথা জিজ্ঞেস করবে কিনা? উনারা কি সত্যিই একসময় বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন?
আবার সে ভাবছে, জিজ্ঞেস করলে যদি রাবীর রেগে যায়? তাও, জিজ্ঞেস তো করতেই হবে। মেহুল আস্তে করে রাবীরের মাথায় হাত রাখে। তার চুল টেনে দেয়। চুলে বিলি কেটে দেয়। মাথা টিপে দেয়। মূলত যতভাবে রাবীরের মাথাকে ঠান্ডা রাখা যায় তার সবই করে। রাবীরও ভীষণ আরাম পায় তাতে। সে এগিয়ে এসে মেহুলের কোলে মাথা রাখে। মেহুল একটু নড়ে বসে। মনে মনে ঠিক করে এখনই জিজ্ঞেস করবে। সে একটা ঢোক গিলে মৃদু সুরে বলে,
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব, রাবীর?’
‘হু, বলুন।’
‘আচ্ছা, আপনি আর সাদরাজ কি একসময় বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন?’
কথাটা শোনা মাত্রই রাবীর চট করে উঠে বসে। মেহুল ভয় পেয়ে যায়। রাবীর কি খুব রেগে গিয়েছেন। রাবীর তার দিকে কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি এই কথা কোথ থেকে শুনেছেন?’
‘আসলে, আমাকে রিতা বলেছে।’
‘রিতা কী করে জেনেছেন?’
‘আমি ঠিক জানি না। কিন্তু, এটা কি সত্যিই? আপনি আর সাদরাজ বেস্টফ্রেন্ড ছিলেন?’
রাবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তপ্ত স্বরে বলে,
‘হ্যাঁ, ছিলাম।’
মেহুল এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাহস করে। সে জিজ্ঞেস করে,
‘তাহলে এখন আপনাদের সম্পর্ক এত খারাপ হয়ে গেল কী করে?’
রাবীর আবার তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। বলে,
‘থাক না এসব। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলতে আমার এখন আর ভালো লাগে না। চুলগুলো টেনে দিন। মাথা ব্যথা করছে।’
মেহুল আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ তার চুল টেনে দিল। কিন্তু মনের অস্থিরতা তার এখনো যাচ্ছে না। সবটা জানতে পারলে হয়তো যেত। কিন্তু পুনরায় কোনো প্রশ্ন করার সাহসও পাচ্ছে না সে।
রাবীর তার দিকে ঘুরে শুয়ে আছে। মেহুল চুল থেকে হাত সরিয়ে তার গালে হাত রাখে। গালের উপর একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু সুরে ডাকে,
‘রাবীর।’
রাবীর চোখ বুজেই বলে,
‘বলুন।’
‘আমার মনের অস্থিরতা তো কমছে না। আপনি বলুন না আমায় সবকিছু, প্লিজ।’
রাবীর তার দিকে তাকায়। মেহুল অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে। রাবীর জিজ্ঞেস করে,
‘এসব শুনে আপনি কী করবেন?’
‘কিছু না। তাও, বলুন প্লিজ।’
রাবীর আবার চোখ বুজে। ফিচেল স্বরে বলে,
‘একটা সম্পর্কের মূল ভিত্তি কী জানেন? বিশ্বাস। আর সম্পর্কের মধ্য থেকে একবার যদি সেই বিশ্বাসটা হারিয়ে যায় তখন হাজার চেষ্টা করেও সেই সম্পর্কটাকে আর ঠিক রাখা যায় না। সেটা তখন ভাঙ্গবেই। আমাদের বেলায়ও তাই হয়েছিল। বিশ্বাস হারিয়ে গিয়েছিল। সাদরাজ আমাকে আর বিশ্বাস করতে পারেনি। ভুল বুঝেছিল। আর তার পরিণতি আজকে এই। একসময় যে আমার জন্য জীবন দিতে চাইতো আজকে সে আমার জীবন নিতেও দু’বার ভাববে না।’
‘আর এই বিশ্বাসটা কী কারনে হারিয়েছিল?’
‘সেটা এক অনেক বড়ো কাহিনী। অন্যদিন বলব। আজকে আর ইচ্ছে করছে না।’
______________
‘আমার ফ্রেন্ড এটা আমাকে ভালোবেসে দিয়েছিল, কোথায় রেখেছেন আপনি এটা?’
‘যেখানে রাখা দরকার সেখানেই। আমার এই বাড়িতে রাবীরের দেওয়া কোনো জিনিসের কোনো স্থান নেই।’
‘সাদরাজ, আপনি এত অমানবিক কেন বলুন তো? আপনার মধ্যে কি একটুও মায়া দয়া নেই?’
সাদরাজ প্রচন্ড রেগে যায়। সে রিতার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
‘আমি খুব অমানবিক, তাই না? আর কী, আমার মধ্যে কোনো মায়া দয়া নেই কেন জিজ্ঞেস করছিলে, তাই না? কারণ আমি তো মানুষই না, পশু। আর কোনো পশুর মধ্যে কোনো মায়া দয়া থাকে না।’
এই বলে সে রিতাকে এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে দেয়। রিতা তখন তার দিকে চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘আপনাকে মানুষ বানিয়ে তবেই আমি মরব। এর আগে না।’
চলবে….
ভ#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৬।
এক সপ্তাহ চলে গেল। রাবীর আজকাল ভীষণ ব্যস্ত। সামনে আবার তাদের ইলেকশন। মেহুল আবার তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছে। কাল থেকে সে ভার্সিটিতে যাচ্ছে। তবে সবকিছু ঠিক থাকলেও স্বাভাবিক নেই কেবল রিতার জীবন। সে এখনো সাদরাজের বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি। গত পাঁচদিন যাবত সাদরাজ বাসায়ও আসছে না। এই সুযোগে সে অনেকবার চেয়েছিল, একাবার বেরুবে। মা বাবার সাথে দেখা করে আসবে। কিন্তু, সাদরাজের বাড়ির কাজের লোক আর দারোয়ানরা তাকে বের হতে দেয়নি।
__________
মেহুল আজ ক্লাস শেষ করে তার ড্রাইভারকে বলল,
‘আমি এখন বাসায় যাব না। অন্য একটা জায়গায় যাব। নিয়ে যেতে পারবেন?’
ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল,
‘কোথায় যাবেন?’
‘বলছি। তবে আপনাকে ওয়াদা দিতে হবে যে, আমি কোথায় যাচ্ছি সেটা আপনি এখন রাবীরকে বলতে পারবেন না।’
ড্রাইভার এবার চিন্তায় পড়ে গেল। বলল,
‘কিন্তু ম্যাডাম, স্যারকে না জানিয়ে আমি কিছু করলে, স্যার রেগে যাবেন।’
‘কিচ্ছু হবে না। আমি সামলে নিব সবকিছু। আপনি শুধু প্লিজ কাউকে কিছু বলবেন না। পরে সময় মতো আমিই সবাইকে সবকিছু বলব।’
ড্রাইভার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল,
‘আচ্ছা। কোথায় যাবেন?’
‘রাজাপাড়া রোড হয়ে ডানে একটা গলি আছে। সেই গলির ভেতরে বারো নাম্বার রাস্তায় একজনের বাসা। আমি সেখানেই যাব।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
__________
মেহুলের কথা মতো ড্রাইভার সেদিকেই গেল। তবে অনেকটা সময় লাগল তাদের সেখানে পৌঁছাতে। মেহুল বাসার আরো আগেই গাড়ি সাইড করতে বলে, সে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। ড্রাইভারকে বলে,
‘আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।’
‘ম্যাডাম, আমাকে সাথে নিন। পরে কোনো বিপদ হলে..’
‘আরে, কিছু হবে না। আপনি এখানেই বসে অপেক্ষা করুন, আমার বেশি সময় লাগবে না।’
মেহুল দ্রুত এগিয়ে যায়। একটু এগিয়েই মুখে একটা মাস্ক পড়ে নেয়। পরে সে হাঁটতে হাঁটতে একটা বাসার সামনে যায়। গিয়ে দাঁড়ায় সে। বিশাল বড়ো বাড়ি দেখে সে বুঝতে পারে, ঠিক জায়গায় এসেছে। এবার সে মাথায় একটা ঘোমটা দেয়। গেইটের কাছে এগিয়ে গিয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে,
‘এটা কি সাদরাজ স্যারের বাসা?’
দারোয়ান তার আপাদমস্তক পরখ করে ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘জি। কিন্তু, আপনি কে?’
‘আসলে, আমি স্যারের একজন নতুন সহকারী। স্যার আমাকে বাসায় আসতে বলেছিলেন। উনার ওয়াইফের জন্য। স্যার কি বাসায় আছেন?’
‘না, স্যার পাঁচদিন যাবত এই বাসায় আসেন না। ‘
‘ওহহ, আমাকে তো কল দিয়ে আজকেই আসতে বললেন। উনার ওয়াইফের দেখভালের জন্য। ম্যাডাম আছেন বাসায়?’
‘জি।’
‘তাহলে ম্যাডামের সাথেই গিয়ে কথা বলি।’
এই বলে মেহুল ভেতরে ঢুকতেই দারোয়ান তাকে আবার পেছন থেকে ডেকে উঠে,
‘দাঁড়ান।’
মেহুল তপ্ত শ্বাস ফেলে পেছনে চেয়ে বলে,
‘কী?’
‘আপনাকে স্যার বলেছেন আসতে?’
‘জি। স্যার’ই তো বলেছেন, আজকে সকালেই।’
‘ঠিক আছে দাঁড়ান, আমি স্যারের সাথে কথা বলে জিজ্ঞেস করে নিই।’
মেহুল ভয় পায়। সাদরাজকে কল করলে তো সে ধরা পড়ে যাবে। সে ভয়ে ভয়ে ভাবতে থাকে এবার কী করবে। তখনই সে উপরের বারান্দায় রিতাকে দেখে। তাকে দেখেই সে ইশারা দেয়। রিতা প্রথমে তাকে চিনতে পারে না। পরে মেহুল একটু মাস্ক নামাতেই রিতা চমকে যায়। দৌড়ে নিচে নেমে আসে। সে মেহুলের কাছে আসতেই মেহুল বড়ো করে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কেমন আছেন, ম্যাডাম? আমাকে আসলে স্যার পাঠিয়েছেন, আপনার দেখভালের জন্য। আপনাকে নিশ্চয়ই স্যার বলে গিয়েছেন।’
রিতা বুঝতে পারল ব্যাপারটা। সে হেসে বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সাদরাজ আমাকে বলেছিল। আপনিই সেই, তাই না?’
‘জি, ম্যাডাম।’
‘তাহলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে চলুন।’
‘কী করো যাব, ম্যাডাম? আপনার দারোয়ান তো দিচ্ছেন না।’
রিতা চোখে মুখে মেকি রাগ ফুটিয়ে তুলে বলল,
‘কী দিচ্ছে না? এই যে, আপনি উনাকে ভেতরে আসতে দিচ্ছেন না কেন? আপনার নামে সাদরাজের কাছে কমপ্লেন করব?’
দারোয়ান ভয় পেয়ে বলল,
‘না না, ম্যাডাম। আসলে চিনতে পারছিলাম না তো তাই। আপনারা যান যান, ভেতরে যান।’
রিতা মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘চলুন।’
দুজনেই তাড়াতাড়ি করে বাসার ভেতরে চলে গেল। তারা ভেতরে ঢুকতেই খালা রান্নাঘর থেকে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
‘উনি কেডা, মা?’
‘খালা, আমার বান্ধবী।’
খালা চকিত হয়ে বলেন,
‘রাবীর খানের বউ?’
‘জি, খালা।’
খালা প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান। তিনি ভীত সুরে বলেন,
‘উনারে এহানে আনছেন কেন?’
মেহুল বলে,
‘ও আনেনি। আমি নিজে থেকেই এসেছি।’
‘খালা, আপনি বুঝতাছেন না। সাহেব জানতে পারলে কেয়ামত কইরা ফেলব। তার উপর বাইরে সি সি ক্যামেরা আছে। সাহেব ক্যামেরা দিয়া সব দেহে।’
‘সমস্যা নেই, খালা। আমার মুখে মাস্ক আছে।’
‘আহারে, আপনার মুখ না দেখলে কী হইব। সাহেব যদি বুঝে তার বাড়িতে অপরিচিত মানুষ আইছে তাইলেই স্যার দারোয়ানরে ফোন দিব। তহন দারোয়ান সব কইয়া দিব। আপনারা কী বিপদ ডাইকা আনতেছেন কন তো? হেই দিক দিয়া যদি রাবীর খান এসব জানে। তাইলে উনিও রাইগা যাব। খালা, আপনি যান। আপনি এহানে থাকলে বিপদ।’
‘খালা, আমি চলে যাব। শুধু আপনি আমাকে সব সত্যি বলে দিন। তাহলেই আমি এখান থেকে চলে যাব।’
‘কিসের সত্যি?’
‘রাবীর আর সাদরাজের সম্পর্কের মধ্যে এত সমস্যা কীভাবে তৈরি হল? কে উনাদের সম্পর্ক নষ্ট করেছে? কী কী হয়েছিল না হয়েছিল সব বলুন। সব শুনে তবেই আমি এখান থেকে যাব। নয়তো এক পাও নড়ব না।’
রিতাও খালাকে চাপ দিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ খালা, আপনি আমাকে একা কিছু বলেননি। এবার মেহুলের সামনেই সবকিছু বলুন। আমাদের সব সত্যি জানতে হবে। আর কিছু লুকাবেন না, প্লিজ।’
‘আইচ্ছা, আপনারা বন। আমি কইতাছি সব।’
মেহুল আর রিতা সোফায় বসে। মেহুল বলে,
‘তাড়াতাড়ি বলুন, খালা। আমার আবার বেরুতে হবে।’
‘জি, কইতাছি। আসলে সাহেব আর রাবীর খানের মাঝে যত শত্রুতা, তা সব তৈরি হইছে সাহেবের বাপের কারণে। মানে আমাদের বড়ো সাহেব। যত নষ্টের মূল উনিই।’
রিতা ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘কেন, উনি কী করেছেন?’
‘উনিই আমাদের ম্যাডামরে মারছেন।’
মেহুল আর রিতা দুজনেই চমকে যায়। রিতা বলে উঠে,
‘ম্যাডাম মানে? সাদরাজের মা?’
‘হ, উনারে বড়ো সাহেব মারছে। আর দোষ দিছে সব রাবীর খানের উপর। রাবীর খান এর জন্য জেলও খাটছিল। কিন্তু, উপযুক্ত প্রমানের অভাবে উনারে পরে ছাইড়া দেওয়া হইছে। কিন্তু, সাদরাজ আহমেদ বাপের কথারেই বিশ্বাস করছেন। বাপে যা কইছেন তা। বাপের এই মিছা কথারে বিশ্বাস কইরা উনি উনার এত বছরের বন্ধুরে শত্রু বানাইছেন। রাবীর খান অনেক চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু, উনারে বুঝাইতে পারেন না। পরে উনারও মনে খুব কষ্ট লাগে যে, উনার একটা মাত্র প্রাণপ্রিয় বন্ধু কোনো প্রমান ছাড়াই উনার উপর আঙ্গুল তুলছে। সেই কষ্টে উনিও দূরে সইরা গেছেন। পরে উনি রাজনীতিতে আইয়েন। এইদিকে বড়োসাহেবও তার পোলারে রাজনীতিতে আনে। পরে দুজনের মধ্যে আরো প্যাঁচ লাগাইয়া দেন। আর এই প্যাঁচেই দুজনের সম্পর্কের আজ এই অবস্থা। মূলত এই সবকিছু করছেন আমাদের বড়োসাহেব। উনিই সাদরাজের কানে বিষ ঢালতে ঢালতে উনারে আজ এত খারাপ বানাইছেন। নাইলে আমরার এই সাহেব তো ছিল আমাদের ম্যাডামের মতো, ভালা মানুষ। এই লোকটাই তারে খারাপ বানাইছে।’
মেহুল তখন জিজ্ঞেস করে,
‘কিন্তু, এত কথা আপনি কী করে জানলেন?’
‘আমি এই বাড়িতে আছি আজ থেকে ত্রিশ বছর। এই বাড়ির সব খবর আমি রাখি। এই বাড়ির মানুষগুলারে আমি আমার নিজের মানুষ ভাবি। ম্যাডামরে যে বড়োসাহেব মারছে এইডা সাহেব কাউরে ফোনে কইতাছিল। আমি তহনই শুনছি। আর উনি কেমনে কেমনে রাবীর খানরে ফাঁসাইছে সব আমি শুনছি। আমি সব জানি।’
রিতা বলল,
‘তাহলে, তখন আপনি পুলিশের কাছে কেন কিছু বলেননি?’
‘ওমা গো, পুলিশ! আমি পুলিশের কাছে কইলে হেরা আমারে বাঁচায় রাখতো?’
‘তাই বলে আপনি একজন নিরপরাধকে শাস্তি পেতে দেখলেন?’
খালা হেসে বললেন,
‘নিজের জান সবার প্রিয়। আমি কেন মরতে যামু, কন?’
চলবে…