#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৩।
‘একি, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
সাদরাজ মাত্রই বসা থেকে উঠেছে। মেহুল তখনই তাকে প্রশ্নটা করে। সে হাস্যজ্জ্বল মুখে জবাবে বলে,
‘আপনি তো আর সামনেই এলেন না। তবে আন্টি আংকেলের সাথে কথা বলে বেশ ভালো লেগেছে। এখন একটা কাজ পড়ে গিয়েছে, তাই চলে যাচ্ছি। আবার অন্য কোনোদিন আসব।’
‘ওমা, চলে গেলে কী করে হবে?’
সাদরাজ খানিকটা অবাক হয়ে বলল,
‘কেন? যাওয়া যাবে না?’
মেহুল অস্থির হলো কিছুটা। বলল,
‘না না। বলছিলাম কিছুই তো খেলেন না। আর দুপুরের টাইমে কেউ খাবার না খেয়ে চলে যায়? জানেন তো, আমার মায়ের হাতের রান্না কিন্তু দারুণ মজা। আপনি না খেলে চরম মিস করবেন। তাই খেয়ে যান।’
মেয়ের কথা শুনে রামিনা বেগম হকচকিয়ে তার দিকে চাইলেন। মানে এমন হুটহাট কাউকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া যায় নাকি? রান্নাবান্নার একটা ব্যাপার আছে না। কিন্তু, তিনিও পড়লেন বিপদে। মেয়ে বলে ফেলেছে, এখন তিনি তো আর নাকচ করতে পারছেন না। তাই তিনিও মৃদু হেসে বললেন,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বাবা; দুপুর টাইমে এসেছ খেয়ে যাও।’
সাদরাজ মনে মনে ভাবল, “এই সুযোগ। যত বেশি সময় সে এখানে থাকতে পারবে ততই ওদের কাছাকাছি যেতে পারবে।” তাই সেও বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেল। মেহুল খুশি হলো খুব। এবার রাবীর তাড়াতাড়ি এলেই সে বাঁচে।
খাবার টেবিলে সাদরাজ বেশ মজা করেই খাচ্ছে। তার মা বাবা লোকটাকে বেশ যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন। মেহুল এক কোণে মুখ লটকে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। রাবীর এখনো কেন আসছে না কে জানে। সাদরাজ বলল,
‘মেহুল, আংকেলের না হয় খাবারের রুটিন আলাদা তাই বসতে পারছেন না। কিন্তু, আপনি আর আন্টি তো আমার সাথেই বসতে পারেন।’
মেহুল জোরপূর্বক হেসে বলে,
‘না, আপনি খান। আমরা পরে খেয়ে নিব।’
সাদরাজ হেসে বলে,
‘খাবারটা কিন্তু দারুণ হয়েছে, আন্টি।’
রামিনা বেগম বললেন,
‘আরেক পিস মাছ নাও। ভালো হয়েছে বলেও তো খাচ্ছো না কিছু।’
হঠাৎ কলিং বেল বাজল। মেহুল অস্থির হয়ে বলল,
‘আমি দরজা খুলছি।’
সাদরাজ খাওয়া বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল। কলিং বেলের শব্দে কিছুটা অস্বস্তি হলো তার।
মেহুল এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। রাবীর এসেছে। তবে একা নয়। সাথে অনেক পুলিশও আছে। পুলিশ দেখে মেহুল অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘পুলিশ কেন?’
রাবীর তার দিকে চেয়ে শুধায়,
‘কোথায় সাদরাজ আহমেদ?’
‘ভেতরে।’
সে অফিসারের দিকে চেয়ে বলে,
‘চলুন, অফিসার।’
রাবীর অফিসারদের সাথে নিয়ে ডিরেক্ট ভেতরে চলে গেল। রামিনা বেগম তাকে দেখেই হেসে বললেন,
‘জামাই, আপনি?’
সাদরাজ পেছন ফিরে তাকায়। রাবীরকে দেখে বিষম খায় সে। স্তব্ধ হয়ে যায়। কী করবে বুঝতে পারে না। রাবীরকে সে মোটেও এখানে আশা করেনি। এখন এই পরিস্থিতি সে কীভাবে সামলাবে? সবকিছু তো ঘেটে গিয়েছে। সব প্ল্যান শেষ। সে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রাবীর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘অফিসার, এরেস্ট হিম।’
সাদরাজ ভ্রু কুঁচকায়। অফিসার তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন,
‘মি. সাদরাজ আহমেদ, আপনাকে এক্ষুণি আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। চলুন।’
সাদরাজ রেগে যায়। তীব্র স্বরে বলে,
‘হুয়াট ননসেন্স। আমি কেন থানায় যাব? কী করেছি আমি?’
‘আপনি আমাদের সাথে আগে থানায় চলুন। সেখানে গিয়েই আমরা আপনার সাথে কথা বলব।’
‘এখানেই বলুন। কিসের ভিত্তিতে আপনারা আমাকে থানায় নিতে চাইছেন?’
‘আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। আপনি মি. রাবীর খানের গোডাউনে আগুন লাগিয়েছেন।’
সাদরাজ শব্দ করে হাসে। বলে,
‘প্রমান দিন। আছে? আছে কোনো প্রমান?’
অফিসার বলেন,
‘আমরা প্রমান ছাড়া কথা বলি না। থানায় চলুন, সব বলছি।’
‘না, যাব না। আমাকে এখানেই সব বলুন।’
রাবীর এবার চেঁচিয়ে বলে,
‘এটা তোমার অফিস বা কোনো সরকারি জায়গা না যে এখানে তুমি যা চাইবে তাই হবে। এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। এখানে তোমার মতো নিকৃষ্ট লোকের কোনো কথা চলবে না। অফিসার, ওকে এক্ষুনি নিয়ে যান। আর তা না হলে আমি ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব।’
সাদরাজ যেন রাগে কাঁপছে। রাবীর গর্জে বলল,
‘কী হলো, এখনো যাচ্ছেন না কেন?’
অফিসার সাদরাজকে নিয়ে বাইরে চলে যায়। মেহুলের মা বাবা হতভম্ব। কী হয়ে গেল, কেন হলো, কিছুই উনারা বুঝতে পারছেন না। রাবীর শ্বাস ফেলে বলল,
‘আমি দুঃখিত, বাবা। আপনার বাসায় এভাবে সিনক্রিয়েট করতে চাইনি। কিন্তু, ঐ লোকটাকে শাস্তি না দিয়েও উপায় ছিল না। ও আমার সাথে শত্রুতার নেভাতে গিয়ে কতগুলো অসহায়ের মানুষের ক্ষতি করেছে। আপনারা পুরো ঘটনা মেহুলের কাছ থেকে শুনে নিবেন। আমি এখন যাচ্ছি। আমাকেও থানায় থাকতে হবে। মেহুল, মা বাবাকে সব বুঝিয়ে বলবেন। আসছি।’
রাবীর দরজার কাছে যেতেই মেহুল তার কাছে ছুটে গিয়ে বলল,
‘রাবীর, সাবধানে থাকবেন প্লিজ। ঐ সাদরাজ আহমেদকে আমার খুব ভয় করে।’
রাবীর তার দিকে চেয়ে ম্লান হেসে বলে,
‘চিন্তা করবেন না। আমার কিছু হবে না।’
________
‘শুধুমাত্র ঐ লোকটার মুখের কথার ভিত্তিতে আপনি আমাকে এরেস্ট করতে পারেন না। আপনি জানেন না, আমি কী করতে পারি। আপনার কিন্তু চাকরি রিস্কে..’
‘উনার চাকরি নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, সাদরাজ আহমেদ। তুমি তোমার নিজের কথা ভাবো। অনেক করেছো। তোমার জন্য আজ এতগুলো মানুষ অসহায়ের মতো পড়ে আছে। তুমি কী ভেবেছ, এতকিছু করেও পার পেয়ে যাবে? এত সোজা? উহু, তোমাকে কালকে কোর্টে উঠানো হবে। আমি নিজে তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিব। আমিও দেখব, এবার তুমি কী করে বাঁচো।’
সাদরাজ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
‘আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়ব না, রাবীর খান। তুমি আর আর তোমার স্ত্রী মিলে ইচ্ছে করে এসব করেছো তাই না? এসব সাজানো নাটক। আমাকে আটকানোর জন্য। আচ্ছা, আমিও দেখব; ঠিক কতদিন তোমরা আমাকে আটকে রাখতে পারো।’
রাবীর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘তুমি যাতে আজীবন এই জেলেই পঁচে মরো, আমি সেই ব্যবস্থাই করব।’
‘আহ, তোমার এসব হুমকিতে এই সাদরাজ আহমেদ ভয় পায় না। যাও যাও, যা খুশি করো গিয়ে। সাদরাজ আহমেদকে আটকানো এত সহজ না।’
রাবীর বাঁকা হেসে বলে,
‘হুহ, সেটা তো সময়ই বলে দিবে।’
________
‘আপনি আমার কল কেন ধরেন না বলুন তো?’
‘ব্যস্ত ছিলাম।’
‘তাই বলে একটু মেসেজও করা যায় না, নাকি? আমি যে এইদিকে টেনশনে মরে যাই, সেটা কি আপনি বুঝেন না?’
‘আমার আর এত বুঝে কী হবে? আজকাল তো আমার থেকে আপনাকে সাদরাজ আহমেদ’ই একটু বেশি বুঝছেন।’
মেহুল ঠোঁট চেপে হেসে বলে,
‘বাবা, আপনার আবার হিংসেও হয়?’
‘না, আমার কেন হিংসে হবে? আমার তো মন নেই। আমি তো রোবট। আমার ওয়াইফের সাথে আমারই শত্রু এত ভাব বিনিময় করবে আর আমি তা হাসি মনে মেনে নিব, এটাই তো আপনি চান; তাই না?’
মেহুল মৃদু হেসে বলে,
‘আমি এমনটা চাই কখন বললাম? আপনার শত্রু তো আমারও শত্রু। আমি তো আপনার কথা ভেবেই ঐ লোকটার সাথে একটু কথা বলেছিলাম।’
‘হ্যাঁ, বুঝেছি। কিন্তু, ওর এই সাহসের ফল তো ওকে পেতেই হবে। আমার ওয়াইফের দিকে ও নজর তুলে তাকায় কী করে। তাছাড়া ওর অন্যায়ের বোঝা তো কম না। সবকিছু কালকে আমি কোর্টে বলব। তারপর দেখি ওকে কে বাঁচায়।’
মেহুল ভীত সুরে বলে,
‘এতকিছুর পর ঐ লোকটা আপনার কোনো ক্ষতি করে দিবে না তো? যা রাগ উনার আপনার প্রতি।’
‘নিজে বাঁচলেই না আমার ক্ষতি করবে। আগে তো নিজে বাঁচুক। আর এই কয়দিন আপনার বাসা থেকে বের হওয়ার দরকার নেই। ওর এরেস্ট হওয়ার খবর পেয়ে ওর লোকগুলো নিশ্চয়ই আরো তৎপর হয়ে উঠেছে। ওরা এখন যেকোনো মূল্যে ওকে বের করতে চাইবে। তাই আপাতত আপনার বাইরে বের হওয়ার দরকার নেই। আর খুব প্রয়োজন পড়লে আমাকে কল দিবেন। আমি নিজে আপনাকে নিতে আসব।’
মেহুল তৃপ্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘এত ভালোবাসলে ভালোবাসাতেও নজর লাগে; বুঝলেন নেতা সাহেব।’
‘চিন্তা নেই। ভবিষ্যতে আর কেউ নজর দিতে আসলে তার সেই নজর উপড়ে ফেলা হবে।’
চলবে…
#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৪।
‘এতকিছুর পরও সাদরাজ আহমেদকে কোর্ট কেবল জরিমানা করল, কোনো শাস্তি দিল না; আমি তো এই ব্যাপারটাই মেনে নিতে পারছি না। অথচ শাস্তি পেল কে? ঐ লোকটা, যাকে সে ভয় দেখিয়ে এতকিছু করিয়েছে। আপনিই বলুন এখানে কোনো দিক দিয়ে ন্যায় বিচার হয়েছে?’
রাবীর উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে যেন। কোর্টের রায় শোনার পর থেকেই সে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এই রায় একদমই ঠিক হয়নি। যে শাস্তি পাওয়ার কথা তাকে কিছু টাকার জরিমানা দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ যার শাস্তির প্রয়োজন নেই, তাকে দু বছরের কারাদণ্ড দিয়ে বসে আছে। এটা কেমন ন্যায় বিচার হলো। রাবীর প্রচন্ড রকম বিরক্ত। গরমে ঘেমে একাকার। তবুও গাড়িতে গিয়ে বসছে না। ফোনে মেহুল বলল,
‘ঐ লোকটা আবার আগে থেকেই জর্জকে টাকা দিয়ে রাখেনি তো? বা ঐ লোকের কোনো কাছের কেউ এসব করেছে?’
‘হতেও পারে। আমিও তাই ভাবছিলাম। নয়তো এত প্রমানের পরও জর্জ কী করে এই রায় দিতে পারেন? আমার তো রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।’
‘শান্ত হোন। এখন আর আপনি রাগ দেখিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। দুনিয়াটাই এমন। খারাপ মানুষগুলো এভাবেই সবসময় পার পেয়ে যায়। তবে চিন্তা করবেন না, একদিন না একদিন ওদের ঠিক ধরা পড়তে হবে। শুধু সেই সময়ের অপেক্ষা।’
‘মেহুল, এই অপেক্ষা আমি আরো কয়েকবছর আগে থেকেই করছি। কিন্তু, আর কত? এই সাদরাজ আহমেদ শুধরানোর লোক না। ওকে আর এভাবে ছেড়েও দেওয়া যায় না। ওকে ছেড়ে দিলে ও এখন আপনার ক্ষতি করতে চাইবে। আর তেমনটা হলে আইনের আগে আমি নিজেই ওকে খুন করে ফেলব।’
‘আপনি আছেন না? ঐ লোকটা আমার কিছুই করতে পারবে না। এখন আপনি কোথায়? বাসায় আসুন। আমাদের বাসায় আপনার মা এসেছেন। আমাদের অনুষ্ঠানের ডেইট ফিক্সড করার জন্য।’
‘আচ্ছা, আসছি আমি।’
________
রাবীর আসার পর মেহুল বসার রুমে যায়। এতক্ষণ যায়নি। তার শাশুড়ি মা এতক্ষণ তার মা বাবার সাথে কথা বলছিলেন। তিনি মেহুলকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কেমন আছো, মা?’
মেহুল সালাম দিয়ে জবাব দেয়। রাবীর তার দিকে তাকায়। একটা সুতি কমলা রঙের বাটিক শাড়ি পরেছে সে। রাবীরের চোখে মুখে যত ক্লান্তি, বিষাদ, আর বিরক্তভরা ভাব ছিল তা যেন নিমিষেই হাওয়া গেল। সে অবাক হয়ে ভাবল, একটা মানুষ এত স্নিগ্ধ হয় কী করে।
এই মাসের শেষ শুক্রবার রাবীর আর মেহুলের অনুষ্ঠানের ডেইট ঠিক করা হয়। যদিও মেহুল চেয়েছিল ঈদের পর হোক। কিন্তু, রাবীরের একটু বেশিই তাড়া ছিল। তাই তার কথা মতোই তারিখ ঠিক করা হয়েছে।
‘না খেয়ে চলে এলেন যে?’
‘খেয়েছি তো।’
‘এত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ?’
‘হ্যাঁ। আপনি বসছেন না কেন?’
‘আমার এখন খিদে নেই। সকালে নাস্তা বেশি খেয়েছি।’
রাবীর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে মেহুল জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি খুব ক্লান্ত, তাই না?’
‘না, ক্লান্ত না। তবে খুব বিরক্ত। চিন্তা হচ্ছে খুব।’
‘এখানে বসুন।’
একটা চেয়ার দেখিয়ে মেহুল বলল। রাবীর জিজ্ঞেস করল,
‘কেন?’
‘বসুন’ই না। বলছি।’
রাবীর চেয়ারে বসে। মেহুল তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাবীর জিজ্ঞেস করে,
‘কী করছেন?’
‘আপনি চোখ বন্ধ করুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন।’
রাবীর ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘কী করতে চাইছেন বলুন তো।’
‘আহা, আপনি আগে চোখটা বন্ধ করুন না।’
রাবীর চোখ বন্ধ করল। মেহুল পেছনে দাঁড়িয়ে রাবীরের কপালে ম্যাসাজ করে চুল টানতে লাগল। সে এত আরাম করে রাবীরের চুল টেনে মাথা ম্যাসেজ করে দিচ্ছিল যে রাবীরের ঘুমই চলে আসছিল। সে নরম সুরে বলল,
‘ইশ, এভাবে যত্ন নেওয়ার জন্য তো অনুষ্ঠানের ডেইট’টা আগামী শুক্রবারেই ফিক্সড করা উচিত ছিল।’
‘তাই, না? আমি অবশ্য এই কাজে খুব এক্সপার্ট। আপনার একটু ক্লান্তি লাগলেই বলবেন। আমি এভাবে যত্ন করে আপনার মাথা টিপে দিব।’
মেহুল অনেকক্ষণ রাবীরের মাথা টিপে দিল। কাজ শেষ করে সে রাবীরের সামনে এসে একটা হাত মেলে দাঁড়ায়। রাবীর তা দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হলো?’
‘ওমা জানেন না? স্বামীর যত্ন করলে বউকে বকশিশ দিতে হয়।’
রাবীর মৃদু হেসে বলে,
‘না, আগে জানতাম না।’
‘এখন তো জেনে নিয়েছেন। এবার দিন।’
রাবীর তার মানিব্যাগ বের করে পাঁচটা এক হাজার টাকার কচকচে নোট বের করে মেহুলের হাতে দিয়ে বলল,
‘নিন, আপনার বকশিশ।’
মেহুল টাকা দেখে অবাক হয়ে বলল,
‘এত বেশি বকশিশ দিলে কিন্তু একসময় আপনি ফকির হয়ে যাবেন।’
‘আপনাকে এইভাবে বকশিশ দিয়ে ফকির হতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।’
মেহুল টাকাটা হাতে নিয়ে বলে,
‘আচ্ছা দাঁড়ান, বকশিশ বেশি পেলে সার্ভিসও একটু বেশি দেওয়া লাগে।’
এই বলে সে আবার রাবীরের চুলে বিলি কাটতে আরম্ভ লাগল।
.
রাবীর তার মা’কে নিয়ে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে যায়। মেহুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে, এই লোকটা এত অসভ্য কেন। মেহুল যেন লজ্জায় মিশে যাচ্ছিল তখন। এমনিতে কত নিরামিষ। কিন্তু, হুটহাট আবার এমন সব কাজ করে বসে যে রীতিমত হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার রুমের দরজাটা আটকে দেয় শাড়ি চেঞ্জ করার জন্য।
________
অনুষ্ঠানের আর বেশি দিন নেই। তাই দুই পরিবারের বেশ কেটাকাটা চলছে। কাবিনের সময় খুব বেশি কিছু কেনা হয়নি। রাবীরের মা তাই এবার মন ভরে ছেলের বউয়ের জন্য বিয়ের কেনা কাটা করছেন। আর রাবীর খুব একটা সময় দিতে না পারলেও মেহুলকে তিনি এতে সবসময়ই সাথে রাখেন। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। মেহুলের জন্য গয়না কিনবেন। তাই তার পছন্দ অপছন্দ ভীষণ প্রয়োজন।
গয়নার দোকানে গয়না দেখার সময় মেহুল বেশ চিন্তাই পড়ে। তার সবসময়ই খুব সিম্পল জিনিস পছন্দ। কিন্তু, অন্যদিকে তার শাশুড়ি পছন্দ করছেন সব গর্জিয়াস জিনিসপত্র। মেহুল সিম্পল কিছু পছন্দ করলে তিনি সেটা সাইডে রেখে একটা গর্জিয়াস সেট হাতে ধরিয়ে বলেন, এটা দেখো।
অনেকক্ষণ দোকানে এতকিছু দেখার পরেও মেহুলের যখন কিছুই পছন্দ হচ্ছিল না তখন তার শাশুড়ি মা রাবীরকে কল করলেন।
‘মা, কিছু বলবে?’
‘তুমি কোথায় আছো? কাজ শেষ হয়ে থাকলে এক্ষুণি স্বর্ণগ্যালারিতে আসো।’
রাবীর ভাবে কিছু হয়েছে হয়তো। তাই সে চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন মা, কিছু হয়েছে?’
‘হয়েছে। বিরাট ঘটনা। তোমার বউ এখনো এক পিস গয়না পছন্দ করতে পারেনি। এখন তুমি এসেই তাকে পছন্দ করে দিয়ে যাও। আমার দ্বারা আর হবে না।’
‘এখনই আসতে হবে, মা?’
‘হ্যাঁ, এখনই।’
‘আচ্ছা, তুমি রাখো। আমি আসছি।’
শাশুড়ি মা ফোন রাখতেই মেহুল মুখ কাচুমাচু করে বলে,
‘মা, উনাকে ডাকার কী দরকার ছিল? আমি তো পছন্দ করছিলামই।’
‘তা তো দেখছিলামই কী পছন্দ করছিলে। এটা বিয়ের গয়না? কোনো কাজ নেই কিছু নেই। আমি চাই আমার ছেলের বউকে আমি স্বর্ণ দিয়ে ভরিয়ে দিতে। অথচ আমার ছেলের বউ কিনা তার জন্য এইসব স্বর্ণ পছন্দ করছে। উহু, হবে না। এখন রাবীর এসেই সব পছন্দ করবে।’
রাবীর দোকানের ভেতরে প্রবেশ করতেই সবাই তাকে সালাম দেয়। সে সালামের জবাব দিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,
‘কী সমস্যা, মা?’
তার মা কিছু গয়নার সেট তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘দেখ তো, এখান থেকে কোনটা বেশি ভালো লাগে।’
রাবীর তখন মেহুলের দিকে এক পলক চেয়ে বলে,
‘মেহুল আছে না, উনাকেই জিজ্ঞেস করো।’
‘করেছি। কিন্তু, ও যা পছন্দ করছে সেটা নেওয়া যাবে না।’
‘কেন মা? বাজেটের বেশি হয়ে যায়? সমস্যা নেই। আমি কার্ড নিয়ে এসেছি।’
‘বাজেটের বেশি হলে তো হতোই। তোমার বউ যা পছন্দ করছে সেই সকল জিনিস বাজেটের ধারে কাছেও আসে না। এই যে দেখো, এই সেট’টা; এত সিম্পল সেট কেউ বিয়েতে পরে?’
রাবীর গয়নাটা হাতে নিয়ে বলল,
‘কেন, তোমার এটা পছন্দ হয়নি?’
‘না, আমার এটা পছন্দ হয়েছে।'(অন্য একটা ভারি গয়না দেখিয়ে)
রাবীর সেটাও খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে। তারপর নরম সুরে বলে,
‘মা, গয়না কে পরবে? মেহুল তো? তাহলে তো আমাদের উনার কম্পফর্টের কথাটা আগে ভাবতে হবে, তাই না। গয়না ভারি বা হালকাতে কী আসে যায়। তুমি মেহুলকে যা দিবে সেটা তো উনাকে ভালোবেসেই দিবে। আর তাই এখানে তোমার ভালোবাসাটাই আসল। গয়নার ওজন না।’
রাবীরের মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘আমি জানতাম তুমি আমাকে ঠিক ভুলিয়ে ফেলবে। আচ্ছা, নাও নাও মেহুলের যা পছন্দ তাই নাও।’
মেহুল প্রচন্ড খুশি হয়। সে মনে মনে ভাবে, নিশ্চয় এভাবেই রাবীর তার গানের ব্যাপারেও মা’কে রাজি করিয়ে ফেলতে পারবে।
চলবে…