শেষটা সুন্দর পর্ব-৩১+৩২

0
948

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩১।

ভার্সিটি থেকে বের হতেই মেহুল পরিচিত গাড়ির সামনে পরিচিত মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। রাবীরকে এই সময় এখানে দেখে অবাক হলো সে। সে এগিয়ে গেল। রাবীরের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘আপনি এখানে?’

রাবীর তার দিকে চেয়ে ভালো ভাবে তার আপাদমস্তক পরখ করে বলল,

‘কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?’

মেহুল অবাক কন্ঠে বলল,

‘আপনি কী করে জানলেন?’

রাবীর ভ্রু কুঁচকে উল্টো প্রশ্ন করল,

‘আবার সাদরাজের সাথে দেখা করেছেন?’

‘না না, আমি ঠিক দেখা করিনি। দেখা হয়ে গিয়েছিল। আসলে আমি আজকে সিয়ামকে নিয়ে ঐ সংবাদপত্রের অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়েই আমার উনার সাথে দেখা হয়েছে। আর আপনি জানেন, উনি নিজের মুখে সবকিছু স্বীকার করেছেন। এই সবকিছু উনি করেছেন। এখানে সিয়ামের কোনো দোষ নেই। সব দোষ উনার।’

রাবীর গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে বলল,

‘সেই সন্দেহ আমার আগেই হয়েছিল। তা, তারপর আপনারা কী করেছিলেন? রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন?’

‘সেই খবরও আপনার কাছে চলে গিয়েছে? কিন্তু, আপনার সেই গার্ডকে তো আজকে দেখলাম না। তাহলে আপনি এতকিছু জানলেন কী করে?’

‘গার্ড আপনার আশেপাশেই থাকে। আপনি হয়তো তাকে দেখেন না। সে ঠিকই অলওয়েজ আপনার খবরাখবর আমাকে দিয়ে যাচ্ছে। তা এবার সাদরাজের সাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়াটা কবে বন্ধ করছেন?’

মেহুল চোখমুখ কুঁচকে বলে,

‘আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন? আমি কি যেচে পড়ে উনার সাথে রেস্টুরেন্টে গিয়েছি নাকি? গিয়েছি তো ঠেকাই পড়ে। উনার পেট থেকে কথা বের করার জন্য। নাহলে আমার কি কোনো দরকার আছে, এমন একটা কুল, হ্যান্ডসাম হাজবেন্ড রেখে আমি ঐ সাদরাজের সাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার।’

রাবীর কিছুক্ষণ ওর দিকে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,

‘আচ্ছা, বুঝলাম। তারপর কী কী কথা পেট থেকে বের করেছেন শুনি?’

‘বেশি কিছু না। তবে যতটুকু বুঝেছি, উনি যাইছেন আমার কানে আপনার নামে বিষ ঢালতে। আচ্ছা, ছেলেরাও কি মেয়েদের মতো কুটনামী করতে পারে?’

‘ছেলেরা না পারলেও রাজনীতিবিদরা সবই পারেন। আর ঐ ভদ্রলোকের কাছ থেকে আপনি দূরে থাকবেন। আর যেন উনার সাথে আপনাকে রেস্টুরেন্টে না দেখি।’

মেহুল মাথা হেলিয়ে বলল,

‘আচ্ছা।’

‘গাড়িতে গিয়ে বসুন। আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আমি কাজে যাব।’

________

‘স্যার, রাবীর খান এসব জানতে পারলে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিবেন।’

‘ঐ রাবীর খানকে আমি ভয় পায় নাকি?’

অজ্ঞাত লোকটা ভয়ে ভয়ে বলল,

‘তাও স্যার, উনার পরিবারের কোনো মেয়ের দিকে কেউ চোখ তুলেও কখনো তাকাতে পারে না। সেখানে আপনি উনার ওয়াইফ…’

‘শাট আপ, রাবি শ। তুমি আমার পি.এ নাকি ঐ রাবীর খানের? ওর হয়ে তোমাকে এত উকালতি করতে কে বলেছে?’

লোকটা ঢোক গিলে বলল,

‘না মানে স্যার, আমি আপনার কথা ভেবেই বলছিলাম।’

‘আমার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। তুমি গিয়ে চেক করো আগামী বুধবার আমার কোনো জরুরি কাজ আছে কিনা। সেদিন কোনো কাজ না থাকলে আমি অন্য কাজে বেরুব। যাও, এখনই গিয়ে দেখো।’

‘আচ্ছা, স্যার।’

লোকটা বেরিয়ে সাদরাজের কেবিনের দিকে যায়। সাদরাজ তখন তার রকিং চেয়ারে চোখ বুজে বসল। সেই সময় একজন বয়স্ক লোক তার রুমে প্রবেশ করেন। তিনি খাটের এক কোণে বসে বলেন,

‘কতদূর আগালি, বাবা?’

সাদরাজ চোখ বুজা অবস্থাতেই জবাব দেয়,

‘অনেকটাই এগিয়েছি, বাবা। ঐ মেয়েকে একবার হাতে নিতে পারলেই আমার কাজ হয়ে যাবে।’

‘রাবীর এখনও কিছু জানে না?’

‘না।’

‘সাবধানে থাকিস। ও জানলে কিন্তু তোর সেই হাত কেটে আমার কাছে এসে রেখে যাবে।’

সাদরাজ তখন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ওকে আর আমি সেই সুযোগ দিব না, বাবা। ওর প্রাণ ভোমড়া যখন আমার হাতে চলে আসবে তখন ও এমনিতেই ঠুকরে ঠুকরে মরে যাবে।’

এই বলে সাদরাজ কুৎসিত ভাবে হাসে। তার হাসির সাথে তখন তার বাবাও তাল মেলান।

________

‘লোকটা এখনো কিছু স্বীকার করেননি, অফিসার?’

‘না।’

‘আশ্চর্য! এত মার খাওয়ার পরও সে কিছু বলছে না কেন?’

অফিসার তখন চিন্তিত সুরে বললেন,

‘আমার কি মনে হয় জানেন তো, লোকটার নিজের প্রাণের মায়া নেই। ওর মনে অন্য কিছু একটা নিয়ে ভয় আছে। ওর যদি নিজের প্রাণের মায়া থাকত, তবে ও এতক্ষণে সব বলে দিত। যে ওকে দিয়ে এসব করিয়েছে, সে নিশ্চয়ই তাকে অন্য কিছুর ভয় দেখিয়েছে।’

রাবীর খানিক ভেবে বলল,

‘আমি একটু উনার সাথে দেখা করতে চাই।’

‘আচ্ছা, আপনি বসুন। আমি তাকে আনছি।’

অফিসার ভেতরে গিয়ে লোকটাকে নিয়ে এলেন। লোকটি ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না। শরীরে যে তার এইটুকুও শক্তি নেই সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চোখ মুখ ভীষণ কালো হয়ে আছে। শরীরের বিভিন্ন জায়াগায় ছোপ ছোপ দাগ। লোকটাকে রাবীরের সামনে বসানো হলো। সে চেয়ারে বসে ধুলছে। অফিসার তাকে ধমক দিয়ে বললেন,

‘সোজা হয়ে বসো।’

লোকটি খুব কষ্টে সোজা হলো। রাবীরের দিকে চেয়েই সে কেঁদে বলতে লাগল,

‘আমি কিছু জানিনা। বিশ্বাস করুন, আমি সত্যিই কিছু জানি না।’

রাবীর ঠান্ডা গলায় বলল,

‘আপনি সবকিছুই জানেন। ইচ্ছে করেই কিছু বলছেন না। আচ্ছা, আপনার বিয়ে হয়েছে? বউ বাচ্চা আছে?’

লোকটা হুট করেই চেয়ার থেকে ধপ করে পড়ে নিচে বসে পড়ল। রাবীরের পা আঁকড়ে ধরে বলল,

‘আমার বউ বাচ্চার কিছু করবেন না, স্যার। যা শাস্তি দেওয়ার আমাকে দিন। ওদের কিছু করবেন না। ওরা নিষ্পাপ।’

রাবীর যেন এবার কিছু আন্দাজ করতে পারে। সে লোকটাকে টেনে তুলে চেয়ারে বসায়। নরম সুরে বলে,

‘আজ যদি আপনি মারা যান; তাহলে আপনার বউ বাচ্চার কী হবে? কে দেখবে ওদের? আপনি ছাড়া ওদের দায়িত্ব কে নিবে? আর কেউ আছে আপনার পরিবারের?’

লোকটা মাথা নাড়িয়ে না বলল। রাবীর অতঃপর বলল,

‘তাহলে তো ঐ মানুষগুলোর জন্য আপনার বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি। আর আপনার কি মনে হয়, আপনি এভাবে মিথ্যে বলে বেঁচে যেতে পারবেন? কখনোই না। মিথ্যে বললে আপনি কখনোই বাঁচতে পারবেন না। যতই নাটক করেন না কেন, আপনাকে ঠিক মরতে হবেই। আর আপনি মরলে তো আপনার ফ্যামিলিও মারা পড়বে। এবার চিন্তা করে দেখুন, কী করবেন। সত্যি বলে নিজেকে আর নিজের পরিবারকে বাঁচাবেন, নাকি মিথ্যে বলে গোটা পরিবারকে সাথে নিয়ে মরবেন?’

লোকটার চেহারা যেন এখন আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার চোখে মুখে ভীষণ ভয়। গলা কাঁপছে। চোখের পাতা মিটমিট করছে। লোকটি কাঁপা স্বরে বলল,

‘আমি কিছু জানি না। আমার বউ বাচ্চাকে আপনারা ছেড়ে দিন।’

‘আপনার বউ বাচ্চার কিছু হয়নি। ওরা সুরক্ষিত। আপনি কেবল আমাদের কথার সঠিক জবাব দিন তাহলেই হবে।’

‘না না, তাহলে ওরা আমার বউ বাচ্চাকে মেরে ফেলবে। আমি সত্যিই কিছু জানি না।’

রাবীর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস কলল,

‘কারা আপনার বউ বাচ্চাকে মেরে ফেলবে?’

লোকটার হুঁশ আসে। সে বিব্রত সুরে বলে,

‘জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না।’

রাবীর কতক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। লোকটা যেন বিরবির করে কী বলছে। ভয়ে কাঁপছে সে। সবকিছু একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর রাবীর বলল,

‘দেখুন, সাদরাজ চাইলেও আপনার বউ বাচ্চার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। ওদেরকে আলাদা ভাবে সুরক্ষা দেওয়া হবে। আমি প্রয়োজনে পুলিশ পাঠাব ওদের জন্য। ওদের আমি কিচ্ছু হতে দিব না। আমি প্রমিস করছি। আপনি শুধু আমাকে সত্যিটা বলুন প্লিজ। সত্যিটা জানা আমার জন্য খুব জরুরি।’

লোকটি কিছুই বুঝল না। সে আগের মতো করেই বলতে আরম্ভ করল,

‘না না, ওরা আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে। আমি কিছু জানি না। সত্যিই কিছু জানি না। কিচ্ছু না।’

রাবীর খুব চেষ্টার পর অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘এভাবে হবে না। অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।’

চলবে…

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩২।

বুধবারের সকাল,

লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে রাবীর বলল,

‘ দেখুন তো ওদের আপনি চিনেন কিনা?’

রাবীরের ফোনের ছবিটা দেখে লোকটা ভয়ে আঁতকে উঠল। অসহায় সুরে বলল,

‘ওদের দয়া করে কিছু করবেন না, স্যার। ওরা কিছু জানে না। ওরা নির্দোষ।’

রাবীর ফোনটা পকেটে রেখে বলে,

‘ওরা যে নির্দোষ সেটা আমিও জানি। কিন্তু, যেহেতু আপনি অন্যায় করেছেন সেহেতু এখন আপনাকেই সেই অন্যায়ের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এখন বলুন,কীভাবে প্রায়শ্চিত্ত করবেন? সত্য কথাটা বলবেন। নাকি আপনার স্ত্রী আর সন্তানকে কষ্ট পেতে দেখবেন?’

লোকটা দুর্বল। কিছু বলতেও আজকাল কষ্ট হয় তার। চোখ মেলে তাকাতেও কষ্ট হয়। তাও নিজের জীবনের চেয়ে সে তার পরিবারকে ভালোবাসে। তার স্ত্রীকে, সন্তানকে ভালোবাসে। সে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আমি এখন কী করব? সত্য বললেও আমার স্ত্রী আর সন্তানের বিপদ। আর মিথ্যে বললেও আমার স্ত্রী আর সন্তানের বিপদ। প্লিজ, ওদের ছেড়ে আপনারা আমাকে মেরে ফেলুন। আমি মরে গেলেই সব ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে।’

রাবীর রেগে টেবিলের উপর একটা বারি মেরে বলল,

‘সেটা আপনাকে বলতে হবে না। আপনাকে মারার প্রয়োজন বোধ করলে তাই করব। আপনার অনুমতি নিয়ে কিছু করা হবে না। তবে এখন সত্যি না বললে আমরা বাধ্য হব আপনার বউ বাচ্চাকে কষ্ট দিতে। আর যদি সত্য বলে দিন তবে আমি নিজে আপনার শাস্তি মওকুফের ব্যবস্থা করব। তাই দয়া করে এবার সত্যিটা বলুন। কে এসব করেছে? কার কথায় আপনি এসব করেছেন?’

লোকটা এখনো কাঁদছে। সে বলে,

‘সত্যি বলে ছাড়া পেলেও ঐ লোকগুলো তো আর আমাদের ছাড়বে না।’

‘কোন লোকগুলো?’

লোকটা ভয়ে ভয়ে রাবীরের মুখের দিকে তাকায়। সে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। রাবীর তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

‘আপনি ভয় পাবেন না। আপনার আর আপনার পরিবারের সুরক্ষা আমি দিব। আপনারা আমার হেফাজতে থাকবেন। তাও দয়া করে সত্যিটা বলুন।’

লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

‘আমাকে আগে এক গ্লাস পানি দিন, প্লিজ।’

রাবীর এক গ্লাস পানি তার দিকে এগিয়ে দিল। লোকটা ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানি খেয়ে নিজেকে ধাতস্ত করল। অতঃপর ভীত সুরে বলল,

‘এইসব কিছু আমি সাদরাজ আহমেদের কথায় করেছি। উনি আমাকে ভয় দেখিয়ে এসব করিয়েছেন। আমি কখনোই এমন কিছু করতাম না। কিন্তু, উনি বলেছেন, আমি যদি উনার কথায় রাজি না হই তবে উনি আমার স্ত্রী আর সন্তানকে মেরে ফেলবেন। আর আমি সেই ভয়েই এসব করিছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন, স্যার। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।’

রাবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অফিসারের দিকে চেয়ে বলে,

‘আর কোনো প্রমান লাগবে, অফিসার? আশা করছি এবার আপনারা উনার বিরুদ্ধে সঠিক স্টেপ নিবেন।’

অফিসার বললেন,

‘হ্যাঁ, তা এবার নিতেই হবে। উনি কেবল রাজনৈতিক শত্রুতার জেরে এতগুলো মানুষের ক্ষতি করতে পারেন না। আমি উনাকে এরেস্ট করব। তার আগে এইসব কিছুর একটা লিখিত জবানবন্দি নিতে হবে।’

‘যা করার তাড়াতাড়ি করুন।’

‘স্যার, আমার বউ বাচ্চার কোনো ক্ষতি হবে না তো?’

রাবীর লোকটার কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। ওরা এই কয়দিন আমার হেফাজতেই থাকবে। আর সেখানে ওদের কোনো ভয় নেই। যেহেতু আপনিও অন্যায় করেছেন। সেহেতু কোর্টে তো আপনাকেও যেতে হবে। তবে আমি চেষ্টা করব, আপনার শাস্তি মওকুফ করানোর জন্য। আর হ্যাঁ, কোর্টে গিয়েও কিন্তু আপনি সব সত্যি কথাই বলবেন। নাহলে শাস্তি কিন্তু আপনাকেই পেতে হবে। বুঝতে পেরেছেন?’

‘আচ্ছা, স্যার।’

‘আর অফিসার, আমি সাদরাজ আহমেদের নামে এখনই মামলা দায়ের করব। আপনি সেই ব্যবস্থা করুন।’

________

পরপর দুবার কলিং বেলের শব্দে মেহুল বিরক্ত হয়ে তার রুম থেকে বের হয়। মা কোথায়, দরজা কেন খুলছে না। সে রান্নাঘরে গিয়ে মা’কে পায় না। হয়তো ওয়াশরুমে। পরে সে নিজেই যায় দরজা খুলতে। তবে দরজা খুলে রীতিমতো ভুত দেখার মতো চমকে যায় সে। বিস্ময়ে যেন বাকরুদ্ধ। দরজার উপারের লোকটি হেসে বলল,

‘কী হলো, চমকে গিয়েছেন নাকি?’

মেহুল হতভম্ব হয়ে বলল,

‘আপনি এখানে?’

‘জি, এইদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, আপনার বাবাকে একবার দেখে যাই। তা, আমাকে ভেতরে আসতে বলবেন না।’

মেহুল মেকি হেসে বলল,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ভেতরে আসুন।’

সাদরাজ ভেতরে প্রবেশ করে। মেহুল মৃদু হেসে বলে,

‘আপনি বসুন। আমি মা বাবাকে ডেকে আনছি।’

সাদরাজও হেসে সম্মতি জানাল। মেহুল রুম থেকে বেরিয়ে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই লোকটা এখানে কী করে এল। তার বাড়ির ঠিকানা সে কীভাবে পেল। পরে তার মনে পড়ে, সেদিন তো কথার ছলে সে নিজেই তো বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিল। উফফ, এবার এসব রাবীর জানলে কী হবে কে জানে। ঐ সাদরাজকে তো খুন করবেই সাথে তাকেও আস্ত গিলে খাবে।

রামিনা বেগম তখন রান্নাঘরে যাওয়ার সময় মেয়েকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেন,

‘কিরে, এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

‘মা, সাদরাজ এসেছেন।’

‘কে সাদরাজ?’

‘আরে মা, ভুলে গেলে? ঐ লোকটা, বাবাকে যিনি রক্ত দিয়েছিলেন।’

‘ওহহ, ঐ ছেলেটা! আমাদের বাসায় এসেছে নাকি?’

‘হ্যাঁ, বাবার সাথে দেখা করতে।’

‘ভালো তো। কিন্তু, ও আমাদের বাসার ঠিকানা কোথায় পেয়েছে?’

‘ঐ সেদিনই আমি কথার ছলে বলেছিলাম আরকি আমরা এখানে থাকি।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, তুই গিয়ে তোর বাবাকে বল। আমি ওর জন্য নাস্তা নিয়ে যাই।’

‘আচ্ছা।’

.

‘তোমাকে দেখে কিন্তু আমি খুব খুশি হয়েছি, বাবা।’

সাদরাজ হেসে বলল,

‘আপনাকে দেখে আমার আরো বেশি ভালো লেগেছে, আংকেল। আপনাকে এতটা সুস্থ দেখে সত্যিই আমি খুব আনন্দিত।’

‘সেদিন তুমি ছিলে বলেই তো আজ আমি সুস্থ। নাহলে কী যে হতো।’

‘কিছুই হতো না। আমি না থাকলে আল্লাহ অন্য কাউকে আপনার সাহায্য করতে পাঠিয়ে দিতেন। আচ্ছা আংকেল, আপনার আর এখন রক্ত নিতে হয়না। আমি তো মেহুলের কাছে আমার কার্ড দিয়েছিলাম আমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য। কিন্তু, উনিও তো আর কোনো যোগাযোগ করলেন না।’

‘না না বাবা, চিন্তা করো না। রক্ত নিয়ে এখন আমাদেরও আর ভাবতে হয় না। আমার তো একটা ছেলেও আছে। আমার মেয়ে জামাই। ও সবকিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছে। এখন আর রক্ত নিয়ে আমাদের কষ্ট করতে হয় না।’

‘আচ্ছা। উনার কথা অবশ্য আমি মেহুলের কাছ থেকে শুনেছি। বেশ বড়ো রাজনীতিবিদ।’

‘হ্যাঁ। তুমি নাও না। চা নাও। কিছুই তো খাচ্ছো না।’

‘না, এই তো খাচ্ছি। আপনিও নিন। আন্টি, আপনিও নিন না।’

‘আমরা খেয়েছি, বাবা। তুমি খাও।’

‘উম্ম, মেহুলকে তো দেখছি না। উনি কোথায়?’

‘আছে হয়তো, নিজে রুমে বসে আছে।’

‘ওহহ, আচ্ছা।’

মেহুল রাবীরকে কখন থেকে কল করছে। কিন্তু, তার কল উঠানোর কোনো নামই নেই। ইশ, রাবীরকে এখন যেকোনো উপায়ে এখানে আনতে হবে। দুজনকে এখন মুখোমুখি করতে পারলেই একটা ধামাকা হয়ে যাবে। কিন্তু, এই লোকটা কাজের সময় কেন কল ধরে না কে জানে।মেহুল কলের উপর কল দিয়েই যাচ্ছে। একসময় কল রিসিভ হয়। মেহুল কিছু বলার আগেই রাবীর বলে,

‘আমি একটু ব্যস্ত আছি, মেহুল। পরে কল করছি।’

‘আরে শুনুন শুনুন। কল কাটবেন না। জরুরি কথা আছে।’

‘কী একটু তাড়াতাড়ি বলুন।’

‘সাদরাজ আহমেদ আমাদের বাসায় এসেছেন?’

রাবীর সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে বলে,

‘কী?’

‘হ্যাঁ, আপনি তাড়াতাড়ি এখানে আসুন।’

রাবীর চোয়াল শক্ত করে কর্কশ সুরে বলে,

‘ফোন রাখুন। আমি এক্ষুনি আসছি।’

মেহুল কল কেটে দিয়ে মনে মনে হাসে। সাদরাজ যখন আজ সরাসরি রাবীরের মুখের সামনে পড়বে তখন জানি বেচারার কী অবস্থা হয়। হয়তো বোকা হয়ে যাবে। বিস্ময়ে আর কথাই বলতে পারবে না। আর রাবীর, তাকে নিয়ে তো আবার দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। সে আবার রাগের মাথায় কিছু করে না বসে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে