শেষটা সুন্দর পর্ব-২৭+২৮

0
951

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৭।

মেহুল রাবীরের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। রাবীর গ্লাসের পানিটা ঢকঢক করে গিলে গ্লাসটা সাইড করে রাখে। রাবীরের চোখ মুখ দেখে মেহুলের মনে হচ্ছে, আবার নিশ্চয়ই সিরিয়াস কিছু হয়েছে। মেহুল তাকে প্রশ্ন করতেও ভয় পাচ্ছে। আবার অস্থিরতায় চুপ থাকতেও পারছে না। তবে রাবীর নিজে থেকেই এক সময় তার মৌনতা কাটাল। গলা ঝেড়ে বলল,

‘সিয়ামের সাথে কি আপনার খুব ভালো সম্পর্ক?’

মেহুল অবাক হলো। স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘ও আমার জাস্ট ক্লাসমেট।’

রাবীর সেই কথার বিপরীতে কিছু বলল না। তার ফোন বের করে একটা ছবি মেহুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘এই ছেলেটা কে?’

মেহুল মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখে। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে উঠতে না পারলেও পরক্ষণেই সেদিনের কথা মনে পড়ে, যেদিন সে সাদরাজের সাথে রেস্টুরেন্টে বসেছিল। সে বলল,

‘এটা সিয়াম না।’

‘তাহলে কে?’

রাবীরের কাঠ কাঠ গলার এই প্রশ্নে মেহুল বেশ বুঝতে পারছে সে যে ছবিটাকে ইতিবাচক চোখে দেখেনি। তাই সে ঠোঁট চেপে হাসে। পরে স্বাভাবিক গলায় বলে,

‘উনিই হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আমার বাবাকে রক্ত দিয়েছিলেন। একদিন হুট করেই উনার সাথে দেখা হয়েছিল। পরে উনি কফির অফার করেন, তাই এক কাপ কফি খেতে গিয়েছিলাম। কিন্তু, এই ছবিটা কে তুলেছে?’

‘যে তুলেছে সে নিশ্চয়ই আমার শত্রু। আর, এই লোকটার নাম কী? কোথায় থাকেন বা কী করেন উনি?’

‘উনি একটা প্রাইভেট কম্পানিতে জব করেন। আর উনার নাম…’

‘বাবা, আজকে কিন্তু আর যেতে পারবেন না। আমাদের এইখানেই থাকবেন।’

মেহুল নাম বলার আগেই রামিনা বেগম ড্রয়িং রুমে এসে হাজির হলেন। তিনি হেসে কথাটা বললেন। রাবীর মৃদু হেসে বলল,

‘রাতে একটা জরুরি মিটিং আছে, মা। এখানে আজ থাকাটা কোনোভাবেই সম্ভব না। অন্য একদিন এসে অবশ্যই থাকব।’

‘তাহলে খেয়ে যেতে হবে। আমি সব রান্না করছি। না খেয়ে আজ এখান থেকে বেরুতে পারবেন না।’

রাবীর হেসে বলল,

‘আচ্ছা ঠিক আছে, খেয়েই যাব।’

রামিনা বেগম রুম থেকে চলে যাওয়ার পর রাবীর আবার মেহুলের দিকে চেয়ে শক্ত গলায় বলে,

‘তো, লোকটার সম্পর্কে কী বলছিলেন যেন?’

‘লোকটাকে আমি চিনি না। বড়ো জোর দু থেকে তিনবার দেখা হয়েছে, তাও আবার কাকতালীয়ভাবে। কিন্তু, এখন কথা হচ্ছে এই লোকের সাথে আমার এই ছবি আপনাকে কে পাঠাল?’

‘জানি না। যেই নাম্বার থেকে এসেছে সেই নাম্বার এখন বন্ধ। তবে যে এই কাজটা করেছে সে নিশ্চয়ই আরো বড়ো কোনো চাল চালছে। আর এই লোকের ব্যাপারেও আমার সব ইনফরমেশন বের করতে হবে। এই দু থেকে তিনবার একই মানুষের সাথে দেখা হওয়াটা কি শুধুই কাকতালীয়, নাকি অন্যকিছু?’

