শেষটা সুন্দর পর্ব-২৯+৩০

0
969

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৯।

মেহুল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাবীর এখন বেরুবে। সে জুতা পরছিল। জুতা পরা শেষে সে দরজার সামনে আসতেই মেহুল সাইড হয়ে দাঁড়ায়। রাবীর বাইরে বেরিয়ে আসে। পেছন ফিরে মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,

‘আসছি তাহলে, আল্লাহ হাফেজ।’

মেহুল ইতস্তত স্বরে বলে,

‘আজকে থেকে গেলেও তো পারেন।’

রাবীর ভ্রু উঁচু করে অবাক হওয়ার ভান করে বলে,

‘আপনি আমাকে থেকে যেতে বলছেন, স্ট্রেঞ্জ!’

‘জি, যদি মিটিং’টা বেশি জরুরি না হয়ে থাকে, তবে থেকে যেতে পারেন।’

এই কথা শুনে রাবীর তার দিকে কিছুটা এগিয়ে আসে। মেহুল নিজের জায়গাতেই স্থির। রাবীরের দিকে এক খেয়ালে চেয়ে আছে। রাবীর আরো কিছুটা অগ্রসর হয়। মৃদু সুরে শুধায়,

‘প্রেমে পড়েছেন, মিসেস খান?’

মেহুল সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামায়। তীব্র ভাবে মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘একদমই না।’

রাবীর হাসে। সে আরো এগিয়ে গিয়ে মেহুলের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। কোমল স্বরে বলে,

‘প্রেম কিন্তু ভয়ানক রোগ। এর থেকে বেঁচে থাকবেন। নয়তো এই রোগ কিন্তু মনকে একেবারে নিঃস্ব করে ছাড়ে, বুঝেছেন? আজ আসছি। অন্য একদিন নাহয় আপনার এই ইচ্ছে পূরণ করব। আল্লাহ হাফেজ।’

রাবীর ফিরতেই মেহুল আবার প্রশ্ন করে,

‘আপনি কখনো প্রেমে পড়েছেন, নেতা সাহেব?’

রাবীর ঘুরে তাকায়। কিছুক্ষণ মেহুলের দিকে চেয়ে থেকে জোরে নিশ্বাস ফেলে,

‘জি। আপনার নেতা সাহেব ও বোধ হয় এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তার অবস্থা খুব একটা ভালো না। ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে বোধ হয়। চিকিৎসা ছাড়া তো বাঁচার আর কোনো উপায়ও দেখছি না।’

রাবীরের এই কথাগুলো শুনে মেহুলের কেন যেন লজ্জা লাগে। সে মাথা নিচু করে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,

‘আচ্ছা, ডাক্তার দেখিয়ে নিয়েন। এখন যান, আল্লাহ হাফেজ।’

মেহুল দরজা আটকে দেয়। রাবীর মৃদু হেসে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে রাবীরের যাওয়া দেখে। রাবীরের গাড়ি যতক্ষণ দেখা গিয়েছে সে বারান্দা থেকে ততক্ষণ’ই চেয়ে ছিল। রাবীরের গাড়ি দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পর সে রুমের ভেতরে এসে বসে। তখন তাকে রিতা কল দেয়। মেহুল কল রিসিভ করে। রিতা চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে,

‘তুই সিয়ামকে কী বলেছিস, মেহুল।’

মেহুলের পুরোনো রাগ আবারও তাজা হয়ে উঠে। সে ক্ষিপ্ত সুরে বলে,

‘তুই জানিস, ঐ সিয়াম’ই এইসব কিছু করেছে।’

‘তোর কি মাথা খারাপ, মেহুল? সিয়াম কেন এইসব করতে যাবে? এতে সিয়ামের কী লাভ? আর ও যদি এসব করতোই তাহলে তো সে সবকিছু স্বীকার’ই করতো, তাই না? অযথা ও কেন তোকে মিথ্যে বলতে যাবে?’

‘এই একটা ব্যাপার তো আমিও বুঝতে পারছি না। কিছু একটা তো কারণ আছে।’

‘হ্যাঁ, আগে তুই সেই কারণ খুঁজে বের কর। তারপর কারোর উপর দোষ চাপাস।’

‘আশ্চর্য! তুই এইভাবে বলছিস কেন? আমি কারোর উপর দোষ চাপাচ্ছি না। এই কথাগুলো রাবীর সংবাদপত্রের অফিস থেকে পেয়েছেন। উনারাই বলেছেন এইসব কিছু সিয়াম নামের একটা ছেলে করেছে যে আমার ভার্সিটিতেই পড়ে।’

‘সিয়াম নামের ছেলে কি আমাদের ভার্সিটিতে আর নেই? ওদের মধ্যেও তো কেউ একজন করতে পারে।’

রিতা হঠাৎ এত ওভাররিয়েক্ট কেন করছে সেটা মেহুল বুঝতে পারছে না। তাই সে বলল,

‘ঠিক আছে, তোর এখন কিছু বিশ্বাস করতে হবে না। রাবীর এখনও খোঁজাখুঁজি করছেন। কে সত্য কে মিথ্যা সবকিছুই একদিন বেরিয়ে আসবে। আপাতত, তুই তোর বিশ্বাস নিয়ে থাক আর আমি আমার বিশ্বাস নিয়ে থাকি। রাখছি।’

মেহুল কল কেটে দেয়। রিতার এমন ব্যবহার তার মোটেও পছন্দ হয়নি। সাপোর্ট না করুক, তাই বলে এভাবে কথা বলবে? সে তো তার বেস্ট ফ্রেন্ড। মেহুল মন খারাপ করে রান্নাঘরে যায় কফি বানাতে।

_______

রাবীর থানায় আসে। পুলিশ অফিসার বলেন,

‘মি. খান, আমরা সেই লোকটিকে পেয়েছি; যে এই আগুন লাগিয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।’

রাবীর কপালে ভাঁজ ফেলে ফিচেল স্বরে বলে,

‘তাকে এক্ষুনি আমার সামনে এনে সব জিজ্ঞাসাবাদ করুন।’

‘আমরা জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্ব শেষ করেছি। কিন্তু, সে কিছুই স্বীকার করেনি।’

‘স্বীকার করেনি?’

‘না, সে কেবল একটা কথাই বলছে; সে কিছু জানে না। এছাড়া আর কিছুই তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না।’

রাবীর টেবিলের উপরে থাকা পেপার ওয়েট’টা ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,

‘সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকাতে হয়। আর কীভাবে বাঁকাতে হয় সেটা তো আপনারা খুব ভালো করেই জানেন। এই সত্যটা বের করা আমার জন্য খুব জরুরি। যেভাবেই পারেন, ওর মুখ খুলান। ওকে বলতে হবে। যেকোনো মূল্যে ওর মুখ থেকে সব সত্যি বের করতেই হবে।’

‘জি, আমরা আমাদের মতো চেষ্টা চালিয়ে যাব। কতক্ষণ আর চুপ থাকবে, একবার না একবার তো সব স্বীকার করবেই।’

________

পরদিন সকালে ভার্সিটিতে একটা ছোটখাটো হৈ চৈ লেগে যায়। মেহুল আর সিয়ামের বিশাল ঝগড়া হয়েছে। যদিও সবকিছু প্রথমে সিয়াম’ই শুরু করেছিল। তবে পরে মেহুলও তাকে ছাড়েনি। রিতা না থাকলে এই ঝগড়া হয়তো আরো বড়ো আকার ধারণ করতে পারতো। তবে তার জন্যই বড়ো কোনো ঝামেলা হওয়ার আগে সব বেঁচে গিয়েছে।

মেহুল ছোট্ট গাছটা থেকে একটা পাতা টান দিয়ে ছিঁড়ে সেটা টুকরো টুকরো করতে করতে বলল,

‘তুই দেখেছিস ঐ অসভ্য ছেলেটা আজ কী কী করেছে? ও সবার সামনে এভাবে সিনক্রিয়েট করে আমাকে অপমানিত না করলেও পারতো। আমার এখন রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।’

‘তুইও তো কম বলিসনি।’

মেহুল ফোঁস ফোঁস করতে করতে রিতার দিকে তাকায়। ক্রোধ নিয়ে বলে,

‘এখনো তুই আমাকেই বলছিস? ঐ ছেলেকে তুই কিচ্ছু বলবি না? আজকে আমি ওকে কিছু বলেছিলাম? ও ইচ্ছে করে আমার সাথে এসে লেগেছে। একে তো চুরি, তার উপর আবার সিনাজুরি! আর এইসবের পরেও তুই ঐ ছেলের সাপোর্ট’ই করছিস? কী হয় ও তোর? আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। তুই আমার সাপোর্ট করবি।’

রিতা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে,

‘বেস্ট ফ্রেন্ড ভুল করলে তার সাপোর্ট করতে হয় না, তাকে বোঝাতে হয়।’

‘ওহ আচ্ছা, এখন তোর মনে হচ্ছে আমি ভুল করছি। আর ঐ সিয়াম তো দুধে ধুয়া তুলসী পাতা, তাই না? ঠিক আছে, আজ সব সরাসরি প্রমান হবে। আমি ঐ সিয়ামকে নিয়েই ঐ সংবাদপত্রের অফিসে যাব। গিয়ে ডিরেক্ট ঐ লোকের সাথে কথা বলব। তাহলেই তো সব সত্যি বেরিয়ে আসবে, তাই না। চল।’

মেহুল রিতাকে জোর করে টেনে নিয়ে ক্যান্টিনে গেল। সিয়াম তার বন্ধুদের সাথে সেখানেই আড্ডা দিচ্ছে। মেহুল তাদের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সিয়াম আবার ক্ষেপে যায়। ক্ষিপ্ত সুরে জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি এখানে আবার কেন এসেছো? একবার ঝগড়া করে পেট ভরেনি? আবার এসেছো ঝগড়া করতে?’

মেহুল রেগে গেলেও কিছু বলে না। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলে,

‘দেখো সিয়াম, তোমার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। হয়তো একটা বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, কথা কাটাকাটি হয়েছে। এছাড়া আর কিছুই না। তবে আমরা এই ব্যাপারটাকে সলভ করতে পারি। এই যেমন তুমি বলছো, তুমি এইসব কিছু করোনি। কিন্তু, আমি বলছি; তুমিই সব করেছো। আর আমাদের এসব জানিয়েছেন ঐ সংবাদপত্রের রিপোর্টার। এখন আমরা যদি সেখানে গিয়ে সরাসরি তার সাথে কথা বলি তাহলেই তো সব সত্য বেরিয়ে আসবে। হতেও পারে আমার ভুল হয়েছে। আবার হতে পারে ঐ সংবাদকর্মী’ই আমাদের ভুল ইনফরমেশন দিয়েছেন। এই জন্যই আমাদের আগে সেখানে যেতে হবে। কথা না বললে আমরা কিছুই বুঝতে পারব না। এখন তুমি বলো, তুমি কী করবে?’

সিয়াম ভাবতে লাগল। মনে হলো, এটাই ঠিক। সরাসরি গিয়ে কথা বলাই ভালো। এতে সে যে কিছু করেনি সেটা সে সহজেই প্রমান করতে পারবে। তাই সে রাজি হয়ে গেল।
মেহুলও তখন সঙ্গে সঙ্গেই তাকে আর রিতাকে নিয়ে চলে গেল সেই সংবাদপত্রের অফিসে।

চলবে…

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩০।

সংবাদপত্রের অফিসের ভেতরে ঢুকতেই মেহুল সাদরাজের সামনে পড়ে। সাদরাজকে এখানে দেখেই চমকে যায় সে। সাদরাজও হঠাৎ মেহুলকে দেখে থতমত খায়। কী বলবে বুঝতে পারে না। তাও সে মুখে মেকি হাসি এনে বলে,

‘মেহুল, আপনি এখানে?’

মেহুল ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,

‘জি, একটা কাজে এসেছি। আপনারও কি এখানে কাজ ছিল?’

‘হ্যাঁ? ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ। একটা কাজে এসেছিলাম। আচ্ছা, আপনি কেন এসেছেন?’

মেহুলের মনে এখন খটকা লাগে। সাদরাজ মোটেও সুবিধার লোক না। সন্দেহের খাতা থেকে তার নামটা একেবারেই বাদ দেওয়া যায় না। তাই সে সরাসরি বলল,

‘আসলে কিছুদিন আগে, আমাকে নিয়ে খবরের কাগজে একটা প্রতিবেদন লেখা হয়েছিল। আর এখানের একজন রিপোর্টার বলেছেন সেই প্রতিবেদন’টা নাকি আমাদের ভার্সিটিরই সিয়াম নামের একজন লিখতে বলেছে। কিন্তু, এই যে সিয়াম, সে কোনোভাবেই এটা স্বীকার করছে না। তাই এখন এই ব্যাপারটা ক্লিয়ার করার জন্যই আমরা তাকে নিয়ে এখানে এসেছি।’

সাদরাজ সঙ্গে সঙ্গেই মৃদু হেসে বলে,

‘যেখানে ও কিছু করেইনি সেখানে ও কেন সবকিছু স্বীকার করবে বলুন?’

মেহুল, রিতা আর সিয়াম তিনজনেই খুব অবাক হয়। মেহুল ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে বলে,

‘মানে? আপনি এসব কেন বলছেন?’

সাদরাজ তপ্ত শ্বাস ফেলে। মাথার ভেতরে কথা সাজায়। অতঃপর ধীর সুরে বলে,

‘আসলে মেহুল, এইসব কিছু আমি করেছি। সিয়াম না।’

মেহুল চেতে যায়। জিজ্ঞেস করে,

‘আপনি করেছেন মানে? রিপোর্টার কি তবে আমাদের মিথ্যে কথা বলেছেন?’

‘না, আসলে ঠিক মিথ্যেও না। আমিই রিপোর্টারের কাছে আমার নাম সিয়াম বলেছিলাম। যেন আমার পরিচয়টা গোপন থাকে। ভেবেছিলাম, এই খবরের পর আপনার অনেক উপকার হবে। আপনি খুব খুশী হবেন। তারপর না হয় কোনো একদিন আপনার কাছে গিয়ে বলব, এইসব কিছু আমি করেছি। আপনাকে এই বলে চমকে দিতে চেয়েছিলাম।’

মেহুল তখন প্রচন্ড রাগ দেখিয়ে বলে,

‘আর আপনার এসবের জন্য আমাকে কতকিছু ফেইস করতে হয়েছে সেই সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে? আমার সম্পর্কে কিছু করার আগে আপনি আমাকে বলবেন না? আমার অনুমতি ছাড়াই সবকিছু করে ফেললেন? আপনার জন্য অযথা আমি সিয়ামকে এত কথা শুনিয়েছি। ওর আর আমার মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। আর আপনি এতদিনে আসছেন এইসব কিছু বলতে।’

সাদরাজ অনুনয়ের সুরে বলে,

‘আমি দুঃখিত। আমি জানতাম না আপনার সাথে এতকিছু যে হবে বা হয়েছে। আমি আপনার ভালোর কথা ভেবেই এসব করেছিলাম। আপনার গায়িকা হওয়া স্বপ্ন। তাই চেয়েছিলাম ছোট্ট একটা সাহায্য করতে পারি কিনা। আমার এই ব্যবহারে আপনার খারাপ লেগে থাকলে আমি সত্যিই আন্তরিকভাবে দুঃখিত। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করবেন। আর সিয়াম, আমি বুঝতে পারিনি আমার এই মিথ্যে পরিচয় যে আপনার উপরও এভাবে প্রভাব ফেলবে। আমি ইচ্ছে করে কিছু করেনি। তারপরও আমি দুঃখিত।’

সিয়াম বলল,

‘ঠিক আছে, ভাইয়া। সমস্যা নেই। আপনি তো ভালো করতে চেয়েছিলেন। হয়তো সঠিক ওয়েটা বুঝতে পারেননি। আমি কিছু মনে করেনি।’

সাদরাজ আবার মেহুলের দিকে তাকায়। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,

‘আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না, মেহুল? আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দিন।’

মেহুল কিছু একটা ভেবে বলল,

‘ইটস ওকে। আপনি আমার ভালো করতে গিয়ে আরো খারাপ করে ফেলেছেন। তবে ক্ষমা যখন চেয়েছেন তখন তো আর কিছু বলা যায় না। তবে ভবিষ্যতে দয়া করে আর এমন কিছু করবেন না।’

‘না না, একদমই না। ক্ষমা যখন করেই দিয়েছেন তখন ব্যাপারটাকে আরো সহজভাবে নেওয়ার জন্য আমরা কিন্তু একটা রেস্টুরেন্টে বসতে পারি। যদি আপনাদের কারোর কোনো আপত্তি না থাকে।’

রিতা আর সিয়াম সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতি জানাল। মেহুল তাদের দিকে রাগী চোখে তাকালেও তারা তাকে পাত্তা দিল না। আর মেহুলও জানে সাদরাজ কেন এসব করছে। সাদরাজের পরবর্তী পদক্ষেপ জানার জন্য তাকে এখন তার সাথে ভালো একটা সম্পর্ক রাখতেই হবে। সেই ভেবে সেও শেষে সম্মতি দিল। তারপর সবাই গেল একটা কাছের রেস্টুরেন্টে। তবে সেখানে গিয়ে রিতা আর সিয়াম এক টেবিলে বসে পড়ে। আর মেহুল আর সাদরাজকে দিল অন্য এক টেবিলে। মেহুল তাদের এই কর্মকান্ড দেখে বাকরুদ্ধ। ওরা আলাদা কেন বসল, আশ্চর্য! মেহুল চোখ মুখ কুঁচকে তাদের দিকে চেয়ে আছে। সাদরাজ তখন জিজ্ঞেস করে,

‘ওরা কি রিলেশনে আছে?’

মেহুল তার দিকে চেয়ে জবাবে বলে,

‘জানি না।’

সাদরাজ মৃদু হেসে বলে,

‘এটা না জানলেও ওদের দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, ওরা একটু নিজেদের মতো সময় কাটানোর জন্যই আলাদা বসেছে। আর এমনটাও তো না যে ওরা আমাদের একটু স্পেস দেওয়ার জন্য আলাদা বসেছে। কারণ ,ওরা তো নিশ্চয়ই জানে আপনি বিবাহিত। তাই না?’

মেহুল বিরক্তির সুরে বলে,

‘জি।’

‘আচ্ছা, তো কী খাবেন বলুন।’

‘যা খুশি একটা অর্ডার দিন।’

সাদরাজ তখন নরম গলায় বলে,

‘আমার উপর রাগ এখনো কমেনি, তাই না?’

‘না, এখানে রাগের কী দেখছেন? আপনি যা অর্ডার দিবেন আমি তাই খাব। আমার আলাদা করে কোনো পছন্দ নেই।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে দুইটা থাই স্যুপ অর্ডার দিচ্ছি?’

‘ঠিক আছে।’

.

স্যুপ খেতে খেতে সাদরাজ জিজ্ঞেস করল,

‘আপনার হাজবেন্ড নিশ্চয়ই আমাকে চিনেন?’

মেহুল থমকে তাকায়। ভাবে কী জবাব দিবে, হ্যাঁ নাকি না। কিছুক্ষণ ভেবে বলে,

‘না তো। কীভাবে চিনবেন? উনার সাথে তো আপনার কখনো দেখাই হয়নি।’

‘আপনি তো নিশ্চয়ই আমার কথা উনাকে বলেছেন?’

‘না, ওভাবে কখনো বলা হয়নি।’

‘মানে উনি একদমই আমার সম্পর্কে কিছু জানেন না?’

‘না।’

সাদরাজ যেন এতে খুশি হলো। সে বলল,

‘ওহহ। সমস্যা নেই। একদিন অবশ্যই কথা হবে।’

মেহুল তার কথার ধরন বুঝতে পেরে হেসে বলে,

‘হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই হবে।’

সাদরাজ আরো কথা বাড়ায়। মেহুলের বাবার কথা জিজ্ঞেস করে। তার মা’র কথা জিজ্ঞেস করে। তার পড়াশোনা ব্যাপারে পরামর্শ দেয়। কথার ছলে তার কাছ থেকে তার বাড়ির ঠিকানা নেয়। তারপর জিজ্ঞেস করে,

‘আপনার গান গাওয়া নিয়ে কি আপনার হাজবেন্ডের আপত্তি আছে?’

‘না।’

‘তাহলে আপনার প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পর আপনাকে প্রবলেম কেন ফেইস করতে হয়েছে?’

‘আমার শাশুড়ি মা চান না আমি গান গাই।’

সাদরাজ তখন স্যুপের বাটিতে চামচ নাড়াতে নাড়াতে বলে,

‘আজকাল অমন টিপিক্যাল টাইপ শাশুড়ি আছেন নাকি? আজকালকার শাশুড়িরা হবে মর্ডান। তারা গান নাচ সবকিছুতেই ছেলের বউদের পারমিশন দিবেন। এই যেমন আমার মা, উনি তো আমার বড়ো ভাইয়ের বউকে নাচ শেখার অনুমতি দিয়েছেন। উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমার ভাবির নাচ দেখেন। আর আজকালকার শাশুড়ির তো এমনিই হওয়া উচিত, তাই না?’

মেহুল খুব ভালো মতোই বুঝতে পারছে সাদরাজ কী চাইছে। তাই সে তার কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলে,

‘একদমই তাই। এইজন্যই আমার শাশুড়িকে আমার একদমই পছন্দ হয়না। নেহাতই একটা ভালো জামাই পেয়েছি, নাহলে এই বিয়ে কে মানতো।’

সাদরাজ যেন এবার আরো সুযোগ পেয়েছে। সে বলে,

‘ভালো জামাই যখন পেয়েছেন, তখন জামাইকেই বলুন না, শাশুড়িকে রাজি করানোর জন্য। উনার মা নিশ্চয়ই উনার কথা ফেলতে পারবেন না।’

‘হ্যাঁ, উনি বলেছেন কথা বলবেন। এখন বাকিটা উনার ইচ্ছা।’

‘চিন্তা করবেন না, রাজি হয়ে যাবে।’

‘জি, দোয়া করবেন।’

‘অবশ্যই। আর আমার কার্ডটা তো আপনার কাছে আছেই। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে কল দিবেন। আমি আপনার জন্য সবসময়ই ফ্রি।’

মেহুল তখন মিনমিনিয়ে বলল,

‘তা তো দেখছিই।’

সাদরাজ জিজ্ঞেস করল,

‘কিছু বললেন?’

‘না না, কিছু না। আজ তাহলে উঠি। অন্য কোনোদিন আবার কথা হবে।’

‘চলুন তাহলে আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।’

‘না, আমি তো এখন বাসায় যাব না। ভার্সিটিতে যাব। আপনি নিশ্চিন্তে আপনার গন্তব্যে যান। আমি একাই বাসায় ফিরতে পারব।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।’

‘জি, আল্লাহ হাফেজ।’

মেহুল এবার সিয়াম আর রিতার টেবিলের সামনে গিয়ে কর্কশ সুরে বলে,

‘পুরো রেস্টুরেন্ট খাওয়া হয়ে গেলে এবার চল।’

রিতা বলল,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চল।’

রিক্সায় উঠেই মেহুল প্রচন্ড রাগ দেখিয়ে বলল,

‘তুই সিয়ামকে পছন্দ করিস, তাই না?’

রিতা লজ্জা পায় বোধ হয়। অন্যদিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকায়। যার অর্থ, “হ্যাঁ।” মেহুল রাগে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

‘তুই বেস্টফ্রেন্ড এর নামে কল ঙ্ক। এছাড়া আর আমার কিছু বলার নেই।’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে