#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৭।
“এত বড়ো নেতার বিয়ে, সাংবাদিক তো আসবেই।”
আশেপাশে এমনই সব গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সাংবাদিক দেখে অনেকেই বেশ উৎসুক। অনেকে আবার এমন একটা ভাব নিয়ে আছে যেন, তাদের এসবে বড্ড জ্বলছে। সাংবাদিকরা সব মেহুল অর রাবীরকে প্রশ্ন করতে ব্যতিব্যস্ত। যদিও সব প্রশ্নের উত্তর কেবল রাবীর’ই দিচ্ছে। মেহুলের মাথায় এমনি বিশাল দুশ্চিন্তা। তার উপর এখন আবার সাংবাদিকের এত এত প্রশ্নে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে সে। না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে। রাবীর বুঝতে পারছে ব্যাপারটা। তাই সে বেশি সময় না নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘প্রশ্নের পালা শেষ হয়ে থাকলে এবার আপনারা গিয়ে খেতে বসুন। আসলে মেহমানরাও অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছেন। উনাদেরও একটু সময় দিতে হবে।’
একজন সাংবাদিক তখন বললেন,
‘জি, আমরা অবশ্যই খেতে বসব। তবে শেষ একটা প্রশ্ন; আপনার ওয়াইফ আপনাকে রাজনৈতিক ব্যাপারে কতটুকু সাপোর্ট করেন? আপনার এত ব্যস্ততায় উনার কোনো অভিযোগ নেই?’
রাবীর প্রশ্ন শুনে মেহুলের দিকে তাকাল। বলল,
‘এই প্রশ্নের জবাব আমার ওয়াইফ’ই ভালো দিতে পারবেন।’
মেহুল হালকা হাসার চেষ্টা করল। মৃদু সুরে বলল,
‘আমার উনার কিছুতেই কোনো অভিযোগ নেই। আর ভালো কাজে তো সবাই সাপোর্ট করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে উনি উনার এত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে যতটুকু সময় দিচ্ছেন আমি তাতেই খুশি।’
‘আর ম্যাডাম, আপনিও কি সবকিছুতে স্যারের সাপোর্ট পাচ্ছেন? মানে আপনার সব ইচ্ছা অনিচ্ছাতে?’
মেহুল রাবীরের দিকে তাকায়। রাবীরও তার দিকে চেয়ে আছে। রাবীর জানে মেহুলের উত্তর কী হবে। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে মেহুল বলল,
‘জি, উনিও আমার সবকিছুকে সাপোর্ট করেন। অবশ্যই সেটা যদি আমার জন্য ভালো হয় তবে।’
‘ঠিক আছে ম্যাডাম। আমরা আর বিরক্ত করব না। এবার আপনারা আপনাদের বিয়ে এনজয় করুন।’
রাবীর একজনকে ডেকে বলল, সব সাংবাদিকদের খাবার টেবিলে বসানোর জন্য।
তারপর সে গিয়ে আবার মেহুলের পাশে বসে। মেহুলের চোখে মুখে এখনো চিন্তার ছাপ। রাবীর জিজ্ঞেস করল,
‘রিতার ফোন এখনো বন্ধ?’
মেহুল অসহায় সুরে বলে,
‘হ্যাঁ।’
‘কোনো সমস্যায় পড়েছে নাকি?’
‘আমিও তাই ভাবছি। নয়তো এমনি এমনি ও কেন উধাও হয়ে যাবে? ঐ দেখুন, রিতার মা বাবাও কেমন অস্থির অস্থির করছেন। উনারাও ভীষণ দুশ্চিনায় আছেন।’
‘আচ্ছা, কোনো আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুর বাড়ি যায়নি তো?’
‘গেলে অবশ্যই বলে যেত। এভাবে না বলে কয়ে চলে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই।’
‘হ্যাঁ, তাও ঠিক। আচ্ছা, আপনি উনার ফোন নাম্বার’টা দিন। আমি আমার পরিচিত একজনকে পাঠিয়ে রাখি, উনি লোকেশেন ট্র্যাস করতে পারবেন।’
‘তাই? দাঁড়ান দিচ্ছি।’
রাবীর তার পরিচিত ব্যক্তিকে রিতার ফোন নাম্বার’টা পাঠিয়ে দেয়। মেহুলকে আশ্বস্ত করে বলে,
‘এবার ঠিক একটা খোঁজ পাওয়া যাবে। আর চিন্তা করবেন না।’
________
বিয়ে তো আগেই হয়ে গিয়েছিল। আজ কেবল খাওয়া দাওয়া আর পরিচিত পরিজনদের সাথে সাক্ষাতের পর্বটা সমাপ্তি হয়েছে। রাবীরের বাড়ি থেকেও খুব বেশি আত্মীয় আসেনি। রাবীর’ই বারণ করেছিল। সে বলেছে, আত্মীয়স্বজন যা আসবে সব তার রিসিপশনে। এই বিয়ের অনুষ্ঠানে এত ঝামেলার কোনো দরকার নেই। তাই খুব কাছের মানুষদের উপস্থিতিতেই সবকিছু সম্পন্ন হয়েছে।
________
মেয়ে বিদায়ের পালা। এইসময় মায়ের চোখের বাঁধ ভাঙে। রামিনা বেগম অঝোরে কাঁদছেন। উষ্ণ জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। মেহুলের বাবা খুব শক্ত মানুষ। সহজে কাঁদেন না। তবে তিনিও আজ কাঁদছেন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। এই কান্নার, এই বেদনার অন্ত নেই। যত কাঁদবে তত আরো কান্না পাবে। মেহুলও কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বেচারি যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। তার এখন রিতার জন্যও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা এখন কেন তার পাশে নেই। তার তো আজকে এখানে, তার পাশে থাকার কথা ছিল। তবে সে কেন নেই? মেহুল কাঁদতে কাঁদতে মা’কে বলে,
‘মা, রিতা এখনো কেন আসছে না? ওর কী হয়েছে মা? ও কোথায় গিয়েছে?’
রামিনা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে বোঝাচ্ছেন। রিতার মাও ঐদিকে কাঁদছেন। রিতার বাবা আরো আগেই বেরিয়ে গেছেন মেয়ের খুঁজে।
আশেপাশের সবাই এখন অবাক হচ্ছে। রিতা কে? নতুন বউ রিতার জন্য কেন কাঁদছে? রাবীরের মা গিয়ে তাকে এই প্রশ্নটাই করে। রাবীর মা’কে সব খুলে বলে। তিনিও অবাক হয়ে বলেন,
‘ওমা, জলজ্যান্ত একটা মেয়ে সকাল থেকে উধাও!’
‘হ্যাঁ, মা। এইজন্যই তো মেহুলের মন সকাল থেকেই এত খারাপ। মেয়েটা রিতার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে।’
‘রিতার মা বাবা জানেন?’
‘হ্যাঁ, ঐ যে উনার মাও কাঁদছেন।’
রাবীরের মা’র ভীষণ মায়া হয়। তিনি মেহুলের কাছে গিয়ে বলেন,
‘মা, কষ্ট পেও না। তোমার বান্ধবী ঠিক চলে আসবে। হয়তো কোনো সমস্যার কারণে কোথাও আটকে পড়েছে। চলে আসবে মা। আর কাঁদে না। এবার তো আমাদের যেতে হবে, তাই না। উঠো মা, উঠো।’
তিনি মেহুলকে বসা থেকে ধরে দাঁড় করান। মেহুল ধীর পায়ে রিতার মায়ের কাছে যায়। ভাঙা গলায় বলে,
‘রিতা চলে আসবে আন্টি। আমি খুঁজে নিয়ে আসব ওকে। আপনি চিন্তা করবেন না, ও চলে আসবে।’
রিতার মা কিছু বলেন না। তিনি শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে কাঁদেন।
.
চাচি মেহুলকে ধরে ধরে সেন্টারের বাইরে নিয়ে যায়। মেহুলের বাবা মেয়ের হাত রাবীরের হাতে দিয়ে বলেন,
‘আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো, বাবা। ও আমাদের একমাত্র সম্পদ। আজ সেই সম্পদকে আমি তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি আমাদের সম্পদের যত্ন নিও।’
রাবীর স্মিত হেসে বলে,
‘জি, চিন্তা করবেন না। নিজের সবটুকু দিয়ে উনাকে আমি ভালো রাখার চেষ্টা করব।’
মেহুল বাবাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর দুজন তাদের মা বাবাকে সালাম করে। অতঃপর যখন গাড়িতে উঠতে যাবে ঠিক সেই সময়ই একটা গাড়ি আসে। গাড়িটা দেখে সবার মনোযোগ সেদিকেই যায়। রাবীর ভ্রু কুঁচকায় গাড়িটা দেখে। গাড়িটা তার চেনা চেনা লাগে। একটু পর গাড়ি থেকে নেমে আসা ব্যক্তিটাকে দেখে রাবীর যেন আরো বিস্মিত হয়। সাদরাজ এখানে কেন? মেহুলও স্তব্ধ। সাথে তাদের মা বাবাও। সাদরাজের মুখে চওড়া হাসি। যেন খুব দামি বস্তু সে জিতে নিয়েছে। রাবীর ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,
‘তুমি এখানে কেন?’
‘মিষ্টি খাওয়াতে এসেছি।’
সাদরাজের মুখে অদ্ভুত হাসি। রাবীর অবাক হয় তার কথা শুনে। সাদরাজ হেসে বলে,
‘অবাক হচ্ছো? তা তো হবেই। দাঁড়াও, একটা সারপ্রাইজ দেই। কোথায়? আমার একমাত্র ওয়াইফ, মিসেস সাদরাজ আহমেদ? এসো।’
সবাই হতভম্ব হয়ে গাড়ির দিকে তাকায়। সাদরাজ এর বউ?
গাড়ি থেকে একটা মেয়ে নামল। মেয়েটার চোখে মুখে ভয় আর অস্থিরতা। তাকে দেখা মাত্রই মেহুলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে যেন কথা হারিয়ে ফেলেছে। গলায় কথা জড়িয়ে আছে। মুখ দিয়ে তবুও কিছু বের হচ্ছে না। সাদরাজ মেয়েটার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে। তাকে নিয়ে এসে সবার সামনে দাঁড়ায়। আগের মতোই হেসে বলে,
‘সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই, আমার ওয়াইফ; মিসেস রিতা আহমেদ।’
রিতার মাও বাকরুদ্ধ। আত্মীয়স্বজন যেই কয়জনই আছেন সবাই’ই যেন বিস্ময়ে কিছু বলতে পারছেন না। এখানে কী হচ্ছে, সবকিছু তাদের ধারণার বাইরে। রিতার মা মেয়ের কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
‘এসব কী, রিতা?’
রিতা জবাব দেয় না। তিনি চিৎকার করে বললেন,
‘কী হলো, চুপ করে আছিস কেন? বল, কী এসব? তুই বিয়ে করেছিস? পালিয়ে বিয়ে করেছিস? এত বড়ো সাহস তোর?’
এই বলে তিনি তাকে চড় মারতে উদ্যত হতেই সাদরাজ উনার হাত ধরে ফেলে। সে বলে,
‘উঁহু শাশুড়ি মা, আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলার সাহস দেখাবেন না। ও যা করেছে আমার ইচ্ছাতেই করেছে। ও এখন আমার স্ত্রী। তাই ভুলেও ভবিষ্যতে এমন কিছু করতে যাবেন না।’
রিতার মা’র শরীর আষাঢ় হয়ে এল। তিনি এক কোণে গিয়ে বসে পড়লেন। তার মেয়ে যে এমন কিছু করতে পারে তিনি তা কখনো কল্পনাও করেননি।
রাবীর আর নিরব থাকতে পারে না। সে রিতাকে জিজ্ঞেস করে,
‘রিতা, সত্যিই আপনি সাদরাজকে বিয়ে করেছেন? নিজের ইচ্ছাতেই করেছেন, নাকি ও আপনাকে ভয় দেখিয়েছে? দেখুন, আপনি ভয় পাবেন না। সত্যিটা বলুন। আমরা আছি সবাই।’
চলবে…
#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৮।
রিতা মাথা নুইয়ে নরম গলায় বলল,
‘আমি নিজের ইচ্ছেতেই বিয়ে করেছি। কেউ আমাকে জোর করেনি।’
রিতার মুখের কথা আর তার চোখের ভাষা এক না। রাবীর সেটা বেশ বুঝতে পারছে। সে মেহুলের দিকে তাকায়। মেহুল এখনো অবাক হয়ে রিতাকে দেখছে। বিশ্বাস যেন এখনো তার ধারে কাছে ঘেষছে না। সাদরাজ এবার বলল,
‘মেহুল, আপনি খুশি নন? আপনার একমাত্র বেস্টফ্রেন্ড বিয়ে করেছে, আর আপনি তাতে খুশি হওয়ার বদলে এমন মনমরা হয়ে আছেন কেন?’
মেহুল চোখ মুখ কুঁচকে সাদরাজের দিকে তাকায়। রিতাও ভীত চোখে তাকায় তার দিকে। সাদরাজ হেসে বলে,
‘দোয়া করবেন আমাদের জন্য। আর রাবীর খান, তোমাদের জন্যও আমার অনেক অনেক দোয়া রইল। সুখে সংসার করো। আর তোমাদের সংসারে যেন কারো নজর না লাগে।’
তারপর সে রিতার দিকে চেয়ে বলে,
‘তোমার আর কিছু বলার আছে? নাহলে আমাদের এখন যেতে হবে।’
রিতা ভয়ে ভয়ে বলে,
‘আমি একটু মায়ের সাথে কথা বলব।’
‘ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি কথা বলে এসো।’
রিতা এক পা দু পা করে মায়ের দিকে এগিয়ে যায়। তার মা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছেন। রিতা মায়ের পায়ের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে। কান্না ভেজা স্বরে বলে,
‘আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।’
তিনি কোনো কথা বলেন না। শক্ত হয়ে বসে রইলেন কেবল। মায়ের কাছ থেকে কোনোরূপ উত্তর না পেয়ে রিতা উঠে দাঁড়ায়। সে মেহুলের কাছে যায়। তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। শব্দ করে কেঁদে ফেলে। মেহুলও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সেও রিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘এমনটা কেন করলি? তুই তো সিয়ামকে পছন্দ করতি। তাহলে?’
রিতা কিছু বলতে পারে না। সে শব্দ করে কেঁদে চলছে।সাদরাজ বলে,
‘রিতা সিয়াম নামের কাউকে পছন্দ করতো না। আর করেও থাকলে সেটা তার অতীত। আর নতুন বিয়ে হওয়া হাজবেন্ডের সামনে তার ওয়াইফের অতীতকে টেনে না আনাই ভালো। রিতা, হয়েছে তোমার? এবার গিয়ে গাড়িতে বসো।’
মেহুল রেগে বলল,
‘আপনি কি ভেবেছেন, আপনার ষড়যন্ত্র আমরা বুঝি না? আপনি এসব রিতাকে ভয় দেখিয়ে করিয়েছেন। ও না হয় কখনোই আপনাকে বিয়ে করতো না। আপনার মতো একটা খারাপ মানুষকে কি কেউ জেনে শুনে বিয়ে করবে? জীবনেও করবে না। আর আপনি যদি আমার বান্ধবীর সাথে এইটুকুও অন্যায় করেন তাহলে আমি কিন্তু আপনাকে আর ছেড়ে কথা বলব না।’
সাদরাজ শব্দ করে হাসে। বলে,
‘ভয় পেয়েছি মিসেস খান, ভীষণ ভয় পেয়েছি। সেসব পরে দেখা যাবে। আগে তো আমরা আমাদের নতুন জীবন শুরু করি। রিতা, এবার চলো।’
এই বলে সে রিতার হাত টানতে টানতে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। আর রিতা পুরোটা সময় পেছনে তাকিয়ে কাঁদতেই থাকে। মেহুলেরও ওকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়। রাবীরের সারা শরীর রাগে রি রি করছে। তার সাথে শত্রুতা মেটাতে সাদরাজ কি শেষে রিতাকে বিয়ে করেছে? আর তাছাড়া রিতাকে বিয়ে করার ওর আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? সে ভীষণ চিন্তায় পড়ে।
মেহুল রিতার মা’র কাছে যায়। উনাকে বোঝায়। কিন্তু, তিনিও তো বুঝতে পারছেন তার মেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রিতার মুখে সাদরাজের কথা তিনিও শুনেছেন। মেয়ের জন্য কষ্টে উনার বুকটা এখন খা খা করছে। রাবীর বলে,
‘আন্টি, চিন্তা করবেন না। সাদরাজ রিতার সাথে কোনো অন্যায় করতে পারবে না। যদি এই বিয়েটা সত্যিই রিতার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে হয়ে থাকে তবে আমরা এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিব। রিতার কিছু হবে না আন্টি। আপনি ধৈর্য্য ধরুন। আর আংকেলকেও বুঝিয়ে বলবেন।’
মেহুল তার মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
‘মা, তুমি আন্টিকে বাড়ি পৌঁছে দিও। আর আংকেলকেও তুমি সবকিছু বুঝিয়ে বলো। আমি রিতার সাথে কথা বলব। ওর সাথে কোনো খারাপ কিছু আমি হতে দিব না।’
‘ঠিক আছে মা। তুই নিশ্চিন্তে যা। আমি আপার সাথে আছি।’
এমন একটা খারাপ পরিস্থিতিতে মেহুলের এই জায়গা ছেড়ে যেতেও খারাপ লাগছে। কিন্তু, আজ তো তাকে যেতেই হবে। তাই অবশেষে মা বাবাকে বিদায় দিয়ে সে তার গন্তব্যের দিকে রওনা দিল।
______
মেহুলের শ্বশুরবাড়ি ভীষণ সুন্দরভাবে সাজানো গুছানো। চারদিকে আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে। শ্বশুরবাড়িতে রাবীরের কিছু কাজিন আছে। তারাই মেহুলকে নিয়ে রাবীরের রুমে যায়। রাবীরের রুমও সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখা। বিছানা জুড়ে ফুলের মেলা বসেছে যেন। একটা তীব্র বেলি ফুলের ঘ্রাণ এসে তার নাকে ঠেকছে। সবকিছু আজ ভীষণ আনন্দের হতো যদি না রিতার সাথে এই অন্যায়টা হতো। সে আজ এত আনন্দের মাঝে থেকেও নিরস। মনে কোথাও একটা দুশ্চিন্তার আর ভয় কাজ করছে। সাদরাজ রিতার সাথে খারাপ কিছু করবে না তো? তার এতকিছুর পেছনে কী উদ্দেশ্য কে জানে?
রাবীরের একজন কাজিন, বয়সটা হয়তো মেহুলের’ই মতো; সে আলমারি থেকে একটা শাড়ি এনে বলল,
‘ভাবি, মামি বলেছেন এখন শাড়ি চেঞ্জ করে এই শাড়িটা পরার জন্য। তুমি কি শাড়ি পরতে পারো, নাকি আমরা হেল্প করব?’
‘না, আমি পারব।’
‘আচ্ছা, আর শাড়ির সাথে এই গয়নাগুলোও পরতে বলেছেন।’
‘আচ্ছা।’
তারা সবকিছু মেহুলকে বুঝিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মেহুল ভেতর থেকে দরজা আটকে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। নিজেকে আয়নায় দেখে রিতার কথা মনে পড়ে তার। মেয়েটাও তো এইভাবে বউ সাজতে চেয়েছিল। একটা সুন্দর সুষ্ঠ বিয়ে চেয়েছিল। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল। এমনটা তো না হলেও পারতো। এইসব কিছুর সাথে সাদরাজ রিতাকে কেন জড়ালো? এই মেয়েটার কী দোষ? ওর সাথে এমন অন্যায় না হলেও তো পারতো।
________
মেহুল ওয়াশরুমের দরজা খুলে বাইরে বেরুতেই চমকে যায়। রাবীরও হঠাৎ তাকে দেখে অবাক হয়। রিতা বুঝতে পারেনি রাবীর যে এখন রুমে থাকতে পারে। তাই সে কোনোরকমেই শাড়ি পেঁচিয়ে চলে এসেছে। যার দরুন শরীরের অনেক অংশ’ই দৃশ্যমান তার। রাবীরও ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। দরজা লক ছিল, চাবি তো তার কাছে সবসময়ই থাকে তাই ঢুকে পড়েছে। ওয়াশরুমে পানির শব্দ শুনে সে বুঝতে পেরেছিল মেহুল ভেতরেই চেঞ্জ করছে। কিন্তু এখন সে মেহুলকে এভাবে দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মেহুল লজ্জা পেয়ে আবার ওয়াশরুমে যেতে নিলে রাবীর বলে,
‘আপনি রুমে আসুন। আমি বাইরে যাচ্ছি।’
সে বাইরে চলে যায়। মেহুল পেছন থেকে ডেকে বলে,
‘নক করা ছাড়া রুমে ঢুকবেন না, প্লিজ।’
‘ঠিক আছে।’
রাবীর বেরিয়ে যেতেই মেহুল গিয়ে দরজা লক করে দেয়।
সবকিছু ঠিকঠাক মতো পরে সে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দেয়। রাবীর বাইরে নেই। আশেপাশে আর কাউকেই সে দেখতে পায় না। তাই আবার ভেতরে গিয়ে বিছানায় বসে। মা’কে কল করে। জানতে পারে রিতার মা’কে তিনি ঠিকঠাক মতো বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন। আর রিতার বাবার সাথেও তিনি কথা বলেছেন। উনারা ভীষণ উদ্বিগ্ন। আর তা তো হবারই কথা। একমাত্র মেয়ে উনাদের। চিন্তায় চিন্তায় মানুষগুলো অসুস্থ না হয়ে পড়ে।
মায়ের সাথে কথা বলে ফোন রাখতেই রাবীরের সেই কাজিন এসে বলে,
‘ভাবি, রেডি তুমি?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা। নিচে চলো, মামি খেতে ডাকছেন।’
মেয়েটা মেহুলকে নিয়ে নিচে যায়। রাবীরও সেখানেই ছিল। তার নতুন বউয়ের দিকে চোখ পড়ে তার। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরেছে। মাথায় ঘোমটা টেনে ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। তাও অসভ্য ঘোমটা যেন থাকতেই চাইছে না। রাবীরের চোখে যেন এই মেয়েটা পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর নারী; যাকে দেখলে মনে মায়া না বরং নেশা জাগে।
চলবে….