‘কিন্তু আপনি লোকটাকে কোথায় পাবেন?’

‘এই কাজের দায়িত্ব আমার। আপনি লোকটার নাম কী যেন বলছিলেন?’

মেহুল একটু ভেবে বলল,

‘সাদ..ওহ, সাদরাজ। সাদরাজ আহমেদ মেবি।’

রাবীরের চোখ মুখ নিমিষেই কুঁচকে যায়। বিস্ময়ে হতভম্ব সে। জিজ্ঞেস করে,

‘কী? তার নাম সাদরাজ আহমেদ? আপনি সিউর?’

‘হ্যাঁ, এখানে সিউর না হওয়ার কী আছে? আমার তো উনার সাথে কথাও হয়েছে।’

রাবীরের মাথার রক্ত টগবগ করছে যেন। রাগে শরীর রি রি করছে। সাদরাজের এত বড়ো কলিজা হয় কী করে? রাবীরের তো কিছু মাথাই আসছে না। এই লোকটার কত বড়ো বুকের পাটা, সে সব ছেড়ে ছুড়ে শেষে কিনা রাবীর খানের কলিজায় হাত দিয়েছে! এই হাত কি আর অক্ষত থাকবে? না, কখনোই না। শুধু এই হাত না, এই হাতের মালিকও আর বেশিদিন অক্ষত থাকবে না।

রাবীর চোয়াল শক্ত করে মেহুলের হাত থেকে ফোন নেয়। তারপর আরেকটা ছবি বের করে। মেহুলের চোখের সামনে ধরে বলে,

‘এই লোকটার কথাই বলছিলেন?’

মেহুল চমকে বলে,

‘হ্যাঁ, উনিই তো সাদরাজ। কিন্তু, উনার ছবি আপনার কাছে কী করে এলো?’

রাবীর নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারছে না যেন। ভয়ানক কিছু করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। সে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আনুন।’

মেহুল রাবীরের ব্যবহারে ভীত হয়। কী হলো হঠাৎ? এত রেগে গেলেন কেন উনি? মেহুল যাচ্ছে না দেখে রাবীর তার দিকে চেয়ে ধমক দিয়ে বলে উঠে,

‘গো ফাস্ট, মেহুল। ঠান্ডা পানি আনুন।’

মেহুল ধমক খেয়ে এক লাফে উঠে দাঁড়ায়। তারপর দৌড়ে যায় ঠান্ডা পানি আনতে।

রাবীর এক শ্বাসে পুরো পানি শেষ করে। নিজেকে শান্ত রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করছে সে। মাথায় আঙ্গুল চালিয়ে চুল ঠিক করে। পাঞ্জাবীর উপরের দুটো বোতাম খুলে দিয়ে একটু আরাম করে বসে। এর মধ্যেই প্রচন্ড মাথা ধরেছে তার। সে চোখ বুজে সোফায় হেলান দিয়ে বসে। মেহুল ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু একটা যে বলবে সেই সাহসটুকুও নেই তার। রাবীরের এই আচরণ তার বোধগম্য হচ্ছে না। কেন এই রাগ, এই আক্ষেপ কে জানে? মেহুল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁসফাঁস করছে। রাবীর চোখ বুজা অবস্থাতেই ঠান্ডা গলায় বলল,

‘বসুন।’

মেহুল ঢোক গিলে বসে। তবে অনেকটা দূরত্বে। রাবীর জোরে নিশ্বাস ফেলে। মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,

‘আমার রাজনীতি জীবনের সবচেয়ে বড়ো শত্রু কে জানেন? এই সাদরাজ আহমেদ। যার কারণে রাজনীতিতে আসার পর এই নয় বছরের জীবনে আমি একদিনও শান্তি পাইনি। যার কারণে প্রতিনিয়ত আমার জীবন হুমকির মুখে পড়ে। যার কারণে আমি একদিনের জন্যও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি না। সেই ভয়ংকর লোকটাই হলো, সাদরাজ আহমেদ। আপনার চোখে যিনি ভীষণ দয়ালু, ভীষণ ভালো মানুষ। যিনি আপনার বাবাকে রক্ত দিয়ে সাহায্য করেছেন, তিনি আবার সবথেকে বড়ো শত্রু। আর এই সবকিছু উনি কেন করেছেন জানেন, আমার থেকে শোধ নেওয়ার জন্য। আমার কারণে তাঁর অনেক বেআইনি কাজ আটকে গিয়েছে, অনেক বেআইনি সম্পদ হারিয়েছে। তাঁর ক্ষমতা হারিয়েছে। তাই সে আমার উপর থেকে শোধ নেওয়ার জন্য আপনাকে তুরুপের তাস বানিয়েছে। ভেবেছে, আপনাকে পুঁজি করে সে সহজেই আমার কাছ থেকে সবকিছু হাসিল করে নিতে পারবে। কিন্তু, এসব করতে গিয়ে সে নিজেরই যে কত বড়ো বিপদ ডেকে এনেছে, সেদিকে তাঁর বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। ওকে তো আমি…’

শেষের কথাটা শেষ না করেই রাবীর টি টেবিলের উপর জোরে ঘুষি দিয়ে উঠে। মেহুল ভয় পায়। রাবীর রীতিমতো রাগে কাঁপছে। তার কপাল আর হাতের রগ ফুলে উঠেছে। চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। রাবীরের এমন রূপ দেখে মেহুলের ভয়ে কান্না পাচ্ছে যেন। সে তো কিছু জানতো না। সাদরাজকেও সে চিনত না। রাবীর যদি তাকেও এখন ভুল বুঝে? যদি তার উপরও সে প্রচন্ড রেগে যায়, তখন?

মেহুল ভয়ে ভয়ে বলে,

‘আ-আমি সাদরাজ আহমাদকে চিনতাম না। উনাকে এর আগে কখনো দেখিওনি। আমাকে ভুল বুঝবেন না, প্লিজ। আমি ইচ্ছে করে কিচ্ছু করিনি। বিশ্বাস করুন।’

রাবীর উঠে বসে। মেহুলের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে শান্ত করে বলে,

‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করি, মেহুল। আর আমি জানি এইসব কিছু সাদরাজ ইচ্ছে করে করেছে। আর এইসব কিছুর যে এখন কী ভয়ানক পরিণতি হবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারছে না।’

মেহুলের ভয় একটু কমে। সে রাবীরের কিছুটা কাছে গিয়ে বসে বলে,

‘রেগে গিয়ে কিছু করতে পারবেন না। এই লোকটাকে বুদ্ধি দিয়ে মারতে হবে। আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে। এখন উনার চাল দিয়েই আমাদের উনাকে মারতে হবে।’

‘কীভাবে?’

‘শুনুন, বলছি…’

চলবে…

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৮।

‘না, আমি চাই না আপনি কোনোভাবে ওর সংস্পর্শে থাকুন। ওর ব্যাপারটা আমি দেখে নিব। এসবের মধ্যে এখন আর আমি আপনাকে জড়াতে চাইছি না।’

মেহুল রাবীরকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু, রাবীরের এই ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। নিজের জন্য বা ঐ সাদরাজকে হারানোর জন্য সে মেহুলকে কোনোভাবেই ব্যবহার করতে চায় না। মেহুল বলল,

‘আরে বাবা, আমি উনার সাথে নিজ থেকে কোনো যোগাযোগ করব না। আমি শুধু দেখব, উনি ভবিষ্যতে আর কী কী করেন। এখন তো আমরা সবকিছু জানিই, তাই না? ঐ লোকটার পরবর্তী চালটা কী এখন আমাদের সেটাই বুঝতে হবে। আর তার জন্য আপাতত আমাদের চুপ থাকতে হবে। আপনি যে ঐ লোকটার ব্যাপারে সব জেনে গিয়েছেন সেটা কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না।’

রাবীর ভাবছে; আদৌ এটা ঠিক হবে কিনা। মেহুলের সাথে সাদরাজের এইটুকু কথোপকথনও সে সহ্য করতে পারবে না। সেখানে সাদরাজের সাথে তার এই নরম ব্যবহার সে তো আরো আগেই মেনে নিতে পারছে না। সে অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলে,

‘দেখুন, আপনার সাথে যখনই ওর দেখা হবে বা কথা হবে আমাকে সাথে সাথে বলবেন। আর আমাকে না জানিয়ে নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে বা করতে যাবেন না। সাদরাজ প্রচন্ড চতুর। ওর সাথে আপনি একা পাল্লা দিয়ে পারবেন না, মেহুল।’

‘একা কোথায়? আপনি আছেন না?’

‘হ্যাঁ আছি। এক মিনিটের জন্যও আমি আপনাকে এখন চোখের আড়াল করব না। ভাবছি মা’কে বলব, যেন আমাদের বিয়ের প্রোগ্রামটা ঈদের পর পরই করে ফেলেন।’

মেহুল অবাক হয়ে বলে,

‘ওমা কেন? আমি তো বলেছি আমার অনার্সের পর।’

‘মেহুল দেখুন, আপনি এখানে থাকলে আমার দুশ্চিন্তার ভার বাড়বে। আপনি যদি আমার বাড়িতে থাকেন, তাহলে আমি তুলনামূলকভাবে একটু নিশ্চিন্ত হতে পারব। কারণ, সেখানে আমার পরিপূর্ণ সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে। আপনাকে এখানে রেখে আমাকে সারাক্ষণ একটা দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে। তাই আপাতত আপনাকে আমার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হবে। আপনাকে ঐ বাড়িতে নিতে পারলেই আমার শান্তি।’

মেহুলের মুখ কালো হয়ে গেল। রাবীরের এই প্রস্তাব তার মোটেও পছন্দ হয়নি। সে তো ভেবেছিল অনার্স শেষ করতে করতে তার গানের ক্যারিয়ারটাও পাঁকা করে ফেলবে। তারপর রাবীরের বাড়িতে চলে গেলেও কিছু যায় আসে না। ততদিনে রাবীরও তার মা’কে রাজি করিয়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু, এখন এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেলে তো সবকিছু উলোট পালট হয়ে যাবে।

মেহুলকে উদ্বিগ্ন দেখে রাবীর বলল,

‘চিন্তা করবেন না, ঐ বাড়িতে গেলেও আপনার পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না।’

‘আর গানের?’

মেহুল উৎসুক চোখে চেয়ে আছে রাবীরের দিকে। রাবীর কী উত্তর দিবে সেই প্রতিক্ষায়। রাবীর চাপা নিশ্বাস ফেলে বলে,

‘এই ব্যাপারে মা’র সাথে আমার এখনো কথা হয়নি।’

মেহুল মাথা নিচু করে নরম গলায় বলল,

‘আমার এক স্যারের বন্ধু বেশ বড়ো গায়ক। উনি আবার নতুন সব গায়ক গায়িকাদের নিয়ে কাজ করেন। উনি নাকি স্যারকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন। অফার করেছেন উনার স্টুডিও তে গিয়ে গান করার জন্য। স্যার বলেছেন উনার সাথে কাজ করলে নাকি আমার গানের ক্যারিয়ার এমনিই তৈরী হয়ে যাবে। আমাকে আর বেশি খাটতে হবে না। কিন্তু, আমি তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। আপনার সাথে কথা না বলে কী করে সিদ্ধান্ত নিব? তাই এখন আপনিই বলুন, কী করব? এত বড়ো একটা সুযোগ হাতছাড়া করে দিব? নাকি একবার চেষ্টা করে দেখব?’

