#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৯।
রুমে এসে মেহুল প্রথমবারের মতো রাবীরকে টি শার্ট আর ট্রাউজার গায়ে দেখে। রাবীরকে এভাবে দেখে ভীষণ অন্যরকম লাগে। সবসময়ই একভাবে দেখে আসতে আসতে আজ যেন চোখে তাকে নতুন লাগছে। রাবীর তার দিকে চেয়ে বলে,
‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন।’
মেহুল ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে রাবীরের পাশে বসে। রাবীর জিজ্ঞেস করে,
‘মন খারাপ?’
মেহুল মাথা ঝাঁকিয়ে না করে। রাবীর পুনরায় বলে,
‘রিতার হচ্ছে দুশ্চিন্তা হচ্ছে তাই না?’
মেহুল মৃদু সুরে বলে,
‘ওর সাথে অন্যায় হয়েছে। ও তো সিয়ামকে পছন্দ করতো। ও কখনোই নিজের ইচ্ছাতে সাদরাজ আহমেদকে বিয়ে করবে না। নিশ্চয়ই ঐ লোকটা ওকে ভয় দেখিয়েছে।’
‘রিতার সবথেকে দূর্বলতম জায়গা কোনটা? উনার মা বাবা, তাই না। কিন্তু উনারা তো আজ পুরোটা দিন আমাদের চোখের সামনেই ছিলেন। তবে সাদরাজ রিতাকে অন্য আর কার ভয় দেখিয়েছে?’
‘সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। আর ওর সাথে কথা না বলে কিছু বুঝতেও পারব না।’
‘হু। আচ্ছা, আপনি এখন শুয়ে পড়ুন। আজ অনেক ধকল গিয়েছে। ঘুমানো প্রয়োজন। নয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
এই বলে রাবীর উঠতেই মেহুল বলল,
‘আপনি শুবেন না?’
‘হ্যাঁ, আসছি। একটা জরুরি কল করতে হবে।’
‘আচ্ছা।’
রাবীর বারান্দায় যায়। মেহুল একপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। রিতা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে? রিতার জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। সাদরাজ খারাপ লোক। সে রিতাকে যদি ভালোবেসে বিয়ে করতো তাহলেও কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু, সে তো রিতাকে বিয়ে করেছে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে; ভালোবেসে না। মেহুল শুয়ে শুয়ে দু হাত কচলাচ্ছে আর ভাবছে যেভাবেই হোক খুব দ্রুত তাকে রিতার সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
বারান্দা থেকে কথা শেষ করে রাবীর রুমে এসে দেখে মেহুল ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই সে রুমের দরজা আটকে লাইট অফ করে তার পাশে এসে বসে। মেহুলের মাথার উপর হাত রাখতেই হুট করে তার মনে পড়ে, সে মেহুলের জন্য কিছু একটা এনেছিল। কিন্তু, সেটা তো আর দেওয়াই হলো না। সে আবার উঠে গিয়ে আলমারি খুলে একটা ছোট্ট বক্স বের করে। তারপর আবার গিয়ে মেহুলের পাশে বসে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে মেহুল এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রাবীর সেই বক্স থেকে একটা চেইনসহ পেনড্যান্ট বের করে আস্তে করে মেহুলের গলায় পরিয়ে দেয়। ঘুমের ঘোরে মেহুল কিছু টেরও পায়নি। পরানো শেষে রাবীর মুচকি হাসে। মেহুলের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে সেও পাশে শুয়ে পড়ে।
_______
ঘুমের মাঝেই ভীষণ আলোর ঝাপটা টের পাচ্ছে মেহুল। আরামের ঘুমটা তখন সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে যায়। সে তাকিয়ে দেখে চারদিকে রোদে ঝলমল করছে। এত রোদ! রুমের দরজা জানলার সব পর্দা কেউ খুলে দিয়েছে। মেহুল বিরক্ত হয়ে উঠে বসে। ঘড়িতে চেয়ে দেখে কেবল আটটা বাজতে চলল। আর এর মাঝেই সূর্যের আলো যেন পুরো রুমকে গিলে খাচ্ছে। মেহুল পাশে তাকিয়ে দেখে রাবীর নেই। রাবীর যে সকাল সকাল উঠে সে জানে। তাই সেও তখন ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতেই হঠাৎ তার গলার দিকে চোখ যায়। চেইনের মতো কিছু একটা দেখে টান দিতেই একটা পেনড্যান্ট সামনের দিকে আসে। যেটা দেখে মেহুল খুব অবাক হয়। আয়নায় যেভাবে এটা চিকচিক করছে মনে হচ্ছে ডায়মন্ড। সে তখন বুঝতে পারে, এটা রাবীর নিশ্চয়ই কাল রাতে ঘুমের মধ্যে তাকে পরিয়ে দিয়েছিল। সে মুচকি হাসে। মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। শাড়িটা এলোমেলো হয়ে আছে। সেটা ঠিক করে। চুল বাঁধে। গলার পেনড্যান্ট’টা যেন বারবার তার নজর কাড়ছে। সুন্দর লাগছে জিনিসটা। মেহুল তারপর নিচে যায়। তখনও বাসার কেউ উঠেনি। খালি কাজের খালারা ছাড়া। মেহুল ড্রয়িং রুমে যেতেই রাবীর তখন মেইন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে। রাবীরকে দেখে মেহুল দাঁড়ায়। রাবীর ঘেমে গেয়ে একাকার হয়ে আছে। গলায় ঝুলানোর মাঝারি সাইজের টাওয়ালটা দিয়ে ঘাম মুছছে। মেহুলকে দেখে সে মুচকি হেসে বলে,
‘গুড মর্নিং।’
মেহুলও হেসে বলে,
‘গুড মর্নিং।’
রাবীর এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,
‘এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন যে।’
‘যাওয়ার সময় এভাবে উঠার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলে কি আর ঘুমানো যায়? আপনার রুমে অনেক রোদ আসে।’
রাবীর হাসে। বলে,
‘যাক তাহলে, আমাকে আর কষ্ট করে ডাকতে হয়নি। আচ্ছা, আপনি আসুন। আমি গিয়ে ফ্রেশ হচ্ছি।’
রাবীর যাওয়ার সময় মেহুল জিজ্ঞেস করে,
‘চা খাবেন নাকি কফি?’
‘কফি।’
‘আচ্ছা।’
মেহুল রান্নাঘরে গিয়ে দেখে খালা কাজ করছেন। মেহুল উনার দিকে চেয়ে বলে,
‘খালা, আমাকে একটু কফি পাউডার, দুধ আর চিনির বৈয়ামটা বের করে দাও। আমি কফি বানাব।’
খালা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
‘না না ছোট খালা, আপনার বানাইতে হইতো না। আপনি কন আমি করে দিতেছি।’
‘না খালা, তুমি তোমার কাজ করো। আমি রাবীরের জন্য নিজের হাতে কফি বানাব।’
খালা তখন হেসে বললেন,
‘ওহহ, আইচ্ছা। ভালোবাইসা বানাইবেন। দাঁড়ান, আমি সব বের করে দিই।’
________
মেহুল কফির মগগুলো হাতে নিয়ে বারান্দায় যায়। রাবীর গোসল করে বেরিয়েছে মাত্র। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাথা মুছছিল। মেহুল তার দিকে একটা কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘আপনার কফি।’
রাবীর টাওয়ালটা নেড়ে দিয়ে কফির মগটা হাতে নেয়। তারপর সে এক সিপ খেয়ে বলে,
‘মেবি চিনিটা একটু কম হয়েছে। আমি আরেকটু চিনি দিয়ে খাই।’
মেহুল তখন রাবীরের দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল। সে মনে মনে অন্যকিছু ভাবল। তারপর রাবীরকে বলল,
‘দেখি।’
রাবীরের হাত থেকে কফির মগ নিয়ে সেও এক সিপ খেল। বলল,
‘ঠিকই তো আছে।’
রাবীর তখন বলল,
‘আপনি হয়তো কম চিনি খান। তাই আপনার জন্য এটা ঠিক আছে। তবে আমার কফিতে একটু বেশি চিনি লাগে।’
মেহুল জিজ্ঞেস করল,
‘এখন দিয়ে আনব?’
‘না, থাক। এখন আর কষ্ট করে নিচে নামতে হবে না।’
এই বলে সে মেহুলের কাছ থেকে কফির মগটা নিয়ে খেতে আরম্ভ করে। মেহুল তার দিকে কপাল কুঁচকে চেয়েই থাকে। রাবীর চেয়ে বলে,
‘কী হলো, আপনি খাচ্ছেন না কেন? কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।’
মেহুল মুখ কালো করে অন্যদিকে তাকায়। কোথায় সে ভেবেছিল, সে কফিতে চুমুক দেওয়ার পর রাবীর বলবে, “আপনার ঠোঁটের ছোঁয়াতেই আমার কফি মিষ্টি হয়ে গিয়েছে, আমার আর মিষ্টি লাগবে না।” তা না, সে কিছু না বলে এই কফিই গিলে যাচ্ছে। নিরামিষ কোথাকার!
কফি খাওয়া শেষ করে মেহুলে মগটা রাবীরের হাত থেকে নিয়ে চলে যেতে নিলেই রাবীর তাকে আবার ডেকে উঠে,
‘মেহুল।’
মেহুল চেয়ে বলে,
‘কী?’
‘আপনার কাছ থেকে নেওয়ার পর কফিটা মিষ্টি হয়ে গেল কী করে বলুন তো?’
মেহুল ভ্রু কুঁচকায় সঙ্গে সঙ্গে। রাবীর ভ্রু নাচিয়ে বলে,
‘কী হলো, বলুন।’
মেহুল নাক ফুলিয়ে বলে,
‘জানি না।’
এই বলে সে দ্রুত নিচে নেমে যায়। আর রাবীর তখন তার যাওয়া দেখে শব্দ করে হেসে উঠে।
_______
রিতা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা তার। চোখ মেলে তাকিয়ে যেন সবকিছু ঝাপসা দেখছে। তাও কোনোরকমে চোখ খুলে চাইল। চেয়ে দেখল একটা বয়স্ক মহিলা তার দিকে হা করে চেয়ে আছে। সে বুঝতে পারল না প্রথমে। পরে নিজের দিকে তাকাতেই লজ্জা পেয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিল। কোনোরকমে উঠে বসল। মহিলাটা বলল,
‘ম্যাডাম, আপনার কফি। স্যার কইছে, নিচে গিয়া নাস্তা করতেন। আর আপনার জামা কাপড়সহ যা যা লাগব সব আলমারিতে আছে।’
রিতা ঢোক গিলল। কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,
‘একটু পানি দিবেন।’
মহিলাটা একটা পানির গ্লাস তার দিকে এগিয়ে দিল। রিতা ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলল। মহিলাটাকে বলল,
‘ঐ লোকটা কোথায়?’
মহিলাটা ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘কোন লোকডা?’
‘সাদ-সাদরাজ আহমেদ।’
মহিলা হেসে বলে,
‘ওমা, লোকডা কী? উনি তো আপনার স্বামী লাগেন।’
রিতা চেঁচিয়ে বলল,
‘আমি মরে গেলেও ঐ লোকটাকে আমার স্বামী হিসেবে মেনে নিব না। জানোয়ার একটা।’
মহিলাটা ভয়ে তার মুখ চেপে ধরে। বলে,
‘চুপ চুপ। কী কন এডি? এই বাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে। স্যারের কানে গেলে স্যার মাইরাই ফেলব।’
রিতা তখন শব্দ করে কেঁদে উঠল। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,
‘এই লোকটার সাথে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। ঐ লোকটা মানুষ না। মানুষ হলে উনি কখনোই আমার সাথে এমনটা করতেন না।’
মহিলাটা বলল,
‘এডাই তো স্বামীর ভালোবাসা।’
রিতা চেঁচিয়ে বলে,
‘এটা ভালোবাসা? না, এটা ভালোবাসা না। এটা লোভ। নারীর শরীরের প্রতি পুরুষের লোভ। আর এই লোভ আর যাই হোক ভালোবাসার মতো পবিত্র জিনিস হতে পারে না।’
চলবে…
#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪০।
রাবীর নাস্তা খেয়ে কোনো একটা কাজে বেরিয়ে যায়। আর মেহুল নাস্তা খেয়ে তার রুমে চলে আসে। বিছানায় বসে ফোনটা হাতে নেয় রিতাকে কল করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু রিতার নাম্বারে কল করে দেখে তার নাম্বার এখনো বন্ধ বলছে। মেহুল এবার চিন্তায় পড়ে ভাবে, নাম্বার বন্ধ থাকলে রিতার সাথে যোগাযোগ করবে কী করে। এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও পাচ্ছে না সে।
মেহুল রুমে এই নিয়েই দুশ্চিন্তা করছিল। তখন তার শাশুড়ি মা এলেন। তিনি এসে বললেন,
‘মেহুল, গোসল সেরে তৈরি হয়ে নাও। পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই তোমাকে দেখতে আসবেন।’
ব্যাপারটা মেহুলের কাছে খুব বিরক্তির হলেও সে মুখে হাসির রেখা টেনে বলল,
‘আচ্ছা, মা।’
তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল করতে।
_______
‘আমি কিছু খাব না।’
‘না খাইলে সাহেব বকবেন।’
‘বকলে বকবে। আমি খাব না বললাম তো। নিয়ে যান এগুলো।’
‘মা গো, এমন কইরেন না। আপনি না খাইলে সাহেব আমারে শাস্তি দিবেন। দয়া কইরা এইটুক খাইয়া ফেলেন।’
রিতা চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
‘আচ্ছা, এই লোকটা এত খারাপ কেন? উনার মধ্যে কি নূন্যতম বিবেক নেই। এত খারাপ একটা মানুষ হয় কী করে?’
মধ্য বয়স্কা মহিলাটি হাসলেন। তিনি হাসলে তার পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো কুৎসিত লাগে। তিনি বললেন,
‘মানুষ এমনি এমনি খারাপ হয় না। মানুষরে খারাপ বানানো হয়। জানেন তো, প্রত্যেক মানুষের সাথেই একটা শয়তান থাহে। যে সারাডাদিন খালি চিন্তা করে কেমনে মানুষরে খারাপ বানাইবো। আর হেই মানুষ যদি একবার শয়তানের ধোঁকায় পইড়া যায়, তাইলেই শেষ। আর হেই মানুষরে তহন খারাপ হওয়া থেইকা কেউ বাঁচাইতে পারে না। বুঝছেন?’
রিতা তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বলে,
‘খালা, আপনার ঐ সাহেবকে বোধ হয় শয়তানও দেখে মনে মনে ভাবে, এই মানুষটা দেখি তার থেকেও বড়ো শয়তান।’
খালা আবারও হাসলেন। বললেন,
‘আপনি বুঝেন নাই কিছু। থাক, আপনি খাইয়া লন।’
‘আমি খাবো না খালা। নিয়ে যান এগুলো।’
‘না খাইলে শক্তি কই পাইবেন? খাইতে হইব। শরীরে শক্তি করতে হইব। তাইলেই না লড়াই করতে পারবেন। শক্তি ছাড়া কেমনে দাঁড়াবেন?’
‘লড়াই? কার সাথে? সাদরাজ আহমেদের সাথে? আপনার মনে হয়, আমার মতো একটা মেয়ে ঐ সাদরাজ আহমেদের সাথে লড়াই করে পারবে? কখনোই না।’
খালা নিচে পা ছড়িয়ে বসলেন। রিতা বলল,
‘নিচে বসলেন কেন? উপরেই বসুন।’
‘না। হুনেন একটা কথা। মাইয়া মানুষের সবথেকে বড়ো শক্তি কি জানেন?’
রিতা কপাল কুঁচকে বলল,
‘কী?’
‘ভালোবাসা।’
‘ভালোবাসা?’
রিতা অবাক হয়। খালা বলে,
‘হ, ভালোবাসা। জানেন, মাইয়া মানুষের ভালোবাসার অনেক ক্ষমতা। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না এই ভালোবাসা কী করতে পারে। মাইয়া মানুষ তার এই ভালোবাসার অস্ত্র দিয়া নিজের সবথেইকা বড়ো শত্রুরেও অনায়াসে খু ন করতে পারে। এই ভালোবাসা অনেক শক্তিশালী।’
রিতা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে,
‘এই ভালোবাসা দিয়ে আমি কী করব?’
‘খুন করবেন।’
রিতা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলে,
‘খুন করব? কাকে?’
‘সাদরাজ আহমেদরে।’
রিতা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজায়। সময় নিয়ে বলে,
‘আপনি ঘুরে ফিরে এখন এটা বলতে চাইছেন যে, আমাকে এখন সাদরাজ আহমেদ ভালোবাসতে হবে?’
‘হ, হেডাই।’
‘বেঁচে থাকতে এটা আমার জন্য সম্ভব না।’
‘আরে খালা, আপনি দেহি কিছুই বুঝেন না।’
‘খালা, মাথা ধরেছে খুব। আমি এখন কিছু বুঝতে চাই না। তুমি এসব নিয়ে যাও এখান থেকে।’
‘খালা গো, আমি তো আপনার ভালোর জন্যই কইতেছিলাম। ভালোবাসা দিয়া সব সম্ভব। আপনারে তহন কইলাম না, মানুষ এমনিই খারাপ হয় না। তারে খারাপ বানানো হয়। তেমনিই আমাগো সাহেব। জন্ম থেইকাই কেউ খারাপ হইয়া জন্মায় না। শয়তান খারাপ বানায়। আর আপনি যদি আপনার ভালোবাসা দিয়া একবার সাহেবের মনরে ভুলাইতে পারেন, তাইলেই দেখবেন চারদিকে কত সুখ, কত শান্তি। আমার কথাডা মাথায় রাইখেন খালা। আর খানাডি খাইয়া ফেলান। আমি নিচে যাই। আমার অনেক কাজ।’
খালা চলে গেলেন। রিতা মুখ ভার করে বসে থাকলেও বেশিক্ষণ খাবার না খেয়ে থাকতে পারল না। কাল রাতেও সে কিছু খায়নি। খুব খিদে পেয়েছে। তাই আর রাগ না দেখিয়ে চুপচাপ খাবারটা খেয়ে নিল সে।
খাবার খাওয়ার মাঝেই খালার বলা কথাগুলো মাথায় বাজতে লাগল তার। সাদরাজ আহমেদ এমনিতে খারাপ হননি? তাকে খারাপ বানানো হয়েছে? আর সে কি আদৌ কোনোদিন তাকে ভালোবাসতে পারবে? না, কোনদিনই না। তার মনে তো এখনও শুধু সিয়াম। সে তাকে ছাড়া অন্য আর কাউকে নিয়েই ভাবতে পারবে না। ঐ সাদরাজ আহমেদকে তো ভুলেও না। যেভাবেই হোক সে এখান থেকে পালাবে।
রিতা খেয়ে আস্তে করে দরজা খুলে বাইরে বের হলো। উপরের তালায় কেউ নেই। সে এদিক ওদিক ভালোভাবে খেয়াল করল। তারপর সিঁড়ির কাছে যেতেই নিচে কাজের লোকদের দেখল। তারা মোছামুছি করছেন। রিতা আর নিচে নামল না। তার ফোনটাও সে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। সাদরাজ আহমেদ এটা কোথায় রেখেছে কে জানে। রিতা এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে একটা রুমে যায়। রুমটা একটু অন্ধকার ছিল। তাই সে লাইটের সুইচ খুঁজে বের লাইট জ্বালায়। রুমে আলো আসতেই সে দেখে রুমটা বেশ অগোছালো। অনেকগুলো ফাইল এখানে স্তুপ করে রাখা। কিছু ভাঙ্গা ফার্নিচার আছে। আর কিছু ময়লা কাপড় চোপড়। অনেকটা স্টোর রুমের মতো। রিতার কী মনে হলো, সেই এই রুমেই বিভিন্ন জিনিস নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখতে লাগল তার ফোনটা আছে কিনা। কিন্তু মোবাইল সে কোথাও পায়না। পরে একটা ভাঙ্গা কাবার্ড খুলে সে।সেখানের ড্রয়ারগুলো খুলে দেখে ভেতরে আছে কিনা। তবে সেখানেও কিছু ফাইল ছাড়া আর কিছু পায়নি। তবে তখন আরেকটা জিনিস হঠাৎ তার চোখে পড়ল। একটা ছবি। সে ফাইলের নিচ থেকে ছবিটা বের করল। খুব ময়লা পড়ে আছে বিধেয় ছবিটা কার বোঝা যাচ্ছে না। সে ছবিটা তার ওড়না দিয়ে পরিষ্কার করে। যদিও মানুষগুলোর মুখ স্পষ্ট না। তাও সে মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। ছবির মধ্যে সাদরাজকে সে চিনতে পারে। অনেক আগের ছবি হয়তো, সাদরাজকে তাই এই ছবিতে অন্যরকম লাগছে। তবে তার পাশে আরেকটা ছেলে দাঁড়ানো। যার কাঁধে হাত রেখে সাদরাজ চমৎকার ভাবে হেসে আছে। ঐ ছেলেটাকে রিতার খুব চেনা চেনা লাগে। চেহারাটা খুব পরিচিত তার। কে হতে পারে ভাবতে ভাবতেই হুট করে তার মনে হয়, আরে, এটা তো রাবীর ভাইয়া। সে চমকে যায়। হ্যাঁ, এটা রাবীর। তখন রাবীরের দাঁড়ি ছিলনা। একদম ক্লিন সেইপ ছিল বলে প্রথমে বোঝা যাচ্ছিল না। আশ্চর্য, উনারা দুজন এভাবে কবে ছবি তুলেছেন। দুজনের মুখেই চওড়া হাসি। যেন একজন অন্যজনের ভীষণ আপন। রিতা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না।
তাই সে ছবিটা নিয়ে দ্রুত নিচে নামে। খালাকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে যায়। খালাকে জিজ্ঞেস করে,
‘খালা, এই ছবিতে এই ছেলে দুজন কে?’
খালা ছবিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে। পরে হেসে বলে,
‘চিনতে পারেন নাই?’
‘না।’
‘আপনার শোয়ামি গো মা।’
‘আর সাদরাজের সাথের জন কে?’
খালা হাসলেন। বললেন,
‘উনি? উনি তো আপনার শোয়ামির খুব কাছের মানুষ।’
‘কে খালা, বলেন।’
‘রাবীর খান।’
রিতা অবাক হয়ে আবার ছবিটা দেখে। জিজ্ঞেস করে,
‘উনারা এই ছবি কখন তুলেছেন?’
‘এডা অনেক আগের ছবি। উনারা তহন ভার্সিটিত পড়তেন।’
‘আচ্ছা, উনারা কি দুজন বন্ধু ছিলেন?’
‘হ। খালি বন্ধু না; একজন অন্যজনের জানের জিগার আছিল। আহা, কী যে ভালোবাসতো একজন অন্যজনেরে।’
রিতা অবাক হয়ে বলল,
‘তাহলে উনাদের মধ্যে এত শত্রুতা তৈরি হলো কীভাবে? এখন তো উনারা একজন অন্যজনকে দুই চোখেও সহ্য করতে পারে না।’
‘কেমনে পারব? আমি কইছিলাম না, মানুষেরে দিয়া সব ভুল কাজ করায় শয়তান। উনাদের মাঝেও শয়তান আছিল। শয়তান আইয়া উনাদের সুন্দর সম্পর্কডারে ধ্বংস করে দিছে।’
‘খালা, আপনি আমাকে সবকিছু খুলে বলুন না।’
রিতা অস্থির হয়ে পড়ে। খালা বলে,
‘হে তো অনেক বড়ো ইতিহাস। এহন আমার অনেক কাজ। পরে কমু।’
রিতার বিস্ময় যেন এখনো কাটছেই না। সাদরাজ আর রাবীর একসময় বন্ধু ছিল?
চলবে…