রাবীর মেহুলের মুখের দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখে মুখে এত উৎসাহ দেখে তার খুব খারাপ লাগছে। সে মেয়েটাকে কষ্ট দিতে চায় না। আবার মা’কে ও সে নারাজ করতে পারছে না।

সে ম্লান সুরে বলল,

‘মেহুল, আপনি তো দেখছেনই মা গানের কথা শুনলেই রেগে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় আমি এখন মা’কে গিয়ে এই কথা কী করে বলব? তার উপর আমার ঝামেলারও শেষ নেই। একটার পর একটা লেগেই যাচ্ছে। এসবের মাঝে আপনার এই গানের ব্যাপারটা আমাকে আরো বেশি দুশ্চিন্তায় ফেলছে। আচ্ছা, যদি এখন আমি বলি গানটাকে ছেড়ে দিন, অন্য কিছু নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখুন, তখন আপনি পারবেন? জানি পারবেন না। কষ্ট হবে। তেমনি এখন যদি আপনি বলেন, আপনি আপনার মায়ের কথাকে দাম না দিয়ে আমাকেই সাপোর্ট করুন, তাহলে বলব সেটা আমিও পারব না। আপনি বা মা কাউকেই আমি কষ্ট দিতে পারব না। এখন দুজনকেই ভালো রাখতে এইটুকু কঠোর আমাকে হতেই হবে, মেহুল।’

মেহুল অন্যদিকে মুখ করে বসে। ফিচের গলায় বলে,

‘গান গাইতে দিবেন না, সেটা সরাসরিই বলতে পারেন। এত ভণিতা করার দরকার নেই।’

‘আপনি রাগ করলেও এই মুহুর্তে আমার আর কিছু করার নেই। মা রাজি হবেন না আমি জানি। তাও আমি আবার কথা বলব। তবে আগের বারের মতো এখনো বলছি, মা রাজি না হলে আমি মায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারব না।’

‘সেটা তো আমিও করতে বলছি না। যেখানে আমার মা বাবাই আমাকে সাপোর্ট করছেন না, সেখানে আপনি তো আরো দূরের মানুষ।’

এই বলে মেহুল উঠে নিজের রুমে চলে যায়। তবে এই কথাটা রাবীরের প্রচন্ড ভাবে মনে লাগে। সে মেহুলের “দূরের মানুষ”? এতকিছু করেও সে মেহুলের “কাছের মানুষ ” হতে পারল না? এর থেকে ব্যর্থতার আর কী হতে পারে?

________

মেহুরের বাবা রাবীরের সাথে ড্রয়িং রুমে বসে কিছুক্ষণ কথা বলেন। তিনি এখন অনেকটাই সুস্থ। রাবীর উনার সমস্ত চিকিৎসার দায় ভার নিয়েছে। যদিও এই কথা এখন অবধি উনি জানেন না। জানলে হয়তো আত্মসম্মানে লাগতো। যতই হোক মেয়ের জামাই তো। আর সেইজন্যই মেহুলও আর উনাকে কিছু বলেনি।

_______

ড্রয়িং রুমে রাবীর তখন একাই ছিল। কারোর সাথে ফোনে কথা বলছিল। রামিনা বেগম ব্যাপারটা খেয়াল করেন। তিনি মেহুলের রুমে গিয়ে দেখেন মেহুল কেউ একজনের সাথে ফোনে খুব ঝগড়া করছে। তার কথার ধরনে তিনি সেই ব্যক্তিকে চিনতে পারছেন না। তাই তিনি দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেন। এর কিছুক্ষণের মাঝেই মেহুল কল কেটে দিয়ে ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে মারে। পরে দরজায় মা’কে দেখেই ব্যাখ্যা করতে থাকে কী হয়েছে না হয়েছে।

‘মা, এই খবরের কাগজে এসব কে লিখিয়েছে জানো? আমাদের ক্লাসের সিয়াম। কিন্তু, সে এখন কোনোভাবেই ব্যাপারটা স্বীকার করছে না। তাই এখন ওকে কল দিয়ে খুব ঝেড়েছি। ওর জন্যই তো আমাকে এত কথা শুনতে হয়েছিল।’

‘জামাই ঐ রুমে একা। আর তুই এই রুমে বসে বসে ঝগড়া করছিস?’

মেহুল বিরক্ত চোখে তাকায়। সে কী বলল, আর তার মা কী বলছে? মানে সবকিছুর মধ্যেই উনাকে উনার জামাইকে টেনে আনতেই হবে। মেহুল ধপ করে বিজানায় বসে বলে,

‘তো, উনাকে ঐখানে বসে বসে শোক পালন করতে কে বলেছে। এই রুমে আসলেই তো পারেন। নাকি এই রুমে আসতেও উনাকে এখন দাওয়াত দিয়ে আনতে হবে?’

রামিনা বেগম চেতে মেয়ের মাথায় চাটি মেরে বলেন,

‘চেটাং চেটাং কথা না বললে হয় না, না? যা, জামাইকে গিয়ে তুই বলে রুমে আন। কতদিন পরপর ছেলেটা আসে তাও যদি উনি একটু দাম দিত। না চাইতেই এমন হিরা পেয়ে গিয়েছ তো, তাই মূল্য নেই। হিরা যখন হারাবে, তখন বুঝবে তার কী মূল্য।’

মেহুল উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত জোড় করে মায়ের সামনে মাথা নুইয়ে বলে,

‘ক্ষ্যামা করো মা, আমাকে ক্ষ্যামা করো। তোমার জামাইকে এখন থেকে আমি মাথায় করে রাখব। তাও দয়া করে এইসব ভয়ানক ইমোশনাল কথাগুলো আমাকে আর বলো না। আমার হার্ট অ্যাটাক চলে আসে।’

রামিনা বেগম চোখ পাকিয়ে তাকাতেই মেহুল এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর সে ড্রয়িং রুমের দরজার কাছে যায়। রাবীর তখনও ফোনে কথা বলছে আর ব্যস্ত হয়ে রুম জুরে পায়চারি করছে। মেহুল দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে। খেয়াল করে তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি। লোকটার মাঝে আসলেই নেতা নেতা একটা ভাব আছে। সুঠাম দেহের প্রতিটা অংশ যেন জানান দিচ্ছে তিনি কতটা প্ররিশ্রমী। তার এই চোখে মুখের ভীষণ নিখুঁত গাম্ভীর্যতা তাকে যেন আরো বেশি চমৎকার করে তুলছে। যেন কোথাও কোনো ভুল নেই। খুব যত্নে গড়া একজন মানুষ। প্রতিটা নারীর কল্পনার পুরুষ হয়তো এমনিই। যাকে দেখলেই চোখের তৃষ্ণা মিটবে তবে মনের তৃষ্ণা কেবল বেড়েই যাবে। রাবীরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই আনমনেই তার চোখ রাবীরের ঠোঁটের উপর পড়ে। তার চলমান অস্থির ঠোঁট জোড়া দেখে মেহুলের চোখ যেন তাতেই আটকে যায়। কেমন অদ্ভুত ঘোরে যেন আটকে গেল সে। কোনো পুরুষ মানুষের ঠোঁট এত সুন্দর হয় নাকি? ঠোঁট তো কেবল মেয়েদের সুন্দর। তবে রাবীরের বেলায় এর ব্যতিক্রম কেন হলো?

‘আমি জানি আমার ঠোঁট সুন্দর। তাই বলে এভাবে চেয়ে থেকে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার কোনো মানেই হয়না, মেহুল।’

মেহুল চমকে তাকায়। কী হলো ব্যাপারটা? রাবীরের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি দেখে তার আর বুঝতে বাকি রইল না। ইশ, কীভাবে হ্যাংলার মতো সে রাবীরের ঠোঁটের দিকে চেয়েছিল! রাবীর কী ভাবছে কে জানে। ভীষণ লজ্জায় পড়ে সে। লজ্জায় কী করবে বুঝতে না পেরে দৌড়ে আবার নিজের রুমে চলে যায়।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে